হিরণ্যকশিপু

হিন্দু ধর্মের এক অসুর

হিরণ্যকশিপু [(সংস্কৃত: हिरण्यकशिपु) বা হিরণ্যকশ্যপ (সংস্কৃত: हिरण्यकश्यप) নামেও পরিচিত] হলো হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত দৈত্যদের একজন রাজা ও অসুররাজ[১] হিরণ্যকশিপু শব্দের আভিধানিক অর্থ "স্বর্ণবস্ত্র পরিহিত" যেখানে হিরণ্য অর্থ "স্বর্ণ" এবং কশিপু অর্থ "নরম বালিশ"। হিরণ্যকশিপুর অন্য অর্থ হলো, যে ব্যক্তি সম্পদ এবং ইন্দ্রিয়সুখ পরায়ণ। পুরাণে অবশ্য আরো উক্ত হয়েছে যে, 'হিরণ্যকশিপু' নামক একটি সোনার সিংহাসন থেকে এই নামটি এসেছে, যার অর্থ হলো যে অসুর অতিরাত্র (সোম) যজ্ঞে উপবিষ্ট থাকত। [২] হিরণ্যকশিপুর ছোট ভাই, হিরণ্যাক্ষ, ভগবান বিষ্ণুর বরাহ অবতার কর্তৃক নিহত হয়। এতে প্রতিশোধপরায়ণ ও রাগান্বিত হয়ে, অতিপ্রাকৃত শক্তি তথা অমরত্ব লাভের জন্য ভগবান ব্রহ্মার তপস্যা আরম্ভ করে। কিন্তু, পরবর্তীতে ভগবান বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার তাকে হত্যা করে।

হিরণ্যকশিপু
১৮ শতাব্দীতে অঙ্কিত চিত্রপট, সিংহাসনে উপবিষ্ট হিরণ্যকশিপু তার পুত্র প্রহ্লাদকে হত্যা করতে উদ্যত।
অন্তর্ভুক্তিঅসুর
অস্ত্রগদা
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতা
সহোদরহিরণ্যাক্ষ (ছোট ভাই), হোলিকা (বোন)।
সঙ্গীকয়দু
সন্তানপ্রহ্লাদ, আহ্লাদ (পুত্র)

হিরণ্যকশিপুর কাহিনি প্রকাশ করে যে, অন্যের উপর অত্যাচারকারী ও অহংকারী বিনষ্ট হয় এবং ঈশ্বরে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী ভক্তকে (এখানে: প্রহ্লাদকে) ঈশ্বর সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী, হিরণ্যকশিপু, দেবতা ব্রহ্মা হতে বর লাভ করে। ফলতঃ সে অংশত অমরত্ব লাভ করে। হিরণ্যকশিপু কাহিনির তিনটি পর্ব। প্রথম পর্বে, বৈকুণ্ঠের দ্বারপাল জয় এবং বিজয় বৈকুণ্ঠে চার কুমারকে প্রবেশ করতে না দিলে তারা অভিশাপ দেয় যে, জয়-বিজয়, পৃথিবীতে হিরণ্যকশিপু ও হিরণ্যাক্ষ নামক দৈত্য হয়ে জন্ম নিবে। দ্বিতীয় পর্বে, হিরণ্যকশিপু অমরত্ব লাভের জন্য তপস্যা করে ভগবান ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করে এবং বর লাভ করে। শেষ পর্বে, শত চেষ্টা করেও সে তার পুত্র প্রহ্লাদকে (ভগবান বিষ্ণুর এক ভক্ত) মারতে পারে নি এবং পরে নৃসিংহাবতার হিরণ্যকশিপুকে বধ করে।

জন্ম রহস্য সম্পাদনা

মহর্ষি কশ্যপের ঔরসে তৎপত্নী দিতির গর্ভে এই দৈত্যের জন্ম হয়। তার ভাইয়ের নাম হিরণ্যাক্ষ। হিরণ্যাক্ষ বিষ্ণুর হাতে নিহত হলে হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হয় এবং তার নিকট এরূপ বর প্রাপ্ত হয় যে, সে জীব-জন্তু ও যেকোন অস্ত্রের অবধ্য হবে এবং ভূতলে, জলে বা শূন্যে ও দিনের বেলা কিংবা রাতের বেলা তার মৃত্যু হবে না। এরূপ বরে প্রচণ্ডভাবে দৃপ্ত ও উজ্জীবিত হয়ে হিরণ্যকশিপু যথেচ্ছাচার নিয়ম-কানুন করে রাজ্যশাসন করতে লাগল।

হিরণ্যকশিপু ও প্রহ্লাদ সম্পাদনা

হিরণ্যকশিপুর পত্নীর নাম কয়াধু। তার গর্ভে চারটি পুত্র জন্মে। তন্মধ্যে প্রহ্লাদ সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। এছাড়াও, প্রহ্লাদ পরম বিষ্ণুভক্ত ছিলেন, কিন্তু হিরণ্যকশিপু ঘোর বিষ্ণুদ্বেষী ছিলেন।

বিষ্ণুদ্বেষী হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু সম্পাদনা

পিতার তাড়নায় এবং শিক্ষকের উপদেশে প্রহ্লাদ হরিনাম ত্যাগ না করায় হিরণ্যকশিপু তার প্রাণনাশের আদেশ দিলেন। বিষাক্ত সাপের বিষ প্রয়োগ, প্রজ্জ্বলিত আগুন, গভীর জলে ডুবানো, হাতির পদতলে পৃষ্ট হওয়াসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের মৃত্যু হয়নি দেখে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে নিজ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি এ সমস্ত বিপদ, সংকট হতে কীভাবে পরিত্রাণ পেলে?" প্রহ্লাদ হিরণ্যকশিপুর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, "সর্ববিপদভঞ্জন হরিই আমাকে এ সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছেন।" এরপর হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার হরি কোথায় থাকে?" প্রত্যুত্তরে শিশু প্রহ্লাদ বললেন, "তিনি সবসময়, সব জায়গায় অবস্থান করেন।" দৈত্যরাজ পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তোমার হরি এক্ষণে এ স্ফটিকস্তম্ভে আছে কি?" প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, "আছেন বৈ-কি!" এ কথা শুনে প্রচণ্ড গর্জন করে দৈত্য হিরণ্যকশিপু ঐ স্ফটিকস্তম্ভ পা দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলেন। ঐ মূহুর্তেই তা হতে এক নরসিংহ মূর্তি নির্গত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে স্বীয় দুই উরুর উপর রেখে দিন ও রাতের সন্ধিকালে নখ দিয়ে রক্তাক্ত করে সংহার করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Nurturing Child and Adolescent Spirituality: Perspectives from the World's Religious Traditions, p. 20, Karen-Marie Yust, Aostre N. Johnson, Sandy Eisenberg Sasso, Rowman & Littlefield
  2. G.V.Tagare (১৯৫৮)। Brahmanda Purana - English Translation - Part 2 of 5। পৃষ্ঠা 426 (5.4-5)। 

আরও দেখুন সম্পাদনা

  • সুবলচন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গাল‍া অভিধান, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৯৫।