শেখ জামাল

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র

শেখ জামাল (২৮ এপ্রিল ১৯৫৪ – ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫) শেখ মুজিবুর রহমান এর দ্বিতীয় পুত্র।[১] মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে গৃহবন্দী হন। কিন্তু তিনি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে সক্ষম হন।[২] তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কমিশন প্রাপ্ত অফিসার ছিলেন।

শেখ জামাল
গেরিলা নেতা কাদের সিদ্দিকী (বামে) এবং শেখ জামাল (ডানে), যুদ্ধের পর ঢাকার পল্টনে প্রথম পাবলিক সভায়।
জন্ম২৮ এপ্রিল, ১৯৫৪
টুঙ্গীপাড়া, গোপালগঞ্জ, বাংলাদেশ
মৃত্যু১৫ আগস্ট, ১৯৭৫
ধানমন্ডি, ঢাকা
জাতীয়তা বাংলাদেশ
পরিচিতির কারণমুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র
দাম্পত্য সঙ্গীপারভিন রোজি

জন্ম ও শিক্ষা সম্পাদনা

শেখ জামাল গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকায় পড়াশুনা করে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি গিটার শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন এবং একজন ভাল ক্রিকেটার ছিলেন।[৩]

মুক্তিযুদ্ধ ও সম্পাদনা

শেখ জামাল পরিবারের অন্য সদস্যদের (তার মা, দুই বোন, শেখ রাসেল, এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং অন্যান্য) সাথে মগবাজার অথবা কাছাকাছি কোনো এলাকার এক ফ্ল্যাট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছিলেনে ১২ মে ১৯৭১ এবং ধানমন্ডির বাড়ি ২৬, সড়ক ৯এ (পুরনো ১৮) তে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। এই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস (বিএলএফ), যার নাম পরে হয় মুজিব বাহিনী তে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ শেখ জামাল বাড়িতে ফিরে আসেন।

স্যান্ডহার্স্টের প্রশিক্ষণ ও সেনাবাহিনীতে যোগদান সম্পাদনা

১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় সফরে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশে আসেন। শেখ জামালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রবল আগ্রহ দেখে টিটো তাঁকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৪ সালের বসন্তে ঢাকা কলেজের ছাত্র ও একাত্তরের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু একেবারে ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভাষার অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখ জামালের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্শাল টিটো শেখ জামালকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পরামর্শ দেন।[৪]

১৯৭৪ সালের শরতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে শেখ জামাল লন্ডনে গিয়ে পৌঁছান। তবে স্যান্ডহার্স্টের পূর্বশর্ত হিসেবে জামালকে (ব্রিটেনের) আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকনসফিল্ড থেকে প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রশিক্ষণ (ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ও মৌলিক সামরিক বিষয়) গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। স্যান্ডহার্স্টে (১৮১২) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। স্যান্ডহার্স্ট লন্ডনের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এ সময় স্যান্ডহার্স্টের কমান্ড্যান্ট ছিলেন মেজর জেনারেল রবার্ট ফোর্ড।

১৯৭৫ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত হয় স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি কোর্স-৮-এর প্রার্থিত সভরিন (পার্সিং আউট) প্যারেড। বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কমিশন লাভ করেন তিনজন গর্বিত তরুণ। তাঁদের দুজন হলেন—অফিসার ক্যাডেট আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) ও মাসুদুল হাসান (পরবর্তী সময়ে ক্যাপ্টেন)। তৃতীয় তরুণের নাম শেখ জামাল। তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র। ১ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকে স্যান্ডহার্স্টে রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স শুরু হবার কথা। শেখ জামাল এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও অংশ নিলেন না। কারণ তাঁর দুই প্রিয় বন্ধু বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছিলেন। আর ছিল মায়ের জন্য গভীর টান। মাত্র দেড় মাস পর এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবনকে তছনছ করে দেবে, কে জানতো!

স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে। এখানে তাঁর চাকরিকাল ছিল প্রায় দেড় মাস। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তিনি চমৎকার পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই তিনি অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাঁদেরই একজন হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্স এর প্রথম ব্যাচের কমিশন্ড অফিসার।

মৃত্যু সম্পাদনা

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে ব্যাটালিয়ন ডিউটি অফিসার হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে আসেন তিনি। নায়েব সুবেদার বার্কি বলেন, ‘স্যার, অনেক রাত হয়েছে; আজ রাতে ইউনিটেই থেকে যান। কিন্তু রাতে আর সেনানিবাসে থাকা হয় না শেখ জামালের। তিনি ফিরে আসেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে। বাংলাদেশের কলঙ্ক ‘ঘাতক দল’ ততক্ষণে প্রস্তুতি নিচ্ছে শতাব্দীর এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের জন্য।[৪]

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন তিনি হত্যার শিকার হন তখন তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, হত্যা হন সেই সেনাবাহিনীরই একটি অংশের হাতে যারা কিনা মনে-প্রাণে পাকিস্তানিআমেরিকার মদদপুষ্ট গোষ্ঠী। এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের রক্ত যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা করেছিল, তাদের সেনা আইনে বিচার করতে ব্যর্থ ছিল সেনাবাহিনী

নামকরণ সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "34th anniversary of Bangabandhu murder: National Mourning Day today"The New Nation। ২০০৮-০৮-১৫। ২০১২-০৩-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৫-২২Bangabandhu's wife Begum Fazilatunnesa, three sons Sheikh Kamal, Sheikh Jamal and Sheikh Russel... 
  2. "Sheikh Jamal"। Bangladesh Awami League। ২০০৯-১১-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৫-২২ 
  3. "Martyrs of 15th August 1975"Bangladesh Awami League (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৮-২৩। 
  4. "স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমি ও শহীদ লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল | কালের কণ্ঠ"Kalerkantho। ২০২১-০৪-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-২২