শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ

বাংলার শাসক

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (ফার্সি: شمس الدين فيروز شاه), চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় অবস্থিত মুসলমান রাজ্য লখনৌতির একজন স্বাধীন শাসক ছিলেন। তিনি "আল-সুলতান আল-আজম শামস আল-দুনিয়া ওয়া আল-দীন আবু আল-মুজাফফার ফিরোজ শাহ" উপাধি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহর নামে মুদ্রা প্রচলন করেন।

১২০৬ থেকে ১২১১ খ্রিস্টাব্দ এই ছয় বছর ব্যতীত ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লখনৌতি মুসলমান শাসকদের রাজধানী ছিল। বুগরা খান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের পূর্বসুরী ছিলেন।[১]

পূর্ব জীবন সম্পাদনা

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের পরিচয় সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে।ইবন বতুতার মতে তিনি ছিলেন নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র এবং সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবানের নাতি।ত্রয়োদশ শতাব্দীর পণ্ডিত আমির খুসরো বুগরা খানের দুই ছেলে - কাইকাবাদ এবং রুকুনউদ্দিন কাইকাউসের কথা উল্লেখ করেছিলেন তবে তিনি শামসুদ্দিন ফিরোজের নাম উল্লেখ করেননি।অধিকন্তু, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবান ইরানি রীতিনীতি অনুসরণ করে তাঁর নাতির নাম কায়কোবাদ, কাইকাউস, কাইখুসরাউ, কাইমুরস ইত্যাদি রেখেছিলেন।তবে ফিরোজ নামটি ইরানি ঐতিহ্যের সাথে যায় না।তদ্ব্যতীত, কাইকোবাদ ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের সময় মাত্র ১৯ বছর বয়সী ছিলেন।ফিরোজ যদি কায়কৌসের ছোট ভাই হয়ে থাকে তবে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সিংহাসনে যোগদানের সময় তাঁর বয়স থাকত ৩০ এর কোঠায়।তার বড় দুই ছেলেকে বাবার রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করতে দেখা গেছে, তবে এইরকম বয়সে একজনের পক্ষে দু'একটি বা তার বেশি বয়স্ক পুত্র থাকার সম্ভাবনা কম। এর ভিত্তিতে এবং তাঁর সময়কার মুদ্রা পরীক্ষা করে পণ্ডিতরা মনে করেন যে তিনি বলবান পরিবারের নন।শামসুদ্দিন ফিরোজ কোথাও নিজেকে সুলতানের পুত্র বলে দাবি করেননি, তবে তাঁর সমস্ত পুত্র ও উত্তরসূরীরা নিজেকে সুলতান বিন সুলতান (সুলতানের পুত্র) বলে অভিহিত করেছেন।ধারণা করা হয় যে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবান তাঁর পুত্র লখনৌতির গভর্নর বুঘরা খানকে সহায়তা করার জন্য "ফিরোজ" নামে যে দুজনকে নিযুক্ত করেছিলেন তার মধ্যে শামসুদ্দিন ফিরোজ ছিলেন একজন।এই দুই জনের মধ্যে বিহারের শাসক ফিরোজ ছিলেন বেশি দক্ষ।সম্ভবত দুজন ফিরোজের একজন ফিরোজ ই রুকুনউদ্দিন কাইকাউসের মৃত্যুর পরে বা তাকে জোর করে স্থানচ্যুত করার পরে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ উপাধি দিয়ে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন।সিংহাসনে আরোহণের সময় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন তাঁর পুত্র তাজউদ্দীন হাতেম খাঁ কে।[২]

রাজ্য বিস্তার সম্পাদনা

নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে ফিরোজ শাহ রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। লখনৌতির মুসলিম প্রাধান্য অঞ্চল সমূহের মধ্যে বিহার, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় লখনৌর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল।রুকুনউদ্দিন কাইকাউস ইতিমধ্যে বাংলার পূর্ব অংশ জয় শুরু করেছিলেন এবং ফিরোজ শাহের সময়ে এই কাজ শেষ হয়েছিল।কথিত আছে যে কাইকাউস প্রথমবারের মতো ব্যাংকের মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।তবে ফিরোজ শাহের সময়ে সোনারগাঁও অঞ্চল (দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গ) মুসলিম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।তিনি সোনারগাঁয়ে একটি টাকশাল তৈরি করেছিলেন এবং সেখান থেকে প্রচুর মুদ্রা তৈরি করা হত।

একইভাবে সাতগাঁওয়ের বিজয়টি, কাইকাউসের সময়ে সেনাপতি জাফর খানের অধীনে শুরু হয়ে ফিরোজ শাহের সময়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল। ফিরোজের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে,জাফর খান ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দে দার-উল-খাইরাত নামে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। তাঁর ময়মনসিংহ বিজয় সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। কেবল জানা যায় যে তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর ময়মনসিংহ থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে গিয়াসপুর নামের একটি গ্রামের টাকশাল থেকে মুদ্রা তৈরি করতেন।ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে তাঁর ভাতিজা সিকান্দার খান গাজী সুন্দরবন এলাকার হিন্দু রাজা মতুকের বিরুদ্ধে একটি সফল অভিযানের নেতৃত্ব দেন। সাতক্ষীরা জেলার সর্ব দক্ষিণের একটি গ্রামে সুলতান ফিরোজের সময়কার একটি মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল সিলেট বিজয়।শিলালিপি অনুসারে ফিরোজ শাহ ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জয় করেন। সুফি-সাধক শাহ জালাল এবং সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন এর নাম সিলেট বিজয়ের সাথে জড়িত। ফিরোজ শাহ খিলজিদের বিহার জয়ের প্রধান বাধা ছিলেন। বিহারে আবিষ্কার হওয়া তাঁর রাজত্বের দুটি শিলালিপি এরই সাক্ষ্য বহন করে।এভাবে তাঁর সময়ে লখনৌতি(গৌড়)পশ্চিমে সোন ও ঘোড়া নদী থেকে পূর্ব সিলেট এবং উত্তরে দিনাজপুর-রংপুর থেকে দক্ষিণে হুগলী এবং সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

শাসনকার্য পরিচালনা সম্পাদনা

ফিরোজের ছয় ছেলে ছিল - শিহাবুদ্দিন বুঘদা, জালালউদ্দিন মাহমুদ, গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর, নাসিরুদ্দিন ইব্রাহিম, হাতেম খান ও কুতলু খান।এই ছয়জনের মধ্যে তাজউদ্দিন হাতেম খান ছিলেন বিহারের রাজ্যপাল।ফিরোজ শাহের জীবদ্দশায় তাঁর পুত্র জালালউদ্দীন মাহমুদ, শিহাবউদ্দিন বাঘদা এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর লখনৌতি টাকশাল থেকে নিজস্ব নামে মুদ্রা জারি করেছিলেন।গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর সোনারগাঁও এবং গিয়াসপুরের টাকশাল থেকেও মুদ্রা তৈরি করতেন।এই মুদ্রার ভিত্তিতে একদল পণ্ডিত যুক্তি দিয়েছিলেন যে ফিরোজ শাহের ছেলেরা তাদের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে করে এবং পর্যায়ক্রমে লখনৌতি শাসন করতে থাকে।কিন্তু ফিরোজ শাহের পুত্রদের মুদ্রা উদ্ধারের পর জানা যায় যে তাঁরা তাদের বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে করেনি, বরং এটি তাদের বাবার সাথে তাদের ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার সাক্ষ্য বহন করে।প্রকৃতপক্ষে, ফিরোজ শাহ বেশ বয়স হওায়ার পর লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন, সে সময় তাঁর ছয় পুত্র ছিল এবং তাঁরা তাঁকে রাজ্য পরিচালনায় সহযোগিতা করত।পুত্রদের সহযোগিতায় সন্তুষ্ট হয়ে ফিরোজ শাহ তাঁর পুত্রদেরকে রাজ্যের কিছু অংশ স্বাধীনভাবে পরিচালনা করার অনুমতি দেন এবং মুদ্রার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে তুলে দেন।ছেলেরা তাদের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে বরং বিশৃঙ্খলা এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি হত, ফিরোজের এভাবে রাজ্যের বিস্তৃতি সম্ভব হত না। [৩]

মৃত্যু সম্পাদনা

ফিরোজ শাহ ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

পূর্বসূরী

রুকুনুদ্দিন কাইকুস

বাংলার স্বাধীন সুলতান

১৩০১-১৩২২

উত্তরসূরী

গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. বাংলাপিডিয়া
  2. Lewis, David (২০১১-১০-৩১)। Bangladesh: Politics, Economy and Civil Society (ইংরেজি ভাষায়)। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-1-139-50257-3 
  3. evsjvi BwZnvm: ¯^vaxb myjZvwb Avgj (1338-1538 wLª.)