বুর্কিনা ফাসোতে ইসলাম

বুরকিনা ফাসো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং দেশটির ইসলামের সাথে একটি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময় ইতিহাস রয়েছে। ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুসারে দেশটির মোট জনসংখ্যার ৬৩.২% মুসলিম[১] মুসলমানদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলিম, যারা মালিকি মাযহাবের অনুসারী এবং একটি ক্ষুদ্র অংশ শিয়া ইসলামআহমদিয়া আন্দোলনের অনুসারী। [২] ২০০৯ সালে পিউ ফোরাম রিপোর্ট করে যে, বুরকিনা ফাসোর ১% এরও কম মুসলিম শিয়া।[৩][৪]

বুরকিনা ফাসোর বোবো-দিওলাসোর গ্র্যান্ড মসজিদ

ইতিহাস সম্পাদনা

প্রাথমিক ইতিহাস

১৯ শতকের শেষ অবধি বুর্কিনা ফাসোয় মোসি রাজ্যের আধিপত্য ছিল। তারা ১১ শতকে মধ্য বা পূর্ব আফ্রিকা থেকে বুর্কিনা ফাসোয় এসেছে বলে মনে করা হয়। মোসিরা প্রথমদিকে ইসলামি প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কাঠামোকে রক্ষা করে চলেছিল। এরপর ১৫ শতকে বুর্কিনা ফাসো অঞ্চলে আকান সোনার খনি খোলার মাধ্যমে এবং স্বর্ণ, বাদাম ও লবণের ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি হলে মুসলিম বণিকরা এদিকে ধাবিত হয় এবং বসতি স্থাপন করে। তারা বোবো-ডিউলাসো, কং, বুন্দুকু এবং স্বর্ণখনির আশেপাশে অন্যান্য স্থানে বসতি স্থাপন করেছিল। কিছু ব্যবসায়ী কানেম, বোর্নু এবং হাউসা শহর-রাজ্য থেকে এসে গোঞ্জা, দাগোম্বা এবং বুর্কিনা ফাসোর অন্যান্য অংশে চলে আসেন। মুসলমানরা স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে এবং পরিবার গড়ে তোলে। যেগুলো পিতার মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে এবং মায়ের মাধ্যমে স্থানীয় পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সাথে আবদ্ধ ছিল। তারা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করত; তাবিজ বিতরণ করত এবং জাদুবিদ্যা বিরোধী আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। ফলে তখন এই অঞ্চলের মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র ভাষা গোষ্ঠী ছিল না। কিন্তু নিজেদেরকে মসি রাজ্যের অংশ হিসাবে গণ্য করত।[৫]

১৪৮৩ সালে কোবির যুদ্ধে সোনহাই সুলতান সোনি আলির কাছে মোসিরা পরাজিত হয়। তখম সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ডিউলা সম্প্রদায়গুলি মুসলিম শিক্ষার উচ্চ মান বজায় রেখেছিল। সেসময় কারামোকো নামে পরিচিত একদল উলামা শ্রেণী আবির্ভূত হয়। তারা কোরআন, তাফসির, হাদিস ও নবি মুহাম্মদ সা.- এর জীবন সম্পর্কে শিক্ষিত ছিল। একজন ছাত্র পাঁচ থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে কেবল একজন শিক্ষকের কাছে এই বিষয়গুলি পড়ে এবং তার শিক্ষকের জমিতে কাজ করে একজন খণ্ডকালীন কৃষক হিসাবে তার জীবিকা অর্জন করত। পড়াশুনা শেষ করার পর একজন কারামোকো একটি পাগড়ি ও একটি ইজাজাহ পেত। তারপর সে প্রত্যন্ত গ্রামে তার নিজের স্কুল শুরু করার উদ্দেশ্য চলে রওনা দিতো। এভাবে বুর্কিনা ফাসোর প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।[৫]

ফরাসি ঔপনিবেশিক

১৯১৯ সালে ফ্রান্স বুর্কিনা ফাসোতে ঔপনিবেশিক স্থাপন করে জনগণের ওপর নিজেদের শাসন চাপিয়ে দেয়। তখন এটি আইভরি কোস্ট, নাইজার ও ফরাসি সুদানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং ১৯৪৭ সালে পুনর্গঠিত হয়। ফরাসি আমলে এই অঞ্চলে অনেক খ্রিস্টান মিশনারি আগনন করলেও ফরাসি শাসন ইসলামের শান্তিপূর্ণ ( যা ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উৎসাহী করে না) প্রসারে সহায়তা করেছিল। কারণ, তারা মুসলমানদেরকে অমুসলিম আফ্রিকীয়দের তুলনায় সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অনেক বেশি অগ্রসর বলে মনে করত এবং অমুসলিম অঞ্চলে প্রশাসক হিসেবে মুসলিম প্রধান ও কেরানিদের নিয়োগ করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বুর্কিনা ফাসোতে প্রায় ৩০,০০০ মুসলমান ছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সাল নাগাদ সেই সংখ্যা হয় ৮০০,০০০, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০%। এভাবে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং স্থানীয় পৌত্তলিক ধর্মের অনুসারীরা ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করে। [৫]

স্বাধীন বুর্কিনা ফাসো

১৯৬০ সালে বুর্কিনা ফাসো স্বাধীনতা অর্জন করে। তখন এর নাম আপার ভোল্টা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে বর্তমান নাম বুর্কিনা ফাসো রাখা হয়। দেশটি ফ্রান্সের উপনিবেশ হওয়ার কারণে স্বাধীনতার পরও সেখানে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতি চলমান থাকে। এর ফলে বুর্কিনা ফাসোতে আরবি ভাষা ও ইসলামি সংস্কৃতি প্রচারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। আরবি ভাষাবাদী ও ইসলামবাদী আন্দোলনকে সেখানে ইউরোপীয় আধুনিক ধারার প্রতি-সংস্কৃতি হিসেবে দেখা হয় এবং সেই সাথে দেশের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে এমন একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়।

দেশটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চালু হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এখন মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেককে সেবা দেয়। তবে শুধুমাত্র একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পৌঁছায়। মসজিদ নির্মাণ, জাতীয় টেলিভিশনে ইসলামি অনুষ্ঠান প্রচার, মুসলিম উৎসবের সরকারী স্বীকৃতি এবং আরব বিশ্বের সমর্থন দ্বারাও সেখানে ইসলাম শক্তিশালী হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণত রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য, যারা শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্রের পক্ষে। তবে বুর্কিনা ফাসোর ইসলামী আন্দোলনগুলোও অসংখ্য উপদলে বিভক্ত।[৫][৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The World Factbook — Central Intelligence Agency"www.cia.gov (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০১-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-১৮ 
  2. Breach of Faith। Human Rights Watch। জুন ২০০৫। পৃষ্ঠা 8। মার্চ ১৪, ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মে ৩১, ২০১৪ 
  3. Mapping the Global Muslim Population. Estimate Range of Shia by Country ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৬-১২-১৫ তারিখে. Pew Forum, 2010
  4. Shia Population in: Burkina Faso ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৫-০৫-৩০ তারিখে. ahlulbaytportal.com. 2010 Jan 11.
  5. "Islam in Burkina Faso"Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৩-০৭। 
  6. "Burkina Faso"Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-১১-০৭।