বাংলা উইকিপিডিয়ায় স্বাগতম সম্পাদনা

পীর মোজাদ্দেদ আবু বকর সিদ্দিকী (রহঃ) সম্পাদনা

ফুরফুরা পরিচিতি

হুগলী জেলার একটি গ্রাম বালিয়াবাসন্তী’ গ্রামটি নিয়ে নানা কাহিনী। শুনা যায়। বান্দীরাজা নামে এক অত্যাচারী ভূস্বামীর প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল বালিয়াবাসন্তী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। সময়টা ছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দীন ফিরােজ শাহ্ (১৩০১-১৩২২ খৃঃ)’র। (১)

অত্যাচারী ভূস্বামীর প্রতিপত্তির অবসান ঘটে, মুষ্টিমেয় কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন সুফী সাধকদের দ্বারাতে। এক্ষেত্রে তারা তৎকালীন সুলতানের আঞ্চলিক গভর্ণর সপ্তগ্রামের মীর, জাফর গাজী (রঃ) কর্তৃক সাহায্য প্রাপ্ত হন। আজকের ফুরফুরা শরীফের ভূমিতে, সেদিন থেকেই সুফী-সাধকের পদচারণা শুরু হয়। প্রধান যে দু’জন সাধকের নাম শুনা যায়, তারা হলেন হযরত মনসুর বাগদাদী সিদ্দিকী (রঃ) ও সৈয়দ হােসায়েন বােখারী (রঃ) এ ছাড়া শাহ সােলায়মান (রঃ) চার শহীদ, গঞ্জে শােহাদাগণের সমাধিগুলিও আজ ইতিহাসের নিরব সাক্ষি।(২) যেদিন থেকে এই অঞ্চলের মানুষ ভূস্বামীর অত্যাচার হতে মুক্তি পেল, সেই দিন থেকেই বালিয়া বাসন্তীর নাম হলাে আজকের ফুরফুরা’।*

          ফুরফুরার এই ভূমিতেও বিভিন্ন শতাব্দীতে জন্ম হয়েছে বহু সাধকের, সপ্তদশ শতাব্দীতে এই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন যে প্রথিতযশা, ক্ষণজন্মা, সাধক, তিনি হলেন শাহ আবু বকর সিদ্দিকী (রঃ)'র উর্ধ্বতম ষষ্ট পুরুষ, হযরত মােস্তাফা বাঙালী (রঃ)। (৩) এই সাধক ছিলেন মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রঃ) র পুত্র ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী হযরত খাজা, মাসুম রাব্বানী (হিজরী ১০০৭ - ১০৭৯) (রঃ)'র বঙ্গদেশের অন্যতম প্রধান খলিফা। শাহ আবু বকর সিদ্দিকী এর মত তাঁরও ছিল সুবিশাল প্রভাব। (৪) এদেশে তিনি ছিলেন মুজাদ্দেদীয়া সুফীধারার প্রচারক। বঙ্গদেশে হয়ত সারহিন্দী মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রঃ) (১৫৬৩ - ১৬২৪ খঃ) খলিফা, হযরত হামিদ বাঙালী (মৃঃ ১৬৫৩ খৃঃ) (রঃ)’র  * পর মােস্তাফা বাঙালী (রঃ) *  নাম বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
     ১৯৬১ সালের Hooghly District Hand Book এ ফুরফরাকে a place ofPilgrimage for Musalmans' বলে উল্লেখ করা হয়। সালের পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত West Bengal Dia... Gazetters ; Hooghly { By Amiya Kumar Banerjee I.A.SI একই কথা বলা হয়েছে, Gazetters;"a place of Muslim pilgrimage" হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্ধে বলা হয় -- “ফরফরা বঙ্গের মুসলমানদিগের একটি প্রসিদ্ধ, পীঠস্থান .... ফুরফুরার পীর বংশে ভগদ্ভক্ত ফকির ও মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করায় এই স্থান বঙ্গের মুসলমানদিগের নিকট তীর্থ ক্ষেত্র বলে পরিগণিত।”(৫)
       এই পূণ্যভূমি কেবলমাত্র তীর্থস্থানই নয়, আজকের মত অতীতেও ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গণ্য ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে মােস্কায়া বাঙশলী (রঃ) কর্তৃক এখানে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই প্রতিষ্ঠান কত দিন চালু ছিল তা জানা যায় না। পরবর্তীকালে ফারায়েজী আন্দোলনে প্রবর্তক “হাজি শরিয়তুল্লাহ” মক্কায় উচ্চ শিক্ষা করতে যাওয়ার আগে ফুরফুরাতে এসে আরবী, ফারসী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। (৬)
        বিংশ শতকে যুগপুরুষ, শাহ্ আবু বকর সিদ্দিক (রঃ)'র জন্ম এই ফুরফুরা শরীফের পূর্ণভূমিতে। এই মহা সাধকের সান্নিধ্য পেতে মানুষ ছুটে এসেছে, সূদূর রাশিয়ার বােখারা, কান্দাহার, পেশওয়ার প্রভৃতি স্থান থেকে। তমানে ফুরফুরার খ্যাতি যা কিছু সবই শাহ আবু বকর সিদ্দিকী (রঃ)’র - ন্যই।

তথ্য নির্দেশ

১)সৈয়দ বাহাউদ্দিন, বাংলার ইতিহাসে ফুরফুরার শরীফ

(হযরত পীর আবু বকর (রঃ) ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ফুরফুরা ২০০২]পৃ-৭৮। ২) ওলানা গােলাম সরওয়ার ও মাওলানা মােজাফ্ফর আহমদ, এসলাহ-হুলমুমেনীন’ (উর্দু)। নং রিপােন স্ট্রিট, মমতাজউদ্দিন কৰ্ক প্রকাশিত]পৃঃ-২২৮, ২১৬, ২১৫ ৩)পূর্বোক্ত, ২২৫। ৪) সিম আহমদ ফারুকী, মকতুবাতে খাজা, মাতসুম’(উর্দু) আরকান বুক ডিপাে, নাজিয়াবাদ, লাখনৌ, ১৯৯০]পৃঃ ৩৩।

৫) সুধীর কুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ সবুক হাউস, ৭৮/১ মহাত্মা গান্ধী রােড, কলকাতা, ১৯৯১পৃঃ ১৩০১।

৬) ডঃ এম, এ রহিম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস। নদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ১৯৯৪]পৃ. ৭৪;ডঃ অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ [পঃ জ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৯১)পৃ. ৪৬; শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)'র একটি পত্র সূত্রে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠারতথ্যটি Tয়। যা আমার (লেখক) কাছে সংরক্ষিত আছে।

                           ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব
         উনিশ শতকের শেষার্ধের দিনগুলি ছিল মুসলমানদের জন্য চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগের দিন, ফারয়েজী ও ওয়াহাবী তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনের তীব্রতা তখন প্রশমিত। একদিকে ক্ষমতার শীর্ষে ইংরেজ, তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করেছে জাতীয় উন্নতি, অবনতি। ভাষাগত দ্বন্দ্বের সাথে সাথে স্বজাতি বিজাতীর মধ্যে ছিল ধর্মগত বিরােধ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত।

ইসলামের সঠিক ধর্মমত নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে শীয়া সুন্নি, হানাফী, মােহাম্মাদী, বেদাতী পীর-ফকির, কাদিয়ানী বিরােধের পাশাপাশি খৃষ্টান, আৰ্য্য, বাউলদের প্রচার ও প্রভাবে মুসলিম সমাজ ছিল উভ্রান্ত। (১) | “এই সময় বাংলাদেশের নানা জেলা থেকে খবর আসে,মুসলমানেরা খ্রষ্টান, ব্রাহ্ম ও হিন্দু ধর্ম অবলম্বন করছেন। যশােহর জেলায় কিছু সংখ্যক মুসলমান কারিগর খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে হাটে মাঠে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার করে বেড়ায়। চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটে ও খুলনায়, সাক্ষীরা মহকুমায় কতিপয় মুসলমান ব্রাহ্ম ধর্ম অবলম্বন করে। ... এমন খবরও প্রকাশিত হয় যে রংপুর জেলায় কিছুসংখ্যক মুসলমান “খােল করতাল যােগে হরি সংকীৰ্ত্তন করে নিরামিষ খায় তাহাদের মধ্যে মুসলমানের কোন কিছু দৃষ্ট হয় না।” (২)

| তাছাড়া নানা দেশাচার কুসংস্কারে ও শিরক্ বিদ’আতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিল মুসলিম সমাজ, শিক্ষার আলাে বলতে যা ছিল তা হলাে অপ্রতুল অতিক্ষুদ্রকায় শ্রেণীর মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক দিকের পর্যালােচনায় এটি খুবই স্পষ্ট যে, সবদিক থেকেই যুগটি ছিলপতনের যুগ। অথচ ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র কাওমী মাদ্রাসা আধ্যাত্মিক অনুশীলন কেন্দ্র খানকা ছিল না তা নয়।

সমকালীন অবিভক্ত বঙ্গ আসামে এমন সব ডলা আজকের দিনে ভারতে যেরূপ বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তি দুর্লভ বললে অত্যুক্তি ম না যেমন - শামসুল উলামা পীর হযরত গােলাম সালমান (রঃ) মৃ ১৯১২] ইসলামিক দর্শন শাস্ত্রের, পণ্ডিত, আল্লামা, লুৎফর রহম (রঃ) (মৃঃ ১৯২০-২১] হাদিসতত্ববিদ, আল্লামা, এসহাক বর্ধমানী (রঃ) (মৃঃ ১৯২৮] শ্রেষ্ঠ ফকিহ, আল্লামা বেলায়েত হােসেন কলকাতাবী [১৮৬৪১৯২২] আরবী সাহিত্যের পণ্ডিত, আল্লামা, বেলায়েত হােসেন বীরভূমী (১৮৮৭) (রঃ) মুহাদ্দিস, আল্লামা, আবদুল ওয়াহেদ চাটগামী (রঃ) (মৃঃ ১৯১০] আল্লামা মুহাম্মদ মঙ্গলকোটি বর্ধমানী (রঃ) (মৃঃ ১৯০৭] চট্টগ্রামের খ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ হাসান ওরফে মুহাদ্দিস সাহেব (রঃ) [মঃ ১৯২০] আল্লামা মুহাম্মদ তাহের সিলেটি (রঃ) (মৃঃ ১৯৪০] এমন অনেক বিদগ্ধ পণ্ডিতগণের নাম জানা যায়। এই সকল উলামারা মাদ্রাসায় শিক্ষাদানে। রত ছিলেন অনেকে উর্দু ও আরবী বই-পুস্তকও রচনা করেন, (৩) কেউ কেউ পীরও ছিলেন, যেমন শামসুল উলামা গােলাম সালমানী (রঃ) ফুরফুরার শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)'র সাথে তার কেবল আত্মীয়তার সম্পর্ক নয়, উভয়ের মধ্যে ছিল নিবিড় এক আত্মিক যােগসূত্র। গােলাম সালমানী (রঃ) বয়সে বড় ছিলেন বলে, শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) তাকে বড় ভাই বলে সম্বােধন করতেন। উভয়ে ছিলেন শাহ সুফী ফতেহ আলী (রঃ)’র খলিফা। শাহ গােলাম সালমানী (রঃ) এই বলে তাকে দুয়া করতেন; আল্লাহ আমার ভাই শাহ আবুবকর (রঃ) দ্বীনের প্রচার করছেন, আমার হায়াত কম করে দিয়ে তার হায়াতে বরকত দান করবেন। গােলাম সালমানী (রঃ) যেমন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন, অনুরূপ একজন পীর মুর্শিদও ছিলেন। (৪)
       আল্লামা আবদুল আউওয়াল জৌনপুরী (রঃ) (১৮৬৬-১৯২১) মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০ - ১৮৭৩) (রঃ)’র কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত উর্দু, আরবী ও ফারসী ভাষায় ১২১টি পুস্তকপুস্তিকা রচনা করে যেসব ছােট-বড় পুস্তক-পুস্তিকা এবং গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে ৮৭টি প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৪৫টি আরবীতে, ৪০টি উর্দুতে দু’টি ফার্সীতে।তার বৃহৎ গ্রন্থ মুফীদুল মুফতী’ ২৮৬ পৃষ্ঠার। 
       ঢাকার শাহ আহসানুল্লাহ (রঃ) মুশরিশােলার শাহ সাহেব নামে পরিচিত, কলকাতার শাহ সুফী মাওলানা খায়রুদ্দিন কাসুরী (রঃ) মাওলানা আযাদের পিতা, বরকত আলী শাহ মুজাদ্দেদী (রঃ) (১৯২৬ মৃঃ)। এমন অনেকের নাম জানা যায় এঁরা বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পীর-মুরিদী করতেন। এছাড়া সমকালীন দু’জন প্রসিদ্ধ পীর ছিলেন যথাক্রমে নক্শবন্দীয়া-মুজাদ্দেদিয়া সুফী ধারার শাহ সুফী ফতেহ আলী ওয়সী (রঃ) [১৮৮৬ মৃঃ] আর কাদেরীয়া সুফী ধারার শাহ মুর্শিদ আলী আলকাদেরী (রঃ) মেদনাপুরী (রঃ) [১৮৫২ - ১৯০১] এবং এঁদের খলিফাগণও পীর-মুরিদী করতেন। (৬) এই সকল উলামা এবং পীর-মুর্শিদগণের দ্বারা মাদ্রাসা ও খানকায়ী তালীম বা শিক্ষা ধারা অব্যাহত থেকেছে। এঁদের উপস্থিতি সত্বেও দেশ ও সমাজ সে দিন এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়ােজন উপলব্ধি করেছিল, যিনি স্বয়ং শরীয়ত ও তরিকতের জ্ঞানের সুদক্ষ হওয়ার সাথে সথে সময়ের দাবিতে ধর্ম ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের ময়দানে কর্মদক্ষ ও প্রতিভাশালী ব্যক্তিবর্গের যথার্থ মূল্য নিরূপণকারী হবেন, অন্যের দৃষ্টিতে যা মূল্যহীন তার প্রজ্ঞা বা অন্তদৃষ্টির বিচারে তার মূল্য প্রমাণিত হবে, যিনি বিক্ষিপ্ত প্রতিভাকে সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের দ্বারা দ্বীনের কাজে লাগাতে সক্ষম হবেন, লেখনীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির যােগ্যতাকে দ্বীনের প্রচারে, বাগ্মী-ভাষায় দক্ষ ব্যক্তিকে দ্বীনের আহ্বানে ধনীর সম্পদকে দ্বীনের পথে লাগাতে সক্ষম হবেন, যাঁর প্রয়াসে সমাজের অনৈসলামিক আচার-আচরণ এবং সমাজে অনুপ্রবিষ্ট শিরক, বিদ’আদ অনেকাংশে দূর হয়ে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামিক চেতনার উন্মেষ ঘটবে, মুসলমানদের জাতীয় জীবনে যিনি হবেন নির্ভীক সাহায্যকারী, যার দ্বারা দেশের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তেশরীয়ত ও তরীকতের শিক্ষা পরিব্যাপ্ত হবে, মুসলিম মানসে ধর্মীয় আবেগের অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে এইরূপ ব্যক্তিকে বলা হয় যুগের ইমাম বা যুগের অগ্রবর্তী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। (৭)
      বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রঃ) মতে এই শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গকে, মুজাদ্দিদ’ বা যুগ-সংস্কারক বলা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি এঁরা যা লিখেছেন তার সারসংক্ষেপ হলাে, যাঁরা এই শ্রেণীভুক্ত হন, তারা কোরআন ও হাদিসের বিজ্ঞ পণ্ডিত হওয়ার সাথে সাথে ইলমবাতেনী বা আল্লাহ প্রদত্তবিশেষ জ্ঞান-প্রজ্ঞারও অধিকারী হয়ে থাকেন। সমকালে তিনি হন প্রবল আকাঙ্খিত পুরুষ, সৰ্ব্ব স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরােক্ষ ভাবে নিজ নিজ যােগ্যতা অনুসারে তার জ্ঞান ভাণ্ডার হতে উপকৃত হন, অতঃপর তারা পারদর্শী ও দক্ষতা অর্জন করেন। ঐ সময়ের মানুষের মধ্যে তার আনুগত্য প্রকাশ পায়। আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কল্যাণ দ্বারা পুরস্কৃত করেন। তাঁর দ্বারা শরিয়ত ও তরীকতের ইলম প্রসার লাভ করে। তাঁর খলিফার সংখ্যা হয় বহুল পরিমানে বাতেল বা অসত্যের বিলপ্তি ঘটিয়ে হক’ বা সত্যের প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্রে ঐ যুগে তিনি হন মাধ্যম স্বরূপ।
       জাল হাদিসের প্রচার এবং ধর্মীয় বিষয়ে কিয়াসকারীদের বাড়াবাড়ি কিংবা শিথিলতা থেকে শরিয়তের বিধি-বিধানকে স্বচ্ছ ও নির্মল রাখতে তিনি হবেন বদ্ধপরিকর এমন ব্যক্তিবর্গের দ্বারা মহান আল্লাহ স্বীয় দ্বীনকে সজীব করেন, প্রতিপক্ষরা এরূপ যুগ-সংস্কারকের বিরােধীতা করেও ব্যার্থ হন। (৮)।
     উনিশ শতকের শেষবিংশ শতকের যুগসন্ধিক্ষণের সাক্ষী হয়ে এইরূপ যে ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটলাে, তিনি হলেন শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) বহুমাত্রিক গুণের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার জীবনে উপযুক্ত গুণাবলীর সাথে সাথে আমরা পাই সাধকের নিষ্ঠা জ্ঞানের গভীরতা, জাতীয় প্রেম; জনচেতনা সৃষ্টির ক্ষমতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, তাঁর প্রতিযুগের সর্বশ্রেণীর মানুষের আনুগত্যতা, বাস্তবমুখী-চিন্তা। এসবের প্রাসঙ্গিকতা এই পুস্তকের পরবর্তী অধ্যায়গুলি থেকে আশাকরি আমরা অনেকটাই উপলব্ধী করতে পারবাে। 
    কলকাতা মাদ্রাসা আলীয়ার ভূতপূর্ব মুহাদ্দিস শামসুল উলামা শাহ সফিউল্লাহ (রঃ)’র মতে -- ফুরফুরার আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) ছিলেন বঙ্গবাসীর পথপ্রদর্শক ও উচ্চপর্যায়ের ইমাম।
     হুগলী মাদ্রাসার ভূতপূর্ব প্রধান হযরত শামসুল উলামা গােলাম সালমানী (রঃ) তার ব্যাপক খিদমতের জন্য দীর্ঘায়ুর দুআ করতেন।

হযরত আশরাফ আলী থানবী (রঃ)'র অন্যতম প্রধান খলিফা শামসুল উলামা ইসহাক বর্ধমানী (রঃ)'র মতে আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)র ব্যক্তিত্ব ছিল। স্পর্শ মণিতুল্য। (৯)

দেওবন্দ বিশ্যবিদ্যালয়ের বর্তমান শাইখুল হাদীস আল্লামা সাইদ আহমদ পালনপুরীর মতে শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) ছিলেন ১৩ ও ১৪ হিজরী শতকের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম। এঁর দ্বারা মহান আল্লাহ দ্বীন ইসলামকে জিন্দা করেছিলেন।

          নদোওয়াতুল উলামার বর্তমান মুহাদ্দিস খালেদ নাদোবী গাজীপুরী একই রূপ মন্তব্য করেন। 
      কবি মােজ্জামেল হকের মতে, (১৮৬০-১৯৩৩) এরূপ যুগ-পুরুষর আবির্ভাব ছিল মুসলিম বাংলার জন্য সেভাগ্য এমন ব্যক্তির জন্ম না হলে, হয়তাে বঙ্গের ইসলাম তরণী উপযুক্ত কর্ণধার অভাবে সে দিন বিপথগামী হয়ে পড়াতাে।(১০) তৎকালীন সাহিত্যিক বা লেখক ডাঃ সৈয়দ আবুল হােসেন [জন্ম,১৮৬৪]-এর মতে “মাওলানা আবুবকর (রঃ) সাহেব বঙ্গীয় মােসলেমাকাশের পূর্ণ শশীর পদ পাইয়াছেন এবং সেই স্মিজ্যোতিতে মােসলেম জগৎ হাঁসিয়া উঠিয়াছে।” (১১)
     যুগ-পুরুষ শাহ আবুবকর (রঃ) চেয়েছিলেন, মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষার উন্নতি। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সচেতনতা এবং প্রচলিত শিরক, বিদআত বা কু-সংস্করগুলি দূরিকরণের সাথে সাথে ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা তারই ভাবনা চিন্তার অভিব্যক্তি ঘটে ছিল, তার শিষ্য ও ভাবশিষ্যদের কর্ম-জীবনে। তার বিশাল প্রভাবতার প্রতি জনগণের অঢেল ভক্তি ও ভালবাসা তার নৈতিক বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে অসংখ্যক হৃদয় স্পন্দিত আবেগে সত্যের পতাকাতলে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল এসে। কয়েক শতকের মধ্যে পূর্ব ভারতে এমন ক্ষণজন্মা পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিল কি না তা ইতিহাসই বলবে। আশ্চৰ্যজনক হলেও সত্য যে, আজ প্রায় এক শতাব্দীকাল হতে চলল তিনি গত হয়েছেন, তার যুগের জাগরণবাদীদের নাম টুকু কেবল ইতিহাসের পৃষ্ঠায় শশাভা পাচ্ছে, কিন্তু আবুবকর(বঃ) নামটি জীবন্ত এক ইতিহাস, আজও তিনি এই উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের স্পন্দন। তার প্রভাব উভয় বঙ্গে সক্রিয় রয়েছে সমানভাবে, এক কথায় বলা চলে যে তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশে বিংশ শতকের যুগ চেতনার এক শুভ অভিব্যক্তি।

তথ্য নির্দেশ

১।ডঃ ওয়াকিল আহমদ উনিশ শতকে বাঙশলী মুসলমানের চিন্তা-চেতনার ধারা’ ২ঃ [বাংলা একাডেমী; ঢাকা ১৯৮৩] বিভিন্ন পৃষ্ঠা। ডঃ অমলেন্দু দে, বাঙালী বুদ্ধিজীবি ও বিচ্ছিন্নতাবাদ’ [পঃ বঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষদ, ১৯৯১] পৃঃ ১১৯।
২। ডঃ অমলেন্দু দে, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩১-১৩২
৩। মাওলানা নূর মােহাম্মদ আজমী, হাদীসের তত্ব ও ইতিহাস’ [বাংলা ইসলামিক একাডেমী, দিল্লী, ১৯৯৭] বিভিন্ন পৃষ্ঠা দ্রঃ; মুসলিম মনীষী’ (সংকলন) [ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, গবেষণা বিভাগ, ২০০১]পৃঃ ৩১৫-৪১
৪। মাওলানা হুসামুদ্দিন সাহেব, অমিয় নিঝর’(১ম সংস্করণ সালমানিয়া কুতুবখানা, ১৯৮৩) পৃঃ ৩৯। 

৬। ডঃ মতিউর রহমান, আয়নায়ে ওয়সী’ (উর্দু [৪নং রামন রােড, পাটনা, ১৯৭৬]পৃঃ ১৭১,১৭২, ১৭৬; ডঃ Afee UfG), Sufi Movements in Eastern India, (IDARAH-I-ADABIYAT-IDELLI,2009) Pg. No.81-82 ৭।মাওলান সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদোভী (রঃ) তারিখে দাওয়াত ও আজিমত’ (উর্দু) গ্রন্থের বর্ণনা প্রদ্ধতি অবলম্বনে লিখিত।

৮। শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রঃ) তাফহীমাতে এলাহীয়া’ (আরবী) [আলমাজলেসুল ইলমী, মদিনা বারকি প্রেস, বিজর,ইউ পি, ১৯৩৬]পৃঃ ২৯, ৪০। 

৯। মাওলানা রুহুল আমীন, ফুরফুরার হযরতের বিস্তারিত জীবনী’ ২য় সং, দ্রঃ। পৃঃ ৩৫৯-৩৬০ ১০। মােজাম্মেল হক, (কবি) মাওলানা পরিচয়’ [সূর্য কুমার নাথ ও গনেশচন্দ্র নাথ, ২৯ ক্যানিং স্ট্রীট, কলকাতা,১৯১৪]পৃ. ২৯.৪০।

১১। আবুল হােসেন এম,ডি (সৈয়দ) মােসলেম পতাকা, তারিখুল ইসলাম’ [দরবার প্রেস, ৬৩ নংকলিন স্ট্রীট, কলকাতা, ১৯২৪]পৃ.৮০৩।


                              মহানুভবতা

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর খলিফাদের মহাজীবনে, জাতী ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি প্রেম-প্রীতির যে নিদর্শন ছিল, তা কারও অজানা নয়।

শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)'র জীবনটা ছিল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং সেই আলােকে উদ্ভাসিত। যে কারণে তিনি ছিলেন, মুক্ত-প্রাণের এক মহৎ ব্যক্তিত্ব। ছিলনা তার কাছে উচু-নিচুর প্রভেদ; ঘৃণ্যজাতীভেদ ও বৈরিতার ঠাই, জাতী ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সর্ব শ্রেণীর মানুষ তার প্রশস্ত হৃদয়ের মাঝে স্থান পেত নিঃসংকোচে। (১) |

          তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্রতা এমন ছিল যে, তিনি যেখানে যেতেন শুধুমাত্র তার সৌম্য-সুন্দর স্বর্গীয় আলােক-দীপ্ত জ্যোতির্ময় মুখ-দর্শনে শতসহস্র মানুষ উদ্বেলিত হৃদয়ে থাকতাে প্রতীক্ষায়। (২) তঁার কথা-বার্তার মধ্যে গাম্ভীর্যতা সত্বেও তিনি ছিলেন সদাচারী ও মিষ্টিভাষী। (৩)। 
         তাঁর মুক্তা ঝড়া মুখনিসৃত বাণী মানুষের হৃদয়কে সহজে জয় করেফেলত। (৪) তার সংস্পর্শে প্রেমের পরশে অনেকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল। (৫) সমকালীন তিনি মুসলিম বাংলার সমুচ্চ আসনে ছিলেন অধিষ্ঠিত, অথচ কোন সময়ের জন্য অপর কোন ধর্মের প্রতি আঘাত করেননি। ধর্ম ভিন্ন হলেও, মানবতা ও মানবিক মূল্যবােধের বিষয়টি তার কাছে গুরুত্ব i Å ó Ë û li á Islam in ModernöBengal i Corsican FTC3168001 - "Fearless God intoxicated and selfless, Pir Abu Bakar Shone as a great Spiritul luminary in the Muslim World ...... As a religious preacher he would never attack 0t he ..।” (৬) 
        পীর আবুবকর একজন নির্ভীক, খােদাভীরু, নিস্বার্থ এবং মুসলিম বিশ্বের আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তিনি একজন (মুসলিম) ধর্ম প্রচারক হয়েও কখনাে অন্য ধর্মকে আঘাত করেননি।”
            বঙ্গ-ভাষা সংস্কৃতি সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাতা কায়স্থ’ পত্রিকার সম্পাদক, শ্রীসুধীর কুমার মিত্র বিদ্যা বিনােদ লিখেছেন – “..ফুরফুরা বঙ্গের মুসলমান দিগের একটি প্রসিদ্ধ পীঠস্থান; এক সমর প্রধান পীর মৌলানা আবুবক্কার সাহেবের ধর্মনিষ্ঠা এবং পবিত্র চরিত্রের জন্য প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান তাহার শিষ্যত্বগ্রহণ করিয়াছেন। ইনি স্বয়ং সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করেন না বলিয়া ইহার শিষ্যবর্গ ও সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে আছেন বলিয়া প্রকাশ ..। (৭) তবে, মাওলানা রুহুল আমিন (রঃ) কবি মােজাম্মেল হক প্রমুখ লিখেছেন, শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)’র শিষ্য সংখ্যা কত ছিল তা নির্ধারণ করা কঠিন। তৎকালীন সময়ে উভয় বঙ্গ-আসামের মুসলিম জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল, তার শিষ্য ও প্রশিষ্য কেউ বা অনুরক্ত। (৮) ভারতে হিন্দু মুসলমান কলহ বিদ্বেষ ও বিরােধকালীনশাহআবুবকর সিদিকীর অন্যতম প্রধান শিষ্য ভাষাবিদ ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেব বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি কালচারের মধ্য দিয়াই আমাদের মিলন হইবে। যে পর্যন্ত মুসলমান হিন্দুকালচার সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিবে এবং হিন্দু মুসলমান কালচার সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকিবে সে পর্যন্ত কখনই আন্তরিক মিল হইবে না। এই মিলনপন্থী হইয়াও আমি স্বীকার করি প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের অধিকার আছে।” (৯) ১৯২৭ সালে অধুনা বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার কুলকাঠি’ গ্রামে মসজিদের সম্মুখে বাদ্য বাজানাে নিয়ে হিন্দু মুসলমানে তুমুল বিরােধ দেখা দিলে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিক্রমে গুলির অর্ডার হয়। ২০ জন নিহত এবং ৩০ থেকে ৪০ জন আহত হন। এই সংবাদটি বাংলা ও ইংরাজী দেশ বিদেশের সংবাদপত্রগুলিতে ফলাও করে ছাপা হয়। এই সময় ডঃ শহীদুল্লাহ গবেষণা উপলক্ষ্যে প্যারিসে ছিলেন, সংবাদ মাধ্যমে তিনি এই ঘটনাটি জানতে পারেন। প্যারিস থেকে ডঃ শহীদুল্লাহ তার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, বেলায়েত হােসেনকে এক চিঠিতে লেখেন – “... কাগজে পটুয়াখালীর সত্যাগ্রহ ও হিন্দু মিশনের কার্যকারিভা সম্বন্ধে দুন্দুভিনাদ দেখিতেছি, আমার মনে হয় হিন্দু মুসলমান উভয় পাগল হইয়াছে। কথামালায় পড়িয়াছিলাম, একজন একটি ঘােড়া ভাড়া করিয়াছিল। দুপুরের রৌদ্রের সময় সে ঘােড়ার ছায়ায় নামিল, ঘােড়ার মালিক বলিল, এ ছায়া আমার তুমি ঘােড়া ভাড়া করিয়াছ, ছায়া ভাড়া কর নাই। তখন ছায়ার অধিকারলইয়া দুইজনের মধ্যে তুমুল বচসা বাধিয়া গেল, শেষে হাতাহাতি।এহঅংশ ঘােড়া যে কোথায় পলাইয়া গেল, তাহা কেহই জানিল না। বাস্তবিক মসাজলেন সামনে বাজনা বাজানাে কি না বাজনার ছায়া লইয়া মারামারি। এই ঝগড়া ফলে স্বরাজ ঘােড়া পলাইয়া যাইতেছে। .... হিন্দু ধর্ম প্রচার করিতেছে; মুসলমান খৃষ্টান প্রভৃতি হিন্দু বানাইতেছে, তাহাতে রাগ করিবার কিছু নাহ। তুমিও তােমার ধর্ম প্রচার কর।.... আমি হিন্দুদের ধর্ম প্রচারে আনন্দিত হইয়াছি, যদি ইহাতে মুসলমানদের শৈথিল্য ঘুচে। কিন্তু সকল কাজের উপর শিক্ষার বিস্তার, মূর্খ জাতির কোন ধর্ম নাই; কর্ম নাই, উদার শিক্ষার সঙ্গে উদার ধর্মের সম্মিলন, এই-ই চাই।” (১০)
           নিজ ধর্ম সম্পর্কে যেমন সতর্ক ছিলেন, অন্য ধর্মের বিষয়টিও আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) যে মাথায় রাখতেন, তার একাধিক দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি হলাে, ১৩২৯ সালের ২৪শে বৈশাখ শনিবার, যশােহর জেলার দৌলতডিহি নামক স্থানে আঞ্জুমানে ওয়ায়েজিন’ (১৯১১) এর বার্ষিক অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলির মধ্যে পাঁচ নম্বর প্রস্তাব ছিল – “এই সভা দৃঢ়তার সহিত জ্ঞাপন করিতেছে যে, জাতি ও ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় আইন সভাতে মােসলমান, খৃষ্টান, হিন্দু প্রভৃতি জাতীর সমাজ ও ধর্মনীতির বিরুদ্ধে কোন আইন যেন পাশ না করা হয়। বিভিন্ন জাতীর সামাজিক ও ধর্মনীতির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন পূর্বক সমাজ ও ধর্মে হস্তক্ষেপ করিয়া জনসাধারণকে যেন বিচলিত না করা হয়।” (১১)।
           যশাের জেলার সিংঝুলি গ্রামে ২৪শে, ২৫শে অগ্রহায়ন, বার বাজারে এবং শেখেরমাগুড়ায় ২৭শে অগ্রহায়ন ধর্মসভায় হিন্দু, মুসলিম হাজার হাজার শ্রোতা মণ্ডলীর উপস্থিতিতে শাহ আবুবকর (রঃ) বলেছিলেন -- “হিন্দু মুসলমানে মিলিত হইয়া দেশ ও দশের উন্নতি কল্পেশান্তিপদ ও সৎ অনুষ্ঠান। সমূহ করা একান্ত প্রয়ােজন, কিন্তু তাহাতে ধর্মের কোন অংশহীন করিয়া ধর্মদ্রোহী হইবেন না। শান্তি ও সভাবে হিন্দু মােসলমানে মিলন হওয়া খুব ভাল।” (১২)। 
      শাহ আবুবকর (রঃ) বিশ্বাস করতেন ধর্ম ভিন্ন হলেও, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা সকলেরই এক। যে যার ধর্ম পালনের পরেও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে এক্যবদ্ধ হওয়াতে বাধা কোথায় ! সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা যখন একই।উগ্রতার পরিবর্তে সহনশীলতাই ছিল তার চারিত্রিক ভূষণ। জেলা পাবনার ইতিহাসের একটি ঘটনা, পাবনা জেলার এক জমিদার আলোকনাথ মৈত্র ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ ও দানশীল ব্যক্তি। তার জমিদারীতে মুসলিম সম্প্রদায়কে কোন সময়ের জন্য অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি, কিও তার মৃত্যুর পর তারই পােষ্যপুত্র যােগেন্দ্রনাথ মৈত্র একজন অত্যাচারী জমিদার হলেন। তার জমিদারীতে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। না। এক সময়ের ঘটনা, রমজান আলী নামক এক ব্যক্তি গরু কোরবানী দেওয়ার অপরাধে, যােগেনমৈত্র বরকন্দাজ দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এসে জুতা পিটাতে পিটাতে রমজান আলীর মৃত্যু ঘটে। এই সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, বিভিন্ন গ্রাম থেকে পাঁচ-সাত হাজার মুসলমান যােগেন মৈত্রের বাড়ী ঘেরাও করে বসে থাকে। তাকে বাঁচাতে স্বজাতীর কেউ এগিয়ে এলােনা সেদিন, বেগতিক দেখে মৈত্র বাবু’ তার ঘনিষ্ঠ আত্মিয়কে পাঠান শাহ আবুবকর (রঃ) এর কাছে। ফুরফুরার শাহ আবুবকর (রঃ) ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং তিনি সকলকে শান্ত হতে অনুরােধ জানান, সে যাত্রা যােগেন মৈত্র’ রক্ষা পান। পরবর্তীকালে নিজ গ্রাম শীতলাই ছেড়ে পাবনা শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। (১৩)
        ১৯২৪ সালে ২৮শে মার্চ কলকাতা মনুমেন্ট ময়দানে শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)’র সভাপতিত্বে একটি সমাবেশ হয়। এই সমাবেশে একজন বক্তা জমিদারের দ্বারা মােসলমান প্রজাগণের উৎপীড়ণ-এবং গরু কোরবানীর বিষয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহনশীলতার নিন্দা করেন এবং প্রধান কিছু স্থানে জোর পূর্বক কোরবানী করার প্রস্তাব দেন। সভার সভাপতি শাহ আবুবকর (রঃ) এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংশােধনী প্রস্তাব আনেন যে, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আপােষ মীমাংসায় এই সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। কোথাও গােলযােগ হলে মীমাংসার জন্য উলামারা ঘটনাস্থলে যাবেন। (১৪) শাহ আবুবকর (রঃ) সকল সময় দ্বন্দ্ব, বিবাদ, হিংসার পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে থেকেছেন। ১৯০৬ সালে হুগলী জেলার উত্তরপাড়া, রিষড়া এলাকায় উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি হলে তৎকালীন উত্তর পাড়ার প্রভাবশালী জমিদার রাজা পিয়ারী মােহনলাল মহাশয় একটি সাম্প্রদায়িক সমপ্রীতির সভা ডাকেন, এই সভায় বিশেষ ভাবে শাহআবুবকর সিদ্দিকী (রঃ)কে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তিনি এই সভায় উপস্থিত হন এবং উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি শান্তির আহ্বান জানালে, অশান্তির কালছায়া দূর হয়ে শান্তি ফিরে আসে।(১৫)
        প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ধর্মকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি ও বিকাশ হলেও, ধর্ম নিষ্ঠা ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। ধর্মের আচার-বিচার ও তত্ত্বের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে তাকে বলা হবে ধর্মনিষ্ঠ। সাম্প্রদায়িকতা হল, ব্যক্তির সেই মনােভাব, যা অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধচারণ ও ক্ষতিসাধনকে সূচীত করে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন – “লােক যে সব শয়তানীর জন্য ধর্মকে নিন্দা করে, ধর্ম সে দোষে মােটেই দোষী নয়। কোন ধর্মই মানুষের উপর অত্যাচার করেনি .... কোন ধর্মই এই ধরনের অন্যায় কাজের সমর্থন করেনি। ... রাজনীতিই এইসব অন্যায় কাজে মানুষকে প্রেরােচিত করেছে। ধর্ম নয়।” (১৬)। | শাহ আবুবকর সিদ্দিকী (রঃ) অপরাধী বা অতি বড় শত্রুকেও ক্ষমা সুন্দর নজরে দেখতেন। তবে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে তার নীতি ছিল আপােষহীন, কারণ ধর্মের নির্মল ধারা ও স্বচ্ছতাকে অক্ষুন্ন রাখাই ছিল তার কর্মময় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।


তথ্য নির্দেশ

১।মাওলানা মুহাম্মাদ বাকীবিল্লাহ সিদ্দিকী (রঃ) জীবন-চরিত’

[প্রকাশক রমজান আলী, আতাইকুলা, পাবনা, দ্বি-সং ২০০৪]পৃ.৭৩;মাওলানা রুহুল আমিন (রঃ) হযরত পীর সাহেব কেবলার বিস্তারিত জীবনী [ মােঃ শরফুল আমিন কর্তৃক প্রকাশিত, বসিরহাট, দ্বি-সং ১৪০৪] পৃ. ২৬৬। ২। মােজাম্মেল হক (কবি), মাওলানা পরিচয় [২৯ নং ক্যানিং স্ট্রীট, গনেশ পুস্তকালয় সূৰ্য কুমার নাথ ও শ্রী গনেশচন্দ্র নাথ কর্তৃক প্রকাশিত, ১৯১৪]পৃ. ২৯-৪০; সৈয়দ আবুল হােসেন (এম. ডি) মােসলেম পতাকা বা তারিখুল ইসলাম (২য় খণ্ড) [সৈয়দ আবুল হাশেম, দরবার প্রেস ৬৩, কলিন স্ট্রীট কলকাতা হইতে মুদ্রিত, ১৯২৪]পৃ.৮০৩; মাওলানা, বাকীবিল্লাহ সিদ্দিকী (রঃ) জীবন-চরিত’ [প্রকাশক, রমজান আলী, পাবনা, ২০০৪] পৃ. ২৬

৩। আবুল হােসেন (সৈয়দ) পূর্বোক্ত, পৃ. ৮০৪; শ্রী অবনী সাহা, মহা পুরুষ কথা’ [জ্যোতি প্রকাশন, কলকাতা ১৯৭৭]প ১৭।

৪। আবুল হােসেন (সৈয়দ) পূর্বোক্ত, পৃ.৮০৪;শ্রীঅবনী সাহা,পূর্বোক্ত, ১৭;মাওলানা, বাকীবিল্লাহ সিদ্দিকী (রঃ)|জীবন-চরিত’ [প্রকাশক রমজান আলী, আতাইকুলা, পাবনা, ২০০৪ পৃ.]২৬; মাওলানা, রুহুল আমিন (রঃ) পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৫। ৫। The Role of Muslim Religious Movments in the Spread of Islam in

Bengal. 'The Muslim Digest' Edit or Mohammad Makki, 100 Brick liela | Road Durban]Vol.23 No. 4, october 1972/P72; শ্রী অবনী সাহা, মহাপুরুষ কথা

(জ্যোতি প্রকাশন, ২এ নবীন কুণ্ডু লেন, কলিকাতা, ১৯৭৭) পৃ. ১৭; মাওলানা, রুহুল আমিন (রঃ), পূর্বোক্ত, | ২৫৫; আবদুস ছাত্তার, জীবন-চরিত’ [আবদুল্লাহ প্রিন্টার্স এণ্ড পাবলিশার্স, ঢাকা, তৃ-সং ২০০৩ পৃ.৫৬। ৬। Islam in Modern Bengal' by Benoy Gopal Ray Published in the visvabharati Duarterly' vo 21' in the year 1955.

৭। শ্রী সুধীর কুমার মিত্র, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’ (২য় খণ্ড) (মণ্ডল বুক হাউস, ৭৮/১মহাত্মা গান্ধী। | রােড,কলিকাতা, ১৯৬২]পৃ.১৩০১। 

৮।মাওলানা রুহুল আমিন (রঃ), পূর্বোক্ত, ৮২; মােজাম্মেল হক(কবি) পূর্বোক্ত, ৪০।

৯। সুলতান’৮ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা (১৩৩০) 

১০।নুরুল ইসলাম, পত্র সাহিত্যে ডঃ মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ’(ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৭) পৃ. ৪৬-৪৭। ১১। ইসলাম-দর্শন’(১৯২০)১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা। ১২। শরিয়ত’(১৯২৪) ১মবর্ষ, ৯মসংখ্যা (১৩৩১)।

১৩। চৌধুরী মােঃ বদরুদ্দোজা, জেলা পাবনার ইতিহাস’ ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৬; মুহাম্মাদ তালিব (অধ্যাপক) ‘পাবনার ইসলাম’ [ইসলমিক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা, ১৯৯৬]পৃ.৭২ 

১৪। সাপ্তাহিক ছােলতান’৮ম বর্ষ, ২৮শে মার্চ ১৯২৪। ১৫। দিমুসলমান’ ১৬ই অক্টোবর, ১৯০৮;আবুল হােসেন,(সৈয়দ) পূর্বোক্ত, পৃ. ৮০৪। ১৬। তপন কুমার চট্টোপাধ্যায় (অধ্যাপক) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' (প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, ২০১২)পৃ. ২৬-২৭। SKMEHRAJULISLAM (আলাপ) ০৮:২১, ১৪ অক্টোবর ২০১৯ (ইউটিসি)উত্তর দিন