সিরাজুদ্দীন হোসেন

বাংলাদেশী সাংবাদিক

সিরাজুদ্দীন হোসেন (জন্ম: ১৯২৯ - মৃত্যু: ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১) একজন বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদররাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাকে তার রাজধানীর চামেলীবাগের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক। [১]

সিরাজুদ্দীন হোসেন
জন্মমার্চ,‌ ১৯২৯
শালিখা থানা, শরুশুনা গ্রাম, মাগুরা জেলা
মৃত্যু১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সালের পূর্বে)
 পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ (১৯৭১ সালের পর)
পরিচিতির কারণসাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা
পুরস্কারএকুশে পদক, (১৯৭৮)

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন ৷[২] মাত্র সাড়ে ৩ বছর বয়সে তিনি তার বাবাকে হারান। তার চাচা মৌলবী মোহাম্মদ ইসহাক তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসলেও পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি চাচার কাছ থেকে সরে আসেন৷ চাচার কাছে থাকাকালীন সময়ে তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর স্কুল, যশোর জেলা স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন৷[৩] পরে যশোরের ঝিকরগাছার কাছে মিছরিদিয়াড়া গ্রামের এক বিধবার বাড়িতে জায়গির থেকে ঝিকরগাছা স্কুলে পড়াশোনা করতে থাকেন৷ ঐ পরিবার সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করত৷ পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বৃদ্ধার ছেলেদের চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতেন এবং তাদের জন্য মাঠে ভাত নিয়ে যেতেন৷ ম্যাট্রিক পরীক্ষা নিকটবর্তী হলে সেই উদারপ্রাণ বৃদ্ধা তার বাড়ির একটি বড় মোরগ বিক্রি করে ফি-এর ঘাটতির টাকার সংস্থান করে দেন৷[৪] তারপর তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং যশোর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলেজে আইএ-তে ভর্তি হন৷ আইএ পাশ করার পর সিরাজুদ্দীন হোসেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বিএ পড়া শুরু করলেও কলেজ জীবনে বই কেনার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা তার ছিল না৷ অন্যের বই আর শিক্ষকদের লেকচারের উপর ভিত্তি করে নিজের তৈরি নোটের মাধ্যমে তিনি লেখাপড়া করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি 'দৈনিক আজাদ'-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং পরে তিনি 'আজাদ'-এর বার্তা সম্পাদক হন৷ সে সময় এত অল্প বয়সে বার্তা-সম্পাদকের পদে কাজ করার সৌভাগ্য আর কারো হয়নি৷ ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি থেেক ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আজাদ পত্রিকায় সিরাজুদ্দীন হোসেন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেছে-এই রকম একটি সংবাদ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম করার জন্য সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ রেখে যান। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট অফিস থেকে যুক্তফ্রন্ট না ভাঙার বিষয়টি জানিয়ে একটি বিবৃতি পাঠানোয় সিরাজুদ্দীন হোসেন দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নিক্তিতে সংবাদটি বিচার করে ছেপেছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন। পরদিনই মওলানা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে চাকরিচ্যুত করেন। [২] এরপর তিনি ঢাকার ইউএসআইএস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসবে কিছুদিন কাজ করেন৷ ১৯৫৪ সালে তিনি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেন।১৯৫৪ সালে 'আজাদ'-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার এক বছর পর তিনি 'ইত্তেফাক'-এর বার্তা সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন৷[৫] ১৯৬৬ সালে আইয়ুবী দুঃশাসনামলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে সিরাজুদ্দীন হোসেন সংবাদ প্রতিষ্ঠান পিপিআই -এর ব্যুরো চীফ হিসেবে কাজ করেন।সিরাজুদ্দীন হোসেন দীর্ঘদিন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক থাকার পর ১৯৭০ সালে নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন।[৩]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

তার স্ত্রীর নাম নূরজাহান সিরাজী। তাদের আট ছেলে। তাদের পুত্ররা হলেন শামীম রেজা নূর, শাহীন রেজা নূর, ফাহিম রেজা নূর, নাসিম রেজা নূর, সেলিম রেজা নূর, শাহীদ রেজা নূর, জাহীদ রেজা নূর ও তৌহীদ রেজা নূর। শাহীন রেজা নূর ছিলেন প্রজন্ম’৭১-এর সভাপতি। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। শামীম রেজা নূর, ফাহীম রেজা নূর ও সেলিম রেজা নূর প্রবাসী। ফাহীম রেজা নূর নিউইয়র্কের ঘাতক দালার নির্মূল কমিটির সভাপতি। নাসিম রেজা নূর দেশের বড় একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। রেজা নূর ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি করেছেন। পঞ্চাশোর্ধ বইয়ের রচয়িতা তিনি। আজকের পত্রিকার উপ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। তৌহীদ রেজা নূর অর্থনীতিতে পিএইচডি। গণহত্যা নিয়ে পোস্ট-ডক্টরাল করছেন।


মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পাদনা

সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বেতারে প্রচারের দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের নামে ছাপিয়ে দেন ইত্তেফাকে, কারণ তখন কোন নেতাকে টেলিফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না। দৃশ্যত সাংবাদিকতার প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে ইত্তেফাকে তোফায়েল আহমদের নামে উল্লিখিত বিবৃতিটি প্রকাশের ব্যবস্থা না করলে বঙ্গবন্ধৃর ৭ মার্চের ভাষণটি আদৌ রেডিওতে প্রচারিত হতো কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে৷[৬]

১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইটের সময় ইত্তেফাকে গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর মে মাসে পাকিস্তান সরকার ক্ষতিপূরণ দিলে ইত্তেফাক পূণরায় প্রকাশিত হয়। সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রথমে এই পত্রিকায় কাজ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পত্নী মাজেদা বেগমের অনুরোধে তিনি ইত্তেফাকের সঙ্গে যুক্ত হন।

বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবনের এই পর্যায়ে সিরাজুদ্দীন হোসেন খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাকিস্তানি রাজনীতির অসারতাগুলো তুলে ধরেন। ইত্তেফাকেই কাজ করেছেন তিনি এবং 'ইত্তেফাক'-এর পাতায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতেন। কোনো জরুরি তথ্য ওপারে পাঠাতে হলে শফিকুল কবিরকেই খবর দিতেন সিরাজুদ্দীন হোসেন যিনি তা আগরতলার কংগ্রেস ভবন পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন৷[৭] তিনি প্রবাসী সরকারের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের আমেরিকান কনস্যুলেটের গোপন প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছিলেন, যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার প্রচারিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠতে সাহায্য করে।[৮] যুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন 'ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়' নামে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন যেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, যে দোষে শেখ মুজিবকে দোষী বলা হচ্ছে, পশ্চিমা রাজনীতিকরা সেই একই দোষে দুষ্ট ৷ এ সময় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুখপাত্র 'দৈনিক সংগ্রাম'-এ 'অতএব ঠগ বাছিও না' নামে একটি উপ সম্পাদকীয় লিখে তাকে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর হুমকি দেয় ৷ কিন্তু এসব হুমকি তার কলমকে থামিয়ে রাখতে পারেনি ৷[৪]

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাকে তার শান্তিনগর, চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদর বাহিনীর লোকেরা ৷তারপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।[৯]

বুদ্ধিজীবী হত্যার রায় সম্পাদনা

৩রা নভেম্বর, ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিরাজুদ্দিন হোসেন সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। [১০] [১১]

সন্মাননা সম্পাদনা

  • একুশে পদক, ১৯৭৮
  • মানিক মিয়া স্বর্ণপদক (মরণোত্তর), ২০১০ [১২] সিরাজুদ্দীন হোসেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পাদনা

  • ছোট থেকে বড়ো
  • মহীয়সী নারী
  • ইতিহাস কথা কও[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. দৈনিক প্রথম আলো
  2. "মানিক মিয়া স্বর্ণপদক পেলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন"বাংলানিউজ২৪। ডিসেম্বর ১৩ ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ২০শে ফেব্রুয়ারি,২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন"যশোর নিউজ। ডিসেম্বর ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. রেজা নূর, জাহীদ। "সিরাজুদ্দীন হোসেন"গুণীজনদল। সংগ্রহের তারিখ ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  5. "শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ"দৈনিক প্রথম আলো। ১০-১২-২০০৯। ২০২০-০২-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  6. আমির হোসেন, ইত্তেফাকের সিরাজ ভাই/স্মৃতিপটে সিরাজুদ্দীন হোসেন, ২৯৭-২৯৯ পৃষ্ঠা
  7. 'সিরাজ ভাইয়ের শেষ কথা' -শফিকুল কবির
  8. "শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ"দৈনিক জনকন্ঠ। ডিসেম্বর ১০ ২০১০। সংগ্রহের তারিখ ১৯শে ফেব্রুয়ারি,২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  9. "শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ"দৈনিক আমার দেশ। ডিসেম্বর ১০ ২০১০। ১৬ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯শে ফেব্রুয়ারি,২০১১  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  10. বুদ্ধিজীবী হত্যার সাজা ফাঁসি, প্রথম আলো দৈনিক পত্রিকা, লেখকঃ কুন্তল রায় ও মোছাব্বের হোসেন, ৪ঠা নভেম্বর, ২০১৩।
  11. মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড, আকবর হোসেন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ৩রা নভেম্বর, ২০১৩।
  12. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১১ 

বহি:সংযোগ সম্পাদনা