দুর্গা

হিন্দু দেবী পার্বতীর একটি উগ্র রূপ
(মহিষাসুরমর্দিনী থেকে পুনর্নির্দেশিত)

দুর্গা (সংস্কৃত: दुर्गा; অর্থাৎ "যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন"; এবং "যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন")[] হলেন হিন্দু দেবী পার্বতীর এক উগ্র রূপ। হিন্দু সংস্কৃতিতে তিনি জনপ্রিয় এক দেবী। তাঁকে আদ্যাশক্তির রণরঙ্গিনী এক মহাদেবীর রূপ বলে মান্য করেন। তিনি চণ্ডিকা, যোগমায়া, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, মহিষাসুরসংহন্ত্রী, নারায়ণী, মহামায়া, কাত্যায়নী, দাক্ষায়ণী, অদ্রিজা, নগনন্দিনী, সিংহবাহিনী, শারদা, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও পরিচিতা। দুর্গার বাহুসংখ্যা অনেক। তার শতভুজা, সহস্রভুজা, ত্রিংশতিভুজা, বিংশতিভুজা, অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তির উল্লেখ পুরাণ গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় বা বিভিন্ন স্থাপত্য-ভাস্কর্যে দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই সমধিক জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ (উত্তর ও পশ্চিমভারতে আঞ্চলিকভাবে বাঘ)। মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাঁকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। তার অনেক রূপ, যার মধ্যে কালী রূপটি অন্যতম জনপ্রিয়‌।

দুর্গা
শক্তি এবং সুরক্ষার দেবী
মানভূমে পাওয়া দেবী দুর্গার প্রস্তর মূর্তি, ভারতীয় জাদুঘরে (কলকাতা) রক্ষিত
অন্যান্য নামআদি শক্তি, মহিষাসুর মর্দিনী, ভগবতী, ভবানী, জগদম্বা
দেবনাগরীदुर्गा
অন্তর্ভুক্তিমহাদেবী, আদ্যাশক্তি, পার্বতী, মহাকালী
আবাসমণিদ্বীপ, কৈলাস
মন্ত্র"সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে,
শরণ্যে ত্রম্বকে গৌরি নারায়নী নমস্তুতে"
অস্ত্রত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, গদা, শঙ্খ, শক্তি, ঢাল বা খেটে, বাণ এবং ধনুক, ঘণ্টা, পরশু, নাগপাশ
দিবসশুক্রবার
বাহনসিংহ (কেশরী)
গ্রন্থসমূহদেবীভাগবত পুরাণ, দেবীমাহাত্ম্যম্, কালিকা পুরাণ, শাক্ত উপনিষদ, তন্ত্র
উৎসবদুর্গা পূজা, দুর্গা অষ্টমী, নবরাত্রি, বিজয়াদশমী, বাথুকাম্মা, তীজ, কালী পূজা
ব্যক্তিগত তথ্য
সহোদরবিষ্ণু[]
সঙ্গীশিব
দুর্গা
শব্দের অনুবাদসমূহ
বাংলাদুর্গা
সংস্কৃতदुर्गा
গুজরাটিદુર્ગા
হিন্দিदुर्गा
ভোজপুরি𑂠𑂴𑂩𑂳𑂏𑂰 (দুরুগা)
কন্নড়ದುರ್ಗಾ
মালয়ালমദുർഗ
মারাঠিदुर्गा
নেপালিदुर्गा
ওড়িয়াଦୁର୍ଗା
পাঞ্জাবিਦੁਰਗਾ
তামিলதுர்க்கை (তুর্ক্কই)
তেলুগুదుర్గ
হিন্দুধর্মের প্রবেশদ্বার

সনাতন ধর্মে দেবী দুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ।[] তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতীর উগ্র রূপ, কার্তিকগণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্য গুলোতে এবং আগমনী গানে দুর্গারূপে শিবজায়া হিমালয়দুহিতা পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের আনন্দময় দিনগুলোর (দুর্গাপূজা) এবং তার বিবাহিত জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়। মহাদেবী দেবতাদের অনুরোধে দুর্গম অসুরকে বধ করেন তাই দেবী পার্বতী দুর্গা নামে অভিহিত হন।

দুর্গার আরাধনা বাংলা (পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ), আসাম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা মূলত নবরাত্রি ব্রত রূপে উদযাপিত হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে দুর্গা দেবী ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিতা হন। দাক্ষিণাত্য এবং কাশ্মীরে অম্বিকা ও অম্বা নামে, গুজরাটে হিঙ্গলা ও রুদ্রাণী নামে, কান্যকুব্জে কল্যাণী নামে, কুমারিকা প্রদেশে কন্যাকুমারী নামে দেবী পূজিতা হন।[] বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে – আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা। সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম সাড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন এবং তারপর নেত্রকোনা জেলার, মেন্দিপুর গ্রামের মঠবাড়িতে দূর্গা পূজার সূচনা হয়।

দুর্গা নামের উৎপত্তি

সম্পাদনা
 
মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা, কালীঘাট পটচিত্র, ১৮৮০

দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে হিরণ্যাক্ষ পুত্র রুরুর বংশধর দুর্গম সমুদ্র মন্থনকালীন অসুরদের বঞ্চনা তথা তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কামনায় ব্রহ্মার তপস্যা করে। সেই কঠোর সাধনায় সন্তুষ্ট ব্রহ্মার কাছে দুর্গম এই বর প্রার্থনা করে যে তাকে এমন এক নারী বধ করবেন যিনি অনাবদ্ধকে আবদ্ধ করতে পটিয়সী। বরলাভের অহংকারে মত্ত দুর্গম এর পর শুরু করে চরম বিশৃঙ্খলা, মাৎস্যন্যায়। তার অত্যাচার আর ধ্বংসলীলায় ত্রিভুবন বিধ্বস্ত। ক্ষমতা আর বিজয়গর্বে মত্ত অসুর এবার চতুর্বেদকে হস্তগত করলে সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় দেবী মহামায়া এক দশভুজারূপী মঙ্গলময়ী দেবী রূপে আবির্ভূতা হন আর দুর্গমাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেন। বিন্ধ্যাচলে ১০ দিন ব্যাপী ঘোরযুদ্ধে দেবী ও তার অংশোদ্ভূতা গুহ্যকালী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরা, ভৈরবী প্রভৃতি দেবীগণ দুর্গমাসুরের কোটি সৈন্যকে নিধন করেন। এরপর দেবী দুর্গমাসুরকে সুতীক্ষ্ণ শূলের আঘাতে বধ করেন এবং চতুর্বেদ ও সকল মন্ত্র উদ্ধার করেন। দেবী তাই সর্বমন্ত্রময়ী। ক্ষমাশীলা পরমাজননী দেবী এরপর অনুতাপদগ্ধ দুর্গমাসুরকে অদ্বৈত ব্রহ্মের জ্ঞান প্রদান করে মোক্ষলাভ করান। দেবী দুর্গা স্বয়ং সচ্চিদানন্দময়ী পরব্রহ্মস্বরূপা আদ্যাশক্তি মহামায়া। যে সময় বা কাল সৃষ্টিতে একমাত্র আবদ্ধ নয়,যে কাল চিরন্তন সত্য, সেই কালকে পিষ্ট করেন মহাকাল শিব আর মহাকালকে পদতলে রেখেছেন দেবী মহামায়া। তিনি পরমাপ্রকৃতি; দেবী ভিন্ন শিব কেবল জড় বস্তু, দেবীর শক্তিতেই ব্রহ্মা সৃজন, বিষ্ণু পালন এবং রুদ্র সংহার করেন। মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী ও দুর্গতিনাশিনী দুর্গাকে এক অভেদ মূর্তিকল্পে প্রতিষ্ঠিতা।

নানা রূপে দেবী

সম্পাদনা

দুর্গা মূলত শক্তি দেবী। ঋগ্বেদে দুর্গার বর্ণনা নেই, তবে ঋগ্বেদোক্ত দেবীসূক্তকে দেবী দুর্গার সূক্ত হিসাবেই মান্যতা দেওয়া হয়। দেবী দুর্গা নির্গুণ অবস্থায় এই জগৎসংসারে বিরাজ করেন। তার জন্ম হয়না, আবির্ভাব ঘটে। দুর্গা সপ্তশতী তে বর্ণিত আছে, যে মহাশক্তি ব্রহ্মার ব্রহ্মত্ব, শিবের শিবত্ব, বিষ্ণুর বিষ্ণুত্ব প্রদান করেছেন, সেই দেবী দেবতাদের সমষ্টিভূত তেজপুঞ্জ থেকে স্বরূপ ধারণ করেন। দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্রপুরাণেই প্রচলিত। যেসকল পুরাণউপপুরাণে দুর্গা বা দেবী সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলো হল: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, বামনপুরাণ, কালিকাপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বরাহপুরাণ, শিবপুরাণদেবী ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী, কালী, গৌরী, উমা, মহাদুর্গা, অগ্নিদুর্গা, শূলিনী দুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, মূলা দুর্গা, মহামায়া, মহিষমর্দিনী, চামুণ্ডা প্রভৃতি নামে ও রূপেও পূজিতা হন। তিনিই জগদীশ্বরী, আপন মহিমায় দ্যাবাপৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন প্রতিটি কণায়। তিনি ঘটন-অঘটন পটিয়সী, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। তিনিই জগতকে চালান ও প্রতিপালন করেন জগদ্ধাত্রী রূপে, আবার প্রলয়কালে তিনিই কালিকা রূপে জগৎকে গ্রাস করেন। বঙ্গ দেশে এবং উৎকলে এই দেবীকে নবপত্রিকার মাধ্যমে নয়টি রূপকে পূজা করা হয়। যা অনেকাংশে কলা বউ নামে পরিচিত। যদিও কলা বউটা লোক ভাষায় পরিচিত যার কোন পুরাণগত ব্যাখ্যা নেই।

 
চন্দনকাঠের দুর্গা মূর্তি, মুর্শিদাবাদ থেকে প্রাপ্ত, বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘর, কলকাতায় রক্ষিত আছে

দেবী দুর্গা শাক্তমতে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব মতে তাকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈবমতে দুর্গাকে শিবের অর্ধাঙ্গিনী পার্বতী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। কেনোপনিষদে বর্ণিত উমা(পার্বতী) হৈমবতীকে দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গার একটি স্বরূপ আখ্যা দেওয়া হয়েছে যিনি হরির সহায়িকা শক্তি তথা শিবভক্তি প্রদায়িনী। এইগুলো ছাড়াও দুর্গাদেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়। দেবী দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন অবতার সমূহ হল: কালিকা, নন্দা, ভ্রামরী, শাকম্ভরী, রক্তদন্তিকা, কৌশিকী, ভীমা, উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী, কাত্যায়নী, শান্তা দুর্গা, অজিতা, অপরাজিতা ইত্যাদি।

সাঁওতালদের বয়ান

সম্পাদনা
 
মহীশূর, কর্নাটক, ভারতে দানব মহিষাসুরের মূর্তি

সাঁওতালরা তাদের বয়ানে দুর্গাকে খলনায়িকা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং এর বিপরীতে তারা হুদুর দুর্গা নামে মহিষাসুরপূজা করে থাকে।[][] হুদুর দুর্গা হল খেরওয়াল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা, যাকে সাওতালরা মহিষাসুর বলে দাবি করে থাকে।[] অনেকের মতে, এটি সম্পূর্ণ রূপেই গল্পকথা এবং এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তাদের মতে, হুজুর দুর্গার গল্প আদতে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এবং দেবপক্ষ ও অসুরপক্ষের সংগ্রামকে আর্যঅনার্য দ্বন্দ্ব বলে দাগিয়ে দেওয়ার একটি ভিত্তিহীন প্রয়াস। [] এই বর্ননার বিরোধীগণ এই বিষয়টিকে মূলনিবাসী তত্ত্ব ও এই ঘটনার সমর্থনকারী, বিশেষ করে এ ঘটনার সমর্থনকারী সাওতালদের মূলনিবাসীতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করে থাকে। ভারতের ঝাড়খণ্ডের খেরওয়াল সাঁওতাল ও অসুর নামক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতে, হুদুর দুর্গা ছিলেন তাদের সহস্র বছরের পুরনো পূর্বপুরুষ, চাইচাম্পা নামক গ্রামের রাজা। তিনি অত্যন্ত বলশালী ও ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন। আর্যরা ভারতে আসার পর কোনমতেই তাকে পরাজিত করতে পারছিল না। তখন তারা বিভিন্নভাবে রাজাকে মারার উপায় ভাবতে লাগল। তারা জানতে পারল রাজা অত্যন্ত নারীবৎসল এবং তাদের সমাজেও নারীদের অত্যন্ত উঁচু চোখে দেখা হয়। তাই আর্যগণ রাজাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তচর হিসেবে এক গৌরবর্ণের রূপবতী নারীকে পাঠাল, কোন কোন বর্ণনামতে, উক্ত নারী গণিকা পেশাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিল। আর্যগণ রাজার কাছে উক্ত নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল এবং রাজাও নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন। বিয়ের পর নয়দিন রাজা উক্ত নারীর সাথে রাত্রি যাপন করেন এবং নবম দিনে উক্ত নারী রাজাকে হত্যা করে। রাজার মৃত্যুর খবর শুনে আর্যগণ রাজ্য দখলের উদ্দেশ্যে রাজ্যে আক্রমণ করে এবং রাজ্যের পুরুষগণ তাদের ধর্মগুরুর পরামর্শ অনুসারে সরস্বতী নদীতে স্নান করে নারীদের বেশ ধারণ করে দাসাই নৃত্য করতে করতে রাজ্য থেকে পালিয়ে যায়। উক্ত ঘটনার নারীকেই আর্যগণ বা হিন্দুগণ দেবী দুর্গা হিসেবে এবং রাজাকে মহিষাসুর হিসেবে অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করে তাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ করেছে বলে সাঁওতালগণ দাবি করে থাকে, এবং তাদের আরও দাবি তাদের রাজা হুদুর দুর্গার নামই উক্ত নারীর নাম হিসেবে ভুলভাবে বর্ণিত হয়েছে। দুর্গাপূজার সময় তারা দুর্গাকে পূজা না করে মহিষাসুর পূজা করে থাকে এবং নারীদের বেশ ধরে পথে পথে দাসাই নৃত্য করে শোক পালন করে থাকে।[][][১০] আর অনেকের দাবিমতে, উক্ত নারী গণিকা হওয়ার কারণে হিন্দুগণ দুর্গা পূজায় দুর্গার প্রতিমা তৈরি করতে গোমূত্র, গঙ্গাজল, গোবরের সঙ্গে গণিকালয়ের (পতিতালয়ের) মাটি ব্যবহার করে।

ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে

সম্পাদনা
 
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেবী দুর্গা, বাম থেকে: ৭ম-৮ম শতাব্দীর কম্বোডিয়া, ১০ম-১১দশ শতকের ভিয়েতনাম, ৮ম-৯ম শতাব্দীর ইন্দোনেশিয়া।

জাপানি দুর্গা বা “জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)” ১৮ হাতের দুর্গা রূপ। মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। সিন্ধু সভ্যতায় তথা ব্যবিলনীয় সভ্যতায় উল্লেখ পাওয়া যায় এই মাতৃ পূজার। মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির আদি পর্ব থেকে শুরু সিংহবাহিনী দেবীর পূজা। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী ইনান্না-র। কুশান সম্রাট কনিষ্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। এখনও দেবী চণ্ডী “বিবি নানা” হিসেবে এইসব অঞ্চলে পূজিত হন।

শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০ – ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্।  এই সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলি একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম অব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজাকেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়। কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়া দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে। অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পরে হিন্দুধর্মের হাত ধরে। এই সময়ের যে দুর্গা মূর্তিগুলি কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, অধিকাংশ চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুরমর্দিনী। মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্যাবলি যে এখানে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর মতো চতুর্ভুজা এবং শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণকারী।

জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলো মধ্যে প্রাচীনতম তারিখ অনুমান অষ্টম শতাব্দীর। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎ বিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। এটি একটি ইউনেস্কো-স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ। ১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসলামের আগমনের পর দুর্গার আরাধনা পাড়ি জমায় আরও পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে।

দুর্গাপূজা

সম্পাদনা
 
মা দুর্গা

দুর্গাপূজা হল শক্তির অধিষ্ঠাত্রী পার্বতীদেবীর দুর্গা রূপের উপাসনার উৎসব। দুর্গাপূজা শরৎ (আশ্বিন) এবং বসন্ত (চৈত্র) ঋতুর শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুযায়ী, দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন হয়েছিল বসন্ত ঋতুতে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি কর্তৃক। দেবী ভাগবতকালিকাপুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দেবী পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী দুর্গা রূপের পূজা করেছিলেন রাবণ বধের নিমিত্তে; এজন্য একে, ‘অকালবোধন’ও বলা হয়ে থাকে।

পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডে দুর্গাপূজা বহুলভাবে উদ্‌যাপন করা হয়; উত্তর ভারতে এটি নবরাত্রি হিসাবে পালন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক রাষ্ট্র দুর্গাপূজা পালন করে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও সকলে দুর্গাপূজা পালন করে। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন তথা ষষ্ঠীর থেকে আরম্ভ করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে এই দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দুর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। এই পক্ষটিকে দেবীপক্ষ নামেও জানা যায়। পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন এই দেবীপক্ষের সূচনা হয়, একে মহালয়াও বলা হয়ে থাকে; আর পূর্ণিমার দিনটিকে লক্ষ্মী পূজার দিন হিসাবে গণ্য করা হয় ।

 
ঢাকার একটি মন্দিরে দেবী দুর্গার প্রতিমা।

নাম ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

হিন্দুশাস্ত্রে "দুর্গা" শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:



অর্থাৎ, "দ" অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ রোগ নাশ করে, "গ" অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং অ-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।" অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, "দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা"। অর্থাৎ, যিনি দুর্গ নামে অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত।[১২] দেবী পার্বতী দেবগণের অনুরোধে ও শিবের আদেশে এক উগ্র রূপ ধারণ করে দুর্গম অসুর কে বধ করেন তাই তিনি দুর্গা নামে অভিহিত হন।

প্রভাব

সম্পাদনা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দে মাতরম গানের পিছনে অনুপ্রেরণা দেবী হিসেবে দুর্গা, পরে ভারতের সরকারি জাতীয় গান। দুর্গা ভারতীয় জাতীয়তাবাদে উপস্থিত যেখানে ভারত মাতা অর্থাৎ ভারত মাতাকে দুর্গার একটি রূপ হিসাবে দেখা হয়। এটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ভারতীয়দের জন্য মা এবং রক্ষক হিসাবে দুর্গার প্রাচীন আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি পপ সংস্কৃতি এবং জয় সন্তোষী মা- এর মতো ব্লকবাস্টার বলিউড সিনেমায় উপস্থিত রয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী হিন্দুস্তানি বাক্যাংশ ব্যবহার করে যেমন "দুর্গা মাতা কি জয়!" এবং " কালীমাতা কি জয়!"। যে কোনও মহিলা যে ভাল এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই করার জন্য একটি কারণ গ্রহণ করে তার মধ্যে দুর্গার আত্মা রয়েছে বলে বলা হয়।[১৩][১৪]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; G নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  2. বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, প্রথম ভাগ, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৮৬
  3. পৌরাণিকা, প্রথম খণ্ড, অমলকুমার মুখোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০১
  4. দেবী দুর্গা: স্বামী অভেদানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ,২০১৩,ISBN 81-88446-62-9, পৃঃ ৫
  5. "দুর্গাপূজার সময়ে যেভাবে শোক পালন করেন 'মহিষাসুরের বংশধরেরা'"BBC News বাংলা। ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২১ 
  6. "Not Durga Puja! It's Mahishasura's martyrdom that these tribals observe"The New Indian Express (ইংরেজি ভাষায়)। ৮ অক্টোবর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১ 
  7. "অসুরপূজা নিয়ে ঘোর বিতর্ক; দুর্গা-মহিষ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী কী বলে আবহমান সংস্কৃতি?" 
  8. "Myth against myth"Dhaka Tribune (ইংরেজি ভাষায়)। ২ অক্টোবর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১ 
  9. "For The Asurs of Bengal, Durga Puja Is The Time To Celebrate The 'Demon God' Durga Slayed"ScoopWhoop (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ অক্টোবর ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১ 
  10. Chattopadhyay, Arunava (সেপ্টেম্বর ২০১৮)। DURGA: Ekti Obolokon। Atmajaa Publishers। পৃষ্ঠা ৪৮, ৪৯। সংগ্রহের তারিখ ১৭ মার্চ ২০২১ 
  11. পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪ থেকে উদ্ধৃত
  12. শব্দকল্পদ্রুম ৩।১৬৬৬; পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪
  13. Sabyasachi Bhattacharya (২০০৩)। Vande Mataram, the Biography of a Song। Penguin। পৃষ্ঠা 5, 90–99। আইএসবিএন 978-0-14-303055-3। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  14. Sumathi Ramaswamy (২০০৯)। The Goddess and the Nation: Mapping Mother India। Duke University Press। পৃষ্ঠা 106–108। আইএসবিএন 978-0-8223-9153-1 

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা
বাংলা/সংস্কৃত
ইংরেজি

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা