মৈমনসিংহ গীতিকা

ময়মনসিংহ অঞ্চলের পালাগানের সংকলনগ্রন্থ
(ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মৈমনসিংহ-গীতিকা একটি সংকলনগ্রন্থ যাতে তৎকালীন পূর্ব-ময়মনসিংহ (বর্তমান নেত্রকোনা) অঞ্চলে প্রচলিত দশটি পালাগান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।[১] প্রথম খণ্ডের দশটি পালার রচয়িতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে[২] এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো অন্যান্যদের সহায়তায় সংগ্রহ করেন এবং স্বীয় সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাথা সংগ্রহ করছিলেন। এই গীতিকাটি বিশ্বের ২৩টি ভাষায় মুদ্রিত হয়।

মৈমনসিংহ-গীতিকা
মৈমনসিংহ-গীতিকা
ভাষাবাংলা (নেত্রকোনীয়া আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত বাংলার মিশ্রণ)
প্রকাশিত১৯২৩

উল্লেখযোগ্য পালা সম্পাদনা

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ড.দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গাথা সংগ্রাহক হিসেবে চন্দ্র কুমার দে মহাশয়ের কাছ থেকে নিম্নের পালাগুলো সংগ্রহ করেন।

  • মহুয়া (দ্বিজ কানাই)
  • মলুয়া (এই পালাটির সূচনাতে কবি চন্দ্রাবতীর একটি বন্দনা রয়েছে বলে এর রচয়িতা হিসেবে চন্দ্রাবতীকে মনে করা হয়)
  • চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ)
  • কমলা (দ্বিজ ঈশান রচিত)
  • দেওয়ান ভাবনা (চন্দ্রাবতী প্রণীত)
  • দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী)
  • রূপবতী
  • কঙ্ক ও লীলা (দামোদর দাস, রঘুসুত, শ্রীনাথ বেনিয়া এবং নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত)
  • কাজলরেখা
  • দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী)

মহুয়া পালা সম্পাদনা

নামকরণ

তৎকালীন ময়মনসিংহে (বর্তমান নেত্রকোনা) ১৬৫০ সালে রচনা হয় মহুয়া পালা। দীনেশ চন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন। মৈনমনসিংহ গীতিকায় মহুয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৩ ভাষায় মুদ্রিত হয়। এই মহুয়া গাছের নাম ধরেই মহুয়া পালা।

মহুয়ার পালার রচয়িতা দ্বিজ কানাই। রসের দিক থেকে রোমান্টিক ট্র‍্যাজেডি ঘরানার কাব্য মহুয়া পালার সংগ্রাহক দীনেশচন্দ্র সেন। এর চরিত্রগুলো হলো- নদের চাঁদ, মহুয়া, হুমরা বেদে। এর রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। এই পালায় মোট ৭৮৯টি ছত্র আছে। দীনেশচন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন।[২]

নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্জাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতী মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চনপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলত ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসেন তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করেন। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে। এক দিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাঁদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌঁছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহূতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্মত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান। [৩]দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত বইয়ের পালাটিতে অবশ্য মহুয়া আত্মহত্যার পর নদের চাঁদকে হুমরার লোকেরা হত্যা করার কথা কাব্যে পাওয়া যায়।[৪]

দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, “মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় অশ্রু আসিতেছে, কিন্তু প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরজীবী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে।”[২]


মলুয়া পালা সম্পাদনা

প্রধান চরিত্র মলুয়ার নামে পালার নামকরণ করা হয়েছে “মলুয়া পালা”। মলুয়া পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। তবে রচনার শুরুতে কবি চন্দ্রাবতীর একটি ভণিতা থাকার কারণে ধারণা করা হয় এটি চন্দ্রাবতীর রচনা।[২] কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে এই ধারণা অসত্য বলে মন্তব্য করেন।[২] যদিও বাংলার পুরনারী নামের বইয়ে মলুয়া চন্দ্রাবতীর রচনা বলে মন্তব্য করেন। মলুয়া গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১২৪৭। পালাটি মোট ১৯টি অঙ্কে বিভক্ত।

মলুয়া ও চাঁদ বিনোদের দাম্পত্য সম্পর্ক, কাজির ক্ষমতায় বিচ্ছেদ, উত্থান-পতন, ক্ষমতাবান কাজির দাপট ও তার কাছে হার না মানা এক বাঙালি নারীর কাহিনী হলো “মলুয়া পালা”।[২] মলুয়া চরিত্র সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, “রাগে উজ্জ্বল, বিরাগে উজ্জ্বল, সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল এই মহীয়সী প্রেমের মহাসম্রাজ্ঞীর তুলনা কোথায়?”[২]

চন্দ্রাবতী সম্পাদনা

নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত। এই কবি রঘুসুত, দামোদর প্রভৃতি অপর অপর কয়েকজন কবির সহযোগে 'কঙ্ক ও লীলা' নামক আর একটি গাথা প্রণয়ন করেন। চন্দ্রাবতী সুবিখ্যাত মনসাভাসান-লেখক কবি বংশীদাসের কন্যা। পিতা ও কন্যা একত্র হইয়া মনসাদেবীর ভাসান ১৫৭৫ খৃঃ অব্দে রচনা করিয়াছিলেন। পিতার আদেশে চন্দ্রাবতী বাঙ্গালা ভাষায় একখানি রামায়ণ রচনা করেন, তাহার পূর্ব্ব-মৈমনসিংহে মহিলা-সমাজে এখনো ঘরে ঘরে পঠিত ও গীত হইয়া থাকে। তাহার একখানি আমাদের সংগ্রহের মধ্যে আছে। জয়চন্দ্রকে ভালবাসিয়া এই সাধ্বী ব্রাহ্মণললনা যে মৰ্ম্মন্তুদ কষ্ট পাইয়াছিলেন এবং সেই ঘোর পরীক্ষার আগুনে পুড়িয়া তিনি কিরূপ বিশুদ্ধ সোনার ন্যায় নির্মূল হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা এই গাথাটিতে বর্ণিত আছে। বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই চন্দ্রাবতীর পরিচয় ভাল করিয়া জানেন। বংশীদাসের পিতার নাম ছিল যাদবানন্দ এবং মাতার নাম ছিল অঞ্জনা। চন্দ্রাবতী নিজে বংশ ও গৃহপরিচয় এইভাবে দিয়াছেন-

"ধারাস্রোতে ফুলেশ্বরী নদী বহি যায়।

বসতি যাদবানন্দ করেন তথায়।।

ভট্টাচার্য্য ঘরে জন্ম অঞ্জনা ঘরণী।

বাঁশের পাল্লায় তালপাতার ছাউনী।।

ঘট বসাইয়া সদা পূজে মনসায়।

কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছাড়ি যায়।।

দ্বিজবংশী বড় হৈল মনসার বরে।

ভাসান গাইয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।।

ঘরে নাই ধান-চাল, চালে নাই ছানি।

আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।।

ভাসান গাইয়া পিতা বেড়ান নগরে।

চাল-কড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।।

বাড়াতে দরিদ্র-জ্বালা কষ্টের কাহিনী।

তাঁর ঘরে জন্ম নিলা চন্দ্রা অভাগিনী।।

সদাই মনসা-পদ পূজি ভক্তিভরে।

চাল-কড়ি কিছু পান মনসার বরে।।

দূরিতে দারিদ্র্যদুঃখ দেবীর আদেশ।

ভাসান গাহিতে স্বপ্নে দিলা উপদেশ।।

সুলোচনা মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা।

যাঁর কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা॥

মনসা দেবীরে বন্দি জুড়ি দুই কর।

যাঁহার প্রসাদে হৈল সর্ব্ব দুঃখ দূর॥

মায়ের চরণে মোর কোটি নমস্কার।

যাঁহার কারণে দেখি জগৎ সংসার॥

শিব-শিবা বন্দি গাই ফুলেশ্বরী-নদী।

যার জলে তৃষ্ণা দূর করি নিরবধি।।

বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়।

‌পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায়॥"

দেখা যাইতেছে জয়চন্দ্রের সঙ্গে বিবাহপ্রস্তাব ভাঙ্গিয়া যাইবার পরে এবং চন্দ্রার আজীবন কুমারীব্রত গ্রহণের পর এই রামায়ণ লিখিত হইয়াছিল। কারণ এই গাথায়ই আছে, মনে শান্তিস্থাপনের জন্য বংশী চন্দ্রাকে রামায়ণ লিখিতে আদেশ করিয়াছিলেন। যদিও চন্দ্রার এই বন্দনায় সেই প্রেমঘটিত কথার কোন উল্লেখ নাই, তথাপি তাঁহার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ যে চলিয়া গিয়াছিল "চন্দ্রা অভাগিনী" কথাটাতেই তাহার কিছু আভাস আছে। তিনি যে পিতৃগৃহের গলগ্রহ হইয়া তাঁহাদের চিরকষ্টদায়ক হইয়া থাকিতেন-এঐ পদের পূর্ব্ব-ছত্রে সে কথাও রহিয়াছে। এই গাথার পূর্ণ আলোকপাতে চন্দ্রার করুণ আত্মবিবরণীটি আমাদের নিকট পরিষ্কার হইয়াছে। চন্দ্রাবতীর পিত্রালয় ফুলেশ্বরী নদীর তীরস্থ পাতুয়ারী গ্রামে যে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এবং সে মন্দিরের গাত্রে জয়চন্দ্র রক্তমালতীপুষ্পের রস দিয়া বিদায়পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা ফুলেশ্বরী তীরে নিষ্ঠাবতী রমণীর নৈরাশ্যকে ভগবদ্‌ভক্তিতে উজ্জ্বল করিয়া এখনও জীর্ণ অবস্থায় বিদ্যমান। জয়চন্দ্রের বাড়ী ছিল সুন্ধ্যা গ্রামে, তাহা পাতুয়ারীর অদূরবর্তী ছিল। নয়ানচাঁদ ঘোষ কোন সময়ে এই গাথাটি রচনা করিয়াছিলেন, তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে রঘুসুত কবি যিনি ইহার সঙ্গে "কঙ্কও লীলা" লিখিয়াছিলেন, তিনি ২৫০ বৎসর পূর্ব্বে জীবিত ছিলেন। রঘুসুতের বংশলতায় এই অনুমান সমর্থিত হয়। পাতুয়ারী গ্রামটি কিশোরগঞ্জ হইতে বেশী দূরে নহে। এই গাথাটির ছত্রসংখ্যা মোট ৩৫৪। ইহাকে আমরা ১২ অঙ্কে বিভাগ করিয়া লইয়াছি।

কমলা পালা সম্পাদনা

মূল চরিত্র কমলার নাম থেকে পালার নামকরণ করা হয়েছে। পালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। কমলা পালায় মোট ১৩২০টি ছত্র এবং ১৭টি অঙ্কে বিভক্ত।

প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণে রাজা জানকীনাথ মল্লিক তার স্ত্রীর নামে কমলা সায়র দিঘি খনন করান। কিন্তু দিঘিতে জল না উঠায় রাজা নরকপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় পেলে রানি কমলা স্বামীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন। তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দাসীদের হাতে সমর্পণ করে সদ্যখোঁড়া দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরতরে হারিয়ে যান। রানিকে হারানোর শোকে কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করে ধারণা করেন এই কাহিনীর মূল ঘটনা সত্য।[২]

উল্লেখ্য যে দিঘীটির অবস্থান নেত্রকোণা জেলার সুসং দুর্গাপুর উপজেলায়।

দেওয়ান ভাবনা সম্পাদনা

এই পালাটি (সুনাই - মাধব) পালা নামেই বেশি পরিচিত । পালাটির রচয়িতা চন্দ্রাবতী।

দেওয়ান ভাবনা-দেওয়ানদের অত্যাচারের কথা যে সকল গীতিকায় বর্ণিত আছে, তাহাদের কোনটিতেই কবির নাম পাওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে কবিদের সতর্কতা অকারণ নহে।

দেওয়ান ভাবনা মোট ৩৭৪টি ছত্রে সম্পূর্ণ, -আমি গানটিকে ৯ অঙ্কে ভাগ করিয়াছি। এই গীতিকা ২০০/২৫০ বৎসর পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল বলিয়া অনুমান করা যায়। গীতিবর্ণিত "বাঘরা"র নামে তদঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ একটি হাওর পরিচিত। প্রবাদ এই, সোনাই-এর মত বহু সুন্দরীর সন্ধান দেওয়ার পুরস্কারস্বরূপ বাঘরা নামক এক গুপ্তচর ('সিন্ধুকী') দেওয়ানদের নিকট হইতে এই বিস্তৃত 'হাওর' লাখেরাজস্বরূপ পুরস্কার পাইয়াছিল। 'বাঘরা'র হাওর' নেত্রকোণার দশমাইল দক্ষিণ-পূর্ব্বে। বোধ হয় 'দীঘলহাটী' গ্রামের অস্তিত্ব লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু উক্ত হাওরের নিকটবর্ত্তী 'ধলাই' নদীর তীরে 'দেওয়ানপাড়া' নামক একটি গ্রাম আছে, -সম্ভবতঃ এইখানেই 'দেওয়ান ভাবনা'র আবাস ছিল।

'দেওয়ান ভাবনা' ১৯২২ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দ্রকুমার দে আমাকে সংগ্রহ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। কেন্দুয়ার (নেত্রকোনা জেলার একটি উপজেলা) নিকটবর্তী কোন কোন স্থানের মাঝিদের মুখে এই গান তিনি শুনিয়াছিলেন। নৌকা-'বাইছ' দেওয়ার সময়ে এখনও তাহারা এই গান গাহিয়া থাকে।

দস্যু কেনারামের পালা সম্পাদনা

চন্দ্রাবতী প্রণীত। চন্দ্রাবতীর পরিচয় তৎসম্বন্ধীয় গাথার বিবরণে প্রদত্ত হইয়াছে, পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কেনারামের বাড়ী ছিল বাকুলিয়া গ্রামে। নলখাগড়ার বনসমাকীর্ণ সুপ্রসিদ্ধ "জালিয়ার হাওর' কেন্দুয়া শহরের পূর্ব্ব দক্ষিণে অবস্থিত, এইখানেই বংশীদাসের সঙ্গে কেনারামের সাক্ষাৎ হয়। এই গীতাক্ত ঘটনা ১৫৭৫ হইতে ১৬০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময়ে হইয়াছিল। প্রবাদ এই যে, প্রেমাহতা চন্দ্রা জয়চন্দ্রের শব দর্শন করার অল্পকাল পরেই হৃদ্রোগে লীলা সংবরণ করেন। ফুলেশ্বরী নদীর গর্ভেই কেনারাম তাহার মহামূল্য ধনরত্ন বিসর্জন দিয়াছিল। এই গীতের মোট ছত্র সংখ্যা ১০৫৪, তাহার মধ্যে অনেকাংশ মনসাদেবীর গান, সেগুলি অপরাপর কবির লেখা, সুতরাং আমি গাথাটির অনেকাংশ বর্জন করিয়াছি। মনসাদেবীর গানের মধ্যে যেখানে চন্দ্রাবতীর লেখা কেনারামের বিবরণ আছে, সেই সেই স্থান আমি নক্ষত্রচিহ্নিত করিয়াছি।

রূপবতী সম্পাদনা

এই গাথাটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলিবার নাই। কবির নাম পাওয়া যায় নাই। ছত্রসংখ্যা ৪৯৩। ১৯২২ খৃঃ অব্দের ৩০শে মার্চ ইহা আমার হস্তগত হয়। আমি ইহাকে ৭ অঙ্কে বিভাগ করিয়াছি।

কঙ্ক ও লীলা সম্পাদনা

এই গাথার রচক ৪ জন, দামোদর, রঘুসুত, নয়ানচাঁদ ঘোষ ও শ্রীনাথ বেনিয়া। রঘুসুত ২৫০ বৎসর পূর্ব্বে জীবিত ছিল, ইহারা জাতিতে পাটুনি, বহু পুরুষ যাবৎ ইহারা গায়কের ব্যবসা করিতেছে, ইহারা এজন্য 'গায়েন' (ময়মনসিংহে 'গাইন') উপাধিতে পরিচিত। রঘুসুতের নিম্নতম বংশধর, রামমোহন গায়েনের পুত্র শিবু গায়েন 'কঙ্ক ও লীলা'র পালা অতি উৎকৃষ্টভাবে গাইতে পারিত। ইহাদের বাড়ী নেত্রকোণায় কেন্দুয়া থানার অধীন “আওয়াজিয়া" গ্রাম। উৎকৃষ্ট পালাগায়ক বলিয়া ইহারা গৌরীপুরের জমিদারদিগের নিকট হইতে অনেক নিষ্কর জমি পুরস্কারস্বরূপ লাভ করিয়াছে। ২০/২১ ব ৎসর হইল শিবু গায়েনের মৃত্যু হইয়াছে। কবিকঙ্ক পূর্ব্ববঙ্গের সাহিত্যাকাশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র: ইনি বিপ্রবর্গ বা বিপ্রগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ গ্রাম কেন্দুয়ার অদূরবর্তী রাজেশ্বরী বা রাজী নদীর তীরে, বিপ্রবর্গের নিকট ধলেশ্বরী বিলের সন্নিকট এখনও পাঁচ-পারের একটা জায়গা আছে এবং তথায় "পীরের পাথর” নামক একটা পাথর আছে। গীতোক্ত পীর এইখানে আড্ডা করিয়াছিলেন।

কবিকঙ্কের রচিত “মলুয়ার বারমাসী" এক সময় পূর্ব্ব মৈমনসিংহের (নেত্রকোনা) কাব্যরসের খনি ছিল । এখনও তাহার দুই-একটি গান গ্রাম্যকৃষকের মুখে শোনা যায়। এখন পর্যন্ত আমরা পালাটি সংগ্রহ করিতে পারি নাই। কিন্তু চন্দ্রকুমারের বহু চেষ্টায় কবিকঙ্কের "বিদ্যাসুন্দর" খানি সংগৃহীত হইয়াছে। এই বিদ্যাসুন্দরের মুখবন্ধে কবি তাঁহার পিতামাতার নাম, তাঁহার চণ্ডাল পিতা ও চণ্ডালিনী মাতার নাম ও গর্গের কথা লিখিয়াছেন। কিবচতুষ্টয়-প্রণীত এই গাথায় তাঁহার বাল্যলীলার যে ইতিহাস আছে তিনি নিজেও সেই কথা অতি সংক্ষেপে বলিয়াছেন। পল্লীগাথাগুলির ঐতিহাসিকত্বের ইহা অন্যতম প্রমাণ। খুব সম্ভব কঙ্ক চৈতন্যের সমকালবর্তী ছিলেন। "কঙ্ক ও লীলা" ১০১৪ সংখ্যক ছত্রে পূর্ণ। আমি এই গাথাটিকে ২৩ অঙ্কে বিভাগ করিয়া লইয়াছি। কবিকঙ্কের বিদ্যাসুন্দরই বাঙ্গালা 'বিদ্যাসুন্দর'গুলিরমধ্যে প্রাচীনতম প্রাণারাম কবি 'বিদ্যাসুন্দর' গুলির যে তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে নিম্নাবাসী কৃষ্ণরামের বিদ্যাসুন্দরকে 'আদি বিদ্যাসুন্দর' বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তিনি পূর্ব্ববঙ্গবাসী কবিদের • কথা অবগত ছিলেন না।

কাজল রেখা সম্পাদনা

মৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা কাজল রেখা পালা। এই পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। এই পালার কিছুটা সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলিতে।[২]

ধনেশ্বর তার অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্যের কারণে শুকপাখির উপদেশে কন্যা কাজল রেখাকে এক গভীর নির্জন বনের ভাঙা মন্দিরে রেখে আসে। সেই মন্দিরে এক সন্ন্যাসী কোনো এক মৃতপ্রায় রাজপুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য সূঁচ বিঁধিয়ে রেখেছিলেন। পিতা ও সন্ন্যাসীর কথায় কাজল রেখা সেই সূঁচরাজপুত্রকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তার সূঁচ তুলে রাজরানী হয়ে থাকার সময় আবার এক দুর্ঘটনা ঘটে। হাতে কাঁকন দ্বারা কিনে নেওয়া দাসীর কৃতঘ্নতায় কাজল রেখা দাসী হয়ে স্বামীর রাজ্যে বাস করতে থাকে। এক সময় সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কাজল রেখা।[২]

দেওয়ানা মদিনা সম্পাদনা

মনসুর বয়াতী রচিত এই পালাটিতে প্রকাশ পেয়েছে গ্রামবাংলার এক বধু "মদিনার" তার স্বামীর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা।

বানিয়াচঙ্গের দেওয়ানদের সম্বন্ধে গাথা। এই গানে ধনু নদীর উল্লেখ আছে, দীঘলহাটি গ্রাম খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। ইহার লেখক মনসুর বাইতি সম্বন্ধে নাম ছাড়া আর কিছু জানিতে পারা যায় নাই। কবি যে নিরক্ষর ছিলেন, তাহা যেমন তাঁহার কাব্যপাঠে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি যে প্রকৃত কবিত্বশালী, করুণরসসৃষ্টিতে সুপটু ছিলেন, তাহাও তেমনই অবধারণ করা যায়। মদিনার স্বামীর ভালবাসায় অগাধ বিশ্বাস-যাহা তালাকনামা পাইয়াও দীর্ঘকাল টলে নাই-সে অগাধ বিশ্বাসে যেদিন হানা পড়িল, সেদিন সে মৃত্যুশয্যাশায়ী হইল। তাহার অপূর্ব্ব সংযম, যাহাতে এরূপ কৃতঘ্নতায়ও স্বামীর বিরুদ্ধে একটি কথা সে বলিতে পারিল না, এই অপূর্ব্ব প্রেম ও চিত্তসংযম কোন্ উচ্চ লোকের, পাঠক তাহা ধারণা করুন। চাষার ভাষায় লেখা বলিয়া অবজ্ঞা করিবেন না।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "মৈমনসিংহ গীতিকা"bn.banglapedia.org। বাংলাপিডিয়া। 
  2. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; সপ্তসিন্ধু নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি