হিমশৈল

হিমশৈল হলো পরিষ্কার পানির বরফের একটি বৃহৎ টুকরা যা হিমবাহ বা একটি বরফের বড় তাক ভেঙে গিয়ে তৈরী হ

হিমশৈল (ইংরেজি: iceberg) হলো পরিষ্কার পানির বরফের একটি বৃহৎ টুকরো , যা হিমবাহ বা একটি বরফের বড় তাক ভেঙে গিয়ে তৈরী হয় এবং খোলা পানিতে অবাধে ভেসে বেড়ায়।[১][২] হিমশৈলের ছোট বিটগুলিকে "গ্রোয়ার" বা "বার্গি বিট" বলা হয়। একটি আইসবার্গের বেশিরভাগ অংশ পানির নিচে থাকে যা "আইসবার্গের ডগা" হিসেবে অভিব্যক্ত করা হয়। এটি পানির উপর থেকে দেখা না যাওয়ায় একে অদৃশ্য অংশ বলে অভিহিত করা হয়। আইসবার্গ সমুদ্রপথের মারাত্মক ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য ১৯১২ সালের টইটানিক জাহাজ ডুবির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে ১৯১৪ সালে আন্তর্জাতিক আইস প্যাট্রোল গঠিত হয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের চারপাশের সমুদ্রে বিভিন্ন হিমবাহ দ্বারা সজ্জিত আইসবার্গগুলি অনিয়মিত আকারের হয়। অ্যান্টার্কটিকায় বরফের তাকগুলি বড় টেবুলার অর্থাৎ টেবিলের মতো বিস্তর এবং সমতল হয়। সর্বকালের সবচেয়ে বড় আইসবার্গটি ছিল আইসবার্গ বি-১৫ এ যা ২০০০ সালে অ্যান্টার্কটিকার রস আইস শেল্ফ থেকে আলাদা হয়ে যায়।

আর্কটিক সাগরে একটি হিমশৈল।

আকার-আকৃতি সম্পাদনা

বরফের ঘনত্ব প্রায় ৯২০ কেজি/মিটার এবং সমুদ্রের জলের প্রায় ১,০২৫ কেজি/মিটার। একটি আইসবার্গের সম্পূর্ণ অংশের মাত্র দশ ভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরে থাকে তাই ভূগর্ভস্থ অংশটি উপরের অংশটি দেখে বিচার করা কঠিন হতে পারে। আইসবার্গগুলি প্রায়শই ম্যানহাটন অঞ্চলের আকারের সাথে তুলনা করা হয়।আইসবার্গগুলি সমুদ্রের পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় পৌঁছতে পারে এবং প্রায় ১০০০০০ টন থেকে ১০০০০০০০ টনের চেয়েও বড় আকার ধারণ করতে পারে। আইসবার্গ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটারের চেয়ে কম উঁচু এবং ছোট ভাসমান বরফের টুকরোগুলিকে "বার্গি বিট" হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়, ১ মিটারের চেয়ে ছোটগুলিকে বলা হয় "গ্রোয়ার"। উত্তর আটলান্টিকের সবচেয়ে বেশি পরিচিত আইসবার্গটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৮ মিটার উঁচু যা একটি ৫৫ তলা ভবনের সমান। এই আইসবার্গগুলি পশ্চিমের গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয় এবং এর অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা -১৫ থেকে -২০°C (৫ থেকে −৪°F) থাকে।

আইসবার্গের বরফ গলে যাওয়ার সময় এটি "বার্গি সেল্টজার" নামক সোঁ-সোঁ ধরনের এক প্রকার শব্দ তৈরি করে। মূলত বরফ জলে পরিণত হওয়ার সময় বরফের মধ্যে আটকে থাকা সংকুচিত বাতাসের বুদবুদ থেকে এই শব্দটি তৈরী হয়। এটি হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি বুদবুদ ফেটে এক ধরনের "পপ" শব্দ করে। এ বুদবুদগুলি বরফ তৈরী হওয়ার সময় তৈরী হয় এবং বরফের ভেতরের চাপে আটকে থাকতে থাকতে তুষার বরফে রূপান্তরিত হয়ে যায় যা বরফ গলার সময় আবার বাতাস উৎপন্ন করতে পারে।

আইসবার্গের দুটি প্রকারের হয়ে থাকে- ট্যাবুলার এবং অ-সারণী।

ট্যাবুলার আইসবার্গের খাড়া দিক এবং সমতল শীর্ষ রয়েছে, অনেকটা একটি মালভূমির মতো। এই ধরনের আইসবার্গটি আইস দ্বীপ হিসাবেও পরিচিত,এটি যথেষ্ট বড় হতে পারে। আইস শেল্ফ, যেমন রস আইস শেল্ফ বা ফিলচনার-রন আইস শেল্ফ থেকে শুরু করে এন্টার্কটিক আইসবার্গগুলি সাধারণত টেবুলার হয়। বিশ্বের বৃহত্তম আইসবার্গগুলি এভাবেই গঠিত হয়।

অ-সারণী আইসবার্গগুলির বিভিন্ন আকার রয়েছে, যেমন- গম্বুজ: বৃত্তাকার শীর্ষ সহ একটি আইসবার্গ। চূড়া: এক বা একাধিক অংশবিশিষ্ট একটি আইসবার্গ। ওয়েজ: একদিকে খাড়া প্রান্ত এবং বিপরীত দিকে কাদার মতো নরম অংশবিশিষ্ট একটি আইসবার্গ। শুকনো ডক: একটি আইসবার্গ যা কোন স্লট বা চ্যানেল গঠনে ক্ষয় হয়েছে। ব্লকি: খাড়া,সোজা এবং সমতল শীর্ষসহ একটি আইসবার্গ। এটি ট্যাবুলার আইসবার্গসের চেয়ে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতায় অনুপাতে ছোট।

ইতিহাস সম্পাদনা

১৯১০ এর দশকের শুরুর দিকে আইসবার্গস দ্বারা অনেকগুলি মারাত্মক জাহাজ ডুবেছিল, তাছাড়া সংঘর্ষের হাত থেকে জাহাজ রক্ষার জন্য আইসবার্গস ট্র্যাক করার মতো কোন ব্যবস্থা ছিল না। ১৯০৭ সালে, এসএস ক্রোনপ্রিনজ উইলহেম, একটি যাত্রাবাহী জাহাজ, একটি আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তার যাত্রা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে ইস্পাতের জাহাজ নির্মাণ উদ্ভাবনের ফলে ডিজাইনাররা তাদের জাহাজগুলিকে "অবিচ্ছিন্ন" হিসাবে ঘোষণা করে। কিন্তু ১৯১২ সালের এপ্রিলে টাইটানিকের ডুবে যাওয়া এবং তার ২,২২৩ জন যাত্রী ও কর্মচারীদের মধ্যে ১,৫১৮ জন মৃত্যু, এই দাবিটিকে অস্বীকার করেছিল। ফলে সে বছর অবশিষ্ট শীতকাল জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী জলের উপর টহল দেয় এবং বরফের প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে। ১৯১৩ সালের নভেম্বরে আইসবার্গগুলি পর্যবেক্ষণের আরও স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লন্ডনে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন মাসের মধ্যে অংশগ্রহণকারী সামুদ্রিক দেশগুলি আন্তর্জাতিক আইস প্যাট্রোল (আইআইপি) গঠন করে যার লক্ষ্য ছিল স্রোত, বরফ প্রবাহ, সমুদ্রের তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততার মাত্রা পরিমাপের জন্য আবহাওয়া এবং সমুদ্রবিজ্ঞানের তথ্য সংগ্রহ করা। তারা নিউফাউন্ডল্যান্ডের গ্র্যান্ড ব্যাংকগুলির কাছের আইসবার্গের ঝুঁকিগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিল এবং সমুদ্রসীমা সম্প্রদায়ের কাছে আশেপাশের সমস্ত পরিচিত বরফেসীমার তথ্য সরবরাহ করেছিল। আইআইপি ১৯২১ সালে তাদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেছিল, যা বছরের পর বছর আইসবার্গের চলাচলে তুলনামূলক আলোচনা প্রদর্শন করে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মার্কিন জাতীয় বরফ কেন্দ্র (এনআইসি) দ্বারা আইসবার্গগুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যবেক্ষণ করা হয়, যা আর্টিক, অ্যান্টার্কটিক, গ্রেট লেকস এবং চেসাপেক-বে তুষারের অবস্থার বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাস তৈরি করে। এছাড়াও সমুদ্রের বরফ বিশ্লেষণে ব্যবহৃত ৯৫% এরও বেশি তথ্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকারী স্যাটেলাইটগুলোর দূরবর্তী সেন্সরগুলি থেকে পাওয়া যায়।

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পাদনা

১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে সমুদ্রের বায়ু নজরদারি 'চার্টার সিস্টেম' বিকাশ লাভ করে যা সমুদ্রের স্রোত এবং আইসবার্গের অবস্থানগুলি সঠিকভাবে বিশদ দিতে পারত। ১৯৪৫ সালে, এ আইসবার্গগুলি সনাক্তকরণে রাডারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা শুরু হয়। এক দশক পরে, তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সমুদ্রবৃত্তীয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো স্থাপন করা হয়েছিল যেগুলো পরিবেশ গবেষণায় কাজ করে চলছে। ১৯৬৪ সালে সমুদ্রবৃত্তীয় পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে একটি জাহাজে প্রথম একটি কম্পিউটার বসানো হয়েছিল, যা তথ্যগুলির দ্রুত মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়। ১৯৭০ এর দশকের মধ্যে, বরফ ভাঙতে সক্ষম এ ধরনের জাহাজগুলি অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত বরফের স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংগ্রহ করতে পেরেছিল। অপটিক্যাল স্যাটেলাইটগুলির সিস্টেম এর মধ্যে কিছুটা উন্নত হয়ে গেলেও আবহাওয়াজনিত কারণে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ১৯৮০-এর দশকে, অ্যান্টার্কটিক জলের মধ্যে সমুদ্রবৃত্তীয় এবং জলবায়ু গবেষণার জন্য ড্রিফটিং বুয়ে ব্যবহৃত করা হয়। এগুলো সমুদ্রের তাপমাত্রা এবং স্রোতগুলি পরিমাপ করতে সক্ষম এমন এক ধরনের সেন্সররের সাথে বায়ুবাহিত রাডার ব্যবহার করে সব রকম আবহাওয়ায় আইসবার্গগুলোর ছবি তুলতে সক্ষম হয়। নভেম্বর ৪, ১৯৯৫-এ কানাডা 'রাডারস্যাট-১' চালু করে যেটি কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পৃথিবীর চিত্র সরবরাহ করে। এই সিস্টেমটিই প্রথম সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার(এসএআর) ব্যবহার করেছিল, যা সমুদ্রের পৃষ্ঠে মাইক্রোওয়েভ শক্তি প্রেরণ করে এবং আইসবার্গগুলিকে ট্র্যাক করে এদের প্রতিচ্ছবি রেকর্ড করে। এরপর ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি 'ENVISAT' নামক একটি পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট ১৯ মার্চ,২০০২ এ চালু করেছিল। এটি উন্নত সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার (এএসআর) প্রযুক্তি যুক্ত করে, যা আইসবার্গগুলোর উচ্চতাগুলি সঠিকভাবে সনাক্ত করতে পেরেছিল। কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে 'রাডারস্যাট-২' চালু করে, যা এসএআর এবং মাল্টি-পোলারাইজড পদ্ধতি ব্যবহার করে 'রাডারস্যাট-১' এর সাথে একই কক্ষপথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।

সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত বড় আইসবার্গসমূহ সম্পাদনা

  • ১৯৮৭, আইসবার্গ বি -৯, ৫৩৯০ বর্গ কিমি (2,080 বর্গ মাইল)
  • ১৯৯৮, আইসবার্গ এ -৩৮, প্রায় ৬৯০০ বর্গ কিমি (2,700 বর্গ মাইল)
  • ১৯৯৯, আইসবার্গ বি -১৭, ১৪০ বর্গ কিমি (54 বর্গ মাইল),এর উপর শিপিং সতর্কতা জারি করা হয়েছে ২০০৯ এর ডিসেম্বর সময়
  • ২০০০, আইসবার্গ বি -১৫, ১১০০ বর্গ কিমি (4,200 বর্গ মাইল)
  • ২০০২, আইসবার্গ সি -১৯, ৫৫০০ বর্গ কিমি (2,100 বর্গ মাইল)
  • ২০০২, আইসবার্গ বি -২২, ৫৪৯০ বর্গ কিমি (2,120 বর্গ মাইল)
  • ২০০৩, আইসবার্গ বি -১৫, ৩১০০ বর্গ কিমি (1,200 বর্গ মাইল)
  • ২০০৬, আইসবার্গ ডি -১৬, ৩১০ বর্গ কিমি (120 বর্গ মাইল)
  • ২০১৪, আইসবার্গ বি -৩১, ৬১৫ বর্গ কিমি (237 বর্গ মাইল)
  • ২০১৭, আইসবার্গ এ -৬৮, ৫৮০০ বর্গ কিমি (2,200 বর্গ মাইল)
  • ২০১৮, আইসবার্গ বি -৪৬, ২২৫ বর্গ কিমি (87 বর্গ মাইল)
  • ২০১৯, আইসবার্গ ডি -২৮, ১৬৩৬ বর্গ কিমি (2৩২ বর্গ মাইল)

এগুলো ছাড়াও ২০১১ সালের জুনে পিটারম্যান আইস আইল্যান্ডের কিছু বৃহত টুকরা ল্যাব্রাডর উপকূলে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। আইস শীট, ২২৬০ কিলোমিটার (১০০ বর্গ মাইল), ১৯৬২ সাল থেকে বৃহত্তম আর্কটিক আইসবার্গ হিসাবে বিবেচিত। উত্তর গ্রিনল্যান্ডের পিটারম্যান গ্ল্যাসিয়ার হতে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আগস্ট, ২০১০ সালে যা এর প্রায় এক মাস পরে গ্রিনল্যান্ডের পাশে নরেস স্ট্রেটের জো আইল্যান্ডে বিধ্বস্ত হয়ে দু'টুকরো হয়ে যায়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Definitions of the word "Iceberg""। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১২-২০ 
  2. "Common Misconceptions about Icebergs and Glaciers"। Ohio State University। Icebergs float in salt water, but they are formed from freshwater glacial ice.