মকালু বরুন রাষ্ট্রীয় নিকুঞ্জ

নেপালের জাতীয় উদ্যান

মকালু বরুন রাষ্ট্রীয় নিকুঞ্জ বা মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যান (নেপালি ভাষায়: मकालु-बरूण राष्ट्रिय निकुञ्ज) নেপালের হিমালয় অঞ্চলে অবস্থিত অষ্টম জাতীয় উদ্যান। ১৯৯২ সালে সাগরমাথা জাতীয় উদ্যানের পূর্বে বর্ধিত অংশ হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নেপালের সলুখুম্বু এবং সাঙ্খুওয়াসাভা জেলার ১,৫০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে উদ্যানটি বিস্তৃত। ভূমির উচ্চতায় ৮,০০০ মিটারের তারতম্য বিশিষ্ট এটাই পৃথিবীর একমাত্র সংরক্ষিত অঞ্চল। এখানে রয়েছে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ, গ্রীষ্মপ্রধান বনাঞ্চল। উদ্যানের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বে বাফার জোন হিসেবে প্রায় ৮৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে।[১] পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম পর্বত মাকালু (৮,৪৬৩ মিটার) এই উদ্যানে অবস্থিত। উদ্যানের অন্যান্য উচ্চ পর্বতের মধ্যে রয়েছে চামালাং (৭,৩১৯ মিটার), বরুনসে (৭,১২৯ মিটার) এবং মেরা (৬,৬৫৪ মিটার)। পূর্ব-পশিমে উদ্যানটি ৬৬ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪৪ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। উদ্যানের সর্বনিম্ন উচ্চতার স্থান অরুন নদীর উপত্যকা, ৩৪৪-৩৭৭ মিটার; এবং সর্বোচ্চ উচ্চতার স্থান মাকালু পর্বতশীর্ষ, ৮,০২৫ মিটার।[২] মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যানের উত্তর প্রান্তে তিব্বতের কোমোলাংমা জাতীয় প্রকৃতি অভয়ারন্য র‍্যেছে।

মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যান
মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যানের ভূপ্রকৃতি
নেপালের অবস্থান
অবস্থাননেপাল
স্থানাঙ্ক২৭°৪৫′২৫″ উত্তর ৮৭°০৬′৪৯″ পূর্ব / ২৭.৭৫৬৯৪° উত্তর ৮৭.১১৩৬১° পূর্ব / 27.75694; 87.11361
আয়তন১,৫০০ কিমি (৫৮০ মা)
স্থাপিত১৯৯২
কর্তৃপক্ষজাতীয় উদ্যান ও বনপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ভূমি সংরক্ষণ ও বন মন্ত্রণালয়

হিমালয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষের ক্ষেত্রে এই উদ্যানটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

১৯৮০-এর শুরুতে এবং মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন বেসরকারি সংস্থা দ্য মাউন্টেইন ইন্সটিটিউট বরুন উপত্যকার জীববৈচিত্র্য মূল্যায়নের জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে উৎসাহিত হয়ে নেপাল সরকার মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠা করে। এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবনা ১৯৮৫ সালে তৈরি করা হয়।[৪] ১৯৮৮ সালে মাকালু-বরুন সংরক্ষিত অঞ্চল প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পটি ছিল দ্য মাউন্টেইন ইন্সটিটিউট এবং নেপাল সরকারের জাতীয় উদ্যান ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি যৌথ উদ্যোগ।

১৯৯১ সালে প্রকল্পটির গেজেট তৈরি হয়। সে সময়ে প্রায় ৩২,০০০ মানুষ অঞ্চলটির ১২টি গ্রাম উন্নয়ন কমিটিতে বাস করতো। তারা প্রধানত শেরপা, রাই, গুরুং, তামাং, মাগার, নেওয়ার, ব্রাহমিন এবং ছেত্রি সম্প্রদ্বায়ের মানুষ। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটির অধীনে সম্প্রদ্বায়-ভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে বনের সম্পদ ব্যবহারের জন্য সম্প্রদ্বায়ের মধ্য থেকে ব্যবহারকারী দল গঠন করা হয়। তারা বনসম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনগতভাবে অধিকার লাভ করে। এই সংরক্ষিত অঞ্চলে বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী ধরা এবং হত্যা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া যদি কোন বিপন্নপ্রায় প্রাণী কৃষকের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে, সেক্ষেত্রে সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়।[৫]

১৯৯৯ সালে সংরক্ষিত অঞ্চলটি বাফার জোনে পরিণত করা হয়। বাফার জোন ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা অনুযায়ী নেপাল সরকার এই উদ্যানের বন, বন্যপ্রাণী এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ এবং বিকল্প শক্তির বিকাশেও সরকার গুরুত্বের সাথে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়।[৬] বরুন নদীর উপত্যকা অঞ্চল, অরুন নদের হিমবাহবেষ্টিত শাখা নদীসমূহ এবং সংরক্ষিত অঞ্চলটির অগম্য স্থানে রয়েছে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ও বনাঞ্চল যা এখনও মানুষের প্রভাব থেকে মুক্ত। এই এলাকাগুলোকে প্রথমবারের মত নেপালের নিয়ন্ত্রিত প্রকৃত অভয়ারন্য হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য প্রকৃতিকে প্রভাবিত না করে প্রাকৃতিক বিষয়বস্তর উপর গবেষণা, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন জীব-প্রজাতির সংরক্ষণ ও বিকাশ লাভের সুযোগ অবারিত রাখা।[২]

জলবায়ু সম্পাদনা

উদ্যানটি হিমালয়ের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় মৌসুমি জলবায়ু জুন থেকে সেপ্টেম্বরে শেষ অবধি থাকে। এই সময়ে বছরের ৭০% (৪,০০০ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাত ঘটে। এপ্রিলে মৌসুমি মেঘের আবির্ভাব ঘটে। উদ্যানের ভূমির উচ্চতায় ব্যাপক তারতম্য থাকায় তাপমাত্রাতেও সে অনুসারে তারতম্য ঘটে। নিম্ন উচ্চতার স্থানে শীতকালে মাঝারি এবং এপ্রিল-মে মাসে উষ্ণ থাকে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে সাধারণত তুষারপাত ঘটে না এবং মাসিক গড় তাপমাত্রা ১৮°C-এর উপরে থাকে।[৭]

উদ্ভিদ সম্পাদনা

পূর্ব-হিমালয় অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল মাকালু বরুন জাতীয় উদ্যানে দেখা যায়। ভূমির উচ্চতায় ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বনের বৈশিষ্ট্যেও বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া মৌসুমভেদে আদ্রতার পরিমাণ, তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের কারণেও বনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়ে থাকে। ২,০০০ মিটারের নিচে বনাঞ্চল অধিক কৃষিকাজের দরুণ হ্রাস পেয়েছে এবং বর্তমানে প্রধান কিছু ধরনের বনের অস্তিত্ব রয়েছে। ২,০০০ মিটারের ঊর্ধ্বে তাপমাত্রা কম হওয়ায় কৃষিকাজ সম্ভব হয়না, ফলে বনাঞ্চল মূলত অবিকৃত রয়েছে। জলবায়ুভেদে মূলত পাঁচ ধরনের বন দেখা যায়:

  • ক্রান্তীয় – ১,০০০ মিটারের নিচে।
  • উপক্রান্তীয় – ১,০০০ থেকে ২,০০০ মিটারের মধ্যে
  • নিম্ন ও উচ্চ নাতিশীতোষ্ণ – ২,০০০ থেকে ৩,০০০ মিটারের মধ্যে
  • সাবআলপাইন – ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ মিটারের মধ্যে

এপর্যন্ত উদ্ভিদবিদরা এই অঞ্চলে ৩,১২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ চিহ্ণিত করেছেন। এর মধ্যে ২৫ প্রজাতির রোডোডেন্ড্রন রয়েছে।[৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Bhuju, U. R., Shakya, P. R., Basnet, T. B., Shrestha, S. (2007). Nepal Biodiversity Resource Book. Protected Areas, Ramsar Sites, and World Heritage Sites ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ অক্টোবর ২০১২ তারিখে. International Centre for Integrated Mountain Development, Ministry of Environment, Science and Technology, in cooperation with United Nations Environment Programme, Regional Office for Asia and the Pacific. Kathmandu, Nepal. আইএসবিএন ৯৭৮-৯২-৯১১৫-০৩৩-৫
  2. Carpenter, C. and R. Zomer (1996). Forest ecology of the Makalu-Barun National Park and Conservation Area, Nepal. Mountain Research and Development 16 (2): 135–148.
  3. DNPWC (২০১২)। "Sacred Himalayan Landscape"। Kathmandu: Department of National Parks and Wildlife Conservation, Government of Nepal। ১২ জুন ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১৬ 
  4. Taylor-Ide, D. and T. B. Shrestha (১৯৮৫)। "The Makalu-Barun Park: a proposal"। McNeely, J. A., Thorsell, J. W. and S. R. Chalise। People and Protected Areas in the Hindu Kush-Himalaya: International Workshop on the Management of National Parks and Protected Areas in the Hindu Kush-Himalaya। Kathmandu, Nepal: King Mahendra Trust for Nature Conservation। পৃষ্ঠা 129–132। 
  5. Mehta, J. N. and S. R. Kellert (1998). Local attitudes toward community-based conservation policy and programmes in Nepal: a case study in the Makalu-Barun Conservation Area. Environmental Conservation 25 (4): 320–333.
  6. Heinen, J. T. and J. N. Mehta (2000). Emerging Issues in Legal and Procedural Aspects of Buffer Zone Management with Case Studies from Nepal. Journal of Environment and Development 9 (1): 45–67.
  7. Zomer R. J., Ustin S. L. and Carpenter C. C. (2001). Land Cover Change Along Tropical and Subtropical Riparian Corridors Within the Makalu Barun National Park and Conservation Area, Nepal. Mountain Research and Development 21: 175–183.
  8. Shrestha, T. B., Sakya R., Nepali, H. S. (1990). Scientific Report on field survey of 1989: General and Phyto-ecology Working paper No. 8, Makalu-Barun Conservation Project, Kathmandu, Nepal.