মনিরউদ্দীন ইউসুফ
মনিরউদ্দীন ইউসুফ (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৯ - ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭) একজন বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক। তিনি কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, কিশোরসাহিত্য, অনুবাদ ও আত্মজীবনী মিলিয়ে ২৮টি গ্রন্থ রচনা করেন। পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামা বাংলায় অনুবাদ করার জন্য তাঁকে 'বাংলার ফেরদৌসী' নামে অভিহিত করা হয়।[১] বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৩ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক-এ ভূষিত হন।[২]
মনিরউদ্দীন ইউসুফ | |
---|---|
জন্ম | মনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ জাওয়ার, তাড়াইল উপজেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু | ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৬৭)
পেশা | লেখক, সম্পাদক ও অনুবাদক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
শিক্ষা | বাংলা |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধরন | কবিতা, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি |
|
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | বাংলা একাডেমি পুরস্কার একুশে পদক |
সক্রিয় বছর | ১৯৬০–১৯৮৭ |
সন্তান | সুলতান আহমদ শহীদ, সাঈদ আহমদ আনিস |
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
সম্পাদনামনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জ মহকুমার তাড়াইলের জাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মিসবাহউদ্দীন আহমদ ও মা সানজিদা খাতুন। বাবা মৌলবি মিসবাহ ছিলেন কিশোরগঞ্জের বৌলাই গ্রামের জমিদার। তার পূর্বপুরুষরা মুঘলদের বংশদের ছিলেন। সম্রাট আকবরের সময় করিম খাঁ নামে একজনকে সুবা বাংলার আমীর হিসেবে পাঠান। ইউসুফ তারই উত্তরসূরি।[৩] তাদের পারিবারিক ভাষা উর্দু হওয়ায় একজন উর্দুভাষী ওস্তাদের কাছে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি স্থানীয় মধ্য ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি কিশোরগঞ্জের রামানন্দ হাইস্কুল ও ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। জিলা স্কুল থেকে তিনি ১৯৩৮ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন ও ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে আইএ পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে কলকাতা হয়ে দিল্লি চলে যান।[২]
কর্মজীবন
সম্পাদনাদিল্লি যাওয়ার পরে ইউসুফ চাকরি নিয়ে মুম্বাই চলে যান। সেখানে নয় মাস থাকার পর দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি কিছুদিন ব্যবসা করেন। ঢাকায় এসে প্রথমে ডেইলি অবজারভার এবং পরে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় চাকরি করেন। সবশেষে তার ছোটবেলার বন্ধু সাংবাদিক সৈয়দ নুরুদ্দিনের আমন্ত্রনে কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের জনসংযোগ বিভাগে এ.ডি.সি পদে যোগদান করেন। তিনি কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে প্রকাশিত 'কৃষি সমাচার' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ সংস্থায় চাকরিরত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন।[৩]
সাহিত্যকর্ম
সম্পাদনামনিরউদ্দীন ইউসুফ ছাত্রজীবনে উপয়ন নামে একটি কবিতার বই লিখেন। পরে তার রচিত মৌলিক কবিতাসমুহের মধ্যে রাত্রি নয় কলাপি ময়ূর নয়, বেতস পাতা জলের ধারা, এক ঝাঁক পায়রা, মনিরউদ্দীন ইউসুফের অগ্রন্থিত কবিতা উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে এই কবিতার বইগুলো নিয়ে বেলাল চৌধুরী সম্পাদনা করেন কাব্যসমগ্র।[৪] তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ঝড়ের রাতের শেষে। এতে সমকালীন সামাজিক বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাস পনসের কাঁটা ও ওর বয়েস যখন এগারোয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ২০০৩ সালে আবদুল হাই শিকদার তার রচিত উপন্যাসগুলো নিয়ে উপন্যাসসমগ্র সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।[১] ফারসি ও ইংরেজি রচনার অনুবাদে ছিল তার বিশেষ দক্ষতা। তিনি কবি ইকবাল ও গালিবের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেন। এছাড়া পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসীর মহাকাব্য শাহনামা বাংলায় অনুবাদ করেন। ১৯৭৭ সালের এর প্রথম খন্ড ও ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়। তার মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি ছয় খণ্ডে শাহনামা প্রকাশ করে।[৫]
মৃত্যু
সম্পাদনামনিরউদ্দীন ইউসুফ ১৯৮৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।[৬]
গ্রন্থতালিকা
সম্পাদনাউপন্যাস
- ঝড়ের রাতের শেষে (১৯৬২)
- পনসের কাঁটা (১৯৮১)
- ওর বয়েস যখন এগারো (১৯৮১)
নাটক
- ঈশা খাঁ (১৯৬৮)
প্রবন্ধ
- রুমীর মসনবী (১৯৬৬)
- উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৬৮)
- বাংলা সাহিত্যে সূফী প্রভাব (১৯৬৯)
- আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি (১৯৭৮)
- কারবালা: একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত, সংস্কৃতি চর্চা (১৯৮০)
- বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব (১৯৮৪)
- নব মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৯)
অনুবাদ
- ইকবালের কাব্য সঞ্চয়ন (১৯৬০)
- দীওয়ান-ই-গালিব (১৯৬৪)
- কালামে রাগিব (১৯৬৬)
- শাহনামা প্রথম খন্ড (১৯৭৭)
- শাহনামা দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭৯)
- শাহনামা ছয় খন্ড (১৯৯১)
জীবনী
- হযরত ফাতেমা (১৯৬৪)
- হযরত আয়েশা (১৯৬৮)
- ইসলাম ও মুহম্মদ (২০০৮)
কিশোর সাহিত্য
- ছোটদের ইসলাম পরিচয়
- ছোটদের রসুল চরিত্র
- মহাকবি ফেরদৌসী (১৯৮৮)
- চল যাই ছড়ার দেশে (২০০৩)
আত্মজীবনী
- আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা (১৯৯২)
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনা- গভর্নর স্বর্ণপদক (১৯৬৮)
- হাবিব ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮)
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮)
- আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫)
- একুশে পদক (১৯৯৩, মরণোত্তর)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ মিজানুর রহমান (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "Moniruddin Yusuf : Bengali translator of Shahnama"। দ্য ডেইলি নিউ ন্যাশন (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১২ জুলাই ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ "মনিরউদ্দীন ইউসুফ"। প্রিয় নিউজ। ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ "মনিরউদ্দীন ইউসুফ"। আমাদের কিশোরগঞ্জ। ১২ জুলাই ২০১০। ২০ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ আবদুল মুকিত চৌধুরী (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "Book Review : Kabya Samagra"। দ্য ডেইলি নিউ ন্যাশন (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা, বাংলাদেশ। ১২ জুলাই ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
- ↑ আসাদ চৌধুরী (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "মনিরউদ্দীন ইউসুফ"। দৈনিক নয়া দিগন্ত। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ সুলতান আহমদ শহীদ (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। "কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ তার স্মৃতি"। দৈনিক ইনকিলাব। ঢাকা, বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]