'মনোরোগ বিজ্ঞান' বা ' মানসিক রোগ বিজ্ঞান' [psychiatry] হচ্ছে মানসিক রোগের চিকিৎসা বিষয়ক অধ্যয়ন। এই অধ্যয়নে মানসিক রোগের ব্যাপ্তি, মূল কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, [মনোবিজ্ঞান] বা মনস্তত্ত্ব (Psychology) বিষয়ে সাধারণত মনের (রোগবিহীন) বিষয়ে অধ্যয়ন করা হয়। মনোরোগ বিজ্ঞান অধ্যয়ন করে এই বিভাগের চিকিৎসা প্রদানকারীদেরকে 'মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ' (Psychiatrist) বলা হয়।

Psychiatry শব্দটি প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন ১৮০৮ সালে জার্মান চিকিৎসক 'জোহান খ্রিষ্টান রেইল'(Johann Christian Reil)। Psychiatry শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে মনোরোগ বিদ্যা।

সাধারণত মানসিক রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর রোগ সমূহ ও অন্যান্য প্রাসংগিক তথ্য আহরণ করা হয় ও 'মানসিক স্থিতির পরীক্ষণ'(Mental Status Examination) করা হয়। কিছুক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষার (Psychoogical test) সহায়তা নেওয়া হয়। এইভাবে রোগ চিনে নেওয়ার পরে তার চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন ঔষধ, ব্যবহারিক চিকিৎসা, মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, বৈদ্যুতিক মৃগী সৃষ্টি (Electro Convulsive Therapy, সংক্ষেপে ECT) ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশ করেছে যে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

ইতিহাস সম্পাদনা

মনোরোগ বিজ্ঞান ইতিহাস বহু পুরানো হলেও Psychiatry শব্দটি প্রথম প্রকাশ করা হয় ১৮০৮ সালে, জোহান খ্রিষ্টান রেইল-এর দ্বারা। ঊনবিংশ শতকে চিকিৎসালয়ের ধারণা গড়ে ওঠার পরে মনোরোগ বিজ্ঞান বিষয়টি গড়ে উঠে। মনোরোগ বিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আরম্ভ করা হয় ১৮ শতকের পর থেকে। তার আগে মানসিক রোগকে বিভিন্ন ভূত-প্রেত, অপদেবতার প্রকোপ বা ভগবানের শাস্তি বলে ভাবা হত। তবুও মানসিক রোগের বিষয়ে কমবেশি অধ্যয়নের আভাস বহু আগে থেকেই পাওয়া গেছে। [১]

প্রাচীন যুগ সম্পাদনা

খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের থেকেই মানসিক রোগের বিষয়ে তথ্য উল্লেখ আছে যদিও সেটি কোনো রোগের লক্ষণ বলে মনে করে ভগবানের শাস্তি বা অপদেবতার প্রকোপ হিসাবে উল্লেখ আছে। মানসিক রোগকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসাবে ধরা হত, যার ফলে এর চিকিৎসার জন্য সাধারণত পুরোহিতরা ঝাড়-ফুঁকের বিধান দিত। [২] বাইবেলে উল্লিখিত নেবুচাডনেজ্জারের কাহিনীটি এই বিষয়ক প্রথম উল্লেখ বলে মনে করা হয়। নেবুচাডনেজ্জারের ঐতিহাসিক শাসনকাল খ্রী.পূ. ৬০৫-৫৬২ বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই উল্লেখ যদি সত্য হয় তবে এটি মানসিক রোগের প্রথম লিখিত বিবরণী হবে।

খ্রী.পূ. চতুর্থ শতকের হিপোক্রেটিস-এর লেখনীতে 'বিষাদগ্রস্ততা' (Depression) ও 'হিস্টিরিয়া'-র (Hysteria) উল্লেখ আছে। হিপোক্রেটিস এই দুই মানসিক রোগের কারণও ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্য সেই ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়নি।

লক্ষ্যণীয় যে 'প্রাচীন যুগ'এ (Ancient Age) মানসিক রোগকে এক প্রকার রোগ হিসাবে ধরে নিয়ে চিকিৎসা করার চেষ্টা করা হয়েছিল যদিও 'মধ্য যুগ'এ (Middle Age) সেই ধারা বদলে যায়।

মধ্য যুগ সম্পাদনা

মানসিক রোগীর জন্য বিশেষ চিকিৎসালয়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৭০৫ খ্রীস্টাব্দের বাগদাদ-এ। প্রায় সমসমায়িক অন্য দুটি এমন চিকিৎসালয়র কথা জানা যায়, ফেসকায়রো-তে। দশম শতকের পার্সি চিকিৎসক 'মহম্মদ বিন জাকারিয়া রাজি' মনস্তাত্ত্বিক ও ভেষজ – দুই ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমেই মানসিক রোগ চিকিৎসা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তখনকার সমসাময়িক আরব চিকিৎসক 'নজব উদ-দিন আহমেদ' মানসিক রোগসমূহকে শ্রেণী বিভাগ করার চেষ্টা করেছিলেন। [৩]

একাদশ শতকে অন্য একজন পার্সি চিকিৎসক, 'আবু আল-হুসেইন ইবন আব্দুল্লা ইবন সিনা' ( পাশ্চাত্যে 'আভিসেনা'(Avicenna) নামে পরিচিত) ধমনীতে রক্তের গতির (Pulse) সাথে 'আবেগ'-এর সংযোগ লক্ষ্য করেন।[৪] তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'Cannon of Medicine (Al-Qanun fi al-Tibb)'-তে মানসিক রোগের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে । এতে যৌন সমস্যা, প্রেমজনিত রোগ, অহেতুক বিশ্বাস, মৃগী, নিদ্রাহীনতা, বিষাদগ্রস্ততা, একাংগী, স্মৃতিবিলোপ ইত্যাদির বিষয়ে আলোচনা অগ্রসর হয়েছে। [৫]

১১ ও ১৩ শতকে প্রথমে [ইউরোপ]-এ মানসিক রোগীদের জন্য '[পাগলাগারদ]'এর প্রচলন হয়। এই পাগলাগারদ সমূহ মানসিক রোগীর জন্য জেলের মতো ছিল, যাতে তাঁরা সাধারণ মানুষের শান্তিভংগ করতে না পারে।[৬] ১৩ শতকে স্থাপিত হয়েছিল লন্ডনের বিখ্যাত Bethlem Royal Hospital সংক্ষেপে Bedlum। ১৯৪৮ সাল থেকে এই চিকিৎসালয়টি চালু হয়েছিল। [৭]

 
ফিলিপ পিনেল-কে আধুনিক মনোরোগ বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।

আধুনিক যুগের প্রথমে সম্পাদনা

১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে ফ্রান্সর চতুর্দশ লুই মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য প্রথম একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ইংলণ্ডে ১৭৫৮ সালে 'উইলিয়াম বেটি' (William Battie) প্রথম মানসিক রোগীদেরকে চিকিৎসার সাথে সহৃদয়তা ও সমবেদনার সাথে দেখা হোক - এই ধারণার বিষয়ে বলে গিয়েছিলেন।[৮] ১৭৯৮ সালে ইংল্যান্ড-এর রাজা তৃতীয় জর্জর মানসিক বিকার ভাল হওয়ার পরে 'মানসিক রোগ উপশম হতে পারে' এই বিশ্বাস প্রথমে গড়ে ওঠে।[২] এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানসিক রোগের চিকিৎসালয়ের প্রসার ঘটে সমগ্র ইউরোপে। অবশ্য চিকিৎসালয় বলা হলেও তাতে চিকিৎসার জন্য বিশেষ কিছু করা ছিল না। কারণ মানসিক রোগের চিকিৎসা সেই সময় করার কোনো উপায়ই ছিল না। চিকিৎসালয়সমূহে রোগীকে সাধারণত বেঁধে রাখা হত।

রোগীকে বন্ধন থেকে মুক্ত করার পোষকতা করা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন '[ফিলিপ পিনেল]' (Philippe Pinel)। তিনি ১৭৯৩ সালে [প্যারিস]-এর 'বিয়েট্রি'(Bisetr / Bicetre) চিকিৎসালয়র রোগীদেরকে আবদ্ধ করে রাখার নিয়ম বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পিনেলের এই কাজকে মানসিক রোগ বিজ্ঞানের সাথে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক মাইলফলক বলে গণ্য করা হয়। তাঁকে '[মনোরোগ বিজ্ঞানের জনক]' বলে অভিহিত করা হয়।[২] রোগীকে বন্ধন মুক্ত করে সাধারণ মানুষের মতো চিকিৎসা করতে সাহায্য করা তাঁর মতবাদকে 'মানবীয় চিকিৎসা' (Moral Treatment) নাম দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য এই মতবাদ সম্পূর্ণরূপে পিনেলের সৃষ্টি ছিল না। এই মতবাদের সঙ্গে '[জঁ বাপ্টিস্ট পুসি]'-র (Jean-Baptiste Pussin (1745-1811)) অবদানের কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করে গেছেন। পিনেল মানসিক রোগীদের লক্ষণ সমূহ অধ্যয়ন করার ক্ষেত্রে জোর দেন। এই ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই যে আজও মানসিক রোগের নিদানের জন্য লক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় রোগের নিদান রোগের কারণের উপর ভিত্তি করে করা হয়। মানসিক রোগের কারণসমূহ এখনও বিশদভাবে জানা যায়নি, এজন্য এই ব্যবস্থা এখনও মেনে চলা হচ্ছে। পিনেলের এই অবদান পরবর্তীতে মানসিক রোগের শ্রেণিবিভাগ করতে বিশেষ আগ্রহ যোগায়।

পিনেলের আদর্শ আনুধাবন করে '[উইলিয়াম টুক]' (William Tuke) [ইংল্যান্ড]-এ 'ইয়র্ক রিট্রিট' (York Retreat) নামক এক মানসিক রোগ চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।[২] একই আদর্শে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এ ব্রেটেলবোরো (Brattleboro) ও হার্টফোর্ড রিট্রিট (Hartford Retreat, বর্তমান নাম Institute of Living) গড়ে তোলা হয়।

পিনেলের কাজই মানসিক রোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটায়।

উনবিংশ শতক সম্পাদনা

পিনেলের আদর্শে গড়ে ওঠা মানসিক রোগ চিকিৎসালয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে এবং ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগে সমগ্র পৃথিবীতে এরকম চিকিৎসালয় গড়ে ওঠে।[৯] উল্লেখনীয় যে, এমন চিকিৎসালয় সংখ্যায় অসংখ্য ও সেখানে রোগীকে মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে রাখা হ'লেও প্রকৃত চিকিৎসার নামে তেমন কোনো বিকাশ ছিল না।[১০] এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিকিৎসালয় বলা হলেও সাধারণত 'পাগলাগারদ' (Asylum) বলে ডাকা হত৷ তথাপি এই চিকিৎসালয়গুলি মনোরোগ বিজ্ঞানের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল কারণ এই প্রতিষ্ঠান মানসিক রোগী অধ্যয়ন করতে সুবিধা প্রদান হত৷ 'পাগলাগারদ'গুলি নিয়ন্ত্রণ করত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, এবং মানসিক রোগ বিষয়ে আগ্রহী লোকদেরকে রোগী অধ্যয়নের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।[১১] এই বিষয়ে অনেকটা অগ্রণী দেশ ছিল [জার্মানী]। সেই জন্যই এইসব রোগীর লক্ষণ বর্ণনা বিষয়ে জার্মান ভাষার শব্দ বিদ্যমান।[১২] এই রাসায়নিক ছিল 'এসিটাইলকোলিন' (ACh : Acetylecholine)। ইহা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের মধ্যে বার্তাবাহকের কাজ করে। অর্থাৎ একটা কোষ অন্য একটা কোষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই রাসায়নিকের সহায়তা নেয়। এই আবিষ্কার মস্তিষ্কের কার্য-প্রণালী বুঝতে একটি নতুন দিকের জন্ম দেয়। দৃশ্যমান অসংগতি না থেকেও যে মস্তিষ্কের কার্য্য-প্রণালী ব্যাহত হতে পারে তাকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হয়।

ফ্রয়েডের তত্ত্ব অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে ফ্রয়েডের তত্ত্বের বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্তের মাধ্যমে সকল মানসিক রোগকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস করা হয়। অবশ্য এই প্রচেস্টা সম্পূর্ণ সফল হয় নি। এই তত্ত্বের দ্বারা নিউরোসিসের বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া গিয়েছিল এবং মনোবিশ্লেষণ চিকিৎসাও করা হয়েছিল। একইভাবে কিছু সংখ্যক ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞানের নিয়মের মাধ্যমে মানসিক রোগ চিকিৎসা করার প্রয়াস করা হয়েছিলো। তখন সাইকোসিসের একটিও ব্যাখ্যা অগ্রগামী ছিল না। উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মনোরোগ বিজ্ঞান মূলতঃ ফ্রয়েডীয় ও ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞানের ধারণায় পরিপুষ্ট ছিল। নিউরোসিস রোগীদেরকে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হত। অন্যদিকে, সহায়তা করতে না পেরে সাইকোসিসের রোগীদের পাগলাগারদে রাখা হত। তাতে তাঁদের জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা ছিল না।

বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ সম্পাদনা

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মনোরোগের চিকিৎসার জন্য মোটামুটি দুটো পদ্ধতি ছিল। ফ্রয়েড ও উত্তরসূরীদের 'মনোবিশ্লেষণ' (Psychoanalysis), অন্যদিকে '[ব্যবহারিক মনোবিজ্ঞান]'-এর ['ব্যবহারিক চিকিৎসা]' (Behavioural Therapy)। এই দুইটি পদ্ধতিতে মোটমাট নিউরোসিস রোগের চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল। 'পাগল' বলে সাধারণভাবে অভিহিত করা 'সাইকোসিসের রোগীদের চিকিৎসার বিশেষ ফলপ্রসূ উপায় ছিল না। থাকা উপায় সমূহ ছিল 'ইলেক্ট্রো' কনভালসন থেরাপি','ইনসুলিন কমা থেরাপি' ইত্যাদি। কিন্তু এই চিকিৎসাসমূহের দ্বারাও দীর্ঘকালীন সাফল্য পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেইসময় রোগীকে মানসিক চিকিৎসালয়ে রেখে যাওয়ার পর বাইরে নিয়ে আসার কোন উপায় ছিল না।

কিন্তু ১৯৫০ সালে হওয়া একটি অভিনব আবিষ্কার এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করে। ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে ফ্রান্সের 'রইন-পোলে কোম্পানী' (Laboratoires Rhone-Poulenc) 'প্রোমেথাজিন'(Promethazine) নামক রাসায়নিকের আণবিক গঠনের কিছু পরিবর্তন করে একটি নতুন রাসায়নিক প্রস্তুত করে। রসায়নবিদ 'পল চারপেণ্টিয়ার'-এর (Paul Charpentier) প্রস্তুত করা এই ঔষধটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'ক্লোরপ্রমাজিন'(Chlorpromazine)। এই ঔষধটি [অ্যানেস্থেসিয়া] র (Anaesthetic drug) সহায়তাকারী ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এর গুণাগুণ লক্ষ্য করে '[হেনরি লেগুলিট]' নামক একজন শল্য চিকিৎসক একে মানসিক অস্থিরতা কমাবার জন্য ব্যবহার করার প্রস্তাব দেন। এই ঔষধ দিয়ে '[ম্যানিয়া]'তে ভুগতে থাকা একজন রোগীকে তিন সপ্তাহ চিকিৎসার পরে বাড়ি যাওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়।

এর গুণাগুণ লক্ষ্য করে '[পিয়ের ডেনিকার]' (Pierre Deniker) [প্যারিস]-এর সেন্ট এনি হসপিটালকে (Hôpital Sainte-Anne) মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য এর ব্যবহার করেন। এই ওষুধের ক্রিয়া ছিল চমকপ্রদ। এগুলির বাইরেও এই ওষুধটি অন্যান্য লক্ষণ সমূহেরও উপশম করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা হয়। খুব তাড়াতাড়ি এই ওষুধের প্রয়োগ বেড়ে যায়। ১৯৫৪ সালে আমেরিকায় কিছু মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য একে ব্যবহার করতে নেওয়া হয়। এই ওষুধটির জন্যই প্রথমবারের জন্য পাগলাগারদে ভর্তি থাকা রোগীদের সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো হয়েছিল। মানসিক রোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্লোরপ্রোমাজিনোর আবিস্কার এক বৈপ্লবিক ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়। সেই সময়েই এটি ওষুধের মধ্যে কম পার্শ্বক্রিয়া থাকা নতুন ওষুধ মানা হয়। এই নতুন ওষুধর মধ্যেই '[বিষাদগ্রস্ততা]'র (Depression) ওষুধও পাওয়া যায়।

ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানসিক রোগের কারণ নির্ণয়ের জন্য একটি নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যায়। সেটি হচ্ছে, ওষুধটি কোন শারীরতন্ত্রে কীভাবে কাজ করে তার অধ্যয়ন করা। এই পদ্ধতির দ্বারা কয়েকটি মানসিক রোগে যে মস্তিষ্কের ভিতর নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যপ্রণালীতে অসংগতির জন্যই মানসিক রোগ হয় তা জানা গেছে। কিন্তু এই অসংগতি কি এবং কীভাবে হয়, তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনো পর্যন্ত দেওয়া যায়নি। মানসিক রোগ চিকিৎসার কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানসিক রোগ সম্পর্কে এক নতুন ধ্যান-ধারণা আরম্ভ হয়। এমিল ক্রেপেলিন-এ অগ্রণী ভূমিকায় 'মস্তিষ্কের বিকার' ধারণাটির পুনর্জন্ম হয় এবং বর্তমানের মনোরোগ বিজ্ঞান এই ধারণাতেই উদ্বুদ্ধ; অর্থাৎ মানসিক রোগসমূহ মস্তিষ্কে ঘটা কিছু জৈবিক প্রক্রিয়ার ফল। সেইজন্য এই ধারণাকে 'জৈবিক মনোরোগবিজ্ঞান'(Biological Psychiatry) বলা হয়ে থাকে।

কিন্তু সমস্ত মানসিক রোগের ক্ষেত্রে জৈবিক কারণ এখনো পূর্ণরূপে আবিষ্কার হয়নি। অন্যদিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে একটি কথা জানা গিয়েছিল যে, সকল জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্যই মানসিক রোগ না হতেও পারে। মানসিক রোগের কারণের মধ্যে চারপাশের পরিবেশ, বংশগতি, এমনকি সমাজ ও শিক্ষারও প্রভাব থাকতে দেখা যায়। সেইসব বর্তমান সমস্ত রোগের ক্ষেত্রে 'জৈব-মনো-সামাজিক নমুনা' (Biopsychosocial Model) প্রয়োগ করা হয়। ১৯৭৫ সালে '[জর্জ এঞ্জেল]'-এর (George L.Angel) প্রবর্তন করা এই মতবাদ অনুসারে, যেকোনো রোগের লক্ষণ ও তার চিকিৎসার সাথে তিনটে ধারণা একসাথে নিহিত হয়ে থাকে। 'রোগের জৈবিক কারণ', 'রোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তির মানসিক ধারণা' ও 'সমাজটির রোগ ও রোগীর প্রতি পোষণ করা ধারণা', এই তিনটি বস্তুও রোগটির লক্ষণ ও চিকিৎসার সেই অসুখটি নির্ণয় করে। সেইসব রোগের উপশমের জন্য ওষুধ দেওয়ার বাইরেও চিকিৎসককে রোগীর মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার প্রতিও দৃষ্টি রাখা দরকার। বর্তমান মানসিক রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই তিনটি কারকের উপর কাজ করার প্রয়াস করা হয়।

মানসিক রোগ সম্পাদনা

মানসিক রোগ বলেলে সাধারণতে মস্তিষ্কের বিকার ঘটে অদ্ভুত আচরণ করাটিকে ধরে নেওয়া হয়, যদিও এটি আসলে মানসিক রোগের একটি ছোট অংশ। সংজ্ঞা অনুসারে, মানসিক রোগ হল যেকোনো এমন অসুখ যার জন্য একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন কাজ-কর্মে হানি ঘটে অসুখ হয়, এবং সেই অসুখসমূহ অন্য কোনো রোগ, বা দ্রব্যের প্রয়োগ, বা পরিস্থিতির দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।

এই সংজ্ঞা অনুসারে, একজন মানুষের আচার-ব্যবহারে হওয়া পরিবর্তন, চিন্তা-চর্চায় হওয়া পরিবর্তন, তাঁর অনু্ভূতিতে হওয়া পরিবর্তন, অতি মাত্রায় নেশাযুক্ত দ্রব্য ব্যবহার করা, বুদ্ধি ও স্মৃতি-শক্তির হীনতা, কিছু শারীরিক লক্ষণ যাকে অন্যান্য রোগের দরুন ব্যাখ্যা করতে যায় না, ইত্যাদি বহু ধরনের মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। কিন্তু মানসিক রোগ সনাক্তকরণের জন্য উপর্যুক্ত দৈনন্দিন জীবনের অসুখ হওয়াটি প্রয়োজনীয়। খাদ্যাভাসের পরিবর্তন, যৌন সমস্যা, মানসিক দৃঢ়তার অভাব, ইত্যাদিও মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে।

মানসিক রোগের শ্রেণী বিভাগ সম্পাদনা

এমিল ক্রেপেলিন প্রথম মানসিক রোগের শ্রেণিবিভাজন আরম্ভ করেন। তিনি এর জন্য রোগের লক্ষণ ও দৈর্ঘ্যের (রোগটি কতদিন ধরে চলতে থাকে) উপর ভিত্তি করেছিলেন। তিনি মূলত মানসিক রোগকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন- 'সাইকোসিস' ও 'নিউরোসিস'। যেসব রোগে মানুষজন নিজেই বুঝতে পারে যে সে কোনও একটি মানসিক অসুখে ভুগছে, সেগুলিকে বলা হয়--'নিউরোসিস' এবং যেসব রোগে রোগী নিজের মানসিক অবস্থাকে বুঝতে পারে ননা, সেগুলিকে 'সাইকোসিস' বলে। উদাহরণস্বরূপ, 'মানসিক অশান্তি' (tension), 'বিষাদগ্রস্ততা' (Depression) একটি 'নিউরোসিস'। কারণ এই দুটিতে ভুক্তভোগী নিজেই বুঝতে পারে যে তাঁর মানসিক জগতে একটি অসুখ হচ্ছে। অন্যদিকে 'স্কিজোফ্রেনিয়া' (Schizophrenia) রোগে মানুষজন অদ্ভুত আচরণ করে, কিন্তু তাঁরা নিজে বুঝতে পারে না যে তাঁরা কোন্ অসুখে ভুগছে। এইসব রোগসমূহকে 'সাইকোসিস' বলা হয়। এখনো পর্যন্ত 'সাইকোসিস' বা 'নিউরোসিস' বিভাজনকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে নেওয়া হয়নি। কারণ দেখা গেছে যে, এসব মানসিক অবস্থা বুঝতে পারা বা না পারা অন্য বহু কারকের উপর নির্ভর করে। যেমন, একটি সমাজে প্রচলিত নীতি-নিয়মের ভিত্তিতে রোগটিকে মানুষ অন্যান্য ধরণেও ব্যাখ্যা করতে পারে। যেমন, ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক মানসিক রোগকে অপদেবতার কাণ্ড বলে ভাবা হয়। সেইসব মানুষজন নিজেও এমন হলে সেটিকে মানসিক অসুখ না বলে বহিরাগত শক্তির দরুন হওয়া বলে ভেবে নেওয়া হয়।

মানসিক রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিভাগ সম্পাদনা

মূল প্রবন্ধ: রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিভাগ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রবর্তন করা 'রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিভাজন'-এর (ICD: International Classification of Diseases) দশম সংস্করণের নিয়মাবলীতে মানসিক রোগসমূহকে 'F' অধ্যায়ে রাখা হয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের 'আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট এসোসিয়েসন'-এ প্রবর্তন করা DSM (Diagnostic and Statistical Manual for classification of mental illness)-এর চতুর্দশ সংষ্করণ মানসিক রোগ শ্রেণিবিভাজনের অন্য একটা বহুল ব্যবহৃত শ্রেণী বিভাজনের নিয়ম।

এই নিয়ম অনুসারে মানসিক রোগসমূহকে লক্ষণ ও 'দৈর্ঘ্য'র (রোগটি কতদূর প্রসারিত) উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হয়েছে।

--'রোগের আন্তর্জাতিক শ্রেণিবিভাজন'-এর (ICD: International Classification of Diseases) দশম সংস্করণ অনুসারে মানসিক রোগের শ্রেণী বিভাজন—এই সংষ্করণে মানসিক রোগসমূহকে পঞ্চম অধ্যায়, 'F'-র অধীনে রাখা হয়েছে।

  • F00-F09—জৈবিক কারণে হওয়া মানসিক রোগ বা রোগের লক্ষণ (Organic, including symptomatic, mental disorders)
  • F10-F19—মাদকযুক্ত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে হওয়া মানসিক বা ব্যবহারিক রোগ (Mental and behavioural disorders due to psychoactive substance use)
  • F20-F29 -- স্কিজোফ্রেনিয়া, স্কিজোটিপাল ও ডেলুইসনাল রোগ (Schizophrenia, schizotypal and delusional disorders)
  • F30-F39—আবেগ সম্বন্ধীয় রোগ (Mood [affective] disorders)
  • F40-F48—নিউরোটিক, মানসিক চাপজনিত বা শরীরে লক্ষণ উৎপন্ন হওয়া রোগ (Neurotic, stress-related and somatoform disorders)
  • F50-F59—ব্যবহার সম্বন্ধীয় রোগ যা সাধারণ দৈহিক ক্রিয়াতে প্রভাব ফেলতে পারে (Behavioural syndromes associated with physiological disturbances and physical factors)
  • F60-F69—প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিত্ব ও ব্যবহার সম্বন্ধীয় রোগ ( Disorders of adult personality and behaviour)
  • F70-F79—মানসিক বিকাশের মন্থরণ (Mental retardation)
  • F80-F89—মানসিক বিকাশ সম্বন্ধীয় রোগ (Disorders of psychological development)
  • F90-F98—শিশু বা কৈশোর অবস্থায় হওয়া ব্যবহারিক বা আবেগ জনিত রোগ (Behavioural and emotional disorders with onset usually occurring in childhood and adolescence)
  • F99—অনির্দিষ্ট মানসিক রোগ (Unspecified mental disorder)

কয়েক জায়গায় * এই চিহ্নটি দিয়ে কিছু রোগকে বিশেষ শ্রেণীতে রাখা হয়েছে। যেমন:

F00* -- আলৎসহাইমারের রোগের কারণে হওয়া চিত্তভ্রংশ (Dementia in Alzheimer's disease), F02* -- অন্য অধ্যায়ে উল্লেখিত রোগের ফলে হওয়া চিত্তভ্রংশ (Dementia in other diseases classified elsewhere)

মানসিক রোগসমূহর ব্যাপ্তি সম্পাদনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি ৪ জনের ভিতর একজন মানুষ কোনো একটি মানসিক রোগের শিকার হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ মিলিয়ে ৪৫ কোটি মানুষ বর্তমানে মানসিক রোগে ভুগছেন। তার ১৫ কোটি ৪০ লাখ 'বিষাদগ্রস্ততা'(), ২ কোটি ৫০ লাখ 'সিজোফ্রেনিয়া' (), ৯ কোটি ১০ লাখ মদব্যবহারজনিত রোগ এবং ১ কোটি ৫০ লাখ অন্যান্য নেশাযুক্ত দ্রব্যজনিত রোগে ভুগছেন। এই পরিসংখ্যান মতে, মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব ডায়াবেটিস, কর্কট রোগ ও হৃদযন্ত্রের রোগেও বেশি। মানসিক রোগসমূহে গোটা পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রাদুর্ভূত রোগের তালিকার প্রথম দশটি স্থানের ভিতর পাঁচটিই অধিকার করে আছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও পশ্চিম ইউরোপে সর্বাধিক প্রাদুর্ভূত রোগী হল মানসিক রোগ।

মানসিক রোগ যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে। বয়স, লিঙ্গ, উপার্জনে তারতম্য, ধর্ম-বিশ্বাস ইত্যাদি ভেদে সমস্ত লোকই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এদের মধ্যে বেশি প্রাদুর্ভাব থাকা মানসিক রোগ কয়টি হচ্ছে বিষাদগ্রস্ততা, সিজোফ্রেনিয়া, মানসিক চাপজনিত সমস্যা ও নেশাযুক্ত দ্রব্যর ব্যবহার।

মানসিক রোগ থেকে হওয়া ক্ষতি সম্পাদনা

সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০০ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। প্রতিটি সফল আত্মহত্যার বিপরীতে ২০ টা অসফল আত্মহত্যার প্রচেষ্টা থাকে। উন্নত দেশে বিগত পাঁচ দশকে আত্মহত্যার হার ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের আত্মহত্যা ১৫ - ৩৪ বছর বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যুর ৩ নং কারণ। বর্তমানে বৃদ্ধদের আত্মহত্যার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানসিক রোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতিও অনেক বেশি হয়ে থাকে। মানসিক রোগের জন্য একজন ব্যক্তির কর্মকুশলতায় এবং সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে অশান্তির আবির্ভাব ঘটে। এইভাবে অর্থহানি হওয়া ছাড়াও মানসিক রোগের চিকিৎসাও খরচসাপেক্ষ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মানসিক রোগের চিকিৎসার নামে প্রতি বছরে ব্যয় হয় ১৫০০০ কোটি ডলার।

মানসিক রোগ রোগীকে মানসিক ভাবে পঙ্গু করে ফেলতে পারে। একটি দেশের গৃহহীন নাগরিকদের বৃদ্ধি, নেশাযুক্ত দ্রব্যর সরবরাহ, ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। এমন ক্ষতি সংখ্যা হিসাবে প্রকাশ করা সহজ নয় যদিও এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রভূত পরিমাণের হয় বলে মনে করা হচ্ছে। [১৩]

মানসিক রোগের কারণ সম্পাদনা

বিগত দশকে মানসিক রোগ চিকিৎসা বিজ্ঞানে যথেষ্ট পরিমাণে গবেষণা হয়েছে এবং তার দরুন নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এর পরেও, এখনো মানসিক রোগ কি কারণে হয়, তার সম্পূর্ণ সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়নি। অবশ্য কয়েকটি কারণের কথা বেরিয়ে এসেছে। এমন কারক সমূহ নিচে আলোচনা করা হল। মনে রাখবেন যে, এতে সামগ্রিকভাবে মানসিক রোগের কারণর বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু মানসিক রোগ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে, তাই এই আলোচনা বিশেষ রোগের বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন (nature vs. nurture) সম্পাদনা

বিভিন্ন সময়ে মানসিক রোগের কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন মত সামনে আনা হচ্ছে। এই সমগ্র কারণকে মূলতঃ প্রকৃতি ও প্রতিপালন সম্বন্ধীয় বিবাদ বলে আলোচনা করতে পারি। 'প্রকৃতি' মতবাদ অনুসারে মানসিক রোগ প্রাকৃতিক ঘটনার ফলে হয়। যেমন বংশগতির ফলে, কোনো জীবাণুর আক্রমণে, বা পরিবেশের অসমতার ফলে। অন্যদিকে, 'প্রতিপালন' মতবাদ অনুসারে, মানসিক রোগের মূল কারণ হচ্ছে, বিকাশের সময়ে (মূলত শৈশবে) একজন ব্যক্তির লাভ করা প্রতিপালনের গুণাগুণের উপর, যেমন রোগীর বাবা-মা কি পরিবেশে ব্যক্তিটিকে ছোট থেকে বড়ো করেছিলেন।

এই বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য অনেক মানসিক রোগগ্রস্ত সন্তানের উপর গবেষণা চালানো হয়েছে। বিশেষত রোগগ্রস্ত সন্তান, যার জিনের ক্রম এক কিন্তু কোন্ কারণে আলাদা আলাদা (তুলে নেওয়া হয়েছে) বাবা-মায়ের কাছে প্রতিপালন হচ্ছে, তেমন রোগগ্রস্ত সন্তানের উপর। এমন গবেষণার থেকে দেখা গেছে যে, প্রকৃতি ও প্রতিপালন দুটিই মানসিক রোগের কারণ হতে পারে, এবং তাতে আগ্রহজনক ফলাফল দেখা গিয়েছিল যে আসলে প্রকৃতি ও প্রতিপালন দুটিই কোঠামাফিক হয়নি। আসলে প্রকৃতি প্রতিপালনকে প্রভাবান্বিত করতে পারে এবং এর ঠিক উল্টোটিও হওয়া সম্ভব।

মানসিক রোগের কারক সমূহ সম্পাদনা

  • বংশগতি:

কয়েকটি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে এই রোগ বংশগতি অনুসারে দেখা দিতে পারে। অবশ্য মানসিক রোগ বংশগতির সহজ নিয়ম যেমন, Autosomal dominant ও Autosomal recessive মেনে চলে না। বরং মানসিক রোগ সৃষ্টিকারী 'জিন' (gene) সমূহ কয়েকটি জিনের সাথে মিলিতত হয়ে কাজ করতে পারে। বংশগতি বিজ্ঞানের polygenetic principle, epigentic principle ইত্যাদি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। এটি বাবা-মায়ের থাকলেই যে সন্তানেরও এই রোগ হবে তা বলা যায় না।

  • জীবাণুর সংক্রমণ

কিছু মানসিক রোগ (যেমন, সিজোফ্রেনিয়া)-র ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একটি বিশেষ ঋতুতে জন্ম হওয়া ব্যক্তির এই রোগ বেশি হয়। তার একটি কারণ হতে পারে, সেই ঋতুতে প্রাদুর্ভাব ঘটিত কোনো জীবাণুর (ভাইরাস) সংক্রমণের জন্য সেই মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে পারে, যার জন্য ভবিষ্যতে এই রোগ দেখা দিতে পারে।

  • হরমোনের অসংগতি

কিছু হরমোনের অসংগতির ফলে ব্যক্তির ব্যবহারে পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরূপ, থাইরয়েড গ্রন্থির অধিক ক্রিয়ার ফলে আক্রান্ত মানুষজন অত্যধিক মানসিক চাপে ভুগতে পারে, থাইরক্সিন প্রয়োজনের তুলনায় কম ক্ষরণ হলে রোগীর বিষাদগ্রস্ততার [depression] লক্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে অধিক টেস্টোস্টেরন হরমোন ব্যক্তিটিকে বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে। সেইসব মানসিক রোগের ক্ষেত্রে হরমোনের ভূমিকাও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

  • মস্তিষ্কের সংগঠনমূলক বিকৃতি

মস্তিষ্কে থাকা গঠনমূলক(structural) বিকৃতির জন্যও মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। 'স্ট্রোক' (মস্তিষ্ক থেকে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হওয়া বা মস্তিষ্কের ভিতর রক্তবাহী ধমনী ফাটার ফলে মস্তিষ্কের কোষে শক্তি না থাকা অবস্থা) হওয়ার পরে আক্রান্ত স্থানের উপর নির্ভর করে মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সেইসব মস্তিষ্কের গাঠনিক বা কার্য্যপ্রণালীতে আসা যেকোনো অসুখের জন্য মানসিক রোগ হতে পারে।

  • মনস্তাত্ত্বিক কারণ

মানসিক রোগের কারণ সমূহের বিষয়ে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও আছে। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সমূহের মূল নীতি এই যে, বিকাশকালে বাবা-মা এবং পরিবেশের প্রভাবে ব্যক্তিটির চিন্তা-চর্চা, আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ইত্যাদিতে তারতম্য আসে, যা ব্যক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। ক্রমে বিকাশকালের পরিস্থিতি মানসিক রোগের কারণ হতে পারে।

মানসিক রোগের স্নায়ুগত ব্যাখ্যা সম্পাদনা

মানসিক রোগের কারণ সম্বন্ধে বিভিন্ন মত থাকলেও, কিছু মানসিক রোগে কেমন ধরনের স্নায়বিক পরিবর্তন হয়, তা বুঝতে পারা গেছে। মস্তিষ্কের কাজের জন্য স্নায়ুতন্ত্রের একটি ছোট একক 'স্নায়ুকোষ' (নিউরোন (neuron))-এ হওয়া পরিবর্তনসমূহ কম-বেশি পরিমাণে বোধগম্য হচ্ছে। এই সম্বন্ধে এখনো গবেষণা চলছে যদিও, কয়েকটি নির্ভরযোগ্য তথ্য নিচে সংযোজিত করা হল।

মস্তিষ্ক একটি আন্তর্জালের (network) মাধ্যমে কাজ করে। প্রতিটি স্নায়ুকোষ অন্য স্নায়ুকোষের সাথে আন্তর্জালের সংলগ্ন হয়ে থাকে এবং একটি স্নায়ুকোষে হওয়া পরিবর্তন অন্য স্নায়ুকোষের ক্রিয়ার পরিবর্তন করতে পারে। একটি স্নায়ুকোষ থেকে অন্য একটি স্নায়ুকোষ পর্যন্ত তথ্যের সরবরাহ হয় দুটি স্নায়ুকোষ জোড়া লাগার স্থানে, এই স্থানকে সাইন্যাপস্ বলা হয়। সাইন্যাপস্-এ আগে উল্লিখিত নিউরোট্রান্সমিটারগুলি থাকে। এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলিকেই তথ্যের সরবরাহ করে। মানসিক রোগের স্নায়বিক ব্যাখ্যা এই নিউরোট্রান্সমিটারের গবেষণা করেই পাওয়া গেছে।

  • ডোপামিন (dopamine)

কেটেকোলামিন (catecholamines) গোত্রের অন্তর্গত ডোপামিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার। ডোপামিনের বৃদ্ধি স্কিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। অন্য কারণ থাকলেও এসব বৃদ্ধির জন্যই হয় বলে এতটা জোর দিয়ে বলা হয় হয়। তবুও প্রারম্ভিক পর্য্যায়ের জন্য ডোপামিনের বৃদ্ধিই যে স্কিজোফ্রেনিয়া রোগের সৃষ্টি করে তা বলা যেতে পারে। এই ব্যাখ্যার স্বপক্ষে দেখানো যায় যে, স্কিজোফ্রেনিয়ায় ব্যবহৃত রাসায়নিকসমূহ মস্তিষ্কের ডোপামিনের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে রোগের লক্ষণ কম করতে পারে। নেশাযুক্ত দ্রব্যর ব্যবহার সম্বন্ধীয় রোগে ডোপামিনের প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।

  • এড্রিনালিন, নরএড্রিনালিন (adrenaline, noradrenaline)

বিষাদগ্রস্ততা ও মানসিক চাপজনিত রোগে (depression and anxiety disorders) এই দুটি নিউরোট্রান্সমিটারে হওয়া পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।

  • সেরোটোনিন (serotonin)

বিষাদগ্রস্ততা ও মানসিক চাপ জনিত রোগে এই নিউরোট্রান্সমিটার টিকে

পার্থক্য হতে দেখা গেছে। আজকাল সবরকম ব্যবহৃত বিসাদগ্রস্ততার ওষুধ মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে রোগের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে।

মানসিক রোগের লক্ষণ সম্পাদনা

মানসিক রোগের লক্ষণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। লক্ষণসমূ্হকে নিচে দেওয়া ধরণে আলোচনা করা যেতে পারে:

  • চিন্তার ভ্রান্তি (Problems of Thought)

কিছু মানসিক রোগে রোগীর মনে অমূলক চিন্তা আসতে পারে, যাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন চিন্তার ভ্রান্তি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন, চিন্তার সংগতি না হওয়া, একটি ভুল চিন্তা মনে আসা ও সেইটিকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া, মনে অমূলক চিন্তা আসতে থাকা ও সেই চিন্তার অমূলকতা জেনেও মন থেকে দূরীভূত করতে না পারা।

কয়েকটি উদাহরণ: অহেতুক সন্দেহবাতিকতা, যেমন কারো কোনো অপকার করা, কোনো রোগীকে অনুসরণ করে থাকা বলে ভাবা, পত্নী বা স্বামী অন্যের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করা বলে ভুল ভাবা, নিজের চিন্তা অন্য মানুষ জানতে পরে বলে ভাবা, কোনো শক্তি রোগীকে অনবরত নিয়ন্ত্রণ করে বলে ভাবা, একটি বিষয় বলতে আরম্ভ করে অন্য বিষয়ে চলে যাওয়া, কথার মধ্যে রয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

  • ইন্দ্রিয়ের ভ্রান্তি (Problems in Perception)

আমরা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীর খবরাখবর রাখি এবং সেই মর্মেই আমাদের ব্যবহারের পরিবর্তন হয়ে থাকে। যেকোনো উৎসের খবর আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা পাওয়াকে সংবেদ বা sensation বলা হয়। একটি সংবেদ আমাদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষন করে ব্যাখ্যা করার পরে আমি বুঝতে পারি তার অর্থ কি, সেই প্রক্রিয়াটিকে বিভ্রম বা perception বলা হয়।

কিছু মানসিক রোগে রোগী উৎস না জেনেই কিছু বিভ্রম বা perception অনুভব করে। যেমন, কোনো কিছু কোন্ দিকে থাকা, বা গন্ধ পাওয়া, বা কোনো কিছুর দেখা পাওয়া ইত্যাদি। একে হ্যালুসিনেশন (hallucination) বলা হয়।

  • আবেগের সমস্যা (Problems of Emotion)

সাধারণ মানুষ পরিস্থিতি সাপেক্ষে বিভিন্ন আবেগ অনুভব করে। কিন্তু কোনও একটা আবেগ মানুষ অনবরত অনুভব করতে পারে। যেমন বিষাদগ্রস্ততা, বা অতি মাত্রায় আনন্দ অনুভব করা, বা মানসিক চাপ অনুভব করা।

  • বৈশ্লেষিক অপারগতা (Problems of Cognition)

আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে মস্তিষ্ককে একটি কম্পিউটারের মত করে ব্যবহার করি। পারিপার্শ্বিক থেকে আহরণ করা তথ্যকে মস্তিষ্কের স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়ে থাকা তথ্যাবলীর সহায়তায় বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। এই গোটা প্রক্রিয়াটিকে বোধ বা Cognition বলা হয়। সঠিক বোধ বা Cognition-এর জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের সংবেদ (sensation), স্মৃতি (memory), মেধা (intelligence) ও ঐকান্তিকতার (attention and concentration) প্রয়োজন। এইকয়টিতে আসা অসুখসমূহ মানসিক রোগের লক্ষণ।

কয়েকটি মানসিক রোগের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সম্পাদনা

প্রথমত আমি যে রোগের কথায় সেটার নাম হল ডিপ্রেশন ।আমরা সবারই কোন না কোন সময় মন খারাপ হয় আবার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু যদি কারও দু-সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিষন্নতা চলতে থাকে তখন ধরতে হয় ডিপ্রেশেন রোগ হয়েছে । এই রোগের লক্ষণ সাধারণত ব্যাক্তিসত্তার উপর নির্ভর করে। যেমন সাধারণ অবস্থা থেকে চুড়ান্ত পযায়ে থাকতে পারে। জীবনের উদ্দম্যের অভাব, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ক্ষুদা কম বা বেশি, ঘুম কম বা বেশি, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি। আর কারণ বলতে গেলে একে তিনভাগে ভাগ করা যায় ১) শরীরবৃত্তিয় ২) মনস্তাতিক কারণ ৩) সামাজিক কারণ।

  • শরীরবৃত্তীয় কারণ :- আমদের মস্তিষ্কে অবস্থিত নিউরোট্রান্সমিটার রাসায়নিক খবর আদন-প্রদান করে থাকে। তার মধ্যে যদি Noradrenaline ও Serotonin রাসায়নিকের স্তর নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে কমে যায় তা হলে ডিপ্রেশন দেখা দেয়। তাছাড়া আছে জিনগত কারণ মা-বাবার ডিপ্রেশন থাকলে সন্তানের মধ্যে ডিপ্রেশন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া হরমোনের অস্বাভাবিকতা ও একটি বড় কারণ এই রোগের।
  • সামজিক কারণ :- সাধারণত নানা আঘাত যেমন প্রিয়জনের মৃত্যু, পরীক্ষায় অসফলতা, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং যারা একাকিত্ব জীবন যাপন করে তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন বেশি দেখা যায়।

এই রোগের উন্নত চিকিৎসা সম্ভব কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী চিকিৎসার বাইরে থাকে এবং দু:খজনক ভাবে শেষ পরিনতি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

 এখন আমি যে রোগটা নিয়ে আলোচনা করবো তার নাম অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসওর্ডার এই রোগ একধরনের উদ্দেগজনক বিশৃঙ্খলা বলা চলে। এই ধরনের রোগীর মনে বিভিন্ন অর্থহীন চিন্তা বারবার ঘুরে আসে। রোগী বুঝে যে তার চিন্তাগুলি অর্থহীন এবং সে যথা সম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পযন্ত তার চিন্তাগুলি তার মন দখল করে। অর্থাৎ কোন বদ্ধধারণার বশবর্তী হওয়াকে অবসেশন। আর ঠিক একই ভাবে কোন উদ্ভট বা অর্থহীন কাজ করাকে বলে কম্পালশন। যেমন এই ধরনের রোগীরা বারবার হাত ধোয় ,স্নান করে, কোন কাজ করলে বারবার দেখবে তা ঠিকই হয়েছে কিনা যেমন বারবার দেখবে সে দরজা লাগিয়েছে কিনা। বা টাকা গুনতে দেয়া হল বারবার দেখবে টাকা গুনা হয়েছে কিনা।এই সব রোগীরা সাধারণত খুতখুতে স্বভাবের হয় এবং তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে।

এই রোগ ও ঔষধ এবং থেরাপীর মাধ্যমে সারানো সম্ভব কিন্ত সাধারণত সামাজিক এবং পারিবারিক সচেতনতার অভাবে রোগী চিকিৎসার বাইরে থাকে। সাধারণত এইসব রোগীদের বলতে শুনি লোকটির স্বভাব খারাপ।

এই রোগের কারণ বলতে গেলে বিভিন্ন মত আছে তার মধ্যে সাধারণত শৈশবে অতিরিক্ত কড়া নিয়ম মানবার ফলে এইসব রোগ দেখা যায়। তাছাড়া আমাদের মস্তিষ্কের যেসব অংশ আমাদের চিন্তাধারা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে সেইসব অঞ্চলের বিশৃংখলার ফলে এই রোগ হয়।

 অ্যাংজাইটি ডিসওর্ডার এইরোগের রোগীরা সবসময় একটা অপ্রীতিকর কিছূ ঘটার ভয়, ফলে মানসিক চাপ এবং তার ফলে নানারকম শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয় অ্যাংজাইটি অনেক মনরোগে থাকতে পারে তবে এই রোগে প্রধান লক্ষণই হল আতঙ্ক।

কারণ বলতে গেলে কিছূটা জিনেটিক আর শৈশবে কোন ভীষণ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শিশুদের মনে চিরস্থায়ী আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়ায়।

প্রধান লক্ষণ আতঙ্ক বা উদ্বেগ, রোগীর মনে সব সময় একটা ভাব কখন কি হয়? কিন্তু এই “কিছু” সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। এই আতংকভাব তরুণ বয়স থেকে শুরু করে সারাজীবন চলতে থাকে।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে ঔষধ ও সাইকোথেরাপী বিশেষ কায্যর্করী।

 হিষ্টিরিয়া এইরোগে রোগী বিভিন্ন রোগ তার নিজের সুবিধায় সৃষ্টি করে কিন্তু অবচতেনভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে নয়।

কারণ বলতে গেলে বংশগত কারণ বড় নয় আসল হল পরিবেশ। যারা ছোটবেলায় শৈশবে অতি মাত্রায় আদর দেওয়া হয়। এবং যাদের অতি আদরের ফলে বাস্তব থেকে দূরে রাখা হয় তাদের পরবর্তী সময়ে কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হওয়ার ফলে অচেতন ভাবে হিষ্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণ বলতে গেলে যে কোন রোগের লক্ষণ থাকতে পারে। যেমন হঠাৎ অন্ধতা, বধিরতা, মাথাব্যাথা, মানসিক অবসাদ, ফিট, বাকরোধ।

এইরোগেও সাইকোথেরাপীর পাশাপাশি মেডিসিন ব্যবহার করতে হয়।

 সিজোফ্রেনিয়া এইরোগকে মোটামোটী উন্মাদ অবস্থা বলা চলে। এইরোগে সাধারণত রোগীর চিন্তা শক্তি কমে আসে। রোগীর বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা জন্মায়। যেমন কেউ তাকে পাছে ছুরি মারছে। রোগী কানের কাছে বিভিন্ন ভ্রান্ত শব্দ শুনতে পায়। এই রোগের সমস্যা হল রোগী বুঝতে পারে না সে যে একজন রোগী।

এইরোগের পেছনে বংশগত এবং পারিপাশ্বিক কারণ কাজ করে।

সুচিকিৎসায় রোগী প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু মেডিসিন দির্ঘ্যদিন চালিয়ে যেতে হয়। রোগের লক্ষণ কমে এলে সাইকোথেরাপী বিশেষ কায্যর্কর হয়।

 সাইকো সোমাটিক ডিসওর্ডার এর অর্থ দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যা ও চাপের ফলে দেহে প্রকৃতই রোগের উদ্ভব হয়। এগুলোকেই বলে সাইকো সোমাটিক ডিসওর্ডার।

চিকিৎসা মানসিক সমস্যার সঠিক মূল্যায়ন করে সমস্যাগুলির সমাধান করা। এবং লক্ষণ বোঝে সঠিক চিকিৎসা।

তাছাড়া ও আছে আরো বিভিন্ন মানসিক ব্যাধি যা সঠিক চিকিৎসায় একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। আমি আজ পযন্ত কোন রোগীকে দেখিনি তুক-তাক বা সাধুবাবা -পীরবাবার মাধ্যমে ভাল হতে। যখন তুকতাকের মাধ্যমে রোগী ভাল হয় না তখন ঔ ধুর্ত বাবাদের বলতে শুনি কোন শয়তানের শক্ত থাবা রোগীর উপর পড়েছে এবং তাকে সুস্থ করা সম্ভব নয়।

সবশেষে বলব অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী না হয়ে রোগীকে সঠিক চিকিৎসা করান। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক চেতনা, দাম্পত্য সম্পর্কের সঠিক মূল্যায়ণ, ছেলেমেয়েকে সঠিক বাতাবরনে গড়ে তোলা। যেমন অতিরিক্ত শাসন বা অতিরিক্ত স্নেহ শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। স্কুল স্তর থেকেই শারিরীক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের পাঠ্যক্রম চালু করা। আমি আবারও বলছি চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত মানসিক চিকিৎসা ও উন্নতস্তরে পৌছেঁ গেছে। আর কোন রোগীকে পাগল আখ্যা না দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। সুস্থ মানসিক চেতনাই সুস্থ সমাজ গঠনের হাতিয়ার।

মানসিক রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পাদনা

বর্তমান মানসিক রোগের জন্য মূলত দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ওষুধ ও অন্যান্য জৈবিক চিকিৎসা (biological therapy) ও মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা (psychotherapy)।

মানসিক রোগের জন্য বহুল ভাবে ওষুধের ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য রোগের মতোই নিয়মিত ভাবে রোগীকে ওষুধ সেবন করতে হয়। কিছু অবস্থায় বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে রোগীর মস্তিষ্কে মৃগীর সৃষ্টি করে সুফল পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে ECT (Electroconvulsive Therapy) বলা হয়। এর বাইরেও চুম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা মস্তিষ্ককে শিহরিত করেও চিকিৎসা করা হয়।

মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা: কিছু মানসিক রোগে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা ব্যবহার করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর সাথে মনস্তত্ত্ববিদ (psychotherapist) আলোচনা করেন, এবং সেইসাথে রোগের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা কয়েক প্রকারের আছে। রোগ অনুসারে এই চিকিৎসা পদ্ধতির আলাদা আলাদা ধরন প্রয়োগ করা হয়।

'পাগলাগারদ' ও মানসিক রোগ চিকিৎসালয় সম্পাদনা

মানসিক রোগ ও আইন সম্পাদনা

মানসিক ও স্নায়ুরোগের মধ্যে পার্থক্য7 সম্পাদনা

মানসিক রোগের উপ-বিভাগ সম্পাদনা

ভবিষ্যতর মানসিক রোগ বিজ্ঞান সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Shorter, E. (1997), p. 1
  2. Elkes, A. (1967), p.13
  3. Syed (2002), p.7-8
  4. Syed (2002), p. 7
  5. Mohamed Reza Namazi (2001), "Avicenna, 980-1037", American Journal of Psychiatry 158 (11), p. 1796; Mohammadali M. Shoja, R. Shane Tubbs (2007), "The Disorder of Love in the Canon of Avicenna (A.D. 980–1037)" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ অক্টোবর ২০১১ তারিখে, American Journal of Psychiatry 164 (2), pp 228-229;S Safavi-Abbasi, LBC Brasiliense, RK Workman (2007), "The fate of medical knowledge and the neurosciences during the time of Genghis Khan and the Mongolian Empire", Neurosurgical Focus 23 (1), E13, p. 3.
  6. Shorter, E. (1997), p. 4
  7. Shorter, E. (1997), p. 5
  8. Shorter, E. (1997), p. 9
  9. Shorter, E. (1997), p. 34
  10. Rothman, D.J. (1990). The Discovery of the Asylum: Social Order and Disorder in the New Republic. Boston: Little Brown, p. 239. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩১৬-৭৫৭৪৫-৪
  11. Shorter, E. (1997), p. 35
  12. Shorter, E. (1997), p. 246
  13. http://www.myasha.org/node/12 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ নভেম্বর ২০১১ তারিখে স‌ংগ্রহিত করার তারিখ ৮ আগস্ট, ২০১১

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা