স্টপ জেনোসাইড (গণহত্যা বন্ধ কর) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙ্গালীদের দুঃখ-দুর্দশা, হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকাল প্রভৃতি এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল।

স্টপ জেনোসাইড
পরিচালকজহির রায়হান
প্রযোজকবাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সহায়ক সমিতি
রচয়িতাআলমগীর কবির
চিত্রনাট্যকারজহির রায়হান
বর্ণনাকারীআলমগীর কবির
সম্পাদকদেবব্রত সেনগুপ্ত
প্রযোজনা
কোম্পানি
চিত্তবর্ধন
মুক্তি
  • ১৯৭১ (1971)
স্থিতিকাল২০ মিনিট
দেশবাংলাদেশ
ভাষাইংরেজি

এর প্রথম প্রদর্শনী হয় এক অজ্ঞাত স্থানে, যেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে 'স্টপ জেনোসাইড' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলো। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে শিল্পগত ও গুণগত সাফল্যের দিক থেকে এই চলচ্চিত্রটিকে শীর্ষে স্থান দেয়া হয়ে থাকে।[১]

সারাংশ সম্পাদনা

প্রামাণ্যচিত্রটি শুরু হয় জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বই থেকে লেনিনের বাণী দিয়ে। শুরুতে দেখা যায় গ্রামীণ এক কিশোরী ঢেঁকিতে ধান ভানছে। গ্রাম্য কিশোরীর মনে কোন কষ্ট, যন্ত্রণা, উদ্বেগ বা উৎণ্ঠা নেই। যার মুখে সরল হাসি লেগে আছে। কিশোরীটি ধান ভেনে চলেছে। ধীরে ধীরে দৃশ্য পরিবর্তন হতে থাকে, কিশোরীর হাসির রেশ মিলিয়ে যায়। দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, কাকের কা-কা ডাক, গুলি, ব্রাশফায়ার, বুলেটের শব্দ, গগনবিদারী আর্তচিৎকার ধ্বনি শোনা যায়। মুহূর্তে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে যায়- পর্দায় দেখা যায় পাকিস্তানি গণহত্যার শিকার নারী, শিশু, কুকুরে খাওয়া মৃতদেহ। নদীতে ভাসছে লাশ, শিশুর মৃতদেহ, বিবস্ত্র লাশ পড়ে আছে। পটভূমিতে মেশিনগানের শব্দ, শিয়াল ও কুকুরের চিৎকার শোনা যায়। এরপর দেখা যায় জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুলিপি টাইপ করা হচ্ছে। সেই সাথে জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র থেকে কিছু অংশের পাঠ শোনা যায়। তারপর ভিয়েতনামে মার্কিনী কর্তৃক নারী-পুরুষ-শিশুদের গণহত্যার আলোকচিত্র দেখানো হয় এবং তথ্য উল্লেখ করা হয়।

এরপর বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো গণহত্যা ও শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করা হয়। দেখা যায় সীমান্তের দিকে মানুষের ঢল। আতংকিত মানুষ বেঁচে থাকার আশায় তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকে পথেই মৃত্যুবরণ করছে। আশ্রয় শিবিরে মানুষের তীব্র কষ্ট ও দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। শরণার্থীদের সাক্ষাৎকার ও তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এরপর দেখা যায় একজন কিশোরীকেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তার বাবা, ভাই ও কাকাকে হত্যা করেছে ও তারপরে সৈন্যরা মিলে তাকে গণধর্ষণ করেছে। কিশোরীর চোখে এখন মৃত মানুষের দৃষ্টি, তার মুখে কথা নেই। এরপর শোনা যায় শিশুর কান্না। নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষের মন্তব্য উল্লেখ করা হয়। ইয়াহিয়া খানকে হিটলার, মুসোলিনি, চেঙ্গিস খানের মত অতীতের নরহত্যাকারীদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তুলনায় ভয়াবহ বলে উল্লেখ করা হয়। হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের কথা তুলে ধরা হয়। গ্রামবাসীদের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরা হয়। এরপর জহির রায়হান প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ে যান। গৌড়ের ভগ্নপ্রাসাদের ভিতর ১৯৭১ সালে বাঙালি আশ্রয়প্রার্থীদের শিবির স্থাপিত হয়েছিল। আশ্রয় শিবিরে শরণার্থীদের কথা তুলে ধরা হয়। গণহত্যার তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে বিশ্ববিবেকের এই হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য আশু পদক্ষেপ ও বিচারের আবেদন জানানো। সেইসাথে জাতিসংঘের নিরবতায় বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। এরপর বর্ষা মৌসুমের কথা বলা হয়, হানাদার বাহিনীর বর্বরতার তুলনায় বর্ষার কষ্ট তুচ্ছ বলা হয়।

পর্দায় দেখা যায় বর্ষা উপেক্ষা করে অসহায় মানুষের দল সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখা যায় একজন বৃদ্ধাকে যায় চলার শক্তি নেই, চোখে বলতে গেলে কিছুই দেখেন না। বৃদ্ধা রাস্তায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন আশ্রয় শিবিরের দিকে। তার মুখে একটিই কথা, ‘সব গেছে, কেউ নেই, কিছু নেই’। এরপর দেখানো হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের দৃশ্য। জহির রায়হান মুক্তাঞ্চলে প্রবেশের ধারাবর্ণনা দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে প্রবেশ করেন। যাদের পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি, হাতে রয়েছে রাইফেল। এরা গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ক্যাম্পের কমান্ডারের বক্তব্য তুলে ধরেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দৃশ্য দেখান। তথ্যচিত্রের শেষ দিকে আবার অসহায় মানুষের মুখগুলি দেখানো হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের যে কোনো দেশের, কালের ও জাতির মুক্তিকামী মানুষের জনযুদ্ধেরই একটি অংশ বলা হয়। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রাম, বিপ্লবের কথা বলা হয়। দেখা যায় বার্লিনের একটি প্রাচীর গৃহ আস্তে আস্তে ধসে পড়ছে। এরপর বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাড়ানোর জন্য, পাকিস্তানি বর্বরদের চালানো গণহত্যা বন্ধের দৃঢ় আহ্বান জানিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ হয়।

নির্মাণ সম্পাদনা

কালো ও সাদা তথ্যচিত্রটি ৩৫ মিমি ফিল্ম ব্যবহার করে। প্রামাণ্যচিত্রটির বিবরণটি ইংরেজিতে ছিল এবং এটি ছিল সদ্য জন্ম নেয়া দেশ বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের ভোগান্তির বার্তা সারা বিশ্বের কাছে প্রকাশ করার এক দুর্দান্ত সুযোগ।

তথ্যচিত্রটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী-ও-কুশলী সহায়ক সমিতি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।

দল সম্পাদনা

বিবরণ লেখা এবং তা বর্ণনা করেন আলমগীর কবির। ভাষান্তর করেন আলমগীর কবির নিজেই।[২]

অর্থায়ন সম্পাদনা

জহির রায়হান একাত্তরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই তথ্যচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন চলমান গণহত্যা ও মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার জন্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সহকারী আলমগীর কবিরকে সাথে নিয়ে তিনি স্টপ জেনোসাইডের কাজ শুরু করেন। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও চলচ্চিত্র বিভাগ আর্থিকভাবে সহায়তা করতে সম্মত হয়। কিন্তু পরে এই ছবিটি নিয়ে প্রবাসী সরকারের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়; কারণ ছবিটির কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছিল না। তথ্যচিত্রে জহির রায়হান চেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যুদ্ধের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, গণহত্যা, শরণার্থীদের দুরবস্থা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকটা বেশি করে তুলে ধরতে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সারাবিশ্বই মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বদানের বিষয়ে ওয়াকিবহাল, তাই সেটা আর নতুন করে কিছু বলার নেই। পরে প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমেদসহ অন্যরা পরিস্থিতি সামাল দেন।[৩][৪]

চলচ্চিত্র মুক্তি ও বিতরণ সম্পাদনা

চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে মুক্তি পায়।

এর প্রথম প্রদর্শনী হয় এক অজ্ঞাত স্থানে, যেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেন। তাছাড়া, চলচ্চিত্রটি দেখে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার চলচ্চিত্র বিভাগকে চলচ্চিত্র কিনতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিতরণ করার নির্দেশ দেন।

পুরস্কার সম্পাদনা

স্টপ জেনোসাইড ১৯৭২ সালে তাসখন্দ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি পুরস্কার জিতে।[৫] এছাড়া এটি ১৯৭৫ সালে দিল্লি চলচ্চিত্র উৎসবে সিডলক পুরস্কার জিতে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৩ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  2. মারিয়া, শান্তা (১৬ ডিসেম্বর ২০১৫)। "'স্টপ জেনোসাইড': মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র"bangla.bdnews24.com। ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ জুলাই ২০১৯ 
  3. http://www.thedailystar.net/newDesign/victory_day/news10.php
  4. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৫ মে ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ডিসেম্বর ২০০৯ 
  5. অনুপম হায়াৎ (২০১২)। "চলচ্চিত্র উৎসব"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা