সুচিত্রা মিত্র

ভারতীয় গায়িকা

সুচিত্রা মিত্র (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ – ৩ জানুয়ারি, ২০১১) ছিলেন একজন প্রথিতযশা ও স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি কণ্ঠশিল্পী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের একজন অগ্রগণ্য গায়িকা ও বিশেষজ্ঞ। সুচিত্রা মিত্র দীর্ঘকাল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। সংগীত বিষয়ে তার বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। শেষ জীবনে তিনি রবীন্দ্রসংগীতের তথ্যকোষ রচনার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী এবং অভিনেত্রীর ভূমিকাও পালন করেছেন।[১][২] ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গেও তার দীর্ঘকালের যোগসূত্র ছিল। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।[৩] ২০০১ সালে তিনি কলকাতার শেরিফ মনোনীত হয়েছিলেন।[৪] দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি, সোমবার কলকাতার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুচিত্রা মিত্র
প্রাথমিক তথ্য
জন্ম(১৯২৪-০৯-১৯)১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৪
গুঝাণ্টি স্টেশন, বিহার প্রদেশ, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু৩ জানুয়ারি ২০১১(2011-01-03) (বয়স ৮৬)
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ধরনরবীন্দ্রসংগীত
পেশাকণ্ঠশিল্পী, নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষিকা, লেখিকা (শিশুসাহিত্য ও রবীন্দ্রচর্চা-বিষয়ক)
কার্যকাল১৯৪১–২০১১

জীবনী সম্পাদনা

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর সুচিত্রা মিত্রের জন্ম। তার পিতা রামায়ণ-অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝার উত্তর পুরুষ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক; মায়ের নাম সুবর্ণলতা দেবী। পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের ডিহিরী জংশন লাইনে শালবন ঘেরা গুঝাণ্টি নামে একটি রেলস্টেশনের কাছে, ট্রেনের কামরায়। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে। কলকাতার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে তিনি লেখাপড়া করেছেন। স্কুল বসার আগে প্রার্থনা সংগীতের মতো করে গাওয়া হতো রবীন্দ্রনাথের গান। এখানে পড়ার সময় গানের চর্চা শুরু হয় দুই শিক্ষক অমিতা সেন এবং অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে। বিদ্যান্বেষী সুচিত্রা মিত্র পরবর্তীকালে পড়াশোনা করেছেন স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে

খুব অল্প বয়সে তিনি রবীন্দ্রসংগীত শিখতে শুরু করেন। বাবা ছিলেন রবীন্দ্র সংগীতের বিশেষ অনুরাগী। বাড়িতে সংগীতের নিবিড় আবহ ছিল। তুমুল আড্ডা হতো এবং তাতে গানও হতো। তিনি বসে বসে গান শুনতেন। তার মা-ও গান করতেন। মায়ের গলায় "সন্ধ্যা হল গো ও মা" গানটি শুনে বালিকা সুচিত্রা মিত্রের চোখ জলে ভরে উঠতো। পঙ্কজকুমার মল্লিকের গান শুনে রবীন্দ্রসংগীত শেখায় বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছিলেন। পরে তিনি যাদের কাছে গান শিখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন - ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং শান্তিদেব ঘোষ। ছেলেবেলায় তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ সাহচর্য লাভ করেছিলেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাস টেন-এ পড়ার সময় শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে বৃত্তি লাভ করেছিলেন। ১৯৪১এ ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার মায়া পরিত্যাগ করে তিনি শান্তিনিকেতন চলে যান;- এর মাত্র কুড়ি দিন আগে রবীন্দ্রনাথ লোকান্তরিত হয়েছিলেন।[৫] ১৯৪৩-এ শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসাবে প্রাইভেটে ইন্টারমিডিযেট পরীক্ষা দেন। একই বছর রবীন্দ্র সংগীতে ডিপ্লোমা লাভ করেন৷ এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকেই অর্থনীতিতে সম্মান-সহ বিএ পাস করেন।[৬] ১৯৪৭ সালের ১ মে তিনি ধ্রুব মিত্রের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন জন্ম হয় তাদের একমাত্র পুত্রসন্তান কুণাল মিত্রের। কুণাল মিত্র বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের বাসিন্দা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় সুচিত্রা মিত্রের।[৭]

কলেজজীবনে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের মুক্তির জন্য পতাকা হাতে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করেছেন, কাঁদানে গ্যাস- এর ঝাঁঝে নাকাল হযেছেন। মিছিল, প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছেন। পরবর্তী জীবনে অবশ্য তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন। তবে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরটি অক্ষুণ্ণ ও অম্লান থাকে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর জাতীয় অনুষ্ঠানে তিনি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। আকাশবাণীতে জওহরলাল নেহেরুকে কটাক্ষ করে বাল্মীকি প্রতিভায় গান গাওয়ার অভিযোগে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ ছ'বছর তিনি আকাশবাণীতে গান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন।[৮]

তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। এখানে তার কর্মজীবন শুরু হয় প্রভাষক হিসাবে। তারপর পদোন্নতি পেযে রিডার হয়েছেন, অধ্যাপক হয়েছেন এবং "রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের" প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন৷ দীর্ঘ একুশ বছর শিক্ষকতার পর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রবীন্দ্রভারতী থেকে অবসর নেন। রবীন্দ্রভারতীতে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত থাকাকালে তিনি বাংলায় এমএ পাস করেন।

শিল্পী জীবন সম্পাদনা

একেবারে কৈশোরেই তার শিল্পী জীবনের শুরু। ১৯৪৫ সালে যখন তার প্রথম গানের রেকর্ড বের হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর। সেটি ছিল রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। রেকর্ডের এক পিঠে ছিল "মরণেরে তুঁ হু মম শ্যাম সমান", অন্য পিঠে "হৃদয়ের একুল ওকুল দু’কুল ভেসে যায়"। দ্বিতীয় রেকর্ডটি তার পিতার লেখা গান। এই রেকর্ডের এক পিঠে "তোমার আমার ক্ষণেক দেখা", অন্য পিঠে "আমায় দোলা দিয়ে যায়"।[৬] এরপর মৃত্যু অবধি তার সাড়ে চারশোরও বেশি রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বের হয়েছে।[৯] রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে প্রয়াত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, "রবীন্দ্রনাথের গানে সেরা হচ্ছে সুচিত্রা... সে বেশ গলা ছেড়ে পুরো দমে গায়। এর মধ্যে কোনো গোঁজামিল নেই... তার সাবলীলতা... সে এক দেখার এবং শোনার জিনিস। তার ছন্দজ্ঞানও অসামান্য... সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দিনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন"।[১০]

বেশ কিছু চলচিত্রে প্লে ব্যাক গায়ক হিসেবেও গান গেয়েছেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আর সংগীতের প্রতি আশৈশব ভালবাসা আর তীব্র টানে তিনি পুরোপুরি নিজেকে উৎসর্গ করেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে তিনি রবীন্দ্র সংগীতের প্রধান শিল্পী হিসাবে আবির্ভূত হন। তার গায়কী ঢং ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। তার কণ্ঠ মাধুর্যের সঙ্গে ছিল এক ধরনের দৃঢ়তা । রবীন্দ্র সংগীতে তার উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণ, তার কণ্ঠ আদর্শ হয়ে উঠেছিল। গান প্রাণ পেত তার কণ্ঠে। রবীন্দ্র সংগীতের তুলনারহিত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি অগণিত শ্রোতাদের কাছে । রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও তার গলায় প্রাণ পেয়েছে অতুলপ্রসাদের গান, ব্রহ্মসংগীত, আধুনিক বাংলা গান এবং হিন্দি ভজন[১০]

শান্তিনিকেতনে তিনি নানা বাদ্যযন্ত্র শিখেছেন: সেতার, এস্রাজ, তবলা। এসময় সহপাঠী ছিলেন নীলিমা সেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত তিনি কণ্ঠসংগীতই বেছে নিলেন। ধ্রুপদী সংগীত শিখেছেন ভি ভি ওয়াঝেলকরের কাছে। এ সময় কিছুদিন, প্রায় দু’বছর নাচ শেখার চেষ্টাও করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয় ভালোবাসতেন। তাই যখন রবীন্দ্র সংগীতের সেরা শিল্পীর তকমা জুটে গেছে, সে সময়, পরিণত বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত দহন নামক চলচিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নির্মিত উমাপ্রসাদ মৈত্রের জয় বাংলা এবং মৃণাল সেনের “পদাতিক”-এ অভিনয় করেছেন। এছাড়াও, বিষ্ণু পাল চৌধুরীর টেলিফিল্ম আমার নাম বকুল-এর একটি পর্বে তিনি অভিনয় করেন।[১০] দীর্ঘদিন তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।[৬]

১৯৪১তে বৃত্তি নিযে গান শেখার উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীতে যে সকল নাটকে অভিনয় করেছেন সেগুলো হলোঃ মুক্তধারা, বিসর্জন, তপতী, নটীর পুজা, মায়ার খেলা, চিরকুমার সভানীলদর্পণ।[১০]

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি এ্যাওয়ার্ড তিনি পেয়েছেন; এছাড়া এইচএমভি গোল্ডেন ডিস্ক এ্যাওয়ার্ড, বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে আলাউদ্দিন পুরস্কার লাভ করেছেন। আরো পেয়েছেন সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার-সহ নানা সম্মান। সাম্মানিক ডি-লিট পেয়েছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

বিবিধ সম্পাদনা

রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে তিনি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য লিখেছেন কবিতা ও গল্প; লিখেছেন স্মৃতিকথা। তিনি কক্বাহলিল জিবরানের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সুচিত্রা মিত্র আবৃত্তি করতে ভালবাসতেন। ছবি আঁকা ছিল তার আরেকটি নেশা। ছবির প্রদর্শনী পর্যন্ত তিনি করেছেন। কর্মযোগী সুচিত্রা মিত্র ১৯৪৬-এ কলকাতায রবীন্দ্র সংগীতের স্কুল "রবিতীর্থ" স্থাপন করেন। ভারতে এটি রবীন্দ্র সংগীত শিক্ষার অগ্রগণ্য বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিগণিত। স্কুলের নামটি অধ্যাপক কালিদাস নাগ কর্তৃক প্রদত্ব।[১১] রবিতীর্থের তিনি ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। রবিতীর্থের শিক্ষার্থীদের নিযে তিনি বহুদেশে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেছেন।

তাকেঁ নিযে কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে এবং নীরেন্দ্রনাথ। তার আবক্ষ মূর্তি গড়েছেন শিল্পী রামকিংকর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে; প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরী করেছেন সুব্রত ঘোষরাজা সেন। তিনি সংস্কৃতি এবং আভিজাত্যকে সমন্বিত করেছিলেন সংগীত চর্চার মাধ্যমে, নিজ জীবনাচরণে। ওস্তাদ আমজাদ আলী খান সুচিত্রা মিত্রকে বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসাবে।[১০] ১৯৯৫ সালে আজকাল পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত হয় তার আত্মকথা মনে রেখো

বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিলেন তিনি। সমসাময়িক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের কাছে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়ও সম্মানীয়। তাকে নিয়ে অনেকেই কবিতা রচনা করেছেন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন:[১২]

মৃত্যু সম্পাদনা

জীবনের একেবারে শেষপর্বে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে গান শেখানো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। কেবল ছাত্রছাত্রীরা তার কাছ থেকে ভুলত্রুটি শুধরে নিতে অথবা তার আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে তার বাড়িতে আসতেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি দ্বিপ্রাহরিক আহারের সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।[১৩] তিনি রেখে যান তার একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী পুত্র কুণাল মিত্রকে।[১৪] ৪ জানুয়ারি তার মরদেহ নিয়ে এক বিরাট গণশোকযাত্রা বের হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন), রবীন্দ্রসদন ও তার প্রতিষ্ঠিত সংগীত বিদ্যালয় রবিতীর্থে গুণমুগ্ধ, অনুরাগী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অপরাহ্নে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। পরে গঙ্গায় শিল্পীর অস্থি-বিসর্জন দেন তার কন্যাসমা ভাইঝি সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।[১৫]

সম্মাননা সম্পাদনা

রেকর্ড-তালিকা সম্পাদনা

রবীন্দ্রসংগীত সম্পাদনা

গ্রামোফোন ও এল পি রেকর্ড সম্পাদনা

১৯৪৫-১৯৫০ সম্পাদনা
তারিখ রেকর্ড নং গান সহশিল্পী
ডিসেম্বর, ১৯৪৫ N27564 মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান
হৃদয়ের এ কুল ও কুল দু’কুল ভেসে যায়
--
সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ N27630 আমার কী বেদনা সে কি জান
আরো কিছুক্ষণ না হয় বসিয়ো
--
মে, ১৯৪৭ N27673 আর রেখো না আঁধারে আমায়
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
--
অক্টোবর, ১৯৪৭ N27736 তোর আপনজনে ছাড়বে তোরে
দেশ দেশ নন্দিত করি
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস,
সুপ্রীতি ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
অক্টোবর, ১৯৪৭ N27737 পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা
বাদল মেঘে মাদল বাজে
--
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ N27790 সার্থক জনম আমার
আমার সোনার বাংলা
--
এপ্রিল, ১৯৪৮ N27823 জীবন যখন শুকায়ে যায়
যদি তোর ডাক শুনে কেউ
--
মে, ১৯৪৮ GE7230 ওগো কিশোর, আজি তোমার দ্বারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস,
গীতা নাহা, চিত্রা মজুমদার,
ও অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়
মে, ১৯৪৮ N27829 জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে জগন্ময় মিত্র, দ্বিজেন চৌধুরী,
দেবব্রত বিশ্বাস, নীহারবিন্দু সেন,
কনক বিশ্বাস, সুপ্রীতি ঘোষ,
ও গীতা নাহা
সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ N27906 নৃত্যের তালে তালে --
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯ N27983 আমি কী গান গাব যে
অশ্রুভরা বেদনা
--
মে, ১৯৪৯ N31026 নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
আজি গোধূলি লগনে এই বাদল গগনে
--
সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ N31261 কোন্‌ খেপা শ্রাবণ ছুটে এল
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
--
১৯৫১-১৯৬০ সম্পাদনা
তারিখ রেকর্ড নং গান সহশিল্পী
মে, ১৯৫১ N31334 কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ
জানি গো, দিন যাবে
--
জুলাই, ১৯৫১ N31350 যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়
গানগুলি মোর শৈবালেরই দল
--
জুলাই, ১৯৫১ N31387 এই শরৎ-আলোর কমলবনে
দেখো দেখো, শুকতারা
--
মে, ১৯৫২ N82507 (ও নিঠুর, আরো কি বাণ) তোমার তূণে আছে
আমার প্রাণের মাঝে
--
সেপ্টেম্বর, ১৯৫২ N82528 মেঘের কোলে কোলে যায় রে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
--
মে, ১৯৫৩ N82562 দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে
এবার দুঃখ আমার অসীম পাথার পার হল
--
সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ N82578 যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
ছি ছি, চোখের জলে
--
মে, ১৯৫৪ N82616 অরূপবীণা রূপের আড়ালে
বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ
--
মে, ১৯৫৪ N82627 কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়
আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে
--
জানুয়ারি, ১৯৫৫ N82633 দুঃখ যদি না পাবে তো
আমারে বাঁধবি তোরা
--
মে, ১৯৫৫ N82650 তুমি তো সেই যাবেই চলে
আমার জ্বলেনি আলো অন্ধকারে
--
অক্টোবর, ১৯৫৫ N82671 সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে
সকল জনম ভরে ও মোর দরদীয়া
--
ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ N82690 ওহে জীবনবল্লভ --
এপ্রিল, ১৯৫৬ N82698 পথে যেতে ডেকেছিলে
হৃদয় আমার প্রকাশ হল
--
সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ N82714 অবেলায় যদি এসেছ আমার বনে
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার
--
১৯৫৭ N82741 মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে
আমি যে আর সইতে পারি নে
--
এপ্রিল, ১৯৫৮ N82780 আমি যে গান গাই
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
--
অগস্ট, ১৯৫৮ N82780 সকালবেলার কুঁড়ি আমার
মেঘের পরে মেঘ জমেছে
--
নভেম্বর, ১৯৫৯ N82853 দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া
তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে
--
মার্চ, ১৯৬০ N82865 তোমার মনের একটি কথা
দিনের বেলা বাঁশি তোমার
--
ডিসেম্বর, ১৯৬০ N82906 পূর্বাচলের পানে তাকাই
ভেবেছিলেম আসবে ফিরে
--
১৯৬১-১৯৭০ সম্পাদনা
তারিখ রেকর্ড নং গান সহশিল্পী
মার্চ, ১৯৬১ 7EPE 1005 কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
পুরানো জানিয়া চেয়ো না
তুমি কোন্‌ ভাঙনের পথে এলে
--
এপ্রিল, ১৯৬১ N82923 কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি --
নভেম্বর, ১৯৬১ N82953 প্রভু,আজি তোমার দক্ষিণ হাত
প্রভু, বলো বলো কবে
--
মার্চ, ১৯৬২ N82966 আজ আকাশের মনের কথা
আমার আপন গান
--
এপ্রিল, ১৯৬২ ECLP 2273
(পূর্বতন সেট রেকর্ড, জুলাই, ১৯৪৯
N31053-58/N82662-67)
চণ্ডালিকা গীতিনাট্যের সংগীতাংশ --
নভেম্বর, ১৯৬২ N82995 কত যে তুমি মনোহর
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে
--
জানুয়ারি, ১৯৬৩ ECLP 2280
(সংস অফ প্যাট্রিয়টিজম)
যদি তোর ডাক শুনে কেউ
সার্থক জনম আমার
--
মার্চ, ১৯৬৩ N83009 ফাগুনের পূর্ণিমা এল
দেখা না-দেখায় মেশা
--
মার্চ, ১৯৬৩ ECLP 2272
(পূর্বতন সেট রেকর্ড, অগস্ট, ১৯৫৮
N82680-86/7EPE 53-55)
চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যের সংগীতাংশ --
মার্চ, ১৯৬৩ 7EPE 1009 জীবন যখন শুকায়ে যায়
দুঃখের তিমির যদি জ্বলে
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ
--
মার্চ, ১৯৬৪ N83059 তবু মনে রেখো
আমার মাঝে তোমারই মায়া
--
মার্চ, ১৯৬৪ 7EPE 1017 দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে --
অগস্ট, ১৯৬৪ ECLP 2303 আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার
আজি গোধূলি লগনে
মরি লো মরি
আজ তারায় তারায় দীপ্তশিখার
--
ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫ N83113 লিখন তোমার ধূলায় হয়েছে ধূলি
সখী, আমারি দুয়ারে কেন
--
এপ্রিল, ১৯৬৫ ECLP 2311
(সিজনাল সংস অফ টেগোর)
আমার নয়ন-ভুলানো এলে
হিমের রাতে ওই গগনের
--
মার্চ, ১৯৬৬ 7EPE 1025 আসা-যাওয়ার মাঝখানে
আরো, আরো প্রভু
--
মে, ১৯৬৬ EALP 1303 শাপমোচন গীতিনাট্যের সংগীতাংশ --

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Dutta, Krishna (২০০৩)। "Cities of Imagination: Calcutta"। Calcutta: a cultural and literary history। Signal Books। পৃষ্ঠা 226। আইএসবিএন 1902669592 
  2. ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে সুচিত্রা মিত্র (ইংরেজি)
  3. Suchitra Mitra: End of an era in Rabindra Sangeet
  4. "Journalist to be new sheriff"Times of India। ২৪ ডিসেম্বর ২০০৯। 
  5. Rabindra Sangeet singer Suchitra Mitra passes away[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. পরবাস অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার
  7. [মনে রেখো, সুচিত্রা মিত্র, আজকাল পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯৭ সংস্করণ, পৃ. ৪৪-৪৫।]
  8. পরবাস অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার
  9. [১]
  10. শ্রীসুচিত্রা মিত্র[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  11. সুচিত্রা মিত্রের ওপর নিবন্ধ
  12. "দাঙ্গার কলকাতায় রাস্তায় নেমে সুচিত্রা গেয়েছিলেন, 'সার্থক জনম আমার...'"anandabazar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০২-০৪ 
  13. প্রয়াত হলেন সুচিত্রা মিত্র
  14. Rabindra Sangeet exponent Suchitra Mitra dead[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  15. বিদায়ের পথে বাঁধভাঙা ভিড়, শোকের সঙ্গে মিশে গেল সুর[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা