সাঁওতাল পরগনা বিভাগ

ভারতের ঝাড়খন্ডের প্রশাসনিক বিভাগ

সাঁওতাল পরগনা বিভাগ ভারতে অবস্থিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাঁচটি প্রশাসনিক বিভাগের একটি। এর বিভাগীয় সদর দপ্তর রয়েছে দুমকা জেলার দুমকা শহরে।

মানচিত্রে সাঁওতাল পরগনা বিভাগ

নামকরণের ইতিহাস সম্পাদনা

 
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অঞ্চলের মানচিত্রে সাঁওতাল পরগনার অবস্থান

সাঁওতাল পরগনা নামে থাকা দুটি শব্দ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ঐ অঞ্চলে উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতালদের আধিপত্য, আবার পরগনা হলো মধ্যযুগে শাসকবর্গের সুবিধার জন্য তৈরী করা একটি প্রশাসনিক একক৷

অবস্থান সম্পাদনা

 
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল পরগনার সীমান্ত মানচিত্র

ঝাড়খণ্ড রাজ্যের উত্তরপূর্ব দিকে অবস্থিত সাঁওতাল পরগনা বিভাগের উত্তর দিকে রয়েছে বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া বিভাগ, উত্তর পূর্বে রয়েছে ঐ রাজ্যেরই ভাগলপুর বিভাগ, দক্ষিণ পূর্বে রয়েছে বিহারের মুঙ্গের বিভাগ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের উত্তর ছোটনাগপুর বিভাগ উত্তর পশ্চিম দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা বিভাগ ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রয়েছে ঐ রাজ্যেরই বর্ধমান বিভাগ৷

ইতিহাস সম্পাদনা

বিভিন্ন ধর্মীয় শাস্ত্র বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মীয় শাস্ত্রগুলিতে এই অঞ্চলটি কজঙ্গল নামে উল্লেখ রয়েছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চম্পা (বর্তমান ভাগলপুর) থেকে কজঙ্গল‌ হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের পুণ্ড্রবর্ধন অবধি নিজের গন্তব্য নিশ্চিত করেন। তার বর্ণনা অনুসারে এই অঞ্চলের উত্তর সীমা তথা বর্তমান সাহেবগঞ্জ অঞ্চল গঙ্গা নদীর সন্নিকটে ছিল। জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে ছিল হাতির চারণভূমি। স্থানীয় লোকেরা ছিলেন সোজাসাপ্টা বুদ্ধিদীপ্ত এবং শিক্ষানুরাগী।[১]

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে ব্রিটিশ সরকার রাজমহল পাহাড় অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসী মাল পাহাড়ি জনজাতির লোকজনদের চাষ বাস করার জন্য বন সাফ করতে বললে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীকালে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাস করার শর্তে কটক, ধলভূম, বীরভূম, মানভূম এবং হাজারিবাগ থেকে বহু সাঁওতালকে এখানে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। কজঙ্গল হয়ে ওঠে সাঁওতাল পরগনা। ব্রিটিশরা সাঁওতালদের থেকে রাজস্ব আদায় করা শুরু করে। ব্রিটিশদের উচ্চ, কর জমিদারদের চাপ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎপীড়ন তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দুই সাঁওতালি বীর সিধু কানু এই সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করলেও ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে তারা পরাস্ত হয়।[২][৩][৪][৫][৬]

 
৫০ সিপাহী সংবলিত চল্লিশতম রেজিমেন্টের দেশীয় সেনাদের উপর প্রায় ৬০০ সাঁওতালের আক্রমণ

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত সাঁওতাল পরগনাকে জেলা স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

 
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ সময়কালীন মানচিত্র

এটি পূর্বতন ভাগলপুর বিভাগের অন্তর্গত ছিল এবং বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের একমাত্র বিভাগ যা ভারতের স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ছোটনাগপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের সময় ভাগলপুর বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলি ছিলো, সাঁওতাল পরগনা, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া এবং মুঙ্গের৷ ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৩৯০ বঙ্গাব্দ বা ১৭ই মে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পূর্বতন সাঁওতাল পরগনা জেলা থেকে দুটি পৃথক যথাক্রমে সাহেবগঞ্জগোড্ডা জেলা গঠন করা হয়৷ ১৭ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৭ বঙ্গাব্দে বা ১লা জুন ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সাঁওতাল পরগনা জেলা থেকে নতুন দেওঘর জেলা গঠিত হয়৷ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে চারটি জেলা সাহবগঞ্জ, দুমকা, গোড্ডা ও দেওঘর নিয়ে গঠিত হয় সাঁওতাল পরগনা বিভাগ৷ ১৪ই মাঘ ১৪০০ বঙ্গাব্দে বা ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারী পুর্বতন সাহেবগঞ্জ জেলার দক্ষিণের মহকুমা পৃথক করে পাকুড় জেলা গঠন করা হয়৷ পরে ২৯শে কার্তিক ১৪০৭ বঙ্গাব্দে বা ২০০০ সালের ১৫ই নভেম্বর তারিখে বিহার রাজ্য থেকে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠিত হলে উক্ত সমস্ত জেলা নবগঠিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যুক্ত হয়৷ ১২ই বৈশাখ ১৪০৮ বঙ্গাব্দ বা ২০০১ সালের ২৬ এপ্রিল সাবেক দুমকা জেলার দক্ষিণের কুণ্ডহিত, নলা, জামতাড়া ও নারায়ণপুর ব্লক চারটি নিয়ে জামতাড়া জেলা গঠিত হয়।

জেলা তালিকা সম্পাদনা

২০২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই বিভাগটি ছয়টি জেলা নিয়ে গঠিত। এগুলি হলো: সাহেবগঞ্জ জেলা, পাকুড় জেলা, গোড্ডা জেলা, দুমকা জেলা, দেওঘর জেলা এবং জামতাড়া জেলা[৭]

জেলা আয়তন (বর্গকিমি) সদর জনসংখ্যা (২০১১)
গোড্ডা জেলা ২,২৬৬ গোড্ডা ১৩,১৩,৫৫১
জামতাড়া জেলা ১,৮১১ জামতাড়া ৭,৯১,০৪২
দুমকা জেলা ৩,৭৬১ দুমকা ১৩,২১,৪৪২
দেওঘর জেলা ২,৪৭৭ দেওঘর ১৪,৯২,০৭৩
পাকুড় জেলা ১,৮১১ পাকুড় ৯,০০,৪২২
সাহেবগঞ্জ জেলা ২,০৬৩ সাহেবগঞ্জ ১১,৫০,৫৬৭

সাঁওতাল পরগনা বিভাগটি ১৪,১৮৯ বর্গকিমি ক্ষেত্রফল জুড়ে বিস্তৃত এবং মোট জনসংখ্যা ৬৯,৬৯,০৯৭ জন৷ বিভাগে সর্বাধিক ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট জেলা দুমকা ও সর্বাধিক জনবহুল জেলা দেওঘর৷

আয়তনানুসারে জেলাগুলির শতকরা ভাগ নিম্নরূপ:

আয়তনানুসারে জেলাগুলির শতকরা ভাগ[৮]

  দুমকা জেলা (২৬.৫১%)
  দেওঘর জেলা (১৭.৪৬%)
  গোড্ডা জেলা (১৫.৯৭%)
  পাকুড় জেলা (১২.৭৬%)

জনসংখ্যানুসারে জেলাগুলির শতকরা ভাগ নিম্নরূপ:

২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনসংখ্যানুসারে জেলাগুলির শতকরা ভাগ[৮]

  দেওঘর জেলা (২১.৪১%)
  দুমকা জেলা (১৮.৯৬%)
  গোড্ডা জেলা (১৮.৮৫%)
  পাকুড় জেলা (১২.৯২%)

ধর্ম ও ভাষা সম্পাদনা

ধর্ম সম্পাদনা

ক্রম জেলার নাম জনসংখ্যা ২০১১ - ৬৯,৬৯,০৯৭ হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ৪৭,৩৫,৭২৩ (৬৭.৯৫%) ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ১৫,৮৪,২৮৫ (২২.৭৩%) খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ২,৯৩,৭১৮ (৪.২২%) শিখ ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ১,৫৪৮ (০.০২%) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ১,২২৯ (০.০২%) জৈন ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ১,৬৮৯ (০.০২%) অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা ২০১১ - ৩,৫০,৯০৫ (৫.০৪%) সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম ২০১১ - হিন্দু
দেওঘর ১৪,৯২,০৭৩ ১১,৬৫,১৪০ (৭৮.০৯%) ৩,০২,৬২৬ (২০.২৮%) ৬,০২৭ (০.৪০%) ১৪৩ (০.০১%) ১৮৮ (০.০১%) ২৮২ (০.০২%) ১৭,৬৬৭ (১.১৯%) হিন্দু
দুমকা ১৩,২১,৪৪২ ১০,৪৪,৪২৬ (৭৯.০৬%) ১,০৬,৮৬৫ (৮.০৯%) ৮৬,৪০৪ (৬.৫৪%) ২৩৪ (০.০২%) ২৬৭ (০.০২%) ১৬২ (০.০১%) ৮২,৭৮৪ (৬.২৬%) হিন্দু
গোড্ডা ১৩,১৩,৫৫১ ৯,৩৭,১২৬ (৭১.৩৪%) ২,৮৯,১৮২ (২২.০২%) ৩৭,৭৯৫ (২.৮৮%) ৯৭ (০.০১%) ১২৮ (০.০১%) ১১৫ (০.০১%) ৪৯,১০৮ (৩.৭৪%) হিন্দু
সাহেবগঞ্জ ১১,৫০,৫৬৭ ৬,২৮,০৪৪ (৫৪.৫৯%) ৩,৯৮,২৪৩ (৩৪.৬১%) ৮৩,২০৮ (৭.২৩%) ১৯৮ (০.০২%) ২৪৫ (০.০২%) ১২৫ (০.০১%) ৪০,৫০৪ (৩.৫২%) হিন্দু
পাকুড় ৯,০০,৪২২ ৪,১০,১২৭ (৪৫.৫৫%) ৩,২২,৯৬৩ (৩৫.৮৭%) ৭৫,৮৬৫ (৮.৪৩%) ৩৫৬ (০.০৪%) ২৮৩ (০.০৩%) ২২২ (০.০২%) ৯০,৬০৬ (১০.০৭%) হিন্দু
জামতাড়া ৭,৯১,০৪২ ৫,৫০,৫৬০ (৬৯.৬০%) ১,৬৪,৪০৬ (২০.৭৮%) ৪,৪১৯ (০.৫৬%) ৫২০ (০.০৭%) ১১৮ (০.০১%) ৭৮৩ (০.১০%) ৭০,২৩৬ (৮.৮৮%) হিন্দু

ভাষা সম্পাদনা

সাঁওতাল পরগনা ঐতিহাসিকভাবে মূলত রাজমহল অঞ্চলে মাল পাহাড়ি অঞ্চল, বাকি অংশ জঙ্গল সঙ্কুল। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসন কালে চাষাবাদ ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এই অংশ জনবহুল হয়ে ওঠে। বিভাগের পশ্চিম দিকের বিহার সীমান্ত বরাবর মৈথিলী-খোট্টা ও হিন্দিভাষী, পূর্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চলে বাংলা ভাষী এবং মধ্যবর্তী অংশে সাঁওতালি ভাষাভাষীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিভাগটিতে কথিত ভাষার পাইচিত্র নিম্নরূপ:

২০১১ অনুযায়ী সাঁওতাল পরগনা জেলার বিভিন্ন ভাষাভাষী

  সাঁওতালি (২৫.১৩%)
  বাংলা (১৬.১১%)
  হিন্দি (৮.৬৯%)
  উর্দু (৫.০৬%)
  মালতো (২.১৫%)
  ভোজপুরি (১.৯৯%)
  অন্যান্য (২.৭৭%)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Roy, Niharranjan, Bangalir Itihas, Adi Parba, (বাংলা ভাষায়), first published 1972, reprint 2005, pp. 99-100, 81-93, Dey’s Publishing, 13 Bankim Chatterjee Street, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৭০৭৯-২৭০-৩
  2. Jha, Amar Nath (২০০৯)। "Locating the Ancient History of Santal Parganas"। Proceedings of the Indian History Congress70: 185–196। আইএসএসএন 2249-1937জেস্টোর 44147668 
  3. This is Our Homeland: A Collection of Essays on the Betrayal of Adivasi। ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২৬ আগস্ট ২০১৯ 
  4. Malik, Dr Malti (১৯৪৩)। History of Indiaআইএসবিএন 9788173354984। সংগ্রহের তারিখ ২৬ আগস্ট ২০১৯ 
  5. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০২০ 
  6. http://wesanthals.tripod.com/id50.html
  7. https://indiacode.nic.in/bitstream/123456789/8120/1/santhal_parganas_tenancy_laws_full.pdf&ved=2ahUKEwiX6rv6yOTtAhWY73MBHTOwBbMQFjAJegQIChAB&usg=AOvVaw3G4wXNiAWbMLQMpcvn7yVv
  8. https://www.census2011.co.in/census/state/districtlist/jharkhand.html