মাদা’ইন সালেহ

নবী সালেহ আঃ এর গোষ্ঠির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর।যা সৌদী আরবের আল-ঊলা নামের এলাকায় অবস্থিত।

মাদা’ইন সালেহ (আরবি: مَدَائِن صَالِح; আল-হিজর এবং হেগ্রা নামেও পরিচিত) একটি প্রাক-ইসলামি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা, যা সৌদি আরবের মদিনা প্রদেশের আল-উলা সেক্টরে অবস্থিত। নাবাতীয় রাজ্যের (১ম খ্রিস্টাব্দ শতাব্দী) প্রধান চিহ্ন বহন করছে। এটি তৎকালীন রাজ্যের সর্বদক্ষিণের অঞ্চল নিয়ে গঠিত যা ঐ রাজ্যের রাজধানী ছিল। পেত্রার পর এটি তখনকার দিনে সবচেয়ে বৃহৎ শহর ছিল।

আল হিজর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান (মাদা’ইন সালেহ)
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান
মানদণ্ডসাংস্কৃতিক: ২, ৩
সূত্র১২৯৩
তালিকাভুক্তকরণ২০০৮ (৩২ তম সভা)

১৯৭২ সাল থেকে এই অঞ্চলটি সরকারীভাবে সংরক্ষণকাজ শুরু হয় দর্শনার্থের উদ্দেশ্যে। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো মাদা’ইন সালেহ –কে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানে তালিকাভুক্ত করে, যা সৌদি আরবের প্রথম বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। এই স্থানকে সুষমভাবে সংরক্ষণ করা হয়, বিশেষভাবে ১৩১ পাথর কেটে তৈরি সৌধ এবং এর আশপাশের সামনের দিকে সুসজ্জিত বিশাল অংশের সংরক্ষণের জন্য।

নামকরণ সম্পাদনা

 
আল হিজর প্রত্নস্থল

এই স্থানের লম্বা ইতিহাস বহুজাতিক সংস্কৃতির চিহ্ন বহন করছে। তাই এই স্থানকে বহু নামে নামকরণ করা হয়, যেসব নামে এখনো ডাকা হয়। এই স্থান বর্তমানে “মাদা’ইন সালেহ”, আরবীতে “সালেহ এর শহর” নামে পরিচিত। যা ১৩৩৬ সালে আন্দালুসিয়ান পর্যটকের মুদ্রা হতে পাওয়া।[১] “আল-হিজর” আরবীতে “পাথরের শহর”, যা এই স্থানের ভৌগোলিক অবস্থাকে পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে।[২] কোর’আনে উভয় নামের শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়।[৩] এই স্থানের প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল সামুদ ও নাবাতীয় জাতি, যাদের অনুসারে এই স্থানকে “হেগ্রা” নামেও ডাকা হয়।

অবস্থান সম্পাদনা

মাদা’ইন সালেহ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আল-উলা শহর থেকে ২০ কি.মি উত্তরে, মদিনা থেকে ৪০০ কিমি. উত্তর-পশ্চিমে এবং জর্ডানের পেত্রা নগরী থেকে ৫০০ কিমি. দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত।[২] এই স্থান হিজায পর্বতের পাদদেশের সমতল মালভূমিতে অবস্থিত।[২] এই স্থানের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি ২০ মিঃ গভীরতাবিশিষ্ট খাল আছে। এই স্থানটি মরুভূমির সৌন্দর্য এবং বিভিন্ন আকার ও উচ্চতায় খোদাইকৃত পাথরের জন্য বিখ্যাত।[৪]

ইতিহাস সম্পাদনা

লিহাইয়ান্স সম্পাদনা

"লিহাইয়ান্স" (আরবি: لحيان) একটি প্রাচীন আরব রাজ্য। এটি মাদা’ইন সালেহ –তে অবস্থিত ছিল। প্রাচীন ৬ষ্ঠ-৪র্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে খোদাইকৃত উত্তর অ্যারাবিয়ান লিপির জন্য পরিচিত ছিল। এই রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাসের একটি সময় জুড়ে একে ডিডেনাইট ডাকা হত, যখন থেকে তাদের রাজধানী ডিডান, যা এখন আরবের উত্তরপশ্চিমস্থ এবং তেইমা থেকে ১১০ কিমি. দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত আল-উলা মরুদ্দ্যান নামে পরিচিত। পরবর্তীতে লিহাইয়ানাইটস এর সাথে জোট হয়ে নবটিয়ান নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্রাক-নবেটিয়ান সম্পাদনা

 
নবেটিয়ান অঞ্চলে বাণিজ্যকৃত পণ্য 'গন্ধ সামগ্রী"

বিশেষজ্ঞদের মতে মাদা’ইন সালহে –র নিকটে অবস্থিত আথলেব পর্বতের[৫] শীর্ষে অবস্থিত পাথরের উপর ৩য়-২য় খ্রিস্টপূর্ব[২] শতাব্দীতে অঙ্কিত প্রাচীন চিত্রের প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন গুলো লিহাইয়ান্টস এর সাক্ষী বহন করে। যা এই এলাকার প্রাচীন মানুষদের বসবাস নির্দেশ করে। কারণ এই এলাকার প্রচুর বিশুদ্ধ পানি ও মাটি উর্বর ছিল।[৫][৬] এ স্থানে নিহাইয়ান্সদের বসবাস বসবাসের কারণ এই স্থান বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। এ স্থানে পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণের এলাক্য উৎপাদিত পণ্যের বাজার গড়ে উঠেছিল।[৫]

উত্তর-নবেটিয়ান ও রোমান সম্পাদনা

১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নবেটিয়ান রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হয়। হেগ্রার চারপাশ ঘিরে অবস্থিত হেজায, আরবের রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।[৭][৮] ১০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আল হেজায অঞ্চলকে আরবে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সমওিত করা হয়। ১৭৫-১৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লিখিত একটি স্মারক রোমান সূত্র-লিপি, যাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যা সাম্প্রতিক আবিষ্কার করা হয়। বাণিজ্যের স্থলপথ উত্তর থেকে পশ্চিমদিকে আরব উপত্যকা দিয়ে লোহিত সাগর পর্যন্ত তৈরী হওয়ায়, হেগ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য দিনদিন হ্রাস পেতে থাকে, যা হেগ্রার পরিত্যক্ত হওয়ার প্রধান কারণ।[৬]

আরবে রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে ইসলামের বিকাশ পর্যন্ত হেগ্রার ইতিহাস এখনো অজানা। যদিও কিছু পর্যটক ও মনীষীদের লেখা থেকে এর কিছু বিক্ষিপ্ত কিছু ইতিহাস পাওয়া যায়। তাদের ভাষ্যমতে হেগ্রা ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হত, যাতে ধার্মিকদের খাদ্য পানি সরবরাহের মাধ্যেম সাহায্য করা হত। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে এই স্থান অটোম্যান শাসনাধীন হয়। আল-হিজরে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। এই দুর্গ মক্কাগামী ধার্মিকদের নিরাপত্তার জন্য তৈরী করা হয়।

কোর’আনে উক্ত স্থান সম্পাদনা

কোর’আন অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে, মাদা’ইন সালেহ এলাকায় ছামুদ নামে জনগোষ্ঠী বসবাস করত। কোর’আনে বলা হয়েছে, তারা মূর্তি পূজা করত; এসব জনগোষ্ঠী বিভিন্ন শোষনের শিকার হত। নবী সালেহ, যার নাম অনুসারে মাদা’ইন সালেহ। তার কথা বিশ্বাস না করার ফলে তাদের উপর আযাব বর্ষিত হয়, যা কুর’আনে উল্লেখ আছে।

বর্তমান উন্নয়ন কাজ সম্পাদনা

যদিও ১৯৭০ দশকের প্রথম দিকে দাবি করা হয়েছিল, যাতে আল-হিজর –কে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার।[৯] তখন থেকে কিছু অনুসন্ধানও চালানো হয়েছিল। এই স্থানের উপর বিভিন্ন জিনিসের উপর ধর্মীয় অনুশাসন বিদ্যমান থাকায় তা অনেকাংশে স্বীকৃতি পেতে বিলম্ব ঘটায়। ফলে ২০০০ সালে ইউনেস্কোর একটি বিশেষজ্ঞ দল এ স্থান পরিদর্শনে আসলে সৌদি সরকারকে তাদের নিরাপত্তা বিধানে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।[৪][৯] যাহোক ২০০৮ সালে এই স্থানকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।[১০]

স্থাপত্য সম্পাদনা

১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেগ্রার নবেটিয়ান অঞ্চল আবাসিক এলাকা হিসেবে নির্মাণ করা হয়। এই স্থানের পাথরগুলো কাটা হয় ওখানকার বসবাসকারীদের গোরস্থান তৈরীর উদ্দেশ্যে। এই চারটি গোরস্থান আছে যাকে ১৩১ টি আকর্ষক পাথর যাকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে, যা ১৩.৪ কিমি (৮.৩ মাইল) যা নবেটিয়ান সম্মুখভাগের অন্তর্লিপিতে পাওয়া যায়।[১১][১২] তার চিত্র এইরকমঃ

গোরস্থান অবস্থান নির্মাণকাল বৈশিষ্ট্য
'জাবাল আল-মাজহার উত্তর তথ্যবিহীন পূর্ব ও পশ্চিমদিকের চারটি বৃহৎ পাথরখন্ড সমান্তরালভাবে কাটা। সম্মুখভাগে ছোট আকারের নকশা বিদ্যমান[২]
কাসার আল ওয়ালাদ" তথ্যবিহীন ০-৫৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ শতাব্দী কাল্পনিক প্রাণী, মানুষের মুখ, পাখির নকশা সংবলিত অতি সুন্দর নকশা সংবলিত ৩১ টি সমাধি। এই অংশে সর্ববৃহৎ সম্মুখভাগ বিদ্যমান, যার উচ্চতা ১৬ মিঃ[২]
এরিয়া সি দক্ষিণ-পূর্ব ১৬-৬১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ শতাব্দী একক সমাধীসহ মোট ১৯ টি সমাধী। সম্মুখভাগ নকশাবিহীন[২]
জাবাল আল-খুরায়মাত দক্ষিণ-পশ্চিম ৭-৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ শতাব্দী চারটি বৃহৎ সমাধী সংবলিত গোরস্থান। অসংখ্য সমাধী বিভিন্ন বালুময় এলাকা দ্বারা বিভক্ত। যদিও শুধু ৮টি সমাধী সম্মুখভাগ খচিত। সংখ্যায় মোট ৪৮ টি।

[১৩]

সৌধবিহীন গোরস্থানসহ, মোট ২০০০টি সমাধী। যা এই স্থানের অংশ।[২]

সমতল ভূমির মধ্যাংশে আবাসিক এলাকা অবস্থিত।[২] যা সমাধীক্ষেত্র হতে দূরে। এই বাসস্থান তৈরীর প্রধান উপকরণ হল মাটির তৈরী রোদে শুকানো ইট,[২] যার কিছু অংশ এখনো বিদ্যমান। এই স্থানের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে মোট ১৩০ কূয়ায় পানি সরবরাহ করা হত। ৪-৭ মিঃ ব্যাসবিশিষ্ট্য এসব কূয়ার গভীরতা ছিল মাত্র ২০ মিঃ।[২] যার অধিকাংশ কূয়া পাথর কেটে তৈরী করা হয়েছিল। তবে কিছু কিছু কূয়া পাথর দ্বারা শক্তি প্রয়োগ করে মাটি নরম করে তৈরী করা হয়েছিল।[২]

 
মাদা'ইন সালহে -এর প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন, যা পেত্রার সাথে তুলনা করা হয়।[২]

গুরুত্ব সম্পাদনা

 
সমাধীর উপরে নবেটিয়ান লিখিত ভাষায় লিখিত লিপি

আল-হিজর প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাটি শুষ্ক এলাকায় অবস্থিত। শুষ্ক আবহাওয়া, পরিত্যক্তের পর পুনঃউপনিবেশের অভাব এবং স্থান সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস, যা এই স্থানের অসাধারণ সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি অনেকাংশে জর্ডানের পেত্রা নগরীর চেয়েও বেশি বিখ্যাত।[২] এই প্রত্নতত্ত্ব এলাকার অবস্থান বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ সড়কে, তারসাথে বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, কলা-কৌশল যা এর বিভিন্ন সম্মুখভাগে বিদ্যমান নকশাতে লক্ষণীয়। সৌদি আরবের ৪০০০ প্রত্নতত্ত্ব এলাকার মধ্যে এটি অলিখিতভাবে “সৌধের রাজধানী” হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।[৬][৯]

আরও দেখুন সম্পাদনা

আরও পড়ুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Madain Saleh tour service"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৮ 
  2. "ICOMOS Evaluation of Al-Hijr Archaeological Site (Madâin Sâlih) World Heritage Nomination" (পিডিএফ)। World Heritage Center। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৬ 
  3. "Madain Saleh – Cities inhabited by the People of Thamud"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৭ 
  4. Hizon, Danny। "Madain Saleh: Arabia's Hidden Treasure – Saudi Arabia"। ২০০৮-০৭-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৭ 
  5. "HISTORY: Creation of Al-Hijr"Historic Madain Saleh: UNESCO's World Heritage Site। ২০১২-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-২০ 
  6. "HISTORY: Madain Saleh"Historic Madain Saleh: UNESCO's World Heritage Site। ২০১২-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-২০ 
  7. The New Encyclopædia Britannica: Micropædia Volume 8। USA: Encyclopædia Britannica, Inc.। ১৯৯৫। পৃষ্ঠা 473। আইএসবিএন 0-85229-605-3 
  8. "HISTORY: Fall of Al-Hijr"Historic Madain Saleh: UNESCO's World Heritage Site। ২০১২-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-২০ 
  9. Abu-Nasr, Donna (২০০৯-০৮-৩০)। "Digging up the Saudi past: Some would rather not"। Associated Press। ২০০৯-০৯-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৭ 
  10. "Official announcement as World Heritage Site"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৭ 
  11. "Information at nabataea.net"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-১৭ 
  12. "HISTORY: Al-Hijr"Historic Madain Saleh: UNESCO's World Heritage Site। ২০১২-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-২০ 
  13. "HISTORY: Tourist sites in Madain Saleh"Historic Madain Saleh: UNESCO's World Heritage Site। ২০১২-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০২-২০ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা