ব্যাঙ তড়িৎকোষ

তড়িৎ রাসায়নিক কোষ বা ব্যাটারি।
(ব্যাঙ ব্যাটারি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

ব্যাঙ ব্যাটারি হচ্ছে একটি তড়িৎ রাসায়নিক ব্যাটারি যা কতগুলো মৃত (কখনও কখনও জীবিত) ব্যাঙ নিয়ে গঠিত যারা তড়িৎ রাসায়নিক কোষ হিসেবে শ্রেণী সমবায়ে যুক্ত হয়ে ব্যাটারি গঠন করে। এটি একটি জৈবব্যাটারি। আগের যুগের বৈজ্ঞানিক তদন্তে এবং শিক্ষামূলক তদন্তে এগুলো ব্যবহার হয়।

মাট্টেউচ্চির ব্যাঙ ব্যাটারি, ১৮৪৫ (উপরে বামে); এল্ডিনির ব্যাঙ ব্যাটারি, ১৮১৮ (নিচে); ব্যাঙ ব্যাটারিতে গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল (উপরে ডানে)।

এই ব্যাটারির কার্যকারিতার মূলনীতি হচ্ছে ঘাত শক্তি (ইনজুরি পটেনশিয়াল) যা পেশী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সৃষ্টি হয় যদিও ১৮ ও ১৯ শতকে এগুলো বুঝা যায় নি। এই শক্তি ব্যাঙের পেশী ব্যবচ্ছেদের পরিণতিতে সৃষ্টি হয়।

ব্যাঙ ব্যাটারি জৈবব্যাটারির বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে একটি শ্রেণী যা যেকোনো সংখ্যক প্রাণী দ্বারা তৈরি করা সম্ভব। এই শ্রেণীর সাধারণ নাম "মাস্কুলার পাইল" অর্থাৎ পেশীর স্তূপ। ১৮৪৫ সালে প্রথম সুপরিচিত ব্যাটারির প্রস্তুতকারক ছিলেন কার্লো মাট্টেউচ্চি। তবে তাঁর আগেও অনেকে এরকম ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন। তিনি অন্যান্য জন্তু দিয়েও এমন ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন এবং জিওভান্নি এলডিনি ষাঁড়ের মাথা দিয়ে এরূপ ব্যাটারি তৈরি করেছিলেন।

পটভূমি সম্পাদনা

বৈদ্যুতিক গবেষণার শুরুর দিকে বৈদ্যুতিক প্রবাহ শনাক্ত করতে ব্যাঙের পায়ের গ্যালভানোস্কোপ পদ্ধতি ব্যবহার হয়। যার ফলে ব্যাঙ বিভিন্ন গবেষণায় ব্যবহার হত। গ্যালভানোস্কোপ হিসেবে ব্যাঙের পা ব্যবহারের জন্য গবেষকগণ বেশকিছু জীবিত ব্যাঙ হাতের কাছে রাখতেন। এগুলো ছিল ছোট, সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, পা গুলো বিদ্যুতের প্রতি বিশেষভাবে স্পর্শকাতর এবং অন্য কোন জন্তুর তুলনায় দীর্ঘক্ষণ বৈদ্যুতিক ক্রিয়া চালিয়ে যায়।[১]

 
শ্রেণী সমাবেশে ব্যাঙের অর্ধ-উরু

প্রস্তুতি সম্পাদনা

ব্যাটারি নির্মাণের জন্য ব্যাঙের উরু ব্যবহার হত। প্রথমে ব্যাঙের পায়ের চামড়া অপসারণ করা হত, এরপর হাঁটু সন্ধি থেকে নিচের পা গুলো বিচ্ছিন্ন করা হত। উরুর পেশী এরপর অনুপ্রস্থভাবে কেটে অর্ধ-উরুতে পরিণত করা হত। নিচু কনিকেল আকৃতির অংশটিই শুধু ব্যবহার করা হত। এরপর অর্ধ-উরু একটি কাঠের অন্তরকে ( বা মোড়ক যার ফলে বিদ্যুৎ বাইরের কোন কিছুর সংস্পর্শে আসে না) এমনভাবে সাজানো হয় যাতে একটি অংশের ভিতরের পৃষ্ঠ অপরটির বাইরের পৃষ্ঠে যুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে বাইরের পৃষ্ঠের কনিকাল প্রান্ত ভিতরের পৃষ্ঠের ফাঁপা প্রান্তে যুক্ত হত (চিত্র দেখুন)। এরপর পেশীর স্তম্ভের প্রান্তদ্বয়কে কাঠে রক্ষিত কাপের পানিতে রেখে ব্যাটারির ধনাত্মক ও ঋণাত্মক প্রান্ত তৈরি করা হত।[২][৩]

এরূপ বিন্যাসের কারণ ছিল একটি ভ্রান্ত তত্ত্ব যা ছিল যে পেশীর অভ্যন্তরীণ অংশ থেকে বহিঃপৃষ্ঠে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এখন জানা গেছে যে অর্ধ-উরু বিদ্যুৎ প্রবাহে বেশি সফল কারণ এটি বেশি আঘাত পায়। আঘাতের ফলে উৎপন্ন তড়িৎ বিভব কর্তন বিভব (ডিমারকেশন পটেনশিয়াল) বা ঘাত বিভব (ইনজুরি পটেনশিয়াল) নামে পরিচিত।[৪]

 
একটি ব্যাঙ ব্যাটারির পাখি আকারের নকশা, ১৮৪৮

অন্য উপায়েও এধরনের ব্যাটারি নির্মাণ করা যায়। উদাহরণ স্বরূপ একটি ব্যাঙ এর স্নায়ু অন্য একটি ব্যাঙের পায়ে যুক্ত করেও ব্যাঙ ব্যাটারি তৈরি করা হয়। পুরো ব্যাঙও ব্যবহার করার যায়। উরুর পেশী দিয়ে তৈরি করতে বেশি সময় লাগলেও ভালো ফল দেয়ায় অধিকাংশ গবেষক এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। [৫]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
১৮০৩ সালে এলডিনির ষাঁড়-মস্তক ব্যাটারি

১৭৯০ সালে ১০ টি ব্যাঙের সমন্বয়ে ইউসেবিও ভাল্লি প্রথম ব্যাঙ ব্যাটারি তৈরি করেন। নিজের কার্যক্রমের ফলাফল বুঝতে অসুবিধা হওয়ায় ভাল্লি লুইগি গ্যালভানির মত অনুসরণ করে বিশ্বাস করে বসেন যে প্রানিজ বিদ্যুৎ (অথবা গ্যালভানিক বিদ্যুৎ) ধাতব-ধাতব বিদ্যুৎ (অথবা ভোল্টায়িক বিদ্যুৎ) থেকে ভিন্ন এমনকি দ্বিতীয় ধরনের বিদ্যুতের অস্তিত্বও স্বীকার করেননি। আলেজান্দ্রো ভোল্টার তত্ত্ব সঠিক প্রমাণিত হয়ে যায় যখন তিনি কোন প্রানিজ বস্তু ব্যবহার না করে ভোল্টায়িক স্তম্ভ তৈরি করেন। যেহেতু ভাল্লি নিজেকে বিতর্কের ভুল প্রান্তে পান এবং প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁর সিদ্ধান্ত বদলাতে অস্বীকৃতি জানান, তাই তাঁর কাজ অনেকটা আড়ালে থেকে যায় এবং সাদামাটাভাবে সংরক্ষণ করা হয়।[৬]

১৮১৮ সালে লিওপল্ডো নোবিলি ব্যাঙের কতগুলো গোঁটা (সম্পূর্ণ) পা ব্যবহার করে ব্যাঙ ব্যাটারি তৈরি করেন যেটিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ফ্রগ পাইল (ব্যাঙের স্তূপ)। তিনি প্রানিজ বিদ্যুতের উপর গবেষণা করতেন কিন্তু তাঁর গবেষণা ভোল্টার সমালোচনার মুখে পড়েছিল যিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে বহিঃবর্তনীর ধাতব পদার্থই বিদ্যুতের প্রকৃত উৎস। ভোল্টার মতে ব্যাঙের তরল খুব সামান্য ইলেক্ট্রোলাইট তথা তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণ প্রদান করত।[৭]

প্রথম সুপরিচিত ব্যাঙ ব্যাটারি তৈরি করেন কার্লো মাট্টেউচ্চি যার বর্ণনা ১৮৪৫ সালে তাঁর পক্ষ থেকে মাইকেল ফ্যারাডে রয়েল সোসাইটিতে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের পদার্থ বিষয়ক পাঠ্যবই গোল্ডিং বার্ডের বিখ্যাত "এলিমেন্টস অফ ন্যাচারাল ফিলোসফি"-এ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্যাঙের ১২ থেকে ১৪টি অর্ধ-উরুর স্তম্ভ দিয়ে এই ব্যাটারি তৈরি করে। একটি ভুল তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হলেও ব্যাঙ ব্যাটারি পটাশিয়াম আয়োডাইড বিশ্লেষণে সম্ভব হয়। নোবিলির কাজে ভোল্টার সমালোচনার জবাব দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে মাট্টেউচ্চি সম্পূর্ণ যন্ত্রটি জীবজ বস্তু দিয়ে তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি শূন্যস্থানে (ভ্যাকুয়াম), বিভিন্ন গ্যাসে এবং বিষাক্ত পরিবেশে পরীক্ষা করে দেখেন যে এটি ঐসমস্ত পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কাজ চালিয়ে যায় এমনকি পরিবেশটি জীবিত প্রাণীর জন্য বিষাক্ত ও প্রাণঘাতী হলেও।[৮]

ব্যাঙদেরই শুধু ব্যাটারি হিসেবে ব্যবহার করা হয় নি। ১৮০৩ সালে জিওভান্নি এল্ডিনি দেখান যে সদ্যমৃত ষাঁড়ের মাথা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। ব্যাঙ গ্যালভানোমিটার দ্বারা ষাঁড়ের জিহ্বা ও কান সংযুক্ত হয়ে গবেষণাকারীর দেহ দ্বারা বিদ্যুতের পথ বা বর্তনী পূর্ণ হলে তা ক্রিয়া প্রদর্শন করে। দুটি বা তিনটি মাথা নিলে ব্যাটারি আরও জোরদার ক্রিয়া দেয়। পরবর্তীতে ১৮৪০ এর দিকে মাট্টেউচ্চি ইল (বান মাছ) ব্যাটারি, কবুতর ব্যাটারি এবং খরগোশ ব্যাটারি তৈরি করেন। এরপর তিনি দুটি কবুতরের বুকের সামান্য জখম করে অন্য কবুতরের দেহে যুক্ত করে জীবন্ত কবুতরের ব্যাটারি তৈরি করেন। তিনি বলেন যে এই নকশাটি পূর্বে প্রচলিত জীবন্ত ব্যাঙের ব্যাটারির নকশার ভিত্তিতে তৈরি। [২][৯]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Bird (1849), pp.28-29
    Valli, p.22
  2. Longet and Matteucci, "Traité des phénomènes electro-physiologiques des animaux", "Rapport entre le sens du courant electrique et les contractions musculaires dues et ce courant" The Medico-chirurgical Review, vol.46, p.311, April 1845.
  3. Matteucci (1848), p.391
    Rutter, pp.110-113
  4. Clarke & Jacyna, p.199
    Hellman, p.32
    Kipnis, pp.144-145
  5. Rutter, p.112
  6. Bird (1848), p.344
    *Valli, p.155, Experiment 122 uses 10 frogs
    Kipnis, pp.144-145
  7. Clarke & Jacyna, p.199
    Clarke & O'Malley, p.186
    Hellman, p.31
  8. Bird (1848), pp.344-345
    Hellman, p.32
    Matteucci (1845), pp.284-285
  9. Bird (1848), p.341-342
    Matteucci (1848), p.391

গ্রন্থাবলী সম্পাদনা