স্বতঃবাষ্পীভবন এক ধরনের বাষ্পীভবন যাতে তরল এর পৃষ্ঠ দেশে তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তন সাধিত হয়। [১] চারপাশের গ্যাস বাষ্পীভূত পদার্থের দ্বারা সম্পৃক্ত হয় না। যখন তরলের অণুগুলির মধ্যে সংঘর্ষ হয় তখন তাদের একে অপরের সাথে কীভাবে সংঘর্ষ হয় তার ভিত্তিতে তারা একে অপরকে শক্তি স্থানান্তর করে। যখন পৃষ্ঠের কাছাকাছি একটি অণু বাষ্প চাপ কাটিয়ে উঠতে পর্যাপ্ত শক্তি শোষণ করে তখন তা তরল থেকে বেরিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী বাতাসে গ্যাস হিসাবে প্রবেশ করে।[২] যখন বাষ্পীভবন ঘটে তখন বাষ্পীভূত তরল থেকে শক্তি বেরিয়ে এসে তরলের তাপমাত্রা হ্রাস করে। ফলে ঘটে বাষ্পীভবন শীতলীকরণ। [৩]

আণুবীক্ষণিক জলের ফোঁটার অ্যারোসল বাষ্প গরম কাপের চায়ের উপরে পর্যাপ্তরূপে ঠান্ডা হয়ে ঘনীভূত হওয়ার পরে বাতাসে আটকে রয়েছে। জলীয় বাষ্প অদৃশ্য গ্যাস কিন্তু মেঘ এর ঘনীভূত জলের ফোঁটা প্রতিসৃত হয়ে সূর্যের আলোয় ছড়িয়ে থাকে বলে দৃশ্যমান হয়।
বাষ্পীভবনে শীতলীকরণের প্রদর্শন। যখন সেন্সরটি ইথানল এ ডোবানো হয় এবং তারপরে বাষ্পীভবনের জন্য বাইরে নিয়ে আসা হয় তখন ইথানল বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রটি ক্রমশ কম তাপমাত্রা দেখায়।

তরলে থাকা অণুগুলির মধ্যে গড়ে একটি ভগ্নাংশের অণুর তরল থেকে বেরিয়ে আসতে পারার পর্যাপ্ত তাপ শক্তি থাকে। তরলের বাষ্পীভবন একটি ভারসাম্যে না পৌঁছানো অবধি অব্যাহত থাকে। যখন তরলের বাষ্পীভবন তরলের ঘনীভবনের সমান হয়ে যায় তখন এই ভারসাম্য অবস্থাপ্রাপ্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না পার্শ্ববর্তী বায়ু তার দ্বারা সম্পৃক্ত হয়ে যায় ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনও বদ্ধ পরিবেশে তরল বাষ্পীভূত হয়।

বাষ্পীভবন হলো জলচক্র এর একটি অপরিহার্য অঙ্গ। সূর্য (সৌর শক্তি) সমুদ্র, হ্রদ, মাটির আর্দ্রতা এবং জলের অন্যান্য উৎসগুলি থেকে জলের বাষ্পীভবন পরিচালনা করে। জলবিজ্ঞানে বাষ্পীভবন এবং প্রস্বেদন (যা উদ্ভিদে পত্ররন্ধ্রর মধ্যে বাষ্পীভবন জড়িত) কে সম্মিলিতভাবে বাষ্পীভূতকরণ বলা হয়। তরলের পৃষ্ঠ উন্মুক্ত হলে জলের বাষ্পীভবন ঘটে। তখন অণুগুলি বেরিয়ে আসতে চাইলে জলীয় বাষ্প গঠন করে। এই বাষ্প তখন উপরে উঠে মেঘ গঠন করতে পারে। পর্যাপ্ত শক্তির সাথে তরলটি তখন বাষ্পে পরিণত হয়।

তত্ত্ব সম্পাদনা

তরলের বাষ্পীভবনের জন্য তার অণুর অবশ্যই পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে, তাদের যথাযথ দিকে চালিত হতে হবে এবং তরল-দশার আন্তঃআণবিক শক্তি কাটিয়ে উঠতে পর্যাপ্ত গতিশক্তি থাকতে হবে।[৪] যখন অণুগুলির একটি সামান্য অনুপাত এই মানদণ্ডগুলি পূরণ করে তখন বাষ্পীভবনের হার কম হয়। যেহেতু একটি অণুর গতিশক্তি তার তাপমাত্রার সাথে সমানুপাতিক হয় তাই উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন আরও দ্রুত হয়। দ্রুত গতিশীল অণুগুলি বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অণুগুলিতে গড় গতিশক্তি কমে যায় এবং তরলের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। এই ঘটনাটিকে বাষ্পীভবনীয় শীতলীকরণ বলা হয়। এ কারণেই বাষ্পীভবন ঘাম দ্বারা মানব দেহ শীতল হয়। বাষ্পীভবন আরও দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ঝোঁক দেখা যায় যদি গ্যাসীয় থেকে তরল অবস্থায় পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ প্রবাহ হার থাকে এবং তরলে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চতর বাষ্পচাপ থাকে। যেমন ধোপার কাপড় শুকনো করার সময় বাতাস বিহীন দিনের চেয়ে বাতাস বওয়ার দিনে কাপড় দ্রুত শুকিয়ে যায় (বাষ্পীভবন দ্বারা)। বাষ্পীভবনের তিনটি মূল ব্যাপার হ'ল তাপ, বায়ুমণ্ডলীয় চাপ (শতাংশের আর্দ্রতা নির্ধারণ করে) এবং বায়ু চলাচল।

আণবিক স্তরে তরল এবং কঠিন অবস্থার মধ্যে কোনও কঠোর সীমানা নেই। পরিবর্তে সেখানে একটি কনুৎসেন স্তর রয়েছে যেখানে পর্বটি নির্ধারণহীন অবস্থায় থাকে। এই স্তরটি কেবলমাত্র কয়েকটি অণু পুরু বলেই আণুবিক্ষণীক মাপকাঠিতে এর একটি পরিষ্কার ধাপের স্থানান্তর দশা দেখা যায় না।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

প্রদত্ত গ্যাসে প্রদত্ত তাপমাত্রায় যে সব তরলের দৃশ্যমানভাবে বাষ্পীভবন হয় না (যেমন ঘরে রান্নার তেল তাপমাত্রা) তাদের মধ্যে এমন অণু থাকে যাদের একে অপরকে শক্তি স্থানান্তর করার ঝোঁক থাকে না। তাই এ ক্ষেত্রে বাষ্পে পরিণত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তাপ কোনও অণু সরবরাহ করে না। তবুও এই তরলগুলির বাষ্পীভবন হয় এবং সেই প্রক্রিয়াটি অনেক ধীর এবং সেই কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে কম দৃশ্যমান হয়।

বাষ্পীভবনীয় ভারসাম্য সম্পাদনা

 
জলীয় বাষ্পের চাপ বনাম তাপমাত্রা। (৭৬০ Torr = ১ এটিএম)

বাষ্পীভবন যদি কোনও বদ্ধ জায়গায় হয় তবে বেরিয়ে যাওয়া অণুগুলি তরলের উপরে একটি বাষ্প হিসাবে জমা হয়। অনেকগুলি অণু তরলে ফিরে আসে। ফিরে আসা অণুগুলি ঘনত্ব এবং বাষ্পের চাপ বৃদ্ধির ফলে আরও ঘন হয়ে আসে। যখন বেরিয়ে যাওয়া ও ফিরে আসার প্রক্রিয়াটি একটি ভারসাম্য এ পৌঁছে যায় [৪] তখন বাষ্পটিকে "সম্পৃক্ত" বলা হয়। তখন ঘনত্ব বা তরলের তাপমাত্রার পরিবর্তন ছাড়া বাষ্পচাপ এর মধ্যে আর কোনও পরিবর্তন হবে না। বিশুদ্ধ পদার্থের বাষ্প এবং তরল সমন্বিত ব্যবস্থার জন্য এই ভারসাম্য অবস্থাটি প্রদত্ত পদার্থের বাষ্প চাপের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এবং তা পাওয়া যায় ক্লাউসিয়াস–ক্ল্যাপিয়রন সম্পর্ক দ্বারা:

 


যেখানে P1, P2 হ'ল বাষ্প চাপ যথাক্রমে T1, T2 তাপমাত্রায়, ΔHvap হ'ল বাষ্পীভবনের এনথ্যাল্পি, এবং R হ'ল সার্বজনীন গ্যাস ধ্রুবক। একটি উন্মুক্ত সিস্টেমে বাষ্পীভবনের হার বদ্ধ সিস্টেমে পাওয়া বাষ্পের চাপের সাথে সম্পর্কিত। কোনও তরলকে উত্তপ্ত করা হলে যখন বাষ্পের চাপ পারিপার্শ্বিক চাপে পৌঁছায় তখন তরলটির স্ফুটন ঘটবে।

বাষ্পীভূত হওয়ার জন্য তরলের অণুর ক্ষমতা মূলত এক একটি কণা কি পরিমাণ গতিশক্তি দিতে পারে তার উপর নির্ভর করে। এমন কি নিম্ন তাপমাত্রাতেও তরলের এক একটি অণু বাষ্পীভূত করতে পারে যদি বাষ্পীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পরিমাণের চেয়ে তাদের বেশি গতি শক্তি থাকে।

বাষ্পীভবনের হারে প্রভাববিস্তারী বিষয়সমূহ সম্পাদনা

দ্রষ্টব্য: এখানে ব্যবহৃত বায়ু একটি সাধারণ উদাহরণ; তবে অন্যান্য গ্যাসেও বাষ্পের পর্ব থাকতে পারে।

বাতাসে বাষ্পীভূত পদার্থের ঘনত্ব
যদি বায়ুতে ইতিমধ্যে বাষ্পীভূত পদার্থের উচ্চ ঘনত্ব থাকে তবে প্রদত্ত পদার্থটি আরও ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হবে।
বাতাসের প্রবাহ গতি
এটি উপরের ঘনত্ব সম্পর্কিত বিষয়টিরই কিছুটা অংশ। "তাজা" বায়ু (অর্থাৎ বায়ু যা ইতিমধ্যে পদার্থে বা অন্যান্য পদার্থে ইতিমধ্যে সম্পৃক্ত থাকে না) সর্ব্বক্ষণ পদার্থের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বায়ুতে পদার্থের ঘনত্ব সময়ের সাথে কম যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে বলে বাষ্পীভবন দ্রুত হয়। এটি বাষ্পীভবন পৃষ্ঠের সীমানা স্তর এর ফল যা প্রবাহ বেগের সাথে হ্রাস পায় এবং স্থির স্তরে আশ্লেষ দূরত্ব হ্রাস পায়।
তরলে দ্রবীভূত খনিজের পরিমাণ
আন্তঃআণবিক শক্তি
তরল অবস্থায় অণুগুলিকে একত্রে রাখার শক্তি যত বেশি হবে বেরিয়ে যেতে তত বেশি শক্তির প্রয়োজন হবে। এটিকেই বাষ্পীভবনের এনথ্যাল্পি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
চাপ
অণুগুলিকে পৃষ্ঠতলে নিজেদের থেকে চালিত করা থেকে বিরত রাখলে বাষ্পীভবন দ্রুত ঘটে।
পৃষ্ঠতল
কোনও বস্তুর পৃষ্ঠের ক্ষেত্র বৃহত্তর হলে দ্রুত বাষ্পীভূত হবে। কারণ প্রতি একক আয়তনের পৃষ্ঠতলে আরও বেশি অণু থাকবে বলে বেরিয়ে যাওয়ার শক্তিও সম্ভাব্যভাবে বেড়ে যাবে।
পদার্থের তাপমাত্রা
পদার্থের তাপমাত্রা যত বেশি তার পৃষ্ঠের অণুগুলির গতিবেগ শক্তি ততো বেশি বলে তাদের বাষ্পীভবনের হার ততো দ্রুত হবে।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থানে বাইরে রাখা মানকযুক্ত "প্যান" (একটি মুক্ত জলের পৃষ্ঠতল) থেকে বাষ্পীভবনের প্রকৃত হার পরিমাপ করে। বিশ্বজুড়ে অন্যরাও একইভাবে করে। মার্কিন তথ্য সংগ্রহ করে বার্ষিক বাষ্পীভবন মানচিত্রে সংকলিত করা হয়। পরিমাপের পরিসীমা প্রতি বছর ৩০ এর কম থেকে ১২০ ইঞ্চি (৩,০০০ মিমি) পর্যন্ত থাকে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "the definition of evaporate"Dictionary.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০১-২৩ 
  2. The New Student's Reference Work (1914)। ১৯১৪। পৃষ্ঠা 636। 
  3. Lohner, Science Buddies,Svenja। "Chilling Science: Evaporative Cooling with Liquids"Scientific American (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০১-২৩ 
  4. Silberberg, Martin A. (২০০৬)। Chemistry  (4th সংস্করণ)। New York: McGraw-Hill। পৃষ্ঠা 431–434। আইএসবিএন 0-07-296439-1