বিশ্ব সিংহ

কোচ রাজবংশের রাজা

বিশ্ব সিংহ (১৫১৫-১৫৪০) কামতা রাজ্য শাসন করা কোচ রাজবংশ-এর আদি রাজা। তিনি কোচ বংশীয় ছিলেন।[১] কোচদের শাসক হাজোর নাতি এবং হাড়িয়া মণ্ডল-এর পুত্র বিশ্ব সিংহ‌ আসামের ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে কয়েকটি জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার প্রতিষ্ঠা করা কামতা রাজ্যর অবশেষ এখনো আছে।

বিশ্ব সিংহ
রাজত্ব১৫১৫-১৫৪০
রাজ্যাভিষেক১৫১৫
পূর্বসূরিনাই
উত্তরসূরিনরনারায়ণ
প্রধান স্ত্রীরত্নকান্তি,হেমপ্রভা,পদ্মাবতী,চন্দ্রকান্তি
রাজবংশকোচ
পিতাহাড়িয়া মণ্ডল

কোচ রাজবংশের আরম্ভ সম্পাদনা

১২শ শতকে কামরূপ রাজ্যর ভাঙনের পর স্থানীয় শাসক এবং জমিদাররা ছোট ছোট রাজ্য ভাগ করে নেয়। একবারে পূর্বে চুতীয়া, আহোম এবং কাছাড় রাজ্য গড়ে ওঠে।[২] পশ্চিম দিকে পূর্বের রাজ্যসমূহ এবং কামতা রাজ্য-এর মধ্যের অংশে ভূঁইয়ারা স্থান নিয়েছিল। ১৪৯৮ সালে গৌড়-এর রাজা আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতার রাজা নীলাম্বর সেন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কামতা অধিকার করে তার এক পুত্র ডানিয়ালকে বসিয়ে যায়। পরে বারভূঞারা হারূপ নারায়ণের নেতৃত্বে ডানিয়ালকে পরাস্ত করে। আক্রমণকারীদেরকে বিতাড়িত করার পরেও ভূঞারা একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি এবং আগের মতোই ছোট ছোট অঞ্চলে শাসন চালিয়ে যায়। পরবর্তী কালে বিশ্ব সিংহ‌ কামতা অঞ্চলের অন্য জনগোষ্ঠীসমূহ একত্রিত করে রাজ্য স্থাপন করতে সমর্থ হন।

জন্ম এবং পরিবার সম্পাদনা

বিশ্ব সিংহের পিতার নাম ছিল হাড়িয়া মণ্ডল। তিনি কোচ নেতা কোচ হাজোর দুই কন্যা হীরা এবং জীরাকে বিয়ে করেছিলেন। হীরার ঔরসে বিশু বা বিশ্ব সিংহর জন্ম হয়। বিশু খুব সম্ভব ডানিয়ালের বিরুদ্ধে ভূঞাদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। [৩]

ভূঁঁইয়াদের সাথে যুদ্ধ সম্পাদনা

১৫০৯ সাল নাগাদ বিশু জনজাতীয় নেতাদেরকে একজোট করার অভিযান আরম্ভ করেন।[৪] দরং, করাইবারী, আতিয়াবারী, কামতাবারী, বলরামপুর ইত্যাদি কয়েকটি জনজাতীয় অঞ্চল তার সাথে জোটবদ্ধ হয়।[৫] এই অভিযানে তিনি ঔগুরির কুসুম ভূঞা, দীঘলা ভূঞা, কলিয়া ভূঞা, ঝারগ্রাঁ- কবিলাস ভূঞা, কর্ণপুর, ফুলগুরি, বিজনী এবং শেষে পাণ্ডুনাথের (গুয়াহাটির পাণ্ডু) ভূঞাকে পরাস্ত করেছিলেন। কর্ণপুরের ভূঞার বিরুদ্ধে অভিযান অতি কঠিন সাব্যস্ত হয়েছিল।[৬] এই অভিযান বান্দুকা এবং সজলাগ্রামের মত স্থানের ভূঞাদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।

কামতাপুরে সম্পাদনা

ভূঞাদেরকে পরাস্ত করে বিশু তার কর্মস্থল চিকণার থেকে কামতাপুরে (বর্তমান কোচবিহার শহরের কয়েক মাইল দক্ষিণ-পূর্বে) তুলে আনেন এবং নিজেকে কামতা রাজ্য-এর শাসক বলে ঘোষণা করেন। তিনি বিশ্ব সিংহ বলে হিন্দু নাম গ্রহণ করেন। এইভাবে ১৫১৫ সালে কামতার কোচ রাজবংশের সূত্রপাত হয়।[৭] তিনি ভাই শিশুকে (শিষ্য সিংহ) যুবরাজ ঘোষণা করেন। পরে শিশুর সন্তান-সন্ততি জলপাইগুড়ির রায়কত রাজা হয়। ভূঞার বিরুদ্ধে অভিযানে সহায়তা করা জনজাতীয় নেতাসমূহের মধ্যে থেকে তিনি কার্জি নামক বারজন মন্ত্রীর পদের সৃষ্টি করেন। এই দুজন কার্জি এবং যুবরাজ মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করে। সেনাবাহিনীর নায়ক হিসেবে সেনাপতি পদের সৃষ্টি করা হয়। একটা লোকগণনার পরে তিনি প্রজার সুনিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদবীর সৃষ্টি করেন। সুস্থ-সবল পুরুষদেরকে পাইক বলা হত, তার ওপর ছিলেন ঠাকুরীয়া (২০ জন পাইকের ওপর), শইকীয়া (১০০ জন পাইকের ওপর), হাজারী (১০০০ জন পাইকের ওপর), ওমরা (৩০০০ জন পাইকের ওপর) এবং নবাব (৬৬,০০০ জন পাইকের ওপরে)।[৮]

জনজাতীয় লোকদেরকে কার্জি হিসেবে নিযুক্ত করে বিশ্ব সিংহ‌ তাদের সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। নিযুক্ত করা একমাত্র ব্রাহ্মণ ছিলেন রাজ পুরোহিত[৯]

বিশ্ব সিংহ বিবাহের মাধ্যমে অন্য রাজা এবং নেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। নেপাল, গৌড়, কামরূপ, বারাণসী, মিথিলা এবং কাশ্মীর থেকে তার আঠারোটি পত্নী ছিল এবং তাদের থেকে আঠারোজন পুত্র লাভ করেছিলেন। পুত্রদেরকেও প্রশাসনিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। নর সিংহকে (নেপালের রত্নকান্তির পুত্র) ভুটান-এর রাজার থেকে জয় করা অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। গৌড়ের হেমপ্রভার পুত্র মল্লদেব (পরে নরনারায়ণ) উত্তরাধিকারী ছিলেন। গৌড়ের পদ্মাবতীর পুত্র শুক্লধ্বজ (পরে চিলারায়), কামরূপের চন্দ্রকান্তির পুত্র গোহাঁই কমল ইত্যাদি রাজ্যের কাজের দায়িত্বে ছিলেন।

প্রাবর রাজ্য সম্পাদনা

কামতা রাজ্য স্থাপন করলেও প্রশাসন এমন সবল ছিল না। গৌড়-এর শাসক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জয় করার মনোভাব পুষে রাখতেন এবং আহোম রাজ্যর সাথে প্রায়ই সংঘাত হত৷ ১৫৩২-৩৩ সালে আহোম রাজ্য আক্রমণ করা তুর্বক[১০] খুব সম্ভব কামতা রাজ্যর মধ্যে দিয়েই গেছিল।[১১] তুর্বল পরাস্ত হয় এবং তার সেনাবাহিনীকে আহোম সেনাপতি টংখাম বুঢ়াগোহাঁই কামতা রাজ্যর পশ্চিম সীমা করতোয়া নদী পর্যন্ত নিয়ে যায়। এই যুদ্ধের শেষে টংখাম বুঢ়াগোহাঁই বিশ্ব সিংহকে কামতা রাজ্য সহ আহোম রাজ্য এবং গৌড়ের মধ্যে প্রাবর রাজ্য (buffer state) হিসেবে থাকতে দেয়।

বিশ্ব সিং‌হ আহোমের করতলগত হয়ে থাকতে না চেয়ে ১৫৩৭ সালে আহোম রাজ্য আক্রমণের মন করেন। রসদ-পাতির অভাব হওয়াতে তিনি এই মনোভাব সামলে আহোম রাজসভায় যান এবং বার্ষিক কর দিতে রাজি হন।[১২] এই কথা তার জন্য অসহনীয় ছিল এবং মৃত্যুশয্যায় উত্তরাধিকারীকে তিনি করতলীয় রাজ্যের থেকে মুক্ত হতে বলে যান।

তিনি সৌমারপীঠ রাজ্য বিজনী, বিদ্যাগ্রাম এবং বিজয়পুর আক্রমণ করে জয়ী হয়েছিলেন। এরপরে তিনি ভুটান আক্রমণ করে জয়ী হন এবং একটি চুক্তি করেন। হুসেইন শাহ শাসন করা গৌড়ের কিছু অংশ তিনি জয় করেছিলেন। তার রাজত্বকালে তুরুক খান এবং গৌড়ের রাজা নুসরত শাহের সঙ্গে মুসলমানরা কয়েকবার আক্রমণ করেছিল এবং কোচদের হাতে পরাস্ত হয়েছিল।

বিশ্ব সিংহ একজন ভাল রাজ্যশাসকও ছিলেন। বিদ্যার প্রতি অনুরাগী রাজা পুত্র নরনারায়ণ এবং শুক্লধ্বজকে বারাণসীতে শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কনৌজ, মিথিলা ইত্যাদি থেকে তিনি পুরোহিত আনিয়ে কয়েকটি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। ১৫৫৪ সালে ৫৩ বছর বয়সে তিনি দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণকে রাজ্যভার দিয়ে হিমালয়ে নির্বাসন নেন।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. "Cooch Behar Government: Royal History : Book of Facts and Events. Translated from "Kochbiharer Itihas", 2nd edition (1988), by Shri. Hemanta Kumar Rai Barma"। ২৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  2. (Nath 1989:19)
  3. (Nath 1989:22–23)
  4. (Nath 1989:28–29)
  5. (Nath 1989:23)
  6. (Nath 1989:25)
  7. (Nath 1989:28)
  8. (Nath 1989:29–32)
  9. (Nath 1989:32)
  10. (Nath 1989:33)
  11. (Nath 1989:34–35)
  12. (Nath 1989:33–34)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Nath, D (১৯৮৯), History of the Koch Kingdom: 1515–1615, Delhi: Mittal Publications