হরিনাথ মজুমদার

বাঙালি কবি

হরিনাথ মজুমদার যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে সমধিক পরিচিত (জন্ম: ২২ জুলাই,: ১৮৩৩ - মৃত্যু: ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৬) তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। তিনি বাউল সঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি সর্বসমক্ষে ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। অধিকন্তু তিনি গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা প্রকাশের জন্যও প্রসিদ্ধ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কুষ্টিয়ায় তার স্মরণে “কাঙাল হরিনাথ জাদুঘর” প্রতিষ্ঠা করে।

হরিনাথ মজুমদার
হরিনাথ মজুমদার
জন্ম(১৮৩৩-০৭-২২)২২ জুলাই ১৮৩৩
মৃত্যু১৬ এপ্রিল ১৮৯৬(1896-04-16) (বয়স ৬২)
জাতীয়তাবাঙালি
অন্যান্য নাম
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়
পেশাবাউল শিল্পী, লেখক

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের নদীয়া জেলার কুমারখালি (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা) জন্মগ্রহণ করেন। খুব ছোটবেলায় তার পিতা-মাতা লোকান্তরিত হন। তার পিতার নাম হরচন্দ্র মজুমদার। বাল্যকালে কৃষ্ণনাথ মজুমদারের ইংরেজি স্কুলে কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষায় বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি।[১] তবে সারাজীবন অবহেলিত গ্রামবাংলায় শিক্ষাবিস্তারের জন্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন করেছেন তিনি। অতঃপর গোপাল কুণ্ডু, যাদব কুণ্ডু, গোপাল স্যান্যাল প্রমুখ বন্ধুদের সাহায্যে ১৩ জানুয়ারি, ১৮৫৫ সালে নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন হরিনাথ মজুমদার। এরপর বেশ কিছুদিন ঐ বিদ্যালয়েই বিনাবেতনে শিক্ষকতার করেন। পরবর্তীকালে তারই সহায়তায় ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৫৬ সালে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে কুমারখালী সরকারি পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

সাংবাদিকতা সম্পাদনা

 
কুষ্টিয়ায় স্থাপিত ‘কাঙাল হরিনাথ জাদুঘর’-এর অভ্যন্তরভাগের একটি দৃশ্য।

অত্যাচারিত, অসহায়, নিষ্পেষিত কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ারস্বরূপ সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন হরিনাথ মজুমদার। অল্পশিক্ষা নিয়েই তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। প্রাচীন সংবাদপত্র হিসেবে বিবেচিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

পরবর্তীকালে ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালি এলাকা থেকে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। মাসিক এ পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।[২] এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়মিত মুদ্রিত হতো। নিজগ্রামের লোকের উপর জোর-জুলুম, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণের সামনে আনার উপলক্ষ্যে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন কবি ইশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ। কবির উপদেশে তার (কাঙাল) প্রবন্ধের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে প্রকাশ করা হতো। তারপর নিজ উদ্যোগে গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। তা ‘কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো।[৩] চার-ফর্মার এই মাসিক পত্রিকার মূল্য ছিল পাঁচ আনা।’[৪] শেষে এক পয়সার সাপ্তাহিকী পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, কুসীদজীবী ও নীলকর সাহেবদের শোষণের কেচ্ছা-কাহিনীও প্রকাশিত হতো। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও দেশী জমিদারদের অব্যাহত হুমকিও তাকে এ-কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

নিঃস্ব কাঙ্গাল হরিনাথ সারাজীবনে সচ্ছলতার মুখ দেখতে না পেলেও ১৮৭৩ সালে কুমারখালির নিজ গ্রামেই ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৮ বছর রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবী'র অর্থ আনুকূল্যে পত্রিকা চালানোর পর আর্থিক কারণে ও সরকারের মুদ্রণ শাসন ব্যবস্থার জন্য পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে হয়।

আশৈশব জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে হরিনাথের মনে যে প্রতিকারচিন্তা জাগে সেখান থেকেই তিনি সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন।”[৪]

বাউল সঙ্গীত সম্পাদনা

দীর্ঘ আঠারো বছর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা পরিত্যাগপূর্বক ধর্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। হরিনাথ মজুমদার আধ্যাত্মিক গুরু ও মহান সাধক ফকির লালনের গানের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। ধর্মভাব প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে তিনি নিজস্ব একটি বাউল সঙ্গীতের দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি কাঙ্গাল ফকির চাঁদের দল নামে পরিচিতি ছিল।

হরিনাথের স্বরচিত গানগুলোও আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর ছিল। গান রচনায় তিনি অসম্ভব পারদর্শিতা ও পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। স্বলিখিত গানে কাঙ্গাল ভণিতার ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ছিল। তাঁর রচিত বাউল সঙ্গীতগুলো ফকির চাঁদের বাউল সঙ্গীত নামে সুপ্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম সাধনার অঙ্গরূপে তিনি বহু সহজ-সুরের গান রচনা করে সদলবলে সেই গান গেয়ে বেড়াতেন। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হ'ল গানটি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। গানটির প্রথম চার চরণ নিম্নরূপ :-

হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পাড় কর আমারে।

তুমি পাড়ের কর্তা জেনে বার্ত্তা তাই ডাকি তোমারে।।

আমি আগে এসে ঘাটে রইলাম বসে।

যারা পরে এল আগে গেল আমি রইলাম পরে।।

রচনাসমগ্র সম্পাদনা

গদ্য এবং পদ্য রচনায়ও হরিনাথ মজুমদার যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁর মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা আঠারোটি। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে -

  • বিজয় বসন্ত (১৮৫৯)
  • চারু-চরিত্র (১৮৬৩)
  • কবিতা কৌমুদী (১৮৬৬)
  • কবিকল্প (১৮৭০)
  • অক্রুর সংবাদ (১৮৭৩)
  • চিত্তচপলা (১৮৭৬)
  • কাঙ্গাল-ফিকির চাঁদ ফকিরের গীতাবলী (১২৯৩-১৩০০ বঙ্গাব্দ)
  • দক্ষযজ্ঞ
  • বিজয়া
  • পরমার্থগাথা
  • মাতৃমহিমা
  • ব্রহ্মাণ্ডবেদ

প্রভাব সম্পাদনা

হরিনাথের গানগুলো অনেক লেখক, সঙ্গীত বোদ্ধাদের মন জয় করে ও ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম। আমৃত্যু বঙ্গদেশে শিক্ষার প্রসার ও সর্বপ্রকার শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিলেন তিনি।

সাহিত্যকর্মে তার সুযোগ্য শিষ্যগণের মধ্যে - অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায়, জলধর সেন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ পরবর্তী জীবনে যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।

প্রয়াণ সম্পাদনা

১৬ই এপ্রিল, ১৮৯৬ সালে এই ক্ষণজন্মা লেখক, শিক্ষানুরাগী ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুতে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, "নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো"।

মৃত্যু পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে হরিনাথ গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সম্পাদকঃ সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম, ২য় সংস্করণ, ২০০৩, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১০৮
  2. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদকঃ অঞ্জলি বসু, ৪র্থ সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২০০২, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ৭৯
  3. "বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশনার ইতিহাসের উপাদান কাঙালকুঠির ও এম.এন. প্রেস"। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. (কাঙাল হরিনাথ ও ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-(কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ - আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী-১৯৯৮ পৃ: ১৭৫)

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা