রুডল্‌ফ ক্রিস্টফ অয়কেন

জার্মান দার্শনিক

রুডল্‌ফ ক্রিস্টফ অয়কেন (জানুয়ারি ৫, ১৮৪৬ - ১৯২৬) জার্মান দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষক। তাঁকে ১৯০৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, "তার সত্য অনুসন্ধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, চিন্তা করার অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, বিভিন্ন স্তরে দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণের যোগ্যতা এবং উপস্থাপনের ক্ষেত্রে উষ্ণ শক্তিময়তার স্বীকৃতিস্বরূপ যা তার বিপুল সংখ্যক রচনায় প্রকাশ পেয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি জীবনের একটি আদর্শিক দর্শনরূপ প্রতিষ্ঠা করেছেন"।[১]

রুডল্‌ফ ক্রিস্টফ অয়কেন
জন্মজানুয়ারি ৫, ১৮৪৬
অরিখ, হানোফার, জার্মান সম্রাজ্য
মৃত্যুসেপ্টেম্বর ১৫, ১৯২৬
জেনা, ট্যুরিঙেন, জার্মানি
জাতীয়তাজার্মান
রুডলফ ইউকেনের জন্মস্থান অরিচ, ওস্টারস্ট্রাই ২৭ (সেপ্টেম্বর ২০১৫)

জীবনী সম্পাদনা

রুডল্‌ফ ক্রিস্টফ অয়কেন জার্মানির নিডারজাখসেন (Niedersachsen) অংশের পূর্ব ফ্রিজলান্ড‌ অঞ্চলের অন্তর্গত অরিখ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম তারিখ ১৮৪৬ সালের জানুয়ারি ৫। অল্প বয়সেই বাবাকে হারান। এরপর বড় হয়েছেন মূলত মায়ের আদর-স্নেহ ও শাসনে। তার প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় জার্মানির গ্যোটিঙেনে।[২] প্রাথমিক অধ্যয়ন শেষে গ্যোটিঙেনবার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। তার পড়াশোনার বিষয় ছিল দর্শন এবং তার প্রিয় দার্শনিক ধারা ছিল এরিস্টটল-এর দর্শন। তিনি সুইজারল্যান্ডের বাসেল এবং জার্মানির জেনাতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়দ্বয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বাসেলে শিক্ষকতা করেছেন ১৮৭১ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত আর জেনাতে ১৮৭৪ থেকে ১৯২০ সাল অর্থাৎ তার শেষ বয়স অবধি।[৩] এছাড়া তিনি ১৯১৪ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সচেঞ্জ অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।[৪]

তিনি ১৮৮২ সালে বিয়ে করেন। তার এক মেয়ে এবং দুই ছেলে হয়েছিল। তার এক ছেলে ভাল্টার অয়কেন বিখ্যাত হয়েছিলেন। ভাল্টার অয়কেন অর্থনীতিতে নব্য উদারনৈতক নীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রুডল্‌ফ অয়কেন ৮০ বছর বয়সে জার্মানির জেনা শহরে মৃত্যুবরণ করেন।

দর্শন ও সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা

তিনি পুরাতন দার্শনিক চিন্তাধারার ব্যাখ্যা করা ছাড়াও নিজম্ব দার্শনিক চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যাকে বলা হয় "এথিক্যাল একটিভিজ্‌ম"। তার রচনাতেই মূলত দর্শনের এই নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এথিক্যাল একটিভিজম নামক এই দর্শনের মূল বক্তব্য হচ্ছে: মানব জীবনের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত নৈতিকতার চর্চা থাকা প্রয়োজন এবং প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিক আত্মার সমন্বয়ে গঠিত যে প্রতিটি ব্যক্তিকে, তার অবশ্যই উচিত আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে প্রাকৃতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। গোঁড়া ধর্মমতসমূহকে তিনি কেবল একটি আশ্রয় জ্ঞান করতেন। তার মতে, এই ধর্মমতগুলো মানুষকে পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক তথা আত্মিক পরিচয়ে পরিচিত করতে পারেনা।[৫]

অয়কেনের দর্শন বিষয়ক অন্যতম বিখ্যাত বইয়ের ইংরেজি নাম "হিস্ট্রি অফ ফিলোসফিক্যাল টার্ম"। এই গ্রন্থ রচনা করেই তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। অয়কেনের সাহিত্যে জীবন দর্শন ছিল মুখ্য। তার দৃষ্টিতে জীবন কেমন তা বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। তার লেখায় ব্যক্তিতের আদর্শ ও মূল্যায়ন ছিল সুস্পষ্ট। তার নোবেলপুরস্কার প্রাপ্তির কারণও ছিল মানবিক উৎকর্ষ ও জীবনকে নব আদর্শে উপস্থাপন।[৬]

বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তি এবং সাংশ্রয়িক বিদ্যাকে অবিশ্বাস করে অয়কেন কেবলমাত্র প্রকৃত মানবীয় অভিজ্ঞতার উপর তার দর্শনকে কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, মানুষ প্রকৃতি ও আত্মার মিলনস্থল; তার মধ্যে আত্মাবহির্ভূত যে সকল বস্তুবাদী সত্তা রয়েছে তা অতিক্রম করা তারই দায়িত্ব। আত্মীক তথা আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য সংগ্রাম করার মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। এ ধরনের প্রচেষ্টা এবং কর্মদ্যোগকে মাঝেমাঝে নৈতিক কর্মনিষ্ঠা বা কার্যক্রিয়া বলা হয়। ইচ্ছাশক্তি ও স্বজ্ঞা এর জন্য আবশ্যিক। তিনি প্রকৃতিবাদী দর্শনের তীব্র সমালোচনা করতেন। তিনি বলতেন, মানুষের আত্মা প্রকৃতির অন্যান্য বিষয়াদি থেকে পৃথক হয়ে এবং কেবল প্রাকৃতিক বস্তু ও বিষয়াদির সূত্র ধরে আত্মাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।[৭]

রচনাসমূহের তালিকা সম্পাদনা

  • ডি মেটোডে ডের আরিস্টোটেলিশেন ফর্শুং (Die Methode der Aristotelischen Forschung; "এরিস্টটলীয় অনুসন্ধানের পদ্ধতি") (১৮৭২)
  • ডি লেবেনআনশাউঙেন ডের গ্রোসেন ডেংকার (Die Lebensanschauungen der großen Denker, "মহান চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে মানব জীবনের সমস্যা") (১৮৯০)
  • ডের কাম্প্‌ফ উম আইনেম গাইস্টিগেন লেবেন্‌সইনহাল্ট (Der Kampf um einen geistigen Lebensinhalt, "জীবনের একটি আধ্যাত্মিক সূচির জন্য সংগ্রাম") (১৮৯৬)
  • ডের ভারহাইট্‌সগেহাল্ট ডের রেলিগিওন (Der Wahrheitsgehalt der Religion, "ধর্মের বিষয়ে সত্য কিছু কথা") (১৯০১)
  • গ্রুন্ডলিনিয়েন আইনার নয়েন লেবেন্‌স্‌আনশাউং (Grundlinien einer neuen Lebensanschauung, "জীবনের ভিত্তি এবং জীবনের আদর্শ: জীবনের একটি নতুন দর্শনের মৌল বিষয়সমূহ") (১৯০৭)
  • ডের জিন উন্ড ভের্ট ডেস লেবেন্‌স (Der Sinn und Wert des Lebens, "জীবনের অর্থ এবং মূল্য") (১৯০৮)
  • গাইস্টিগে ষ্ট্রোমুঙেন ডের গেগেনভার্ট (Geistige Strömungen der Gegenwart, "আধুনিক চিন্তাধারার মূল প্রবাহ") (১৯০৮)
  • ক্যোনেন ভির নখ ক্রিস্টেন জাইন? (Können wir noch Christen sein?, "আমরা কি এখনও খ্রিস্টান থাকতে পারি?") (১৯১১)
  • প্রেজেন্ট ডে এথিক্‌স ইন দেয়ার রিলেশন টু দ্য স্পিরিচুয়াল লাইফ (Present Day Ethics in their Relation to the Spiritual Life, "নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্তৃতাসমূহ") (১৯১৩)
  • ডের জোৎসিয়ালিস্‌মুস উন্ড জাইনে লেবেন্‌সগেষ্টাল্টুং (Der Sozialismus und seine Lebensgestaltung, "সমাজতন্ত্র: একটি বিশ্লেষণ") (১৯২০)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিবন্ধ। সেখান থেকে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে
  2. মাইক্রোসফ্‌ট এনকার্টা ২০০৬। সেখানে অয়কেনের গ্যোটিঙেন ও বার্লিনে পড়াশোনার কথা লেখা আছে। বার্লিনে স্নাতক পর্যায়ে পড়লে গ্যোটিঙেনে অবশ্যই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন।
  3. মাইক্রোসফ্‌ট এনকার্টা ২০০৬। অয়কেনের নিবন্ধে দুটি ব্যপ্তিকাল উল্লেখ আছে।
  4. নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকরা। আবুল বাশার ফিরোজ রচিত এই বইটি প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য প্রকাশনী। সেখানে অয়কেনের নিবন্ধ থেকে তথ্যাদি নিয়েই মূলত এই নিবন্ধটি লেখা হয়েছে।
  5. মাইক্রোসফ্‌ট এনকার্টা ২০০৬। সেখানে অয়কেনের দর্শন বিষয়ে লেখা অংশ থেকে তথ্য নিয়ে এই প্যারাটি লিখিত হয়েছে।
  6. নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকরা। আবুল বাশার ফিরোজ রচিত এই বইয়ে অয়কেনের আরও কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ আছে; কিন্তু ইংরেজিতে বিধায় সেগুলো দেয়া হয়নি। মূল জার্মান নামই এই নিবন্ধে দেয়া হবে।
  7. ব্রিটানিকা বিশ্বকোষ - Eucken, Rudolf Christoph

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা