ভবাই হল পশ্চিম ভারতের বিশেষত গুজরাটের একটি জনপ্রিয় লোকনাট্য যা বেশ বা স্বাং নামেও পরিচিত।

ভোপালের ভারত ভবনে ভবাই অভিনয়
ভবাই শিল্পী

ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

ভবাই শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ভব থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে যার অর্থ প্রকাশ বা আবেগ। এটি হিন্দু দেবী দুর্গার সাথেও জড়িত। ভব মানে মহাবিশ্ব এবং আই মানে মাতা, তাই এটি মহাবিশ্বের মা দুর্গাকে উৎসর্গীকৃত একটি শিল্পরূপ হিসাবেও বিবেচিত হয়। ভবাই বেশ বা স্বাং নামেও পরিচিত, যার আক্ষরিক অর্থ হল অঙ্গ-সজ্জা[১][২][৩][৪]

ইতিহাস সম্পাদনা

১৪ শতাব্দীতে ভবাইয়ের উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে অসৈত ঠাকুরকে ভবাইয়ের উদ্ভাবক হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়।[১][২][৩][৫]

লোককথা সম্পাদনা

চতুর্দশ শতাব্দীতে, উঞ্ঝার প্রধান হেমা প্যাটেলের কন্যা গঙ্গাকে এক মুসলিম সুবেদার অপহরণ করেছিল। তাদের পরিবারের পুরোহিত ব্রাহ্মণ অসৈত ঠাকুর গঙ্গাকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করে সুবেদারের কাছে গিয়েছিলেন। যেহেতু ব্রাহ্মণরা নিম্ন বর্ণের সাথে ভোজন করত না, তাই সত্যতা প্রমাণ করার জন্য সুবেদার তাঁকে সেই সময় গঙ্গার সাথে খাবার খেতে বলেছিল। তিনি তাকে বাঁচানোর জন্য তার সাথে খাবার খেয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে আসার পর অন্যান্য ব্রাহ্মণরা তাঁকে সমাজচ্যুত করে দিয়েছিল। তিনি জীবনধারণের জন্য কিছু নির্দিষ্ট নাটকীয় আকারে লিখিত নাটকে অভিনয় শুরু করেছিলেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হেমা প্যাটেল তাঁকে একখণ্ড জমি এবং আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন, যা গ্রামাঞ্চলে ভবাইয়াদের জন্য অভিনয়ের পৃষ্ঠপোষকতার সূচনা করেছিল।[১][২][৩][৫] প্রসঙ্গত ভবাইশিল্পীদের ভবাইয়া বলা হয়ে থাকে।

ধারণা করা হয় যে অসৈত ঠাকুর প্রায় ৩৬০টি নাটক বা বেশ লিখেছিলেন তবে বর্তমানে তাঁর নামে মাত্র ৬০টি নাটক পাওয়া যায়। তিনি একটি নাটকে তাঁর রচনাটি ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দের বলে উল্লেখ করেছেন।[১][২][৩][৪]

ভবাইয়ের নাটকসমূহ সম্পাদনা

ভবাই বেশয়ে নাপিত, ডাকাত, চুড়ি বিক্রেতা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চোর, দর্জি, ফকির এবং সাধুসহ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষকে চিত্রিত করা হয়। একটি নাটক রয়েছে যেখানে এক বেনে মহিলা এবং একজন মুসলিম দারোগার ব্যর্থ প্রেমের সম্পর্কের গল্প চিত্রিত করা হয়েছে। জাসমা ওদান নাটকটির শেষে একজন মুসলিম ফকির উপস্থিত হয়ে, যার কাছে লোকেরা জস্মাকে পুনর্জীবিত করার জন্য অনুরোধ করে।[১][২][৩]

যে কোনও ভবাই অভিনয়ে কৌতুকরসবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং পৌরাণিক ব্যক্তিত্বগুলো নিয়ে কাজ করার পরেও তা নাটকে আসে। এই বৈশিষ্ট্য ভবাইকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাগুলোর মধ্যে অনন্য করে তুলেছে।[১][২][৩]

ভবাই দলের প্রধানকে নায়ক বলা হয়। তিনি প্রথমে পরিবেশনা আখড়া চিহ্নিত করেন, তারপরে মশাল বা মাটির প্রদীপকে কুমকুম চিহ্নিত করেন যেটি দেবী অম্বার প্রতীক। এরপর দেবীর প্রশস্তি করে প্রার্থনা গান গাওয়া হয়।[৪] তারপরে কোনও থালা দিয়ে মুখ ঢাকা একজন অভিনেতা প্রবেশ করেন, তিনি হলেন বিঘ্ন বিনাশক ভগবান গণেশ। পরবর্তীতে দেবী কালী প্রবেশ করেন এবং তার পরে আসেন ব্রাহ্মণ। এই প্রাথমিক আয়োজনের পরেই মূল বেশ শুরু হয়।[১][২][৩]

নায়ক এবং অন্যান্যরা সর্বদা মঞ্চে থাকেন এবং তাঁদের ভাষ্য ও হাতের মাধ্যমে নাটকটি পরিচালনা করেন। নাটকে গদ্যের পাশাপাশি শ্লোকগানে কথোপকথন ও বক্তৃতার মাধ্যমে গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়। ভবাইতে প্রচুর নাচ-গান আছে। মহিলা চরিত্রগুলোতে পুরুষরাই অভিনয় করেন।[১][২][৩]

ভবাইয়ের ভাষা হিন্দি, উর্দু এবং মারোয়ারির মিশ্রণ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রথমবারের মতো বেশ প্রকাশিত হয়েছিল।[১][২][৩]

রাজস্থানে এটি ভবাই নাচ নামে একটি লোকনৃত্য হিসাবে প্রচলিত রয়েছে।

সমসাময়িক অভিনয় সম্পাদনা

মুলজিভাই নায়ক, প্রানসুখ নায়ক, এবং চিমনলাল নায়ক ২০শ শতাব্দীর কয়েকজন পরিচিত ভবাই অভিনয়শিল্পী। চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনের আবির্ভাবের সাথে সাথে গ্রামের বিনোদন আমূল বদলে যায়, ফলে ভবাইয়ের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে। আধুনিক গুজরাটি থিয়েটারের লোকেরা এটিকে নতুন নাটক দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন তবে কোনও সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো হয়নি।[৪]

চিত্রশালা সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Varadpande, Manohar Laxman (১৯৯২)। History of Indian Theatre। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 173–174। আইএসবিএন 9788170172789 
  2. Sarah Diamond, Margaret Ann Mills, Peter J. Claus (২০০৩)। South Asian Folklore: An Encyclopedia : Afghanistan, Bangladesh, India, Nepal, Pakistan, Sri Lanka। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 63। আইএসবিএন 9780415939195 
  3. Martin Banham, James R. Brandon (১৯৯৭)। The Cambridge Guide to Asian Theatre। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 81–82। আইএসবিএন 9780521588225 
  4. P, G (২০০৪)। The Oxford Companion to Indian Theatre। Oxford University Press। আইএসবিএন 0195644468ওসিএলসি 56986659 – Oxford Reference-এর মাধ্যমে। 
  5. Amaresh Datta (১৯৮৭)। Encyclopaedia of Indian Literature: A-Devo। Sahitya Akademi। পৃষ্ঠা 236। আইএসবিএন 978-81-260-1803-1