মহিপুর জমিদার

মহিপুর জমিদার ছিলেন মুঘল আমল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত এক মুসলিম জমিদার।

মহিপুর জমিদার ছিলেন মুঘল আমল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত এক মুসলিম জমিদার।[] মহিপুর জমিদার ছিল কোচবিহার সরকারের কাজিরহাট চাকলা বা পরগণার অধীন একটি জমিদারি শাসন ব্যবস্থা। এই জমিদারীর স্থায়িত্ব ছিলো ১৭০০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। তিস্তা নদীর গ্রাসে জমিদার বাড়ি হারিয়ে গেলেও শতাধিক বছর পূর্বে জমিদার জিয়া উল্লাহ চৌধুরী ও খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত জমিদারবাড়ি মসজিদ, কবর স্থান, শান বাঁধা পুকুর ও ইন্দারা এখনও অবশিষ্ট আছে।

মহিপুর জমিদার বাড়ি
জমিদার বাড়ি
তিস্তা নদীতে বিলিন মহিপুর জমিদার বাড়ির সামনের অংশ
সাধারণ তথ্যাবলী
অবস্থাতিস্তা নদী গর্ভে বিলিন
ধরনবাসস্থান
অবস্থানগংগাচড়া উপজেলা
ঠিকানামহিপুর, গংগাচড়া, রংপুর
শহরগংগাচড়া উপজেলা, রংপুর জেলা
দেশবাংলাদেশ
উন্মুক্ত হয়েছে১৭০০
স্বত্বাধিকারীজিয়া উল্লাহ চৌধুরী ও খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ চৌধুরী
কারিগরী বিবরণ
উপাদানইট, সুরকি ও রড

ইতিহাস

সম্পাদনা

মহিপুর গ্রামের ইতিহাস

সম্পাদনা

মহিপুর গ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। মহিপুরের পূর্ব নাম ছিল নরসিংহ, পাল বংশের রাজা মহিপালের নামের স্মৃতি রক্ষার্থে এর নামকরণ করা হয় মহিপুর। তবে গ্রাম্য লোকেরা এই গ্রামকে ভেড়ভেড়ি বলেও ডাকে। এই নামেরও একটা ইতিহাস রয়েছে, এই মহিপুর গ্রামের পাশে ভেড়ভেড়ি নামে একটি ছোট বিল ছিল; যা অনেক আগে তিস্তার গর্ভে বিলিন হয়েছে, কিন্তু এখনো এই এলাকার মানুষ এই গ্রামকে ভেড়ভেড়ি বলে ডাকে।

মহিপুর জমিদারির ইতিহাস

সম্পাদনা

জমিদার অর্থ হচ্ছে ভূস্বামী; জমির মালিক হিসেবে যিনি প্রজার নিকট থেকে খাজনা গ্রহণ করেন।[]

১৭০০-১৭৯৩

সম্পাদনা

১৮শ শতাব্দীর প্রথম দিকে কোচ রাজার সেনাপতি আরিফ মোহাম্মদ (এখনও মহিপুরে তাকে হালমাজি বা নগদ খাজনা আদায়কারী বলে) মহিপুর সহ এই অঞ্চলের ৪.৫ আনার রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘জমিদার’ হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি মুঘল সরকারের বশ্যতা স্বীকার করে নিলে মুঘল সরকার তাকে এ পরগণার অধিকারী বানান। পরবর্তীতে তার সময়ে এই পরগণা ভেঙ্গে-কাজিরহাট, মহিপুর, তুষভান্ডার, টেপা ও ডিমলা এই ৫টি জমিদারিতে বিভক্ত হয়। মহিপুর জমিদারিতে ছিল ৪.৫ আনা।[]

আরিফ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র খুলু মোহাম্মদ মহিপুর জমিদারির মালিক হন, খুলু মোহাম্মাদের মৃত্যুর পর তার ভাই খয়রুল্লাহ চৌধুরী এই জমিদারির মালিক হন এবং জমিদারির এক উল্লেখযোগ্য অংশ বিক্রয় করে দেন। খয়রুল্লাহর মৃত্যুর পর জমিদারির কিছু অংশ তার স্ত্রী আনারকলি বেগম পরিচালনা করেন এবং বাকি অংশ পুত্র মজর উল্লাহ চৌধুরীর পরিচালনা করেন।

১৭৯৩-১৮৮৩

সম্পাদনা

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় মোহাম্মদ আমিন মহিপুর জমিদারের মালিক হন। তার সময়ে জমিদারিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু খাজনা বিহীন তালুকের সৃষ্টি হয়; যার ফলে জমিদারির আয়ের পথ সংকুচিত হয় এবং সরকারী দেনা বৃদ্ধি পায়। তার পর জমিদার হন এনায়েত উল্লাহ চৌধুরী (১৮৩২খ্রি.)। তিনি রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক রংপুর জেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য (১৮৭৩খ্রি.) ছিলেন । রংপুর জেলা স্কুলকে পরবর্তীতে উচ্চ ইংরেজি স্কুলে পরিণত করার জন্য এনায়েত উল্লাহ চৌধুরীর নাম অন্যতম দাতা হিসেবে পাওয়া যায়। তিনি বিলাসিতাপূর্ণ জীবন যাপন করতেন, ফলে জমিদারি দেওলিয়া হয়ে পরে। তার পর জমিদার হন জিয়া উল্লাহ চৌধুরী ওরফে বাউরা কর্তা; যিনি ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে মারা যান।

১৮৮৩-১৯৫০

সম্পাদনা

জিয়া উল্লাহ চৌধুরী ওরফে বাউরা কর্তার মৃত্যুর পর তার পুত্র খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ চৌধুরী (জ. ১৮৬২- মৃ. ১৯১২খ্রি.) ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার হন। তিনি সফলতার সাথে জমিদারি পরিচালনা করেন। তার মৃত্যুর পর জমিদারি ভাগ হয়; তার এক পুত্র আব্দুল আজিজ চৌধুরী পান সারে দশ আনা এবং এক কন্যা মজিদাতুন্নেসা চৌধুরাণী পান সারে চার আনা। বোন তার এই সম্পত্তি ভাই আব্দুল আজিজের কাছে বার্ষিক ২২ শত টাকায় পত্তনি দেন, ফলে তিনি ১৬ আনার মালিক হন। তিনি ১৯১৬ সালে স্থাপিত রংপুর কারমাইকেল কলেজের ২৮ জন বিশিষ্ট দাতাদের অন্যতম। তার কোন পুত্র না থাকায় একমাত্র কন্যা জাহেরা খাতুন ১৬ আনা জমিদারির মালিক হন। ঢাকা নিবাসী সৈয়দ হুসাইনুর রহমানের সাথে তার বিবাহ হয়। হুসাইনুর রহমান ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ বৎসর বয়সে একমাত্র নাবালক (৮ মাস বয়স) সন্তান সৈয়দ শামসুর রহমানকে (ওরফে বাবু মিয়া) রেখে মারা যান। এ সময় এই এতিম বালক, বিধবা জাহেরা খাতুন ও বিধবা জমিলা খাতুনের দেখাশুনার ভার গ্রহণ করেন হুসাইনুর রহমানের ছোট ভাই সৈয়দ আতাউর রহমান। নাবালক বাবু চৌধুরী ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসের অধীনে মহিপুরের জমিদার হলেও বয়:প্রাপ্ত হওয়ার আগেই ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে।[]

জমিদার বাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত

সম্পাদনা

তিস্তা নদীর কড়াল গ্রাসে জমিদার বাড়ি হারিয়ে গেলেও শতাধিক বছর পূর্বে জমিদার জিয়া উল্লাহ চৌধুরী ও খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত জমিদারবাড়ি মসজিদ, কবর স্থান, শান বাঁধা পুকুর (বর্তমানে এর মালিক অন্যজন) ও ইন্দারা এখনও অবশিষ্ট আছে।

রংপুরের প্রাচীন ১৮টি জমিদারির মধ্যে একমাত্র মহিপুর জমিদারি ছিল মুসলিম শাসিত জমিদারি যা কোচ-মোঘল দ্বন্দ্বকালীন সময় থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির শেষ দিন (১৯৫০খ্রি.) পর্যন্ত বজায় ছিল। বর্তমান গংগাচড়া উপজেলা কমপ্লেক্স এই জমিদারের জায়গায় অবস্থিত।[]

জমিদারদের ন্যায়পরায়নতা

সম্পাদনা

সৈয়দ শামসুর রহমান ছিলেন প্রজাবৎসল জমিদার। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের করা আইনে সারা দিয়ে ১০০বিঘা সম্পতি রেখে সব জমি গরীব প্রজাদের বিলিয়ে দেন। তিনি ২০০৫ সাল স্ত্রী, এক পুত্র ও তিন কন্যা রেখে মারা যান। জমিদার জিয়া উল্লা চৌধুরী ছিলেন ন্যায়পরায়ন জমিদার। তিনি চুরির দায়ে আপন স্ত্রীকেও ক্ষমা করেননি।[]

অর্থাৎ মহিপুরের জমিদার বাউরা কর্তার স্ত্রী বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য পাল্কীতে উঠে। কিন্তু ৪/৬ জন বেয়ারা পাল্কী উঠাতে পারছিল না। বিসয়টি জমিদারকে জানানো হলে তল্লাসী করে পাল্কীর তলায় কয়েক মন কাঁচা টাকা পাওয়া যায়। তখন জমিদার চুরির দায়ে আপন স্ত্রীকে হত্যা করেন। জমিদার পরে বিষয়টি রংপুর কালেক্টরকে জানালে ব্রিটিশ সরকার তার সাত খুন মাফ করে দেন।[]

তিনি সৎ ও ধার্মিক ছিলেন। তিনি রাতে আল্লাহর ইবাদত ও কুরআন তেলওয়াত করতেন। এমনি এক রাতের ঘটনা তিনি ধ্যানে কুরআন তেলওয়াত করছেন। প্রদীপের তেল শেষ হয়ে গেছে; তিনি তেলওয়াত করছেন; আল্লাহর কুদরতে তেলবিহীন প্রদীপ আলো দিচ্ছে। এমন এক সময় তিনি তেলওয়াত বন্ধ করলেন, প্রদীপও নিভে গেল। আবার তেলওয়াত শুরু করলেন প্রদীপও জ্বলে উঠল। এবার তিনি বুঝতে পারলেন ইহা আল্লাহর কুদরত ছাড়া আর কিছু নয়। পরের রাতে তিনি ঐ আয়াতটি খুজতে লাগলেন কিন্তু আর খুঁজে পেলেন না। এই অতৃপ্ত সন্ধানে তিনি পাগল হয়ে যান। তিনি তিস্তার স্বচ্ছ পানিতে চান্দির টাকা ফেলতেন আর হাসতেন; আর বলতেন দুনিয়ার সম্পদ ক্ষণস্থায়ী। তিনি আল্লাহর ওলি ছিলেন। কেননা জমিদার বাড়ি তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, মাজার ও ওযু করার ইন্দারা এখনও আছে। মনে হয় যেন একটি দ্বীপের মধ্যে এগুলো অবস্থিত।[]

জমিদারির প্রশাসনিক কাঠামো (১৯০০-১৯৫০)

সম্পাদনা

মহিপুর জমিদারের অধিকাংশ জমি বিত্তবান মুসলমান জোরদারদের নামে ইজারা দেয়া হয় যারা বসুনিয়া এবং প্রামানিক নামে পরিচিত ছিল। কর্মচারীর মাধ্যমে খাজনা আদায় করে গংগাচড়া থানার মহিপুর জমিদার বা এস্টেটের সদর কাচারীতে জমা দেয়া হতো। প্রতি বাংলা নববর্ষে (১৪/১৫ এপ্রিল) জমিদার বাড়িতে নজরানা প্রদানের মাধ্যমে জমি ইজারা নবায়ন করা হতো। সদর কাচারীর বরকন্দাজ পাইকররা অধিকাংশই ছিল মোঘল ও বিহারের মানুষ। এ জমিদারির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বসুনিয়া এবং প্রামানিকদের অসামান্য প্রভাব। মহিপুর এস্টেটের রাজস্ব সংগ্রহের সাথে জড়িত ব্যক্তিরাই প্রায় সবাই স্থানীয় মুসলমান। অথচ রংপুরের সব হিন্দু জমিদারিতে স্থানীয় মুসলমান কর্মচারী ছিল না বললেই চলে। এতদসত্ত্বেও তারা ছিল বহিরাগত হিন্দু। মহিপুর জমিদারিতে সর্বশেষ নায়েব ছিল চারুচন্দ্র রায় নামক পাবনার বাসিন্দা, বারেন্দ্রীয় কায়স্থ।

গ্যালারি

সম্পাদনা

 

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. গংগাচড়া উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মো. মাহমুদুল আলম, লেখক সংসদ, রংপুর, ২০১৩খৃ., পৃ. ২৬।
  2. সাক্ষাৎকার, ছগির উদ্দিন বয়াতি, মহিপুর, গংগাচড়া, তাং-২০১১খৃ.।