বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস
বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত; যা পূর্বে প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে গড়ে উঠে মগধ রাজ্যের (যা বর্তমানে ভারতের বিহার প্রদেশ) চারদিকে প্রচারিত হয়েছিলো। বৌদ্ধ ধর্ম অস্তিত্ব মূলত সিদ্ধার্থ গৌতমের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে। বৌদ্ধ ধর্ম আজ পালনকৃত প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে একটি। বৌদ্ধ ধর্মের সূত্রপাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অব্দি ছড়িয়ে পরে। এক সময় এই ধর্ম পুরো এশিয়া মহাদেশের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস নানা ধরনের ভাববাদি আন্দোলনের উন্নয়ন যেমনঃ থেরবাদ, মহাযান ও বজ্রযানের মতো বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য শাখার উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে চিহ্নিত।
সিদ্ধার্থ গৌতম ইতিহাস
সম্পাদনাসিদ্ধার্থ গৌতম বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি শাক্য রাজবংশের এক ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ পরিবারে রাজপুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে এখনও অনেক ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।[১] কিন্তু অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তাগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেনই যে, ৪০০ খৃষ্টপূর্বের কিছু দশক আগে বুদ্ধ মারা গিয়েছিলেন।[২] তাঁর শাক্য-ক্ষত্রিয় বংশের পরিবারগণ ব্রাহ্মণ গোত্রের ছিল, যা তাঁর পরিবার কর্তৃক প্রদানকৃত নাম "গৌতম" দ্বারা নির্দেশিত। ঊনবিংশ শতাব্দির পণ্ডিত এইতেল-এর মতে, সিদ্ধার্থ গৌতমের নাম গৌতম শব্দটি এক ব্রহ্মর্ষি গৌতম থেকে অনুপ্রাণীত।[৩] অনেক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত আছে যে, বৌদ্ধ ছিলেন ব্রহ্মর্ষি অঙ্গিরসের বংশধর।[৪] উদাহরণস্বরূপঃ পালি মহাভাগ্য অঙ্গিরস গ্রন্থে বুদ্ধকে অঙ্গিরস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে যা মূলত গৌতম বুদ্ধ-কে অঙ্গিরস-সম্প্রদায়ভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে।[৫] লেখক এবং ইতিহাসবেত্তা এডওয়ার্ড জে. থমাসও বুদ্ধকে ব্রহ্মর্ষি গৌতম এবং অঙ্গিরসের বংশধর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[৬]
বৌদ্ধ পরম্পরাগত মতবাদানুযায়ী, সন্ন্যাসী জীবনযাপন ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতম ভোগপরায়ণতা এবং স্ব-রিপুদমনের একটি সংযমী পথ আবিষ্কার করেছিলেন।
সিদ্ধার্থ গৌতম সিদ্ধিলাভ করেছিলেন মূলত একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে যেটি বর্তমানে ভারতের বুদ্ধ গয়ায় বোধি বৃক্ষ হিসেবে পরিচিত। সিদ্ধিলাভের পর থেকে গৌতম বুদ্ধ "সম্যকসমবুদ্ধ" বা "আলোকিত ব্যক্তিত্ব" হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিল।
তৎকালীন মগধ রাজ্যের সম্রাট বিম্বিসারের শাসনামলে বৌদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। সম্রাট বিম্বিসার তাঁর ব্যক্তিগত ধর্মীয়-বিশ্বাস হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর রাজ্যে অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের আদেশ প্রদান করেছিলেন। আর এই বিহারগুলোই বর্তমান ভারতের বিহার অঙ্গ-রাজ্যের নামকরণে ভূমিকা রেখেছিল।[৭]
উত্তর ভারতের বারাণসীর বর্তমান হরিণ-পার্ক নামক জায়গাটিতে বৌদ্ধ তাঁর পাঁচ-সঙ্গীকে প্রথম ধর্মদেশনা প্রদান করেছিল। বুদ্ধ সহ তাঁর এই পাঁচ সন্ন্যাস সহচর মিলে প্রথম সংঘ (ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের দ্বারা গঠিত সম্প্রদায়) গঠন করেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ-গ্রন্থ অনুযায়ী,[৮] প্রাথমিক অনিচ্ছা থাকার সত্ত্বেও গৌতম বুদ্ধ পরে সন্ন্যাসীনিদেরও সংঘের আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনিদের "ভিক্ষুণী" হিসেবে অভিহিত করা হয়।[৯][১০] বুদ্ধের মাসি এবং তাঁর সৎ-মা মহাপজাপতি গোতমী ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম ভিক্ষুণী। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে তিনি ভিক্ষুণী হিসেবে সন্ন্যাস পদ গ্রহণ করেন।[১১][১১][১২]
জানা যায়, বুদ্ধ তাঁর অবশিষ্ট জীবনের বছরগুলোতে ভারতের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলগুলোতে পরিভ্রমণ করেন।
বুদ্ধ কুশীনগরের পরিত্যাক্ত এক জঙ্গলে দেহত্যাগ বা মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। মারা যাওয়ার পূর্বে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলে গিয়েছিলেন যে, তাঁর প্রচার করা ধর্মীয়দেশনাই হবে তাদের শাস্তা যা তাদের দিক-নির্দেশনা প্রদানে সহায়তা করবে। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর হতে বুদ্ধবাণীকে সংরক্ষণের জন্য শত শত অরহত পণ্ডিত ভিক্ষু তিনটি সঙ্গায়নের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক সংকলিত হয়েছে।
বৌদ্ধ-ধর্মের প্রারম্ভিক সময়
সম্পাদনাবৌদ্ধ ধর্ম পূর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরে এই প্রাচীন ভূ-খন্ড থেকে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মীয় শাস্ত্রের উৎসগুলো দুইটি ধর্মীয় মহাসঙ্গীতি সংরক্ষণ করেন, যার একটি হলো বুদ্ধের পাঠগত শিক্ষা সংরক্ষণের জন্য সন্ন্যাসী সংঘ ও আরেকটি হলো সংঘের অভ্যন্তরীণ নিয়মানুবর্তিতামুলক সমস্যাগুলো সমাধানের উপায়সমূহ।
১ম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দি)
সম্পাদনাপ্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি গঠিত হয় বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পর অর্থাৎ বুদ্ধের দেহত্যাগের পর। খৃষ্ট-পূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে মহাকাশ্যপ নামক বুদ্ধের একজন কাছের শিষ্যের তত্ত্বাবধানে এবং রাজা অজাতশত্রুর সমর্থনে এই প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি গঠিত হয়। এই মহাসঙ্গীতি গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধের মুখ-নিঃসৃত বাণীগুলোকে মতবাদ-সংক্রান্ত শিক্ষায় (তথা সূত্রে) এবং অভিধর্মে রূপান্ততরিত করা এবং বৌদ্ধের সন্ন্যাসগত নিয়ামাবলীকে লিপিবদ্ধ করা। এই মহাসঙ্গীতি বৌদ্ধের খুড়তুতো ভাই এবং তাঁর প্রধান শিষ্য আনন্দকে ডাকা হয় বুদ্ধের উপদেশ এবং অভিধর্ম আবৃত্তি করার জন্য এবং বুদ্ধের আরেক প্রধান শিষ্য উপালি কে বলা হয় বিনয়ের সূত্রসমূহ পাঠ করার জন্য। এগুলোই মূলত ত্রিপিটকের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচয় লাভ পায় যেগুলো পালি ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়।
তবে প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতিতে অভিধর্মের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ নেই। এটি শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাসঙ্গীতির পরই অস্তিত্ব লাভ করে।
২য় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (খৃষ্ট-পূর্ব ৪র্থ শতাব্দি)
সম্পাদনাদ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয় বৈশালিতে যেটি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিয়ম-শৃংখলার বিভিন্ন বিষয়ের শিথিলকরণের বিতর্ক থেকে উত্থান হয়েছিল। প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতিতে মূল বিনয় গ্রন্থের সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শিথিলকরণসমূহের কারণগুলো বুদ্ধের শিক্ষার পরিপন্থী হওয়ায় দ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির আবির্ভাবের কারণ হয়ে উঠে।
সম্রাট অশোকের ধর্মান্তরীকরণ (খৃষ্টপূর্ব ২৬১ অব্দে)
সম্পাদনামৌর্য্য সাম্রাজ্যের সম্রাট অশোক (২৭৩ - ২৩২ খৃষ্ট-পূর্ব) প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কলিঙ্গ রাজ্যের (বর্তমান ভারতের ওড়িশা প্রদেশ) রক্তাক্ত বিজয়ের পর বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। ভয়াবহ কলিঙ্গ যুদ্ধ যে আতঙ্ক ও দূর্বিপাক সৃষ্টি করেছিল, সেইসব বিষয় নিয়ে অনুতপ্ত হয়ে সম্রাট অশোক সহিংসতা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং মহানুভবতার সাথে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট কলিঙ্গ রাজ্যের জনগণের দুঃখ দূর্দশাকে সম্মান এবং যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেন। সম্রাট স্তুপ এবং স্তম্ভ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারকার্য শুরু করেন এবং পশু-পাখিদের প্রতি দয়াশীল এবং মানুষের জীবনযাপনকে ধর্মমুখী করার জন্য তাঁর ধর্ম-প্রচারের মাধ্যমে আহ্বান করতে থাকেন। তাঁর নির্মাণকৃত স্তুপগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের অঙ্গরাজ্যে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে অবস্থিত সাঁচী স্তুপ। এটার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল খৃষ্ট-পূর্ব ৩য় শতাব্দীতে এবং পরবর্তীতে এটার নির্মাণ কাজ আরো সম্প্রসারণ করা হয়। এই স্তুপের উৎকীর্ণ ফটক যেটি তোরণ নামে পরিচিত, মূলত ভারতে বৌদ্ধ শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্রাট এছাড়াও পুরো দেশ জুড়ে অনেক রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, পান্থশালা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি তাঁর প্রজাদের ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাত, রাজনীতি নির্বিশেষে সমান আচরণ করতেন।
সম্রাট অশোকের আমলেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারতের বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে পরে। অশোকের স্থম্ভ ও স্তুপ থেকে জানা যায়, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্যে সম্রাট তাঁর প্রতিনিধিদের ভারতের দক্ষিণের দিকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত, পশ্চিমের গ্রীক-সাম্রাজ্যে, বিশেষ করে প্রতিবেশী গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্য এবং সম্ভবত ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।
৩য় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (খৃষ্ট-পূর্ব ২৫০ অব্দে)
সম্পাদনাসম্রাট অশোক খৃষ্ট-পূর্ব ২৫০ অব্দে পাটালিপুত্রে (বর্তমান ভারতের বিহার অঙ্গরারাজ্যের রাজধানী পাটনায়) ৩য় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির আহ্বান করেন। এই ৩য় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতির তত্ত্বাবধান করেছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মোগ্গলিপুত্র তিষ্য। এই মহাসঙ্গীতির উদ্দেশ্য ছিল সংঘের শুদ্ধিকরণ, বিশেষ করে অ-বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যারা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আকৃষ্ট ছিল। ৩য় মহাসঙ্গীতির মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ মিশনারী পৃথিবীর অন্যত্র প্রচার হতে থাকে।
হেলেনিস্টিক বিশ্ব
সম্পাদনাঅশোকের কিছু স্থম্ভ থেকে জানা যায় যে, বৌদ্ধ বিশ্বাস হেলেনিস্টিক বিশ্বে প্রচারের জন্য তিনি যে কার্য-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তা ভারতের সীমানা পেড়িয়ে সুদূর গ্রিস অব্দি ছড়িয়ে পরেছিল। পাশাপাশি অশোকের স্তম্ভ থেকে হেলেনিস্টিক অঞ্চলের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রাচীন গ্রীকের রাজাদের নাম এবং তাদের রাজ্যের অবস্থান এবং এমনকি কিছু গ্রিক সম্রাট যেমনঃ সেল্যুসিড সাম্রাজ্যের "এন্টিওকাস ২য় থিউওস" (২৬১-২৪৬ খৃষ্ট-পূর্ব), মিশর সাম্রাজ্যের তৎকালীন অধিপতী "টলেমি ২য় ফিলাডেলফোস" (২৮৫-২৪৭ খৃষ্ট-পূর্ব), ম্যাকাডোনিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট "অ্যান্টিগোনাস গোনাটাস" (২৭৬-২৩৯ খৃষ্ট-পূর্ব), সিরেনেইকা (বর্তমান লিবিয়া) সাম্রাজ্যের "মাগাস" (২৮৮-২৫৮ খৃষ্ট-পূর্ব) এবং এপিরাস (বর্তমান গ্রীসের উত্তর-পশ্চিমাংশ) সাম্রাজ্যের "অ্যালেক্সান্ডার ২য়" (২৭২-২৫৫ খৃষ্ট-পূর্ব) প্রমুখ সম্রাটেরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে দাবী করা হয়।
- "সীমানা পেরিয়ে, ছয়শত যোজন দূরে (৫,৪০০-৯৬০০ কি.মি.) সেখানেই ধর্মের বিজয় সাধিত হয়েছে যেখানে গ্রিক সম্রাট অ্যান্টিওকোস, টলেমি, অ্যান্টিগোনোস, মাগাস এবং অ্যালেক্সান্ডার এবং দক্ষিণে চোল সাম্রাজ্য, পান্ড রাজবংশ, তাম্রপার্নি (বর্তমান শ্রী-লঙ্কা) শাসন বিস্তৃত"। (ত্রয়োদশ শতাব্দির শিলালিপিতে পাওয়া অশোকের অনুশাসন)
পালি সূত্র থেকে আরো জানা যায় যে, সম্রাট অশোকের কিছু প্রতিনিধিরা গ্রিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিলেন যারা দুই উপমহাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখতেনঃ
- "যখন জ্যেষ্ঠ মোগ্গলিপুত্ত, ধর্মের শিখাদীপ প্রজ্জ্বলনকারি সম্রাট অশোক ৩য় মহাসঙ্গীতির সমাপ্তি ঘটান, তখন তিনি তাঁর এক গ্রিক বৌদ্ধ সন্ন্যসী চতুর্থ থের - কে [[ধর্মরক্ষিত]] নামের এক বৌদ্ধ মিশনারীর অধীনে অপারন্তকায় (গুজরাট ও সিন্ধু) প্রেরণ করেন।"
অশোক এছাড়াও গ্রীক এবং আর্মাইক ভাষায় তাঁর ধর্ম-স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন যেগুলো আফগানিস্তানের কান্দাহারে পাওয়া গিয়েছিল। গ্রিক সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের জন্য তিনি গ্রিক শব্দ "eusebeia" কে ধর্ম শব্দের প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহার করেনঃ
- "রাজত্বের দশ বছরের সময়কালে, সম্রাট Piodasses (অশোক) মতবাদ কে (বৌদ্ধ বিশ্বাসকে) মানুষদের কাছে ভক্তি-পূর্ণ রূপে তুলে ধরেছেন। এবং সেই থেকে তিনি মানুষদের আরো ধার্মিক (গ্রীক শব্দ: εὐσέβεια, eusebeia) করে তুলেন এবং সমগ্র পৃথিবীতে উন্নতি লাভে সচেষ্ট করে তুলেন।"
(জি.পি. কারাটেলি কর্তৃক মূল গ্রিক অংশ হতে অনুবাদকৃত)[১৩]
এট স্পষ্টত নয় যে, সাংস্কৃতির এই পারষ্পরিক আন্তঃক্রিয়া বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। তবে কিছু লেখকের মতে ধর্ম-প্রচারে হ্যালিনিস্ট চিন্ত-ভাবনা ও বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে এই সমন্বয় প্রচেষ্টা সেই সময় গ্রীসের দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। সেই সব লেখকগণ আরো উল্লেখ করেছিলেন যে সেই সময়ে হ্যালেনিস্টিক বিশ্বে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল, বিশেষত আলেক্সান্দ্রিয়া (আলেক্সান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ট দ্বারা উল্লেখিত) ও বিশেষ করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার খৃষ্ট-পূর্ববর্তী থেরাপুটি ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে[১৪] যারা হয়তো পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সন্ন্যাস জীবনযাপন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল[১৫] এবং এছাড়াও এদের পশ্চিমে সম্রাট অশোকের ধর্মীয় প্রতিনিধিদের বংশধর হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এছাড়া সাইরিনের দার্শনিক হেজেসিসের মতে, সাইরিন সাম্রাজ্যের সম্রাট মাগাসের শাসনামলে অশোকের বৌদ্ধ মিশনারীদের প্রভাব ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।[১৬]
এছাড়াও টলেমিক সাম্রাজ্যের সময়কালীন বৌদ্ধ ধর্মের যে শিলালিপি পাওয়া যায়, তাও মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে উদ্ধার হয়, ধর্ম-চক্রের সাথে সাজানো রয়েছে।[১৭] খৃষ্ট-পরবর্তী ২য় শতাব্দিতে ব্যাকট্রিয়ানের বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং ভারতীয় উলঙ্গ সন্ন্যাসীদের খৃষ্টান পাদ্রী ও গোড়ামীবাদি আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ট তাদের গ্রিক চিন্তা-ভাবনা ও দর্শনে অবদান রেখেছিল বলে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
- "এভাবেই দর্শন, সর্বোচ্চ উপযোগী একটি জিনিস, যা বিকশিত হয় প্রাচীনত্বের বর্বরদের হাত ধরে, জাতির উপর তাদের আলো প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে। এবং পরবর্তীতে তারা গ্রীসেও এসেছিল। তাদের প্রথম সারীর পদগুলোতে মিশরের ভাববাদিরা ছিল; এবং অ্যাসাইরানদের মধ্যে ছিল কাল্ডিয়া-রা; গল-দের মধে ছিল ড্রুইড-রা; ব্যাকট্রিয়ানদের মধ্যে ছিল শ্রমণরা; ছিল সেল্টিক সভ্যতার দার্শনিকরা; এছাড়াও ছিল পারস্যের জোরোয়াস্ট্রিনরা যারা প্রভু যীশুর আগমনী বার্তা ভবিষ্যত বাণী করেছিল এবং তারা জুডার ভূ-খণ্ডে এসেছিল। ভারতের উলঙ্গ সন্ন্যাসী ও অন্যান্য দার্শনিকরাও এদের মধ্যে ছিল। এবং ভারতীয় উপমহাদেশের এই লোকগুলোর মধ্যে দুইটি শ্রেণী বিদ্যমান ছিল। একটি ছিল শ্রমণ সম্প্রদায় আর আরেকটি ছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়।" - আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ট।
(বইঃ The Stromata, or Miscellanies, চাপ্টারঃ ১৫)[১৮]
শ্রীলঙ্কা ও বার্মায় বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারণ
সম্পাদনাশ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারিত হয়েছিল খৃষ্ট-পূর্ব ৩য় অব্দে, সম্রাট অশোক পুত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু মাহিন্দ ও তাঁর ছয় সহচরের সহায়তায়। তাঁরা শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রাজা দেবানাপিয়া টিস্সা ও রাজ্যের আরো অভিজাত শ্রেণীর লোকদের বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করেন। পাশাপাশি সম্রাট অশোকের মেয়ে সংঘমিত্রাও শ্রীলঙ্কায় মেয়ে-সন্ন্যাসীন্নিদের প্রথা চালু করেন। এছাড়াও অশোক তনয়া তাঁর সাথে একটি বোধি বৃক্ষের চারা গাছও নিয়ে এসেছিলেন এবং সেটি শ্রীলঙ্কা অনুরাধাপুরাতে রোপণ করেছিলেন। সেখানেই মূ্লত মহাবিহার নামক সিংহলিদের প্রাচীন মঠ অবস্থিত। মূলত শ্রীলঙ্কায় পালি ভাষায় ধর্ম-সূত্রগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছিল রাজা ভট্টগমনীর শাসনামলে (২৯-১৭ খৃষ্ট-পূর্ব) এবং থেরবাদ ভক্তি আন্দোলন মূলত সেখানে থেকেই বিকশিত হয়েছিল। বুদ্ধঘোষ (৪র্থ ও ৫ম শতাব্দি) ও ধর্মপালের (৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দি) মতো অনেক প্রখ্যাত বুদ্ধ সন্ন্যাসী থেরবাদ ভক্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল এবং তারা এই মতাদর্শের অনেক নিয়মাবলীও প্রণয়ন করেছিল। যদিও মহাযান বৌদ্ধ শাখা শ্রীলঙ্কায় বেশ অনেক সময় অব্দি প্রভাব বিস্তার করেছিল, তথাপি শ্রীলঙ্কায় পরবর্তীকালে থেরবাদ-ই স্থায়ী হয় এবং এটি এখনও পালন করা হয়। শ্রীলঙ্কা থেকে পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্ম একাদশ শতাব্দিতে ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশগুলোতে প্রচার হতে থাকে।
ভারতীয় উপমহাদেশের একেবারে পূর্বে বার্মা ও থাইল্যান্ডের মানুষজনদের মাঝেও বৌদ্ধ ধর্মের দরুন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষ লক্ষ্যণীয়। বৌদ্ধ ধর্মের দুই শাখা মহাযান ও হীনযান বিভক্তির পূর্বে খৃষ্ট-পূর্ব ৪র্থ শতাব্দিতে থাইল্যান্ড ও বার্মার লোকেরা সম্রাট অশোকের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। খৃষ্ট-পূর্ব ১ম থেকে ৫ম শতাব্দিতে নির্মিত মধ্য মিয়ানমারে অবস্থিত প্রাচীন বার্মিজ বুদ্ধ মন্দির "পেইকথানো" হলো মিয়ানমারে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের নিদর্শন।
থাইল্যান্ড ও বার্মায় যে বৌদ্ধ শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় তা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের গুপ্ত সাম্রাজ্যের চিত্র শিল্প কর্তৃক প্রভাবিত। পাশাপাশি তাদের বিশেষ শিল্প ধারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আরো ছড়িয়ে পরে যখন ৫ম থেকে ৮ম শতাব্দিতে মোন গোত্রের লোকদের (থাইল্যান্ড ও বার্মিজ মানুষ) সাম্রাজ্য আরো বিস্তার লাভ করে। খৃষ্ট-পরবর্তী ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে মহাযান শাখা প্রভাব বিস্তারের পূর্বে থেরবাদ বিশ্বাস মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তরাংশে মোন জাতিগোষ্ঠীর কারণেই আরো বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। অশোকাবদান (খৃষ্টপরবর্তী ২য় শতাব্দি) থেকে জানা যায় যে, সম্রাট অশোক উত্তরে হিমালয়ের দিকেও একটি বৌদ্ধ মিশনারী প্রেরণ করেন যারা খোতান, তারিম বাসিন, ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাভাষি তুষারি লোকদের মাঝেও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন।
শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান (খৃষ্টপূর্ব ২য় - ১ম অব্দ)
সম্পাদনাসম্রাট অশোকের মৃত্যুর ৫০ বছর পর শুঙ্গ রাজবংশ (১৮৫-৭৩ খৃষ্টপূর্ব) ১৮৫ খৃষ্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথ মৌর্য্য কে হত্যার মধ্য দিয়ে সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ সিংহাসন আরোহণ করেন। অশোকাবদানের মতো বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে গোঁড়া ব্রাহ্মণ পুষ্যমিত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরোধী ছিলেন এবং বৌদ্ধ-বিশ্বাসীরা তাঁর শাসনামলে নির্যাতিত হয়েহিল। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে আরো উল্লেখ আছে যে, তিনি শত শত বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস করেছিলেন এবং হাজারের উপর বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হত্যা করেছিলেন।[১৯] ৮৪,০০০ বুদ্ধ-স্তূপ যা সম্রাট অশোক কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল, তা রাজা পুষ্যমিত্র ধ্বংস করে ফেলেন এবং প্রত্যকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মাথার বিনিময়ে তিনি ১০০টি স্বর্ণ মুদ্রা প্রদানের পুরস্কার ঘোষণা করেন।[২০] এর পাশাপাশি অন্যান্য বৌদ্ধ সূত্রগুলো আরো দাবী করে যে, রাজা পুষ্যমিত্র নালন্দা, বুদ্ধগয়া, সারনাথ ও মথুরার মতো স্থানগুলোতে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারগুলোকে হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। কিন্তু আধুনিক ইতিহাসবেত্তাগণ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের নিরিখে উপরিউক্ত তথ্যগুলোর সাথে তাদের মতবিরোধ প্রকাশ করেন। তাদের মতামত অনুযায়ী, অশোকের বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকার দরুন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার-প্রসারে ভাটা পরেছিল ঠিক, কিন্তু পুষ্যমিত্র কর্তৃক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর সক্রিয় নির্যাতনের প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পাওয়া যায় নি। বেলজিয়া পাদ্রী এবং গ্রিক ভাষার প্রভাষক এতিয়ান লেমোতের ভাষ্যানুযায়ী "নথি থেকে বিচার করতে গেলে দেখা যায়, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে পুষ্যমিত্রকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।"।[২১] কিন্তু অন্য দিকে ভারতের জাওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও ইতিহাসবেত্তা রোমিলা থাপর এতিয়ান লেমোত ও অন্যান্য পাশ্চাত্য ইতিহাসবেত্তাদের মতামত নিয়ে দ্বি-মত পোষণ করেন। রোমিলা থাপরের ভাষ্যমতে "পুশ্যমিত্র ছিলেন একজন ধর্মান্ধ বৌদ্ধ-বিদ্বেষী"। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, "বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থের দাবী অনুযায়ী পুষ্যমিত্র আসলে ৮,৪০,০০০ অশোক স্তূপ ধ্বংস করেন নি।"। থাপার আরো বিশদভাবে বলেন যে, পুষ্যমিত্র কর্তৃক মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্যই বৌদ্ধ সূত্রগুলো তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছিল বাড়তি তথ্যগুলো অতিঃরঞ্জিত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে।[২২]
সেই সময় পুষ্যমিত্রের শাসনামলে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা গাঙ্গেয় উপত্যকা ছেড়ে কেউ কেউ উত্তরের দিকে আর কেউ বা দক্ষিণের দিকে যাত্রা করেন। বিপরীতক্রমে, বৌদ্ধ শিল্প মগধ রাজ্যে বিকশিত হওয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং মগধ ছেড়ে তা উত্তর পশ্চিমাংশের গান্ধার ও মথুরাতে এবং দক্ষিণ-পূর্বের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের অমরাবতীতে বিকাশ লাভ করে। এছাড়াও কিছু বৌদ্ধ শিল্প পুষ্যমিত্রের শাসনামলে মধ্য ভারতের ভারহুত অঞ্চলেও বিকশিত হয়েছিল।
গ্রেকো-বৌদ্ধ আন্তঃক্রিয়া (খৃষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দি - খৃষ্টপরবর্তী ১ম শতাব্দি)
সম্পাদনারেশম পথ (সিল্ক রোড) সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই ভারত ও চীনের মধ্যে গঠিত আন্তঃসড়ক মূলত আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে সম্রাট আলেক্সান্ডারের বিজয়ের পর থেকেই গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। প্রথমে ছিল সেল্যুসিড সাম্রাজ্য যার আনুমানিক সময়কাল খৃষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে, তারপর গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্য যার সময়কাল খৃষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দ, এবং সর্বশেষে ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্য যা খৃষ্টপূর্ব ১০ শতাব্দির আগ পর্যন্ত টিকে ছিল।
গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্যের রাজা ব্যাক্ট্রিয়ার প্রথম দেমেত্রিওস ১৮০ খৃষ্টপূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণ করে ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল। আক্রমণের পরেই ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম আবার বিকশিত হতে থাকে এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ গ্রন্থে কারণ হিসেবে পাওয়া যায় যে, মৌর্য্য সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য এবং শুঙ্গ রাজবংশের নির্যাতন থেকে বৌদ্ধদের রক্ষার জন্যই এই আক্রমণ করা হয়। ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজা ছিল প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের (১৬০-১৩৫ খৃষ্টপূর্ব) যিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং মহাযান বৌদ্ধ শাখায় তাকে বৌদ্ধ ধর্মের হিতকারি হিসেবে সম্রাট অশোক ও সম্রাট কণিষ্কের সমতুল্য হিসেবে অভিহিত করেন। মেনাদ্রোসের শাসনামলে তার রাজ্যের মুদ্রায় তাকে "পরিত্রাণকারি রাজা" হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং কিছু মুদ্রায় আটটি কাঁটা বিশিষ্ট ধর্ম-চক্রেরও হদিস পাওয়া যায়। এছাড়া মিলিন্দপঞ্হ এর মতো বৌদ্ধ ধর্ম-গ্রন্থেও সাংস্কৃতিক আন্তঃক্রিয়ার হদিস পাওয়া যায় যেখানে মহারাজ মেনান্দ্রোস ও বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের (যিনি ছিলেন গ্রিক বৌদ্ধ-ভিক্ষু মহাধর্মরক্ষিতার শিষ্য) মধ্যে কথোপকথনের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা মেনান্দ্রোসের মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ তাঁর শাসনকৃত শহরে অবস্থিত স্তুপগুলোতে তাঁর সম্মানার্থে সংরক্ষণ করা হয়।[২৩] মেনান্দ্রোসের অন্যান্য উত্তরসূরীগণ তাদের শাসনামলে মূদ্রায় খরোষ্ঠী লিপিতে ধর্মদেশনা লিপিবদ্ধ করেন এবং মুদ্রা সঙ্গীতে তাদের নিজ নিজ গুণাবলী বর্ণনা করেন।
বুদ্ধের প্রথম নরত্বারোপমূলক উপস্থাপনার বা মূর্তির হদিস পাওয়া যায় গ্রীক-বৌদ্ধ শাসনামলে। বুদ্ধের নরত্বারোপমূলক উপস্থাপনার প্রতি অনীহা মূলত বুদ্ধের বাণীর সাথে সম্পর্কযুক্ত যেটি দিঘা নিকায়ার মতো বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ আছে, যেখানে বুদ্ধ বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাকে যেন কোন রূপ মূর্তি বানিয়ে বা চিত্র এঁকে উপস্থাপন করা না হয়।[২৪] এসব বিধি-নিষেধ পালনে প্রয়োজনীয়তা অনুভূত না করে এবং সম্ভবত তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির প্রভাবের বশীভূত হয়েই গ্রীকরা প্রথম বৌদ্ধের ভাষ্কর্য নির্মাণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। প্রাচীন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, গ্রীকরা বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয়ে যে দেব-দেবী সমূহের রূপায়ণ করেছিলেন তা কালক্রমে বিভিন্ন বিশ্বাসী মানুষদের মাঝে সাধারণ ধর্মীয় অনুশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠে। এটির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো বিভিন্ন বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে গড়ে উঠা দেবতা স্যারাপিসের রূপায়ণ যা টলেমি প্রথম এর শাসনামলে মিশরে পরিচয় লাভ পায় যা মূলত গ্রিক ও মিশরীয়, উভয় ঈশ্বরদেরই সমন্বয়ের ফলস্বরূপ। তাই ভারতের মতো স্থানে গ্রীকদের একটি মহাপুরুষের রূপায়ণ প্রচেষ্টায় হাত দেওয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার যা তাঁরা করেছিল তাদের পূর্ববর্তী ধর্মের সূর্য দেবতা অ্যাপোলো অথবা ইন্দো--গ্রীক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাক্ট্রিয়ার প্রথম দেমেত্রিওস এর শারীরিক গঠন থেকে অনুপ্রাণীত হয়ে, যা পরবর্তীতে গ্রীকরা বুদ্ধের ভৌত-বৈশিষ্ট্য গঠনে প্রতিফলন করেন। মূলত দুই কাঁধ ঢেকে বুদ্ধের কাপড়ের পরিহিত অবস্থায় যে মূর্তি আমরা দেখতে পাই তা প্রাচীন গ্রীক-রোমান সাম্রাজ্যে পরিহিত এক ধরনের গ্রিক ঐতিহ্যগত পোশাক টোগা ও হিমাশনের সমতুল্য বলে অনেক ইতিহাসবেত্তাগণ মনে করেন।[২৫] এছাড়া বুদ্ধের কোঁকাড়ানো চুল এবং উষ্ণীষ (মাথার উপর ডিম্বাকৃতি চুলের ঝুঁটি) মূলত ভাষ্কর্য বেলভেদের অ্যাপোলো এর অনুকরণে রূপায়িত হয়েছে বলে মনে করা হয়। ভারত ও হেলেনিস্টিক শাসনামলে নির্মিত বুদ্ধের ভাষ্কর্য সমূহের একটি বড় অংশই আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরের গান্ধার অঞ্চলের হাজ্জা নামক জায়গাটিতে মাটি খুঁড়ে ভাষ্কর্যগুলোর সন্ধান পাওয়া যায়।
এছাড়াও গ্রীক-বৌদ্ধ শাসনামলে আন্তঃসাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয় গ্রিক ভিক্ষু মহাধর্মরক্ষিত কে যিনি জাতিতে ছিলেন গ্রিক এবং মহাবংশ গ্রন্থের ২৯তম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে রাজা মেনান্দ্রোস প্রথমের শাসনামলে (খৃষ্টপূর্ব ১৬৫- খৃষ্টপূর্ব ১৩৫) ভিক্ষু মহাধর্মরক্ষিতের অধীনে গ্রিক ঔপনিবেশিক শহর আলাসান্দ্রা (যা বর্তমানে ১৫০ কি.মি. জায়গা জুড়ে কাবুলের উত্তরে অবস্থিত) থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত প্রায় ৩০,০০০ এর মতো তাঁর বৌদ্ধ শিষ্য ছিল, যা ছিল মূলত সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের অবদান হিসেবে দেখা হয়।
মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের সম্প্রসারণ
সম্পাদনাআফগানিস্তানের তিলিয়া তেপের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে খৃষ্ট-পরবর্তী ১ম শতাব্দির একটি বৌদ্ধ মুদ্রার হদিস পাওয়া যায় যেটি প্রাচীন ভারতের বলে জানা যায়। মুদ্রাটির বিপরীত পিঠে একটি চলন্ত সিংহকে দেখা যায় যার সম্মুখভাগে নন্দিপদ (ষাঁড়ের খুর সংবলিত এক ধরনের প্রাচীন প্রতীক) রয়েছে এবং সেখানে খরোষ্ঠী লিপিতে সিংহটিকে বর্ণনা করা হয়েছে "Sih[o] vigatabhay[o]" হিসেবে, যার মানে হলো "যে সিংহ ভয় দূরীভূত করে"।
বৌদ্ধ ধর্মে মহাযান শাখায় বুদ্ধকে সিংহ, হাতি, ঘোড়া এবং ষাঁড়ের মতো প্রাণীদের দ্বারা প্রতিকায়িত করা হয়। এছাড়া জোড়া পায়ের পাতা দিয়েও অনেক সময় বুদ্ধের স্বরূপকে বুঝানো হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তারা এই প্রতীকগুলোকে নন্দিপদ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এগুলো আসলে বিভিন্ন প্রতীকের একটি যৌগিক সংমিশ্রণ বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রতীকের উপরের অংশ মূলত বৌদ্ধ ধর্মের "মধ্য পন্থাকেই" রূপায়িত করে। প্রতীকের মধ্যভাগের গোলাকৃতি অংশটি দ্বারা বুঝায় "ধর্ম-চক্র"। এইভাবেই পুরো প্রতীকই আসলে ধর্ম-চক্র অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের স্বরূপ-কেই প্রতিনিধিত্ব করে। এইভাবে মুদ্রার দুই পিঠে চিহ্নিত প্রতীক দুইটির সম্মন্বয় রূপ মিলে মূলত বৌদ্ধ ধর্ম-চক্র ঘুরাচ্ছে, এটিই বুঝানো হয়। এভাবেই ভারতের সিংহের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত বারাণসীর সারনাথ শহরে অবস্থিত বৌদ্ধ নিদর্শনের জায়গাগুলোর স্তম্ভে উল্লেখিত সিংহ, হাতি, ঘোড়া ও ষাঁড় কর্তৃক নন্দিপদ ঘুরানো দ্বারা মূলত বুদ্ধের ধর্ম চক্র ঘুরানোর স্বরূপকে প্রতিকায়িত করে। আরও একটি প্রতীক পাওয়া যায় যেখানে একজন ক্লামাইস (বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে পরিহিত সম্রাট ও উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তিদের পোশাক) ও মাথায় একটি কাপড় পরিহিত উলঙ্গ-প্রায় একজন ব্যক্তি ধর্মচক্র আবর্তন করছেন। খরোষ্ঠী লিপিতে এই প্রতীকের বর্ণনাতে বলা হয়েছে, "ধর্মচক্র-প্রাবাতা(কো)" অর্থাৎ "যিনি আইনের ধর্মচক্র ঘুরাচ্ছেন"। এই প্রতীক থেকে এটা বলা হয় যে, এটি বুদ্ধকে নিয়ে উপস্থাপন করা প্রাচীন প্রতীকগুলোর মধ্যে একটি।[২৬]
ক্লামাইস পরিহিত মানুষটির মাথার কাপড় দ্বারা বুঝানো হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম নির্দেশিত মধ্যপথ। এভাবেই মাথার কাপড় পরিহিতা ব্যক্তিদের মূলত মধ্য-পথ অবলম্বনকারি হিসেবে পরিচায়িত করা হয়। একইভাবে সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরে ৯ জন মহিলার হদিস মিলে যাদের মাথাতেও একই ধরনের কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।
এছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তাদের দ্বারা যেহেতু বৌদ্ধ সাহিত্য ও বুদ্ধের শারীরিক প্রতীকের কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয় নি, তাই এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে পাওয়া মুদ্রা, সীল-মোহর এবং অন্যান্য শিলালিপি-তে দেখতে পাওয়া প্রতীকগুলো নিয়ে দেওয়া বর্ণনাগুলোকে অনেক সময় কল্পনা ও ব্যাখ্যার ভুল হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
মহাযানের উত্থান (খৃষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দি - খৃষ্ট-পরবর্তী ২য় শতাব্দি)
সম্পাদনাবেশ কয়েকজন পণ্ডিতদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ[২৭] রাজ্যের কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় বসবাসরত মহাসাংঘিক নামক এক প্রাচীন আদি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের আবির্ভাব হয়েছিল যা প্রাচীন মহাযানের সূত্রগুলোর মধ্যে একটি।[২৮][২৯]
প্রাচীন মহাযান সূত্র হতে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের প্রথম দিককার সংস্করণের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তাতে অক্ষোভ্য বুদ্ধের পরিচয় মিলে, যেটি খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকেই রচিত হয়েছিল।[৩০][৩১] এছাড়া বিখ্যাত ভারতবিদ্যা-বিশারদ এ.কে. ওয়ার্ডও এই অভিমত ব্যাক্ত করেন যে, বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখার উত্থান দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের তৎকালীন অন্ধ্রদেশেই উত্থান ঘটেছিল।[৩২]
পণ্ডিত অ্যান্থোনি বার্বার ও শ্রী পদ্মও একই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, নাগার্জুন, দিগ্নাগ, চন্দ্রকীর্তি, আর্যদেব, ভাববিবেক-এর মতো যেসব বৌদ্ধ পণ্ডিতরা মহাযান শাখায় ভূমিকা রেখেছিল, তাদের সবারই বসবাস ছিল বর্তমান দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে।[৩৩] আর মহাযান শাখার উত্থানের জায়গাগুলো মূলত অন্ধ্রপ্রদেশের কৃষ্ণা উপত্যকার নিচু ভূমি সংবলিত গুন্টুর জেলার অমরাবতী, নাগার্জুনকোন্ডা, জগ্গয়াপেতা-এর মতো অঞ্চলে অবস্থিত। জাপানী ইতিহাসবেত্তা আকিরা হিরাকাওয়াও বলেন, "বিভিন্ন প্রামাণিক দলিলসমূহ এটাই বলে যে, প্রাচীন মহাযান গ্রন্থগুলো দক্ষিণ-ভারতেই সম্ভূত"।[৩৪]
দ্বি-চতুর্থাংশ মহাসঙ্গীতি
সম্পাদনাচতুর্থ মহাসঙ্গীতির উদ্ভব হয় খৃষ্ট-পরবর্তী ১০০ শতকে, কুষাণ সাম্রাজ্যের সম্রাট কণিষ্কের তত্ত্বাবধানে। ধারণা করা হয় যেখানে চতুর্থ মহাসঙ্গীতির উত্থান হয়, সেটি বর্তমানে কাশ্মীরের জলান্ধার নামক জায়গা। থেরবাদ বৌদ্ধ শাখা প্রায় ৪০০ বছর আগে শ্রীলঙ্কাতে পালি ভাষায় তাদের চতুর্থ মহাসঙ্গীতির আয়োজন করেছিল। তাই চতুর্থ মহাসঙ্গীতি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়; যার চারভাগের দুই ভাগ শ্রীলঙ্কাতে আর বাকি দুই ভাগ কাশ্মীরে।
অভিধর্ম নামক বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে এটা জানা যায় যে, সম্রাট কণিষ্ক বসুমিত্রের নেতৃত্বে ৫০০ জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দ্বারা এই চতুর্থ মহাসঙ্গীতির আয়োজন করেন। সেখান থেকে জানা যায় যে, সেই মহাসঙ্গীতিতে তিন লক্ষ শ্লোক এবং নয় মিলিয়ন বক্তব্য সংরক্ষণ করা হয়। এই মহাসঙ্গীতির ফলে সবচেয়ে যে বড় ফলাফল পাওয়া যায় তা হলো, "মহা-বিভাষা" নামক গ্রন্থের সংকলন এবং "সর্বস্তিবধিন অভিধর্মের" সারসংক্ষেপণ রচনা।
বিভিন্ন ভাষাবিদরা এটাও অভিমত করেন যে, এই মহাসঙ্গীতির ফলে "সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম" গ্রন্থের ভাষারূপের পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, যেখানে প্রাকৃত ভাষা থেকে এটিকে সংস্কৃত ভাষায় পরিবর্তন করা হয়েছিল। ভাষারূপের পরিবর্তন সাধিত হলেও ধর্মীয়-গ্রন্থটির মূল উপজীব্য হারিয়ে যায় নি। এছাড়াও তৎকালীন ভারতে উচ্চ-শ্রেণীর ব্রাহ্মণ, প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ভাষা সংস্কৃত হওয়ায়, সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম গ্রন্থটি ভাষা রূপান্তরে আলাদা তাৎপর্য পায়। আর এইভাবে ভাষারূপের পরিবর্তন সাধন করে সর্বস্তিবধিন অভিধর্ম গ্রন্থটি ভারতের বহু চিন্তাবিদ ও মানুষদের মধ্যে পাঠক-প্রিয়তা অর্জন করে। আর ঠিক এই কারণেই বহু বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যে তাদের অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থের শ্লোক ও বক্তব্যগুলো সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করার ঝোঁক বেড়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য শাখা ধর্মী-গ্রন্থ অনুবাদে ব্যস্থ হয় পরলেও থেরবাদ শাখা কিন্তু সে দিকে পা বাড়ায় নি। কারণ জীবিত অবস্থায় বৌদ্ধ স্পষ্টভাবে বারণ করে গিয়েছিল, তার দেয়া বাণীসমূহ কোন বিশেষ ধর্মের উচ্চমার্গের ভাষায় যেন লিপিবদ্ধ করা না হয়; বরং তা যেন কোন স্থানীয় নিচুমার্গের ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এতো কিছুর পরেও থেরবাদ শাখায় ধর্মীয়-গ্রন্থগুলো যে নিচু-শ্রেণীর যে পালি ভাষায় রচিত হয়েছিল, সেই পালি ভাষা কালক্রমে উচ্চ-শ্রেণীর মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মহাযান শাখার পরিব্যপ্তি (খৃষ্টপরবর্তী ১ম থেকে ১১শ শতাব্দি)
সম্পাদনাকিছু শতাব্দির মধ্যেই, বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা বিকশিত হতে থাকে এবং তা ভারত থেকে ছাড়িয়ে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ, মধ্য এশিয়া, চীন, জাপান, কোরিয়া এবং সর্বশেষ খৃষ্ট-পরবর্তী ৫৩৮ সালে জাপানে এবং ৭ম শতাব্দিতে তিব্বতে প্রচারিত হতে থাকে।
ভারত
সম্পাদনাকুষাণ সাম্রাজ্যের সমাপ্তির পর বৌদ্ধ ধর্ম গুপ্ত সাম্রাজ্যে (খৃষ্ট-পরবর্তী ৪র্থ থেকে - ৫ম শতাব্দি) বিকশিত হতে থাকে। সেই সময় ভারতের বর্তমান বিহার প্রদেশের নালন্দায় মহাযান শাখার অধ্যয়নের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। নালন্দায় প্রতিষ্ঠিত মহাযান শাখার এই বৌদ্ধ-অধ্যয়ন কেন্দ্রটি বহু শতাব্দি ধরে বৃহত্তর ও প্রভাবশালী বৌদ্ধ-বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ছিল এবং নাগার্জুনের মতো বৌদ্ধ পণ্ডিত ছিল উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গুপ্ত সাম্রাজ্যে বিকশিত বৌদ্ধ-শিল্পকলা পরবর্তীতে সুদূর চীন দেশেকেও প্রভাবিত করেছিল।
হুন জাতির আক্রমণ এবং মিহিরকূলের অত্যাচারের পর থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দি থেকে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দূর্বল হয়ে পরে।
৭ম শতাব্দিতে ভারত ভ্রমণের সময় বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ও অনুবাদক হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেন যে, বৌদ্ধ ধর্ম সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিল নাড়ু, বিজয়ওয়াড়া তথা সমস্ত দক্ষিণ ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।[৩৫] তিনি নেপালে জনমানবশূণ্য বৌদ্ধ-স্তুপের বর্ণনা ও গৌড় রাজ্যের রাজা শশাঙ্ক কর্তৃক বৌদ্ধ নিপীড়নের কথা উল্লেখ করলেও, সেই একই সময়কালীন সময়ে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার ভূয়শী প্রশংসা করেন। হর্ষবর্ধনের শাসনামলের সমাপ্তির পর অনেক ছোট ছোট রাজ্যের উত্থান ঘটে যা পরবর্তীতে গাঙ্গেয়ত্রেয় উপত্যকায় রাজপুত জাতির উত্থান ঘটায় এবং বৌদ্ধ-রাজবংশেরও সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলা অঞ্চলে পাল সাম্রাজ্যের উত্থানের পর থেকে বৌদ্ধ-রাজবংশ পুনরায় তাদের গৌরব ফিরে পায়। হিন্দু সেন রাজবংশ কর্তৃক পাল রাজ্য আক্রমণের আগ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম পাল সাম্রাজ্যের অধীনে বিকশিত হয়ে বাংলা অঞ্চল হতে ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দি পর্যন্ত সিক্কিম, ভুটান এবং তিব্বত পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে। পাল রাজবংশের শাসনামলে বহু মন্দির ও বৌদ্ধ-শিল্পকলা বিকশিত হয়েছিল।
হিউয়েন সাঙ্গ আরও উল্লেখ করেন যে, তার পরিভ্রমণের সময় তিনি অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্ম ও জৈন ধর্মে ধর্মান্তরীত হতে দেখেছেন।[৩৬] কেননা দশম শতাব্দিতে পাল রাজবংশের পরাজয় ও বৈষ্ণবীয় মতবাদ উত্থানের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হতে থাকে।[৩৭]
এছাড়া উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের পতনের মাইলফলক তখনই ঘটেছিল, যখন ১১৯৩ খৃষ্টাব্দে তুর্কি আক্রমণকারি ও মুসলিম যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হত্যা করেছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দির শেষের দিকে বিহারে মুসলিম শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর থেকে মধ্য ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হতে থাকে এবং অনেক বৌদ্ধ ধর্ম-বিশ্বাসীরা সেই সময় ভারতের একেবারে উত্তরের দিকে অর্থাৎ হিমালয়ার অঞ্চলগুলোতে এবং একেবারে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার দিকে স্থানান্তরিত হতে থাকে। পাশাপাশি ভারতবর্ষে সেই সময় অদ্বৈত মতবাদ ও ভক্তি আন্দোলনের পুনরুত্থানের এবং সুফিবাদের আগমনের ফলে ধীরে ধীরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব হ্রাস পায়।
মধ্য ও উত্তর এশিয়া
সম্পাদনামধ্য এশিয়া
সম্পাদনাবুদ্ধের সময়কাল থেকেই মধ্য এশিয়া বৌদ্ধ ধর্ম কর্তৃক প্রভাবিত ছিল। থেরবাদ গ্রন্তগুলোতে উল্লেখানুযায়ী, ব্যাকট্রিয়া রাজ্য থেকে তাপাস্সু ও ভাল্লিকা নামক দুই ভাই বুদ্ধের সাথে দেখা করেন এবং ব্যাকট্রিয়া রাজ্যে ফিরে গিয়ে তারা বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন। চীন, ভারত ও পারস্যের মধ্যে মধ্য এশিয়া বহু বছর ধরে সংযোগ স্থাপন করে চলেছিল। খৃষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দিতে হান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের ফলে পশ্চিমাংশকে এশিয়ার হেলেনিস্টিক সভ্যতার আরো নিকটবর্তী করে তুলে; যার মধ্যে গ্রিক-ব্যাকট্রিয় সাম্রাজ্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উত্তরের দিকে বৌদ্ধ ধর্মের পরিব্যাপ্তি এই ধর্মকে তার অনুসারী বৃদ্ধি করতে বিশেষ সহায়তা করে, এমনকি মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ রাজ্যগুলোতেও। রেশম পথ অঞ্চলের অনেক শহরে এখনও বৌদ্ধ স্তূপ ও মঠের সন্ধান পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই বৌদ্ধ মঠগুলো পূর্ব এবং পশ্চিম থেকে আসা-যাওয়াকারি পর্যটকদের জন্য পান্থ-পথ হিসেবে সেই সময়ে ব্যবহৃত হতো।
খৃষ্টপূর্ব ২য় ও ৩য় শতকে থেরবাদ ও মহাযান শাখা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বে, সর্ব প্রথম ইরানে থেরবাদ মতাদর্শ প্রচারিত হয়। উল্লেখিত এই দেশগুলো পূর্বে গান্ধার, ব্যাকট্রিয়, মার্জিয়ানা, সোগ্দা রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল, যেখান থেকে পরবর্তীতে চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়েছিল। সবার আগে ব্যাকট্রিয় রাজ্যই সর্ব-প্রথম খৃষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে আসে। তবে ব্যাকট্রিয় রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মই একক ধর্ম ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি সেখানে জরাথুস্ট্রবাদ, হিন্দু ধর্ম, ইহুদী ধর্ম, মানি ধর্ম, তেংগ্রী ধর্ম, ওঝা ধর্ম (শামানিজম্) এবং আরো অনেক স্থানীয় সু-সংগঠিত নয় এমন ধর্মের অনুসারীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
৭ম শতাব্দি পর্যন্ত নিকায়বাদি বৌদ্ধ পণ্ডিতরা মধ্য এশিয়া ও চীনে ছিল। আর সেই সময়েই মহাযান বৌদ্ধ শাখা উক্ত অঞ্চলগুলোতে প্রভাবশালী হয়ে উঠে। আর যেহেতু মহাযান বৌদ্ধ শাখা নিকায়বাদদর্শী নয় তাই সর্বাস্তিবদিন এবং ধর্মগুপ্তক মধ্য এশিয়ার মঠগুলোতে প্রাধান্যরূপে থেকে যায়।
অনেকগুলো বৌদ্ধ রাজবংশ উভয় মধ্য এশিয়া এবং সম্রাট কণিষ্কের শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে সমৃদ্ধি লাভ করলেও ৫ম শতাব্দিতে হুন জাতির আক্রমণের পর থেকে রাজা মিহিরকূলের শাসনামলে বৌদ্ধরা নির্যাতনের শিকার হয়।
বৌদ্ধ ধর্ম পাকাপোক্তভাবে বিলুপ্ত হতে থাকে মধ্য এশিয়াতে ৭ম শতাব্দিতে ইসলাম ধর্মের সম্প্রসারণ এবং মুসলিমদের কর্তৃক বৌদ্ধ স্তূপ ধ্বংসের মদ্য দিয়ে। এবং মুসলিমরা সেই সময় তাদের শাসনামলে অ-মুসলিম হিসেবে বৌদ্ধদের জিম্মি হিসেবেই অভিহিত করতো। বিখ্যাত ভাষাবিদ ও ইতিহাসবেত্তা আবু রায়হান আল বিরুনিআল বিরুনী গৌতম বুদ্ধ কে "নবী বুর্জান" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
চেঙ্গিজ খান কর্তৃক মঙ্গোল জাতির আক্রমণের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম আবারো আশার আলো দেখতে পায় এবং ইলখানাত এবং চাগাতাই খানাত নামক মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে ত্রয়োদশ শতকে এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকে। কিন্তু ১০০ বছরের মধ্যে উক্ত বৌদ্ধ মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অধিপতিরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে তারা এশিয়া জুড়ে তাদের রাজ্যগুলোতে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকে। শুধুমাত্র পশ্চিমের মঙ্গোলরা এবং ইয়ুয়ান রাজবংশ লোকেরা তাদের বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান শাখা অরক্ষিত রাখে।
পারস্য
সম্পাদনাবৌদ্ধ ধর্ম বর্তমান তুর্কমেনিস্তান দেশের মার্ভ শহরে যেগুলো পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীভুক্ত ছিল, সেসব অঞ্চলগুলোতে প্রচারিত হয়েছিল। একটি সোভিয়েত প্রত্নতাত্ত্বিক দল মার্ভ শহরে অবস্থিত গিঅর-কালা অঞ্চলে খনন করেএকটি বৌদ্ধ ভজনালয়, একটি বিশাল বৌদ্ধ ভাষ্কর্য ও একটি মঠ আবিষ্কার করেন।
পারস্য জাতি বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে সরাসরি যুক্ত ছিল। বস্তুত আন শিগাও নামক একজন পারস্য রাজকুমার চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক বৌদ্ধ-গ্রন্থ চৈনিক ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
তারিম বাসিন
সম্পাদনামধ্য এশিয়ার পূর্ব-ভাগ ([[শিনজিয়াং, তারিম বাসিন]]) অঞ্চলগুলো থেকে অনেক সমৃদ্ধশালী প্রাচীন বৌদ্ধ-শিল্পকলার পরিচয় পাওয়া যায়; মূলত সেসব শিল্পগুলোর মধ্যে দেয়াল ও গুহায় আঁকা বৌদ্ধ নিদর্শন, ক্যানভাসে আঁকা চিত্রশিল্প, ভাষ্কর্য ও শাস্ত্রীয় আচার-পালনের বস্তু-সামগ্রী ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য, যেগুলো মূলত প্রাচীন ভারত আর হেলেনিস্টিক সভ্যতার পরিচয় বহন করে। এসব সেরিন্ডিয়ান শিল্পকলা সমূহ মূলত প্রাচীন গান্ধার (বর্তমান আফগানিস্তান) অঞ্চলের শিল্পশৈলির পরিচায়ক আর পাশাপাশি সেই অঞ্চলে খরোষ্ঠী লিপিতেও কিছু ধর্মীয় গ্রন্থের হদিস মিলে।
মধ্য এশিয়া মূলত পূর্ব দিকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে প্রধান ভূমিকা পাল করেছিল। চৈনিক ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ রূপান্তরকারি ছিলেন পারস্য রাজপুত্র আন শিগাও (১৪৮ খৃষ্টাব্দ) আর তাঁর অনুবাদ কর্মে সহযোগী ছিল আন জুয়ান, এছাড়াও বৌদ্ধ ভিক্ষু লোকক্ষেমা যিনি ছিলেম ইয়ুয়েঝি জাতিগোষ্ঠীর লোক, তিনিও অনেক ভারতীয় ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থ চৈনিক ভাষায় রূপান্তর করেন। পাশাপাশি সোগ্দা জাতিগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা ঝি কিয়ান ও ঝি ইয়াও এর মতো বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও চীনা ভাষায় বৌদ্ধ গ্রন্থ অনুবাদে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল।
এছাড়া তারিম বাসিন অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক দেয়াল চিত্র থেকে জানা যায় যে, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব-এশিয়ার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে এই ধর্মীয় গ্রন্থের আদান-প্রদান আনুমানিক দশম শতাব্দি পর্যন্ত ছিল।
কিনুত যখন চীনা উপনিবেশবাদ এবং চৈনিক সংস্কৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন দুই দেশের এই আন্তঃসাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ব্যাহত হয়ে পরে।
চীন
সম্পাদনাস্থানীয় মানুষদের তথ্যমতে, চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার হয়েছিল হান সাম্রাজ্যের শাসনামলে (২০৬ খৃষ্টপূর্ব - ২২০ খৃষ্টাব্দ)। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, হান সামাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের উদয় হলেও সেই সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিকশিত হয় নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না হান সাম্রাজ্যের ৬ষ্ঠ রাজবংশ (২২০ - ৫৮৯ খৃষ্টাব্দ) ক্ষমতায় এসছিল। মূলত ৬৭ খৃষ্টাব্দে মোটন ও চুফারলান নামক দুই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের হাত ধরেই চীন আনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে পরিচিত হয়েছিল। ৬৮ খৃষ্টাব্দে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চীনের বৌদ্ধরা লুয়োয়াং শহরের কাছে শ্বেত অশ্ব মন্দির (চীনা ভাষা: 白馬寺) প্রতিস্থাপন করেছিল, যেটি আজও চীনে বিদ্যমান রয়েছে।
২য় শতাব্দির সমাপ্তির সময় একটি সমৃদ্ধশালী বৌদ্ধ সম্প্রদায় একটি পেংচং নামক জায়গায় গড়ে উঠে যেটি বর্তমানে চীনের জিয়াংসু রাজ্যের শুঝাও শহর নামে পরিচিত।
প্রথম মহাযান শাখার বৌদ্ধ-গ্রন্থগুলো ১৭৮ থেকে ১৮৯ খৃষ্টাব্দের দিকে কুষাণ সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু লোকক্ষেমা কর্তৃক চৈনিক ভাষায় অনুবাদিত হয়েছিল। যে প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলাগুলো চীনে পাওয়া গিয়েছিল, তার বেশির ভাগই ছিল মানি গাছের ভাষ্কর্য, যেটির সময়কাল আনুমানিক ২০০ খৃষ্টাব্দের যার মধ্যে গান্ধার অঞ্চলের শিল্পকলার ছাপ বিদ্যমান ছিল।[৪১]
৪৬০ থেকে ৫২৫ খৃষ্টাব্দের দিকে উত্তরের ওয়েই রাজবংশের শাসনামলে চৈনিক বৌদ্ধরা বৌদ্ধ শিল্প সমৃদ্ধ ইয়ুগেং নামক একটি কৃত্রিম গুহা নির্মাণ করেন এবং এটি ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দির পাথর-খুদাই শিল্পের সবচেয়ে চমৎকার একটি উদাহরণ। সব মিলিয়ে ঐ জায়গাটিতে ২৫২ টি কৃত্রিম গুহা রয়েছে, যার মধ্যে বুদ্ধ মূর্তির সংখ্যা ৫১,০০০ টি।
আরেকটি বিখ্যাত কৃত্রিম গুহা হলো লংম্যান গুহা এবং এটিও উত্তরের ওয়েই রাজবংশের শাসনামলে ৪৯৩ খৃষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। লংম্যান নামক কৃত্রিম গুহাটিতে ১,৪০০ টি গুহা আর ১,০০,০০০ এর মতো বৌদ্ধ ভাষ্কর্য রয়েছে। আর গুহাগুলোর উচ্চতা ১ ইঞ্চি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫৭ ফিট পর্যন্ত বিস্তৃত। ঐ অঞ্চলে এছাড়াও বিশাল পাথরের উপর খুদাইকৃত ২,৫০০ টি পাথর-ভাষ্কর্য ও শিলালিপি আছে। পাশাপাশি আছে ৬০টির মতো বুদ্ধ মন্দির।
বৌদ্ধ ধর্ম চীনে মূলত পাকাপোক্তভাবে বিকশিত হওয়া শুরু করে তাং রাজবংশের (৬১৮ - ৯০৭ খৃষ্টাব্দ) শাসনামলে। যেহেতু চতুর্থ থেকে একাদশ খৃষ্টাব্দের দিকে প্রচুর চৈনিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ভারতে আসা যাওয়া করতো, তাই তাং রাজবংশ চীন দেশে ভারতের মতো বিদেশি দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবের ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করেছিল। সেই সময় বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার জন্য তৎকালীন তাং রাজবংশের রাজধানী চাংগ'আন (যা বর্তমানে চীনের শানশী প্রদেশের রাজধানী শি'আন) ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রভূমি। আর সেখান থেকেই কোরিয়া আর জাপানে চীন ধর্ম প্রচারকারযক্রম শুরু হয়।
কিন্তু তাং রাজবংশের সমাপ্তির শেষ সময়গুলোতে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব আস্তে আস্তে কমতে থাকে। কেননা চীনের স্থানীয় ধর্ম তাও ধর্মের প্রভাব কমতে থাকায়, তৎকালীন তাং রাজবংশের সম্রাট উঝং তার শাসনাধীন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মসহ, জরাথুস্ট্রবাদ, খৃষ্ট ধর্ম নিষিদ্ধ করে দেন। সম্রাট উঝং তার রাজ্যেজুড়ে বৌদ্ধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বৌদ্ধ মঠ ও মন্দির ধ্বংস এবং অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন।
প্রায় একশ বছরের নির্যাতনের পর বৌদ্ধ ধর্ম আবারা সুং রাজবংশের শাসনামলে (১১২৭ - ১২৭৯ খৃষ্টাব্দ) পুনরজ্জীবিত হয়। বেশ কিছু শতাব্দি যাবৎ বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা চীনে বিকশিত হতে থাকে যা পরবর্তীতে জাপানে গিয়ে পৌঁছে। সুং রাজবংশের আমলেই চীনে মহাযান শাখার ঝেন মতবাদ আবির্ভূত হয়।
বিগত দুই হাজার বছর ধরে চীনে বৌদ্ধরা চারটি পর্বতে বৌদ্ধ নিদর্শন গড়ে তুলেছিল, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উতায় পর্বত, ইমেই পর্বত, জিয়ুহুয়া পর্বত, পুতুয়া পর্বত।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধ নিদর্শন সংবলিত দেশের মধ্যে চীন বর্তমানে অনন্য। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত বৌদ্ধ ভাষ্কর্য সংবলিত স্থানগুলো হলোঃ গানসু প্রদেশের মাগাও গুহা, হেনান প্রদেশের লংম্যান নামক কৃত্রিম গুহা, শানশি প্রদেশের ইয়ুগ্যাং কৃত্রিম গুহা এবং চংকিং শহরের কাছে অবস্থিত দাজু পাহাড় ভাষ্কর্য অন্যতম। এছাড়া তাং রাজবংশের শাসনামলে ৮ম শতাব্দিতে নির্মিত লেশান শহরে অবস্থিত লেশানের বিশাল বুদ্ধ এখও পৃথিবীর বিশাল বুদ্ধ মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি।
কোরিয়া
সম্পাদনাচৈনিক রাষ্ট্রদূতের ৩৭২ খৃষ্টাব্দে কোরিয়ার গোগুরয়ো রাজ্যে আগমনের সময় বৌদ্ধ ধর্ম কোরিয়াতে পরিচয় লাভ করে। তিনি কিছু ধর্মগ্রন্থ ও ছবি নিয়ে এসেছিলেন। ৭ম শতাব্দির দিকে বৌদ্ধ ধর্ম কোরিয়াতে বিকশিত হয়। ১৩৯২ খৃষ্টাব্দে কোরিয়াতে কনফুসীয় য়ি-রাজবংশের উত্থানের সময় বৌদ্ধরা বৈষ্যমের শিকার হয়।
জাপান
সম্পাদনাকোরিয়ায় শাসনাধীন রাজ্যগুলো দ্বারা জাপানে ৬ষ্ঠ শতাব্দিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হয়। চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু জিয়ানঝেন-এর হাত ধরেই বৌদ্ধ ধর্মের বিনয়-সূত্র জাপানে ৭৫৪ খৃষ্টাব্দে প্রচারিত হয়। ৯ম শতাব্দিতে জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সাইচো ও কুকাই সফল উত্তর-সূরী হিসেবে জাপানে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি শক্ত করে তোলেন।
ভৌগলিকভাবে রেশম পথের সমাপ্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য এশিয়া ও চীনে বৌদ্ধ ধর্ম অবদমিত হলেও জাপান কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহ্য একদম শুরু থেকেই সংরক্ষিত করতে পেরেছিল।
আসুকা যুগে (৫২৮ - ৭৯৪ খৃষ্টাব্দ) যুবরাজ শতোকু তাইশির আমলে বৌদ্ধ ধর্ম জাপানে জাতীয় ধর্মের মর্যাদা পেয়েছিল। ৭১০ খৃষ্টাব্দের দিকে জাপানের নারা শহরে অনেকগুলো মন্দির ও মঠ নির্মিত হয় যেখানে উল্লেখযোগ্য হলো পাঁচ-তলা বিশিষ্ট বৌদ্ধ মন্দির ও হোরয়ু-জি এবং কোফুকু-জি মন্দিরের স্বর্ণালি হল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময় অগণিত চিত্রকর্ম ও ভাষ্কর্য নির্মিত হয়েছিল। আর এই বৌদ্ধ শিল্পকলাগুলো মূলত ৮ম থেকে ১৩শ শতাব্দির মধ্যে নারা যুগ (৭১০-৭৯৪), হেইআন যুগ (৭৯৪-১১৮৫) ও কামাকুরা যুগ (১১৮৫-১৩৩৩) সময়কালীন সৃষ্টি হয়েছিল।
কামাকুরা যুগে, বৌদ্ধ ধর্ম রাজকীয় স্তর থেকে জনসাধারণের মাঝে আনার জন্য প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। সেই সময়কার চিরাচরিত বৌদ্ধ ধর্ম মূলত দেশ রক্ষা, খারাপ আত্মা বা অশুভ শক্তি থেকে রাজ-পরিবারের মানুষদের রক্ষা করা এবং সমাজের উচ্চ-শ্রেণীর মানুষ, রাজ-পরিবারের সদস্য ও সন্ন্যাসীদের আত্মার মুক্তির মধ্যেই এর কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। এছাড়াও জাপানে সেই সময় জাপানী ভিক্ষু হোনেন কর্তৃক পূণ্য ভূমি বৌদ্ধ শাখার আরেক উপশাখা জোডো শু এবং আরেক জাপানী ভিক্ষু শিনরান কর্তৃক পূণ্য-ভূমি বৌদ্ধ মতবাদের আরেকটি উপশাখা জোডো শিনশু এর উত্থান ঘটে। হোনেন ও তাঁর শিষ্যরা পাপী ব্যক্তি, সাধারণ নর-নারী, এমনকি পিতৃ-মাতৃ হত্যাকারিদের মুক্তির জন্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পরিচালনা করতেন। আর অন্যদিকে ভিক্ষু শিনরান মূলত অমিতাভ বৌদ্ধের পূজা-অর্চনায় সাধারণ মানুষদের প্ররোচনা করতেন। শিনরান ভিক্ষু এমনকি নিজে বিয়ে করার মাধ্যমে বৌদ্ধ সন্ন্যসাসীদের বিয়ে প্রথা চালু করেছিলেন যা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে প্রথম এবং চিরাচরিত বৌদ্ধ সমাজে এটিকে ট্যাবু (নিষিদ্ধ বিষয়) হিসেবেই দেখা হতো।
কামাকুরা শাসনামলে আরো একটি বড় পদক্ষেপ ঘটেছিল জেন বৌদ্ধমতবাদ এর আবির্ভাবের মাধ্যমে যা জাপানা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দোগেন এবং এইসাই চীন ভ্রমণ শেষে নিজ দেশ জাপানে ফিরে আসার পর প্রবর্তন করেছিল। জেন বৌদ্ধমতবাদ হচ্ছে উচ্চতর দার্শনিকতাসম্পন্ন সরল শব্দ দ্বারা গঠিত গভীর চিন্তা-ভাবনাসম্পন্ন একটি মতবাদ। কিন্তু শিল্পকলার ইতিহাসে এই মতবাদকে শুধু ইংক ওয়াশ ও এন্সো এর মতো নিছক পেইন্টিং এবং হাইকু'র মতো ছোট কবিতায় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও জেন মতবাদের সত্যানু-সন্ধানের বৈশিষ্ট্য জাপানী সমাজে চানোয়ু বা জাপানী চা উৎসব এবং ইকেবানা বা ফুলের সমারোহ আয়োজনের মতো অনুষ্ঠান উপহার দেয়। এছাড়া আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক উপায়ে জাপানী সমাজের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনে অংশ হয়ে উঠার পাশাপাশি জেন বৌদ্ধ মতবাদ সামরিক কলা-কৌশল তথা মার্শাল আর্ট এরও উদ্ভাবন ঘটায়।
বৌদ্ধ ধর্ম জাপানে এখনও উজ্জীবিত রয়েছে। প্রায় ৮০,০০০ বৌদ্ধ মন্দির জাপানে এখনও সংরক্ষিত আছে এবং প্রয়োজনে পুনঃস্থাপিত হচ্ছে।
তিব্বত
সম্পাদনাদেরিতে হলেও বৌদ্ধ ধর্ম ৭ম শতাব্দিতে তিব্বতে পা রাখে। বৌদ্ধ ধর্মের যে শাখাগুলো তিব্বতে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছিল, সেগুলো হচ্ছে মহাযান ও বজ্রযান শাখার সংমিশ্রণ যা বাংলার পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিব্বতে এসেছিল।[৪২] তিব্বতে সর্বাস্তবদিন প্রভাব মূলত কাশ্মীর[৪৩] and the north west (Khotan).[৪৪] এবং চীনের শিনজিয়াং অঞ্চল থেকে আসে।[৪৪] যদিও বৌদ্ধ ধর্মের এসব শাখাগুলোর কোনটারই অস্তিত্ব তিব্বতে নেই, কিন্তু তারপরও এসবের অস্তিত্বের প্রমাণ প্রাচীন তিব্বতীয় বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়। তিব্বতে উত্থিত হওয়া মূলসর্বাস্তিবাদ হলো তিব্বতীয় বিনয়পিটকের মূল উৎস।[৪৫] জেন বৌদ্ধ মতবাদ তিব্বতে প্রচার হয় তিব্বতের পূর্ব দিকের অংশে অবস্থিত চীন দেশ হতে। কিন্তু তিব্বতে জেন বৌদ্ধ মতবাদ একটি ছাপ রেখে গেলেও রাজনৈতিক কারণে এটির কম গুরুত্ব প্রদর্শিত হয়।[৪৬]
প্রথমদিকে বৌদ্ধ ধর্ম স্থানীয় ওঝা ভিত্তিক বৌন ধর্মের বিরোধীতার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীকালে রাজা রালপাচানের (৮১৭ - ৮৩৬ খৃষ্টাব্দ) রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম তিব্বতে সম্মানের সাথে স্থান পায়। রাজকীয় চীন শাসন ও ইয়ুয়ান রাজবংশের শাসনামলে (১২৭১-১৩৬৮ খৃষ্টাব্দ) তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম অন্যান্য ধর্মগুলো থেকে বেশি প্রাধান্য পায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
সম্পাদনাপ্রথম খৃষ্টাব্দের শুরুর দিকে পারস্য সাম্রাজ্যের কারণে তাদের প্রধান শত্রু রোমানদের দমানোর জন্য রেশম পথ দিয়ে ব্যবসায় বাণিজ্যের যাওয়া আসা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এশিয়ান পণ্যের প্রতি রোমানদের চাহিদা থেকে যায়। তাই বাণিজ্যের জন্য ভূমধ্যসাগর, চীন ও ভারতের মধ্যে আন্তঃচুক্তিতে একটি বাণিজ্যিক পথ গড়ে উঠে। আর ঠিক সেই সময় থেকে ব্যবসায়িক যোগাযোগ ও বিভিন্ন ব্যবসায় সংক্রান্ত সমাধান ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে ভারত পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে (ভিয়েতনাম ছাড়া) শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ভারতের সাথে তখন বার্মা, থাইল্যান্ড, সুমাত্রা, জাভা দ্বীপ, কম্বোডিয়া ও আরো অন্যান্য শহরাঞ্চল বিশিষ্ট দ্বীপ অঞ্চলের সাথে বাণিজ্যক পথ গড়ে উঠে।
হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় ঐ অঞ্চলগুলোতে পৌছেছিল। বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পালি ভাষা ও সংস্কৃত ভাষা সমূহের প্রসার, থেরবাদ ও মহাযান শাখার প্রচার এবং রামায়ণ ও মহাভারতের মতো ভারতীয় সাহিত্যের সাথে উক্ত অঞ্চলগুলোর পরিচয় ঘটে।
৫ম থেকে ১৩শ শতাব্দি পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল ছিল খুবই শক্তিশালী সাম্রাজ্য এবং বৌদ্ধ স্থাপত্য ও শিল্পকলায় সেই সময় বৌদ্ধ ধর্ম ছিল এগিয়ে। আর এই প্রভাবের ফলে শ্রী বিজয় ও খের সাম্রাজ্য নামক দুইটি হিন্দু-বৌদ্ধ সংবলিত শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে উঠে যারা থেরবাদ ও মহাযান এবং বৌদ্ধ শিল্পকলায় ব্যাপক অবদান রাখে।
শ্রীবিজিয়ন সাম্রাজ্য (৮ম থেকে ১৪শ শতাব্দি)
সম্পাদনাশৈলেন্দ্র রাজবংশের অধীনে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার উপকূলবর্তী সুমাত্রার পালেমবাং দ্বীপে শ্রীবিজয় নামক রাজবংশ গড়ে উঠে। এই রাজবংশ মহাযান ও বজ্রযান শাখার অনুসারী ছিল। প্রাচীন চৈনিক গ্রন্থ ইয়িজিং উল্লেখ করে যে, পালেমবাং দ্বীপ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্র যা সম্রাট কর্তৃক রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাজারো সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের পূর্বে বাঙ্গালী বৌদ্ধ ভিক্ষু অতীশ দীপঙ্গকর সুমাত্রার পালেমবাং দ্বীপের মঠে অধ্যয়ন করেন।
কিন্তু সেই সময়েও শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যে অনেকে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ মতবাদ ধারণ করতো না। তারা বরং বৌদ্ধ ধর্মের এমন একটি রূপ বের করে যা পরবর্তীতে হিন্দু ধর্ম ও অন্যান্য স্থানীয় ধর্মগুলোর সাথে একীভূত হয়ে যায়।[৪৭]
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সাম্রাজ্য বিস্তৃত করার সময় শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য অনেক বৌদ্ধ শিল্পকলার নিদর্শনের পরিচয় দেয়। সেই শাসনামলে অনেকগুলো বোধিসত্ত্ব মূর্তির সন্ধান মেলে। ৭৮০ খৃষ্টাব্দে নির্মিত জাভা দ্বীপে অবস্থিত বরোবুদুর নামক বৌদ্ধ মন্দির হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধশালী শিল্পকলা-বিশিষ্ট বৌদ্ধ মন্দির যেখানে ৫০৫টি ধ্যানরত বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।
হিন্দু চৌল সাম্রাজ্যের সাথে বিবাদ এবং ১৩শ শতাব্দিতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার কারণে শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের বিলোপ সাধন ঘটে।
খের সাম্রাজ্য (৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দি)
সম্পাদনা৯ম থেকে ১৩শ শতাব্দি পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধ ও হিন্দুদের সমন্বয়ে খের সাম্রাজ্য গড়ে উঠে এবং এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপদ্বীপগুলোতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। খের সাম্রাজ্যের অধীনে ৯০০ এরও বেশি বৌদ্ধ মন্দির কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময় খের সাম্রাজ্যের রাজধানী অংকর ছিল সাম্রাজ্যের সকল স্থাপত্য শিল্পের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। খের রাজ্যের খ্যাতিমান সম্রাট জয়বর্মন সপ্তম (১১৮১-১২১৯ খৃষ্টাব্দ) বয়ন ও অঙ্কর থোমে সর্ববৃহৎ মহাযান বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন।
ভিয়েতনাম
সম্পাদনাভিয়েতনামের বৌদ্ধরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান শাখা পালন করে। ভারত হতে মধ্য এশিয়ার উত্তর ভাগের মাধ্যমে ৩য় শতাব্দিতে বৌদ্ধ ধর্ম ভিয়েতনামে প্রচারিত হয়। ভিয়েতনাম মূলত চৈনিক বৌদ্ধ মতবাদকেই অনুসরণ করে। এছাড়াও ভিয়েতনামের বৌদ্ধ ধর্মে তাও ধর্ম, চৈনিক সংস্কৃতি ও স্থানীয় ভিয়েতনামী সংস্কৃতির মিশ্রণ রয়েছে।
বজ্রযান শাখার উত্থান (৫ম শতাব্দি)
সম্পাদনারাজসভাসদ্বর্গ কর্তৃক বজ্রযান ও শৈব ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতার ফলশ্রুতিতে বজ্রযান বৌদ্ধ শাখার অনেকগুলো শ্রেণীর উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল।[৪৮] মঞ্জুশ্রীকল্প নামক গ্রন্থ যেটি পরবর্তীতে ক্রিয়াতন্ত্রের অধীনভুক্ত হয় সেখানে উল্লেখ আছে, যে মন্ত্রসমূহ শৈব, গারুদা ও বৈষ্ণবীয় গ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত আছে সেগুলো তখনই কাজ করবে যখন কোন বৌদ্ধ এসব মন্ত্রসমূহের প্রয়োগ করবে; কেননা বজ্রযান শাখার ভিক্ষু মঞ্জুশ্রী বাকি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এসব মন্ত্রের প্রয়োগ পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিল।[৪৯] পদ্মবজ্রের গুহ্যসিদ্ধি, যেটি গুহ্যসমাজতন্ত্রের সাথে অন্তর্ভুক্ত, সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শৈব-গুরু হিসেবে কাজ করার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং শিষ্যদের মধ্যে শৈব সিদ্ধান্ত গ্রন্থের প্রবর্তিত করতেও দেখা যায়।[৫০] এছাড়াও চক্রসম্বরতন্ত্র গ্রন্থটি শৈব গ্রন্থ তন্ত্রসদ্ভবঃ থেকে অনুপ্রাণীত।[৫১]
থেরবাদ রেঁনেসা (একাদশ শতাব্দিতে সূচনা)
সম্পাদনাএকাদশ শতাব্দি থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণের পর থেকে মহাযান বৌদ্ধ শাখা বিলুপ্ত হতে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে যে যাত্রাপথ ছিল তা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ায়, সরারসরি সমুদ্র পথের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে চীন পর্যন্ত একটি যাত্রাপথের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কায় পালি গ্রন্থের থেরবাদ শাখার উদ্ভাবন ঘটাতে সহায়তা করে।
পুংগ সাম্রাজ্যের রাজা অনোরথ (১০৪৪-১০৭৮ খৃষ্টাব্দ) পুরো দেশকে একতাবদ্ধ করে এবং বৌদ্ধ ধর্মের থেরবাদ শাখা গ্রহণ করে। একাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দিতে পুংগ সাম্রাজ্যে যে হাজার খানেক মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল, তার মধ্যে বর্তমানে এখনও ২,২০০ টি মন্দির বর্তমান আছে। থাই জাতিগোষ্ঠীদের উত্থান এবং মঙ্গোল জাতিদের আক্রমণের ফলে ১২৮৭ সালে পুংগ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম বার্মার প্রধান ধর্ম বিশ্বাস হিসেবে থেকে যায়।
১২৬০ খৃষ্টাব্দে থাই জাতিগোষ্ঠী বার্মা দখল করলেও সদ্য আগত থাই সুখোথাই রাজবংশ বৌদ্ধ ধর্মের থেরবাদ শাখা গ্রহণ করে। এছাড়াও থাই অযোধ্যা সাম্রাজ্য (১৪শ - ১৮শ শতাব্দি) ক্ষমতায় আসলে থেরবাদ শাখা তখনও ক্ষমতায় বহাল থাকে।
সেখান থেকে থেরবাদ শাখা ১৩শ শতাব্দিতে লাওস ও কম্বোডিয়া তেও ছড়িয়ে পরে। কিন্তু ১৪শ খৃষ্টাব্দ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলীয় প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং দ্বীপগুলোতে ইসলাম ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকলে তা মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের বেশ কিছু দ্বীপ ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে পরে।
তথাপি ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রপতি সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ার ক্ষমতায় এলে, ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের রেঁনেসা সংগঠিত হয়। এটি মূলত রাষ্ট্রপতি সুহার্তো কর্তৃক পাঁচটি ধর্মকে (ইসলাম, প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ, ক্যাথলিক মতবাদ, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম) কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার ফলস্বরূপ। ধারণা করা হয় যে, অন্তত ১০ মিলিয়ন বৌদ্ধ ইন্দোনেশিয়াতে আছে। আর ইন্দোনেশিয়ার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই চৈনিক বংশোদ্ভুত।
পাশ্চাত্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার
সম্পাদনাগ্রিক-বৌদ্ধ শিল্পকলা থেকে পাওয়া চিরায়িত দলিল থেকে এটাই বুঝা যায় যে, পাশ্চাত্যে বৌদ্ধ ধর্ম বিক্ষিপ্তভাবে প্রচার হয়েছিল। ড্যামাসকাসের সন্ত জোহান কর্তৃক বুদ্ধের জীবনীর একটি বিবরণ গ্রিক ভাষায় অনুবাদিত হয় যেটি খৃষ্টানদের মাঝে বারলাম এবং জোসাফেট এর গল্প (একজন ভারতীয় রাজপুত্রের খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণের কাহিনী যেটি মহাযান বৌদ্ধ গ্রন্থে পাওয়া যায়) হিসেবে পরিচিত লাভ করে। ১৪শ শতাব্দির মধ্যে জোসাফেট-এর এই গল্প এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, জোসাফেট শেষ অব্দি ক্যাথলিক-সন্ত হিসেবে পরিচয় লাভ করে।
ইউরোপিয়ানদের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের প্রথম যোগসূত্র ঘটে যখন ক্যাথলিক উপশাখা ফ্রান্সিকানই এর খৃষ্টান সন্ন্যাসী রিব্রুকের উইলিয়াম ১২৫৩ সালে ফ্রান্সের রাজা সেইন্ট লুইসের নির্দেশে মঙ্গোল রাজ্যে মোংগকে খানের সাথে দেখা করতে আসে। মোংকে খানের সাথে এই সাক্ষাত কাইলাক অঞ্চলে (বর্তমান কাজাখস্তান) হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পূর্বে খৃষ্টান সন্ন্যাসী উইলিয়াম ভেবেছিল মঙ্গোলরা হয়তো স্বৈচ্ছাচারী নামমাত্র খৃষ্টান।
হালাকু খানের শাসনামলে মঙ্গোলদের ইলখানাত সাম্রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়। সেই সাম্রাজ্যে অনেকগুলো বৌদ্ধ মন্দিরের নির্মাণ হয় যা ১৫শ শতাব্দি আসার পূর্বেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইলখানাত সাম্রাজ্যে আর্গুন খান আসীন হলে উক্ত রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে পরে।[৫২]
তিব্বতের বৌদ্ধদের সাথে নিয়ে ১৭শ শতাব্দিতে মঙ্গোলরা কালমাইক খানাতে নামক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু ১৮শ শতাব্দিতে তারা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের দরুন বিলুপ্ত হয়ে যায়[৫৩] এবং নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় এই কালমাইক জনগোষ্ঠী রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহি সেনা হিসেবে ভূমিকা পালন করে।[৫৪]
যখন পাশ্চাত্যের লোকেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন বৌদ্ধ নিদর্শন এবং শিল্পকলার সাথে পরিচি হতে থাকে, তখন থেকে তাদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। এছাড়া ১৮৫৩ সালে জাপান কর্তৃক জাপানী শিল্পকলা ও সংস্কৃতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরার ফলে, বৌদ্ধ সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে আরো গ্রহণযোগ্যতা পায়।
১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট চীন ও তিব্বতের স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বিরোধ ও তিব্বতের বৌদ্ধদের মধ্যে চীন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের রূপ নিলে বহির্বিশ্বের সামনে তিব্বতি বৌদ্ধরা প্রচার পেতে থাকে। আর এই বিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্বে আছেন বৌদ্ধ ভিক্ষু চতুর্দশ দলাই লামা যিনি বর্তমানে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। ধারণা করা হয় তিব্বতে বর্তমানে তার ১২০ মিলিয়নের মতো অনুসারী রয়েছে।[৫৫]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Cousins, L. S. (1996). "The dating of the historical Buddha: a review article", Journal of the Royal Asiatic Society (3)6(1): 57–63.
- ↑ Prebish, Charles S. (2008). Cooking the Buddhist Books: The Implications of the New Dating of the Buddha for the History of Early Indian Buddhism, Journal of Buddhist Ethics 15, p. 2
- ↑ Fa-Hien (author), James Legge, transl. (1896): A Record of Buddhistic Kingdoms, Clarendon, Oxford, P. 95 PDF
- ↑ Edward Joseph Thomas (1927). The Life of Buddha as Legend and History, London, K. Paul, Trench, Trubner & Co
- ↑ Vidyabhusana, Satis Chandra (1971), A History of Indian Logic, Delhi, Motilal Banarsidass, p. 19
- ↑ Thomas, Edward J. (1927), The Life of Buddha, London: K. Paul, Trench, Trubner & Co.; p. 22
- ↑ Stanley Wolpert (1991), India, Berkeley: University of California Press, p. 32
- ↑ Book of the Discipline, Pali Text Society, volume V, Chapter X
- ↑ Encyclopedia of feminist theories। Books.google.com। ২০০৩-১২-১৮। আইএসবিএন 978-0-415-30885-4। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৯।
- ↑ "The Outstanding Women in Buddhism Awards"। Owbaw.org। ২০১১-০১-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৯।
- ↑ ক খ "The Life of the Buddha: (Part Two) The Order of Nuns"। Buddhanet.net। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৯।
- ↑ "A New Possibility"। Congress-on-buddhist-women.org। ২০০৭-০৯-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১১-১৯।
- ↑ History of Afghanistan
- ↑ According to the linguist Zacharias P. Thundy
- ↑ "Zen living", Robert Linssen
- ↑ "The philosopher Hegesias of Cyrene (nicknamed Peisithanatos, "The advocate of death") was a contemporary of Magas and was probably influenced by the teachings of the Buddhist missionaries to Cyrene and Alexandria. His influence was such that he was ultimately prohibited from teaching." Jean-Marie Lafont, Inalco in "Les Dossiers d'Archéologie", No254, p.78
- ↑ Tarn, The Greeks in Bactria and India
- ↑ Clement of Alexandria "The Stromata, or Miscellanies" Book I, Chapter XV: http://www.earlychristianwritings.com/text/clement-stromata-book1.html
- ↑ Divyāvadāna, pp. 429–434
- ↑ Indian Historical Quarterly Vol. XXII, p. 81 ff cited in Hars.407
- ↑ "Elst, Koneraad Ashoka and Pushyamitra, iconoclasts?"। ১ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
- ↑ Aśoka and the Decline of the Mauryas by Romila Thapar, Oxford University Press, 1960 P200
- ↑ Plutarch, Praec. reip. ger. 28, 6
- ↑ "Due to the statement of the Master in the Dighanikaya disfavouring his representation in human form after the extinction of body, reluctance prevailed for some time". Also "Hinayanis opposed image worship of the Master due to canonical restrictions". R.C. Sharma, in "The Art of Mathura, India", Tokyo National Museum 2002, p.11
- ↑ Standing Buddhas: Image 1 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে, Image 2 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে
- ↑ "Il semble qu'on ait là la plus ancienne représentation du Buddha, selon une modalité qui n'est pas encore celle de l'iconograhie boudhique traditionnelle" (French): "It seems this might be the earliest representation of the Buddha, in a style which is not yet that of traditional Buddhist iconography", in "Afghanistan, les trésors retouvés", p280.
- ↑ Guang Xing. The Concept of the Buddha: Its Evolution from Early Buddhism to the Trikaya Theory. 2004. pp. 65–66 "Several scholars have suggested that the Prajñāpāramitā probably developed among the Mahasamghikas in Southern India, in the Andhra country, on the Krsna River."
- ↑ Williams, Paul. Buddhist Thought. Routledge, 2000, pages 131.
- ↑ Williams, Paul. Mahayana Buddhism: The Doctrinal Foundations 2nd edition. Routledge, 2009, pg. 47.
- ↑ Akira, Hirakawa (translated and edited by Paul Groner) (1993). A History of Indian Buddhism. Delhi: Motilal Banarsidass: pp. 253, 263, 268
- ↑ "The south (of India) was then vigorously creative in producing Mahayana Sutras" – Warder, A.K. (3rd edn. 1999). Indian Buddhism: p. 335.
- ↑ Warder, A.K. Indian Buddhism. 2000. p. 313
- ↑ Padma, Sree. Barber, Anthony W. Buddhism in the Krishna River Valley of Andhra. SUNY Press 2008, pg. 1.
- ↑ Akira, Hirakawa (translated and edited by Paul Groner) 1993. A History of Indian Buddhism. Delhi: Motilal Banarsidass: p. 252, 253
- ↑ Personality of Xuanzang Sanzang
- ↑ Buddhism in Andhra Pradesh, story of Buddhism: http://www.indiaprofile.com/religion-culture/buddhisminandhra.htm
- ↑ "Buddhism In Andhra Pradesh"। ১৮ মে ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
- ↑ von Le Coq, Albert. (1913). Chotscho: Facsimile-Wiedergaben der Wichtigeren Funde der Ersten Königlich Preussischen Expedition nach Turfan in Ost-Turkistan ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে. Berlin: Dietrich Reimer (Ernst Vohsen), im Auftrage der Gernalverwaltung der Königlichen Museen aus Mitteln des Baessler-Institutes, Tafel 19 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ মে ২০১৭ তারিখে. (Accessed 3 September 2016).
- ↑ Gasparini, Mariachiara. "A Mathematic Expression of Art: Sino-Iranian and Uighur Textile Interactions and the Turfan Textile Collection in Berlin," in Rudolf G. Wagner and Monica Juneja (eds), Transcultural Studies, Ruprecht-Karls Universität Heidelberg, No 1 (2014), pp 134-163. আইএসএসএন 2191-6411. See also endnote #32. (Accessed 3 September 2016.)
- ↑ Hansen, Valerie (2012), The Silk Road: A New History, Oxford University Press, p. 98, আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৯৯৩৯২১-৩.
- ↑ Crossroads of Asia, p. 209
- ↑ Conze, Edward (১৯৯৩)। A Short History of Buddhism (2nd সংস্করণ)। Oneworld। আইএসবিএন 1-85168-066-7।
- ↑ Conze, 1993, 106
- ↑ ক খ Berzin, Alexander (2000). How Did Tibetan Buddhism Develop?: http://studybuddhism.com/en/advanced-studies/history-culture/buddhism-in-tibet/how-did-tibetan-buddhism-develop; Berzin, Alexander (1996). The Spread of Buddhism in Asia: http://studybuddhism.com/en/tibetan-buddhism/about-buddhism/the-world-of-buddhism/spread-of-buddhism-in-asia
- ↑ Berzin, Alexander, as above
- ↑ Berzin, Alexander. Study Buddhism: http://studybuddhism.com/[যাচাইকরণ ব্যর্থ হয়েছে][স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Jerry Bently, 'Old World Encounters: Cross-Cultural Contacts and Exchanges in Pre-Modern Times (New York: Oxford University Press, 1993), 73.
- ↑ Sanderson, Alexis. "The Śaiva Age: The Rise and Dominance of Śaivism during the Early Medieval Period." In: Genesis and Development of Tantrism,edited by Shingo Einoo. Tokyo: Institute of Oriental Culture, University of Tokyo, 2009. Institute of Oriental Culture Special Series, 23, pp. 124.
- ↑ Sanderson, Alexis. "The Śaiva Age: The Rise and Dominance of Śaivism during the Early Medieval Period." In: Genesis and Development of Tantrism,edited by Shingo Einoo. Tokyo: Institute of Oriental Culture, University of Tokyo, 2009. Institute of Oriental Culture Special Series, 23, pp. 129-131.
- ↑ Sanderson, Alexis. "The Śaiva Age: The Rise and Dominance of Śaivism during the Early Medieval Period." In: Genesis and Development of Tantrism,edited by Shingo Einoo. Tokyo: Institute of Oriental Culture, University of Tokyo, 2009. Institute of Oriental Culture Special Series, 23, pp. 144-145.
- ↑ Huber, Toni (২০০৮)। The holy land reborn : pilgrimage & the Tibetan reinvention of Buddhist India। Chicago: University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 94–95। আইএসবিএন 978-0-226-35648-8।
- ↑ The Islamic World to 1600: The Mongol Invasions (The Il-Khanate):http://www.ucalgary.ca/applied_history/tutor/islam/mongols/ilkhanate.html ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে
- ↑ NUPI - Centre for Russian Studies
- ↑ History of Kalmykia, Government of the Republic of Kalmykia
- ↑ Adherents.com estimates twenty million for "Lamaism (Vajrayana/Tibetan/Tantric)." http://www.adherents.com/adh[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] _branches.html#Buddhism