মধ্যপ্রদেশ ও বেরার

ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশ
(মধ্য প্রদেশ ও বেরার থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মধ্য প্রদেশ ও বেরার ছিল ব্রিটিশ ভারতের এবং পরবর্তীতে ভারতের অধিরাজ্যের একটি প্রদেশ। ১৯০৩ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই প্রদেশের অস্তিত্ব ছিল। ব্রিটিশ সরকার হায়দ্রাবাদ রাজ্যের কাছ থেকে বেরার প্রদেশ ইজারা নিয়ে এর সাথে মধ্য প্রদেশ একীভূত করে এ প্রদেশটি সৃষ্টি করে। ১৯০২ সালের ৫ নভেম্বরে হায়দ্রাবাদে ষষ্ঠ নিজাম মাহবুব আলী খান বার্ষিক পঁচিশ লক্ষ রুপি পরিশোধের শর্তে বেরার প্রদেশ ব্রিটিশ সরকারকে ইজারা দেন। লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বেরার প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশ একীভূত করে প্রদেশ সৃষ্টির ঘোষণা দেন।[১]

মধ্যপ্রদেশ ও বেরার
১৯০৩–১৯৫০
ইতিহাস 
• মধ্য প্রদেশ ও বেরারের একীভূতকরণ
১৯০৩
• মধ্য প্রদেশ সৃষ্টি
১৯৫০
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
মধ্যপ্রদেশ
বেরার
মধ্যপ্রদেশ
ছত্তিশগড়
মহারাষ্ট্র

সৌগর ও নারবুদ্দা অঞ্চল এবং নাগপুর প্রদেশ নিয়ে ১৮৬১ সালে মধ্য প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৯০৩ সালে মধ্য প্রদেশের প্রধান কমিশনারের কাছে বেরার প্রদেশের সকল দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলো দেশীয় রাজ্য এ প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হওয়ার পরে এর নামকরণ করা হয় মধ্য ভারত; ১৯৫৬ সালে এর নামকরণ হয় মধ্যপ্রদেশ

নাম থেকেই জানা যায়, ভারতীয় উপদ্বীপের মধ্যভাগে এর অবস্থান ছিল। গাঙ্গেয় সমতলভাগ এবং ডেকান অধিত্যকার মধ্যে অবস্থিত পাহাড় ও উঁচুভূমির একটি বড় অংশ এর আওতাভুক্ত ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় এজেন্সি এলাকা মধ্য প্রদেশ ও বেরার উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিকে বেষ্টন করে রেখেছিল।

ইতিহাস সম্পাদনা

মুঘলমারাঠাদের কাছ থেকে ব্রিটিশদের বিজিত ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যাঞ্চলীয় এলাকা নিয়ে মধ্য প্রদেশ গঠিত হয়। বর্তমান মধ্যপ্রদেশেরছত্তিশগড় রাজ্যের বেশিরভাগ এবং মহারাষ্ট্র রাজ্যের সামান্য অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এর রাজধানী ছিল নাগপুর[২]

তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠি যুদ্ধে মারাঠিদের পরাজয়ের পর ১৮১৭ সালে পেশওয়া (মারাঠি প্রধানমন্ত্রী) এবং ১৮২০ সালে আপ্পা সাহিব (মারাঠি রাজা) সতপুরা রেঞ্জের উত্তরভাগে অবস্থিত এলাকা ব্রিটিশদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হলে ১৮২০ সালে সৌগর এবং নারবুদ্দা ভূখণ্ড গঠন করা হয়, যার দায়িত্বে ছিলেন গভর্নর জেনারেলের একজন প্রতিনিধি। এই ভূখণ্ডগুলো ১৮৩৫ সালে নবগঠিত উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একটি গণঅভ্যুত্থানের ফলে ১৮৪২ সালে প্রদেশ থেকে এদের বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধির অধীনে হস্তান্তর করা হয়। ১৮৫৩ সালে এ এলাকাগুলো পুনরায় উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৮১৮ সালে নাগপুরের ভোঁসলে মহারাজারা ব্রিটিশদের কাছে সার্বভৌমত্ব হারান। ১৮৫৩ সালে ভোঁসলে মহারাজ তৃতীয় রঘুজি উত্তরাধিকারী ছাড়া মৃত্যুবরণ করলে নাগপুর ব্রিটিশরা দখল করে নেয়। ১৮৬১ সালে মধ্য প্রদেশ গঠিত হওয়ার পূর্বে একজন মুখ্য কমিশনার এর দায়িত্বে ছিলেন।

সৌগর এবং নারবুদ্দা ভূখণ্ড আর নাগপুর প্রদেশকে নিয়ে ১৮৬১ সালে মধ্য প্রদেশ গঠিত হয়। ১৯০৩ সালের ১ অক্টোবর বেরার মধ্য প্রদেশের কমিশনারের আওতাভুক্ত করা হয়। ১৯০৫ সালে সম্বলপুর, বামরা, পাটনা, কালাহান্দি ইত্যাদি অঞ্চল মধ্য প্রদেশ ও বেরার থেকে আলাদা করে বাংলা প্রদেশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার, বাংলা প্রদেশের হিন্দিভাষী চান বাখার, ব্রিটিশ কোরিয়া, উদয়পুর প্রভৃতি অঞ্চল মধ্য প্রদেশ ও বেরারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯১২ সালের ভারত সরকার আইন প্রধান কমিশনারের নেতৃত্বে একটি আইনসভা গঠন করার নির্দেশনা দান করলে ১৯১৩ সালের ৮ নভেম্বর মধ্য প্রদেশ আইনসভা গঠন করা হয়।[৩]১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন প্রণীত হলে তদনুযায়ী অনুযায়ী কমিশনারের পরিবর্তে গভর্নরের পদ সৃজন, আইনসভার সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের আওতা বাড়ানো হয়।

১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার অনুযায়ী ১৯১৯ এবং ১৯২০ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৭১ জন সাংসদ নির্বাচিত হন; ৫৩ জন প্রত্যক্ষ ভোটে , ২ জন পদাধিকারবলে এবং ১৬ জন বিশেষভাবে মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হন। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে সাধারণ আসন থেকে ৪০ জন, সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে ৭ জন এবং বিশেষ আসন থেকে ৬ জন নির্বাচিত হন। অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে কংগ্রেস এ নির্বাচন বয়কট করে। গঙ্গাধর রাও চিতনবিশ আইনসভার সর্বপ্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।[৪]

১৯২৩ সালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা নির্বাচনে অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ বছরের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে আয়োজিত নির্বাচনে স্বাধীনতাকামী স্বরাজ দল ৫৪টি নির্বাচিত আসনের মধ্যে ৪১টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হন। অধিকাংশ আসন জিতলেও অসহযোগ নীতির কারণে এটি সরকার গঠনে অসম্মতি জানায়। তখন গভর্নর ফ্রাঙ্ক স্লাই চিতনবিশ এবং স্বতন্ত্র মুসলিম সদস্য সৈয়দ হিফাজত আলীকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন।

১৯২৬ সালের নির্বাচনে স্বরাজবাদীরা দুই ভাগ হয়ে যায়। প্রথম উপদল সরকার গঠনে অসম্মতি জানায়, যেখানে দ্বিতীয় উপদল "সহযোগিতা দল" গঠন করে সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। নির্বাচনের পর বি.এস.মুনজে সহযোগিতা দল, উদারতাবাদী এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে ৩৩ সদস্যের ঐক্যজোট গঠন করেন।

১৯৩৩ সালে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে এই ঐক্যজোটের পতন ঘটলে রাঘবেন্দ্র রাও তিন সদস্যবিশিষ্ট সরকার গঠন করেন। ১৯৩৪ সালে এ মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে বি.জি খারপাড়ে দুই সদস্যবিশিষ্ট আরেকটি সরকার গঠন করে, যা ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত টিকে থাকে।

১৯৩৩ সালে ছত্তিশগড় যৌবরাজ্য ইস্টার্ন স্টেট এজেন্সি এবং মাকরাই কেন্দ্রীয় স্টেট এজেন্সির আওতাভুক্ত হয়। ২৪ অক্টোবর ১৯৩৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্য প্রদেশ কেন্দ্রীয় প্রদেশ ও বেরারে পরিণত হয়।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক আইনসভা গঠিত হয়। ন্যূনতম আর্থিক সঙ্গতি আছে, এমন সকল পুরুষকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাত থেকে নির্বাহী ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ-নিযুক্ত গভর্নরদের দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও সরকার গঠনে অস্বীকৃতি জানায়। তখন ই.রাঘবেন্দ্র রাও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। [৫]

১৯৩৭ সালের জুলাইয়ে কংগ্রেস তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং সরকার গঠনে আগ্রহ দেখায়। তাই গভর্নর এন বি খারেকে ১৯৩৭ সালের আগস্টে পরবর্তী সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানান।

খারে ১৯৩৮ সালে পদত্যাগ করেন এবং রবি শঙ্কর শুক্লা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে ভারতীয় নেতাদের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে গভর্নর জেনারেল জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এর প্রতিবাদে শুক্লা পদত্যাগ করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল জয়ের ফলে শুক্লা আবারো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতার পরে সম্পাদনা

১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মধ্য ভারত, বিন্ধ্য প্রদেশ এবং ভোপাল একীভূত হয়ে মধ্যপ্রদেশ গঠন করে। বেরার এবং নাগপুর মারাঠিদের চাপে বোম্বে রাজ্যে স্থানান্তর করা হয়। বোম্বে রাজ্য ভেঙে পরবর্তীতে মহারাষ্ট্র ও গুজরাত প্রদেশের সৃষ্টি হয়। ২০০০ সালে মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় প্রদেশ সৃষ্টি হয়।[৬]

জনমিতি সম্পাদনা

১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মধ্য প্রদেশ ও বেরারের জনসংখ্যা ছিল ১৬,০৩৩,৩১০। কিন্তু খরা, বিউবোনিক প্লেগ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির ফলে ১৯২১ সালের মধ্যে এর জনসংখ্যা ০.৩ শতাংশ হ্রাস পায়।

১৯৩৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মধ্য প্রদেশ ও বেরারের জনসংখ্যা ছিল ১৭,৯৯০,৯৩৭।

প্রশাসন সম্পাদনা

১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১৬,৮১৩,৫৮৪ জন এ প্রদেশের বাসিন্দা ছিল, যাদের মধ্যে ২,০৯৩,৭৬৭ জন শহরে এবং ১৪,৭১৯,৮১৭ জন গ্রামে বসবাস করত।[৭]

এ প্রদেশ সর্বমোট পাঁচটি বিভাগে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে মোট জেলা ছিল ২২টি। এগুলো হলো:

  1. জবলপুর (জবলপুর, সৌগর, দামো,সিওনি,মন্দলা জেলা)
  2. নারবুদ্দা (নরসিংপুর, হোসাঙ্গাবাদ,নিমার, বেতুল, চিন্দওয়ারা)
  3. নাগপুর (নাগপুর, ভাণ্ডারা,চন্দা, ওয়ার্দা, বালাঘাট)
  4. ছত্তিশগড় (বিলাসপুর, রাইপুর, দুর্গ)
  5. বেরার (আকোলা, বালিচপুর,বুলধানা,বাসিম,উন)

দেশীয় রাজ্য সম্পাদনা

প্রদেশে অবস্থিত যৌবরাজ্যসমূহ নিম্নরূপ :

স্যালুট রাজ্য (বিশেষ সম্মানপ্রাপ্ত রাষ্ট্র) সম্পাদনা

  1. কালাহান্দি
  2. পাটনা
  3. সোনেপুর

অ-স্যালুট রাজ্য (বিশেষ সম্মানপ্রাপ্ত নয় এমন রাষ্ট্র) সম্পাদনা

  1. বামরা
  2. বাস্তার
  3. চুইকন্দম
  4. কানকার
  5. কাহয়ার্দা
  6. খাইরাগড়
  7. মাকরাই
  8. নন্দগাঁও
  9. রায়গড়
  10. রাইরাখল
  11. সাতকি
  12. সারানগাঁও।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The Gazetteers Department - Buldhana"web.archive.org। ২০০৮-১০-০৬। Archived from the original on ২০০৮-১০-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-২৩ 
  2. Hunter, William Wilson (১৮৮৬)। The Imperial Gazetteer 
  3. https://web.archive.org/web/20101008134014/http://maharashtra.gov.in/english/gazetteer/AMRAVATI/his_modern%20period.html
  4. Raghau Raman, Pateriya। Provincial Legislatures and the National Movement 
  5. https://api.parliament.uk/historic-hansard/commons/1937/apr/19/provincial-governments-ministers
  6. Maecovits, Claude। A history of modern India:1480-1950 
  7. http://censusindia.gov.in/Census_And_You/old_report/TABLE_1941_1.HTM