রাজা সীতারাম রায়

রাজা

রাজা সীতারাম রায় (জাপানি: রাজা সীতারাম রায়) (১৬৫৮–১৭১৪) বাংলার একজন স্ব-স্বাসিত রাজা, মুঘল সাম্রাজ্যের একজন সামন্ত, যিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে একটি স্বল্পস্থায়ী হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সীতারাম রায়
রাজা
জন্ম১৬৫৮
মহাপতিপুর, কাটোয়া, বর্ধমান, বাংলা, ভারত উপমহাদেশ
মৃত্যুঅক্টোবর, ১৭১৪ (৫৬ বছর)
মুর্শিদাবাদ, ভারত
স্ত্রীগণ
  • শ্রী
  • কমলা
বংশধরশ্যামসুন্দর, সুরনারায়ন, বামদেব, জয়দেব।
পূর্ণ নাম
সীতারাম দাস
পিতাউদয়নারায়ন দাস
মাতাদয়াময়ী ঘোষ
ধর্মবৈষ্ণব

মাগুরার প্রামাণ্য ইতিহাসের নায়ক ভূষণা তথা মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায়। বাংলার যে সমস্ত খ্যাতনামা জমিদার দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তৎমধ্যে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম  রায় ছিলেন অন্যতম।

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

বংশপরিচয় সম্পাদনা

সীতারাম  উত্তর  রাঢীয়  কায়স্থ। বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কল্যাণগঞ্জ থানার গিধিনা গ্রামে তার পূর্বপুররুষের বসবাস ছিল।মুর্শিদাবাদ জেলার ফতে শিং এলাকার একটি হিন্দু পরিবারে তার জন্ম। এই পরিবারে রামদাস খান গজনবী নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি ১৫ শতকে তার মা এর শ্রাদ্ধে, একটি সোনার হাতি দান করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তার পুত্র অনন্ত রামদাস দিল্লির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তারপর এই বংশের দারিদ্র ও অনটন দেখা দেয়। মহারাজা মান সিংহ এর কাছ থেকে শ্রীরাম দাশের `খাস বিশ্বাস` উপাধি গ্রহণ করার পর এই পরিবারের অবস্থা ফিরে আসে। তার পুত্র হরি নারায়ন দাস মুঘলদের কাছ থেকে `রায় রান` উপাধি প্রাপ্ত হয় এবং এই পরিবারের যশ ও খ্যাতি আরো বৃদ্ধি পায়। হরিশ চন্দ্র দাসের পুত্র উদয়নারায়ন ছিলেন সীতা রাম রায়ের পিতা। তিনি মুঘল আমলে তহশীলদার এবং ভূষণের ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ পান। উদয় নারায়ণ যখন বাংলা রাজধানী রাজমহলে কর্মরত তখন তিনি দয়াময়ী দেবী কে বিয়ে করেন ।দয়াময়ী ছিলেন কাটোয়ার খাস্তা ঘোষ পরিবারের কন্যা।[১] আওরঙ্গজেবের দিল্লির মসনদে বসার কিছু সময় পূর্বে ১৬৫৮ সালে সীতারাম মহীপতিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দয়াময়ী এবং উদয়নারায়ন এর প্রথম সন্তান। সীতা রামের মা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। শৈশবে তিনি একদল ডাকাত এর মোকাবেলা করেছিলেন। মাতা দয়াময়ীর নাম অনুসারে মহম্মদপুরে ‘দয়াময়ী তলা’ নামে একটি গ্রাম আছে। কাটোয়ার অন্তর্গত মহিপতি গ্রামে ছিল সীতারামের মাতুলদের নিবাস।পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ সকলেই ছিলেন মোগল রাজ কর্মচারী। পিতা উদয়নারায়ণ মোগল শাসনাধীনে ভূষণার রাজস্ব সংক্রান্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।

শৈশব ও যৌবন সম্পাদনা

১৬৬০ সালে মীর জুমলা তার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। উদয়নারায়ন সে সময় ঢাকা চলে আসেন। তখন উদয়নারায়ন তার পরিবারকে সাথে আনেননি। ১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। এরপর উদয়নারায়ণ তহশীলদার পদে পদোন্নতি পরবর্তীকালে একটি তালুকের মালিক হন।বর্তমান ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলাধীন গুণবহা ইউনিয়নভূক্ত হরিহরনগরে তার বাসস্থান ছিল। কয়েক বছর পরে হরিহর নগরে মধুমতি নদীর তীরে তিনি তার বাসভবন নির্মাণ করেন এবং পরিবারকে তার কাছে নিয়ে আসেন। সীতারামের শৈশব কাটে কাটোয়ায় তার মাতুলালয়। সুজন পাঠশালায় সংস্কৃত শিখেছিলেন। বাংলা তখন চতুষ্পদী তে শেখানো হতো না। তাই নিজ গৃহে তিনি বাংলা শেখেন। তিনি চন্ডীদাস এবং জয়দেব পড়তে পারতেন। তার হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। একটু বড় হলে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন। তখন মুঘলদের সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। ভূষণে আসার পর মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে তিনি উর্দু ভাষা শেখেন। তিনি লাঠি খেলা, অস্ত্র চালনা, এবং অশ্বারোহণে পারদর্শী ছিলেন।

সীতারাম কীভাবে ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করেন তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেউ কেউ দস্যু সর্দার হিসেবে এলাকা দখলের কথা বলে থাকেন। তবে উত্তরাধীকারী সূত্রে তিনি ভূষণার জমিদারী লাভ করেন বলেই ধারণা করা হয়। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি জমিদারী শুরু করেন। তরুণ বয়সে সীতারাম ঘন ঘন রাজধানী ঢাকায় আসতেন। সুবাদার শায়েস্তা খান তার সাহস এবং কর্মে মুগ্ধ ছিলেন। সে সময় পাঠান বিদ্রোহী করিম খান সাতারা পরগনায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুঘল ফোজদার বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হলে সীতারাম কয়েক হাজার পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এই বিদ্রোহ দমনে অভিযান শুরু করেন। তিনি বিদ্রোহ দমনে সফল হন। করিম খান যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। শায়েস্তা খান অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে নলদী পরগনার জায়গীর দান করেন।

কর্ম জীবন সম্পাদনা

জমিদার সম্পাদনা

জায়গিরদারি লাভ করার পরে তিনি একটি নিজস্ব সৈন্য বাহিনী গঠনে সচেষ্ট হন। সীতারামের সৈন্যদলে বহু মুসলমান সৈনিক ছিলেন। শোনা যায়, তিনি মুসলমান সেনাপতিদিগকে ভাই বলিয়া ডাকিতেন এবং হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য সততা চেষ্টিত ছিলেন। বাগের হাটের খাঁন জাহান আলী মতো সীতারামেরও একদল বেলদার সৈন্য ছিল। ঢাকায় তার সাথে একজন ভাড়াটে সৈনিক রামরূপ ঘোষের পরিচয় হয়েছিল। করিম খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি তার সহযোগী ছিলেন। রামরুপ কুস্তিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি মেনা হাতি নামে পরিচিত ছিলেন। কারণে কোন এক সময় তিনি খালি হাতে একটি ছোট হাতি হত্যা করেছিলেন। রামরূপ সীতারামের সামরিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। সীতারাম ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করার পর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নিয়ে বাহিনী গঠন করেন। মেনাহাতী, রূপচাঁদ ঢালী, বকতিয়ার খান, মৃতরা সিংহ, গোবর দলন প্রমুখ বিখ্যাত সেনাপতিরা সীতারামের সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। মাগুরা ও ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আজও যার বীরত্ব গাথা লোকমুখে ফেরে- তিনি হলেন সীতারামের প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী। মেনাহতীর প্রকৃত নাম রূপনারায়ণ বা রামরূপ ঘোষ। কেউ কেউ বলেন মৃন্ময় ঘোষ। মেনাহাতী নড়াইল জেলার অন্তর্গত রায় গ্রাম নিবাসী ঘোষ বংশের পূর্বপুরুষদের একজন। দৈর্ঘ্যে ৭ হাত, প্রকান্ড মস্তক বিশিষ্ট বিশাল দেহী ছোট খাট হস্তী সদৃশ্য বিধায় মেনাহাতী বলে তার এই খ্যাতি। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি পিঁড়ি দিয়ে পিটিয়ে সীতারামের একটি হাতী হত্যা করেন বলে তার নাম হয়েছিল মেনাহাতী। গ্রাম এলাকায় আজও কেউ কেউ তাকে মেলাই হাতী বলে জানে। রূপচাঁদ ঢালী সীতারামের অপর একজন সেনাপতি ছিলেন। রূপচাঁদের বংশধরগণ মহম্মদপুর উপজেলার খলিশাখালী গ্রামে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেন বলে জানা যায়। রাজা সীতারামের অপর একজন সেনাপতি শিবরাম চক্রবর্তীর নামানুসারে মাগুরা শহরের অদূরে ‘শিবরামপুর’ গ্রাম অবস্থিত। তার বাহিনীর অপর এক সেনাপতি ছিল ফকির মাচ্চকাটা। বক্তিয়ার খান ছিল একজন পাঠান দস্যু । আমল বেগ নামে একজন মুঘল সৈন্য তার বাহিনীতে যোগদান করে। রাজা সীতারাম তার এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় খ্যাতি অর্জন করেন। প্রাচীনকালে মাগুরা অঞ্চল সুন্দরবনের অংশ ছিল। বনাঞ্চলের আধিক্যের কারণে এ এলাকায় দস্যু তস্করদের উপদ্রব হতো। যদুনাথ ভট্টাচার্য তার ‘সীতারাম রায়’ গ্রন্থেরাখা, শ্যামা, রামা, মুম্ভো, বিশে, হরে, নিমে, কালা, দিনে, ভুলো, জগা ও জেদো এই ১২জন কুখ্যাত ডাকাতের উল্লেখ করেছেন। তিনি ভূষণা, হরিহর নগর, মহম্মদপুর, নলদী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন।মুঘল সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যুর পর সমগ্র সুবাহ বাংলা জুড়ে এক অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সমগ্র নলদী পরগনা জুড়ে দস্যুদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। এজন্য প্রাচীন কবিতার বলা হয়,

                             “ধন্য রাজা সীতারাম বাংলা বাহাদুর
                              যার বলেতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেল দূর।
                              এখন বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে
                              এখন রামী শ্যামী পোঁটলা বেঁধে গঙ্গা স্নানে যাবে॥”

অধিকান্ত তিনি বাংলার উপকূল অঞ্চলেও মগ ও ফিরিঙ্গীদের উপদ্রব বন্ধের জন্য চেষ্টা করেন। ১৬৮৪ সালে তার পিতা ও মাতা খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মারা যান। তাদের শ্রাদ্ধের পর তিনি তীর্থ করতে গয়ায় যান। তার সচিব মনিরাম রায় এবং প্রধান সহযোগী রামরূপ ঘোষ তার সাথী হন। জায়গীর এর দায়িত্ব তার ছোটভাই লক্ষ্মীনারায়ণের নিকট হস্তান্তর করা হয়। উত্তর ভারতে তীর্থ করে তিনি সম্রাট আত্তরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং এতদ অঞ্চলের নৈরাজ্যের কথা তাকে অবহিত করেন। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সীতারামকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান পূর্বক সম্রাট ১৬৮৭-৮৮ খ্রীস্টাব্দে তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার রাজ্যকে আরো দক্ষিণে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত করার অধিকার দেয়া হয়। [২] দিল্লী হতে ফিরে এসে তিনি সুবাদার মুর্শিদকূলী খানের সনদ ও অনুমতি বলে উপকূল অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ ও সৈন্য মোতায়েন করেন। ফলে এতদঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছিল এবং জনগণও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।

রাজা সম্পাদনা

একই বছর সীতারাম নালদি, সাঁতার এবং ভাটি অঞ্চলের রাজা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাজা সীতারাম রায় তার পৈতৃক নিবাস মধুমতি নদীর তীরবর্তী হরিহর নগর নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এ শহরটিতে বেশ কিছু সুরম্য ইমারত ও মন্দির নির্মাণ করেন। জনগণের পানীয় জলের কষ্ট লাঘবের জন্য খনন করেন কয়েকটি দীঘি। সে আমলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠে এই হরিহর নগর। এখনও এখানে এসবের কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলেও তার কোন রাজধানী ছিল না। তাই তিনি বর্তমান মাগুরার মহম্মদপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। রাজা সীতারাম ১৬৯৭-৯৮ খ্রীস্টাব্দে মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেন।মহম্মদপুরে তিনদিকে বিল এবং একদিকে মধুমতি নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। দুর্গটি চতুর্ভুজ আকারে তৈরি করা হয়েছিল। যার এক একটি বাহুর পরিমাপ ১৩০০ ফিট বা ৪০০ মিটার এর কম ছিল না। দুর্গটির চারিদিকে প্রসস্থ পরিখা ছিল। দুর্গটির উত্তরায় ও পূর্বে ছিল কালিগঙ্গা নদী। দুর্গের ভিতরে সেনা ছাউনি, মন্দির এবং জলাধার ছিল।[৩] মহম্মদপুরকে রাজধানীর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করার ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে। আর তা হ’ল, একদিন সীতারাম ঘোড়ায় চড়ে এই পথ দিয়ে যান। পথিমধ্যে হঠাৎ তার ঘোড়ার পা মৃত্তিকা গর্ভে আটকে যায়। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ঘোড়ার পা মৃত্তিকা থেকে উঠাতে পারেন না। পরে লোকজন দিয়ে স্থানটি খনন করে ঘোড়ার পা উদ্ধার করেন। খননকালে এখানে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। আর মন্দিরে তিনি পান লক্ষীনারায়ণের মুর্তি। লক্ষীনারায়ণ সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই স্থানটিকে শুভ মনে করে সীতারাম প্রথমত এখানে নিজের বাসভবন নির্মাণ ও পরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানীর নামকরণের ব্যাপারে একাধিক মত আছে। কেউ মনে করে স্থানীয় মুসলিম ফকির মোহাম্মদ শাহের নামানুসারে তার রাজধানীর পুরাতন নাম বাগজান এর স্থলে মহম্মদপুর নামকরণ করেন।আবার কেউ মনে করেন সূফীসাধক মুহম্মদ আলী শাহ এর নামানুসারে সীতারাম রায় রাজধানীর নাম মহম্মদপুর রাখেন। অবশ্য মহম্মদপুর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বড়রিয়া গ্রামে আলী মাওলার দরগাহ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে অদ্যাবধি বিদ্যমান। আবার কেউ কেউ মনে করেন ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক মহানবী হযরত মুহম্মদ এর নামানুসারেই সীতারাম তার মুসলমান প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজধানীর নাম ‘মহম্মদপুর’ রাখেন। মহাম্মদপুর সীতারামের রাজধানী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে এক সময় গৌড় বঙ্গের একটি টাঁকশাল ছিল বলে জানা যায়। ব্যবসায়ীগণকে সব সময় মহম্মদপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহিত করতেন। ক্রমেই মহম্মদপুরে এই অঞ্চলের একটি উঠতি ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সীতারাম তার সেনাবাহিনীতে নতুন সৈন্য ভর্তি করেন এবং গোলন্দাজ ডিভিশন চালু করেন। তার দুটি বিখ্যাত কামান কালে খান এবং ঝুমঝুম খান এই সময় বাহিনীতে সংযোগ করা হয়। মহম্মদপুরে সমৃদ্ধির সময়ে মধুমতি নদী এই স্থানের প্রান্ত দিয়া প্রবাহিত ছিল একসময়। 

স্ত্রী ও উত্তরপুরুষ সম্পাদনা


সীতারামের উত্তরপূরুষ সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তার ৩টি, মতান্তরে ৫ জন স্ত্রী ছিল বলে জানা যায়। তার প্রথমা স্ত্রীর নাম কমলা। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার অন্য একজন স্ত্রীর নাম ‘শ্রী’। এ ‘শ্রী’ থেকেই ‘শ্রীপুর’ (উপজেলা) নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। মহম্মদপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে বালিদিয়া ইউনিয়নভূক্ত ‘শ্রীপুর’ নামে একটি গ্রামও রয়েছে। মাগুরা জেলায় আরও একাধিক ‘শ্রীপুর’ নামের গ্রামের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অনেকের মতে, সীতারামের স্ত্রী ‘শ্রী’-র নামানুসারেই এই গ্রামগুলির নামকরণ করা হয়েছে। শোনা যায় সীতারামের ভ্রাতা লক্ষীনারায়ণ ও তার উত্তর পুরুষগণ হরিহরনগরে দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করেন। যাহোক সীতারামের পতনের পর তার রাজ্য নাটোরের জমিদার রামজীবন রায়চাঁচড়ার জমিদার মনোহর রায় এবং নলডাঙ্গার জমিদারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয়।

মুঘলদের সাথে বিরোধ সম্পাদনা


স্যার যদুনাথ সরকার রাজা সীতারাম রায়কে রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তুলনা করেন। রাজা সীতারামের জমিদারী পাবনা জেলার দক্ষিণভাগ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং নদীয়া জেলার পূর্বপ্রান্ত থেকে বরিশাল জেলার মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার বাৎসরিক রাজস্ব আয় ছিল ৭৮লক্ষ টাকা। বিস্তৃীর্ণ এলাকার জমিদার রাজা সীতারাম স্বল্প কালের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠেন এবং বাংলার শাসকদের স্বাধীনতা প্রিয়তার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠে। তিনি বাংলার সুবাদারকে দেয় রাজস্ব বন্ধ  করে দেন। সুবাদার ইব্রাহিম খানের দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, মুর্শিদকুলী খান এবং আজিমুশ্‌শানের মধ্যকার বিরোধ তার স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছাকে আরও উজ্জ্বীবিত করে। সীতারামের সমৃদ্ধি এবং প্রাধান্য অন্যান্য জমিদারদের মনে হিংসার উদ্রেগ করে। জমিদারগণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং সীতারামের বিরূদ্ধে মোগল ফৌজদারের কান ভারী করতে থাকে।

আজিমুশশান বাংলার সুবাদার নিয়োজিত হবার পর মীর আবু তরাপ নামে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ভুষান এর ফৌজদার নিয়োগ করেন। যদিও আবু তরাপের মূল দায়িত্ব ছিল সীতারামকে নিরীক্ষণ করা কিন্তু তিনি তা না করে সেখানে এক ত্রাসের রাজত্বের সৃষ্টি করেন। আবু তরাপ কর দিতে ব্যর্থ প্রজাদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতেন। সীতারাম বিষয়টি জানার পর মুঘল রাজকোষে আর একটি টাকাও কর দেয়া থেকে বিরত থাকেন। আবু তরাপ সীতারাম রায় কে তার এই সিদ্ধান্তের পরিণতি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেন।

তৎকালীন বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানের সাথে আবু তরাপের সুসম্পর্ক ছিল না। ঘটনা ক্রমে সীতারাম তা জানতেন। আজিমুশান সে সময় দিল্লি অবস্থান করছিলেন। তার পুত্র ফররুখসিয়ার তখন ভারপ্রাপ্ত সুবাদার। তিনি বাংলার চেয়ে দিল্লির উন্নয়নে বেশি আগ্রহী ছিলেন। বাংলার রাজধানী তখন ঢাকা থেকে পাটনায় স্থানন্তরিত করা হয়েছে। এই অবস্থায় আবু তরাপের পক্ষে সুবাদার অথবা দেওয়ান এর নিকট থেকে কোন সাহায্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই তিনি নিজেই রাজা সীতারাম এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট হন। আবু তোরাপ ছিলেন একজন ফৌজদার। তার নিয়ন্ত্রণে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য থাকায় তিনি সীতারামের সাথে পেরে উঠলেন না। ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবাদার নিয়োজিত হন। আবু তরাপ তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। সুবাদার তাকে কোন সাহায্য করেননি। আবু তরাপ আরো একবার সীতারাম এর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন কিন্তু মুঘল বাহিনী এবারও সীতারামের গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি। এরপর আবু তরাপ তার সিপাহসালার পীর খানকে প্রেরণ করেন। মুঘল গোলন্দাজ বাহিনী মধুমতির তীরে অবস্থান নেয়। বারাশিয়া নদীর তীরে মুঘল বাহিনী এবং সীতারামের বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। মির আবু তরাপ সেনাপতি মিনা হাতির নিকট নিহত হন বারাসিয়া নদীর তীরে এক খন্ড যুদ্ধে ১৬৯৯খ্রীঃ এ। ‘তোরাপের মাজার’ বলে কথিত ভূষণা সেনানিবাসের মাঝে আজও তার কবর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। ‘তোরাপের মাজার’ বলে কথিত ভূষণা সেনানিবাসের মাঝে আজও তার কবর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।

সীতারামের বাহিনী আরো অগ্রসর হয় এবং ভূষণের কেল্লা দখল করে নেয়। সীতারাম তার বাহিনীর একটি অংশকে কেল্লায় অবস্থান করতে বলেন এবং সমগ্র এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। সীতারামের সেনারা মধুমতি নদীর তীরে অবস্থান নেয়। সীতারাম জানতেন যে মুঘল বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়ানো যাবে না। তাই তিনি তার পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন।

আবু তরাপের নিহত হবার খবর মুর্শিদাবাদে মুর্শিদকুলি খানের নিকট পৌছালে তিনি তার শ্যালক বক্স আলী খানকে ভূষণের নতুন ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি সকল জমিদারদের সীতারাম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করবার জন্য আদেশ দেন। নতুন ফৌজদার বক্স আলি খান এর সাথে ছিলেন সুবাহ বাংলার সেনাপ্রধান সংগ্রাম সিংহ।মোগল প্রভুভক্ত নিকটবর্তী জমিদার এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার দয়ারামকে অনুরূপ নির্দেশ প্রদান করা হয়। সংগ্রাম শাহ্, সিংহরাম ও দয়ারাম প্রমুখের সহযোগিতায় ফৌজদার বক্সআলী খান সীতারামের ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করেন। মধুমতী তীরে প্রচন্ড লড়াই শুরু হলো। যুদ্ধে প্রথমদিকে সীতারামের জয় হলেও শেষ পর্যন্তু তিনি সম্মুখসমরে টিকে থাকতে পারলেন না। অতপর রাতের অন্ধকারে তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে ভূষণা থেকে রাজধানী মহম্মদপুরের দিকে অগ্রসর হন। মোগল সৈন্যরাও তার পশ্চাদ অনুসরণ করে।

মহম্মদপুরের দুর্ভেদ্য দুর্গে অবস্থান করে রাজা সীতারাম রায় স্বীয় স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রতী হন। প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মোগল পক্ষের যুদ্ধ জয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কুটিলতার আশ্রয় নেন মোগল বাহিনীর সমর্থক স্বার্থান্বেষী মহল। এ যেন পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার পূর্ব মহড়া। বিশ্বাসঘাতক কর্মচারী মুনিরামের পরামর্শে, কুচক্রী জমিদার দয়ারামের সহযোগিতায় প্রধান সেনাপতি  মেনাহাতীকে অতর্কিতভাবে দোলমঞ্চের নিকট আক্রমণ করে আহত অবস্থায় বন্দী করা হয়। ৭ দিন পর্যন্ত তাদের হাতে নিদারুন নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়। শত্রু সৈন্যরা তার মস্তক ছেদন করে নবাব মুর্শিদকুলী খানের নিকট মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। বিশালকার এই মস্তক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে এতবড় বীরকে হত্যার জন্য নিজের সৈন্যদেরকে তিরস্কার করেন। মুর্শিদাবাদ থেকে মস্তকটি ফেরত এলে যথারীতি সৎকার করে সমাহিত করা হয়। বাজারের উত্তর-পূর্ব কোণে ইট নির্মিত মেনাহাতীর সমাধিসৌধের চিহ্ন এখন আর নেই। বর্তমান মোঃ আলিমুজ্জামান সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার নিচে এখন এটি চাপা পড়ে গেছে।[৪]

মৃত্যু সম্পাদনা

প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীর মৃত্যুর পরও সীতারাম প্রাণপণে মোগল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রাখেন। সীতারাম শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হয়ে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। কথিত আছে যে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। নাটোর রাজ্যের সেনাপতি দয়ারাম রায় তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। দিঘাপতিয়ায় যাবারকালে পথিমধ্যে নাটোর রাজবাড়ীর কারাগারে বন্দী রাখা হয়। রাজা সীতারামকে যে কক্ষে বন্দী রাখা হয় তা আজও বিদ্যমান। মুর্শিদাবাদে কয়েকমাস বন্দী অবস্থায় থাকার পর নবাব তাকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেন।
অবশ্য সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। কারো মতে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। জে. ওয়েস্টল্যান্ড সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বন্দী অবস্থায় তাকে ঢাকায় নবাবের কাছে নেওয়া হয়। বন্দীশালায় নবাব তার প্রতি এক নজর তাকান। তাকে অল্প সময় সেখানে অবস্থান করানো হয়। নবাবের একজন অফিসার এসে তাকে বলে, জীবনের আশা নেই। অবশ্যই তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাজা সীতারাম রায় সবসময় বিষযুক্ত আংটি হাতে রাখতেন। অবশেষে তিনি সেই বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। যদুনাথ ভট্টাচার্যের মতে, “কোন শাল বিক্রেতাদিগের সাথে যুদ্ধ করিয়া গঙ্গাতীরে মৃত্যুর কথাই সীতারামের গুরম্নকুল পঞ্জিকায় লিখিত আছে। সীতারামকে কেহ নিহত করেন নাই অথবা তিনি আত্মহত্যা করেন নাই”। সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কেও মহম্মদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত কিংবদন্তি হল, অত্যাচারী রাজা সীতারাম প্রতিশোধের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রামসাগরে নৌকায় স্বহস্তে কুড়াল মেরে সপরিবারে জ্বলে ডুবে আত্মহুতি দেন। আবার অনেকের মতে, মোগলদের নিকট থেকে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ রাজা সীতারাম পরিবার পরিজন নিয়ে একখানি মজবুত কাষ্ঠ নির্মিত নৌকায় উঠেন এবং রামসাগরের মধ্যে নিয়ে যান। তার পর নৌকার মধ্যখানে কুঠারাঘাত করেন। ফলে নৌকার মধ্যে হু হু করে পানি উঠে এবং ফলস্বরূপ নৌকা ডুবে যায়। আর এর সঙ্গে রামসাগরের অতল তলে হারিয়ে যায় রাজা সীতারাম ও তার পরিবার পরিজন। সত্যিই স্বাধীনচেতা, পরোপকারী মহম্মদপুরের এই রাজার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। এমনকি তার মৃত্যু সন তারিখ নিয়েও মতভেদ আছে। তার মৃত্যুর সন ১৭১৪ খ্রি., ১৭১৮ খ্রি., ১৭২২ খ্রি., ১৭২৪ খ্রি. বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

সীতারামের পতন পরবর্তী সময় সম্পাদনা

সীতারামের পতনের পর তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজন জমিদারের উত্থান ঘটে। তারা ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে স্ব স্ব এলাকায় প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করতে থাকেন। ঠিক এমনই একজন হলেন ‘রাজা শচিপতি’। কারো মতে আঠারখাদা গ্রামে আবার কেউ কেউ মনে করেন নিজনান্দুয়ালী গ্রামে তার বাড়ি ছিল। রাজা সীতারামের সমর্থক হওয়ার কারণে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁনের নির্দেশে নলডাঙ্গার জমিদার কর্তৃক তার পতন ঘটে। সীতারামত্তোর আর একজন রাজা ছিলেন যার নাম দেবল রাজা। মাগুরা সদর উপজেলার ঘোড়ানাছ গ্রামে তার বাড়ি ছিল বলে শোনা যায়। কথিত আছে যে, তিনি পরশ পাথর পেয়েছিলেন। এছাড়া শালিখা এলাকায় রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহ, কালিকান্ত রায় এবং শ্রীপুর এলাকায় রাজা রামচন্দ্র নামক জমিদারের কথা শোনা যায়। শ্রীপুর উপজেলা আমলসার ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের রাজা ছিলেন বিক্রম বর্শী। তার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। উপরে উল্লেখিত রাজাদের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।

রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানীর কীর্তি সম্পাদনা

মহম্মপুরের গৌরব রাজা সীতারাম রায় আজ আর নেই, কিন্তু তার অসংখ্যা কীর্তিকালের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে তার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তিনি নির্মাণ করেন মুহম্মদপুর দুর্গ, একাধিক প্রাসাদ, অসংখ্যা মন্দির ও দীঘি। যা মহম্মদপুর সমৃদ্ধির সময়ে মধুমতি নদী এই স্থানের প্রান্ত দিয়া প্রবাহিত ছিল একসময়।  ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে  মহামারীর ফলে মহম্মদপুর প্রায় বিরান হয়ে যায়।  কথিত আছে, সীতারামের সৈন্য ছিল ২২০০ এবং যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময় তারা জনসাধারনের পানীয় জলের জন্য জলাশয় খনন খনন করতো।উহাদের মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রাম সাগর, সুখ সাগর ও কৃষ্ণসাগর নামে দীঘি, দোল মঞ্চ ও রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ সিংহদরওজা, মালখানা, তোষাখানা, দশভুজা মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণের অষ্টকোন মন্দির, কৃষ্ণজীর মন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অতীতে এই দুর্গের চর্তুদ্দিকস্থ খাত দিয়া মধুমতির স্রোত প্রবাহিত হইতো। মাগুরা সদর হতে ২৫ কি.মি. দূরে মহম্মদপুর উপজেলায় রাজবাড়ি নামক স্থানে রাজা সীতারাম রায়ের বাড়িটি অবস্থিত। মহম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড হতে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পার্শ্বে রাজবাড়ির অবস্থান। রিক্সা, ভ্যান অথবা পায়ে হেটে যাতায়াত করা

  • মহম্মদপুর দুর্গ
  • সিংগদরজা
  • রাজ প্রাসাদ (ভগ্নাংশ)
  • বিলাস গৃহ (অস্তিত্ব নেই)
  • কোষাগার(অস্তিত্ব নেই)
  • মালখানা (অস্তিত্ব নেই)
  • তোষা খানা(অস্তিত্ব নেই)
  • নহবত খানা(অস্তিত্ব নেই)
  • গোলাঘর (অস্তিত্ব নেই)
  • কারাগার (অস্তিত্ব নেই)
  • দশ ভূজা মন্দির ( আছে)
  • লক্ষী নারায়ণের অষ্টকোণ মন্দির (আছে)
  • জোড় বাংলা মন্দির, নড়াইল( আছে )
  • শিব মন্দির (অস্তিত্ব নেই)
  • দোল মঞ্চ (অস্তিত্ব নেই)
  • পঞ্চরত্ন মন্দির -ভুষণার রাজা সীতারাম কর্তৃক নির্মিত সুখ সাগর ও বাইরের গড়ের পশ্চিমে অবস্থিত কালাইনগর গ্রামে কৃষ্ণসাগরের পাড়েই এ মন্দিরটির অবস্থান ছিল। সীতারাম কর্তৃক নির্মিত মন্দিরের আয়তন ও উচ্চতা অন্যান্য মন্দির থেকে বেশি ছিল। পূর্বদিকে তিনটি প্রবেশ পথ ছিল, যা অর্ধবৃত্তাকারে খিলালের সাহায্যে নির্মিত। এরপরে বারান্দা ছিল। বারান্দার পরে মন্দিরের গর্ভগৃহ ছিল। গর্ভগৃহের উপর একটি ও মন্দিরের চারকোণে চারটি বুড়া বা রত্ন ছিল। মন্দিরে মোট পাঁচটি রত্ন থাকার জন্য মন্দিরটির নাম পঞ্চরত্ন হয়েছিল। গর্ভগৃহের উপর অবস্থিত চুড়াটি খুব উঁচু ছিলো। এখানে রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। মন্দিরের দেয়াল নানা মুর্তির সাহায্যে অঙ্কিত ছিল। পূর্ব দেয়ালে অঙ্কিত মূর্তি চিত্র বেশি দেখা যেত। মন্দির গার্তে অঙ্কিত কৃষ্ণ ও বনরাম মূর্তি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানের মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
  • রাজা সীতারাম রায়ের কাঁচারী বাড়ি
  • রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গ
  • লক্ষীনারায়ণের পুকুর[৫]
  • রামসাগর দীঘি - এটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০০ ফুট ও প্রস্থে ৬০০ ফুট। ইহার জল এখনও প্রায় নির্ম্মল ব্যবহারোপযোগী আছে।
  • কৃষ্ণসাগর দিঘী- এটি মহম্মদপুর দুর্গের দক্ষিণ পূবর্ব দিকে কানাই নগর গ্রামে অবস্থিত।
  • সুখসাগর দিঘী
  • মনিরামপুর উপজেলা- রাজা সীতারাম রায়ের উকিল মুণিরাম রায়ের নামে এই এলাকার নাম মণিরামপুর হয়েছে।[৬]

বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Jadunath Bhattacharya। Sitaram Ray। পৃষ্ঠা 138। 
  2. "ভূষান ও রাজা সীতারাম"। ১২ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ নভেম্বর ২০১৮ 
  3. Satish Chandra Mitra। Jashor Khulnar Itihash। Dey's Publishing। পৃষ্ঠা 868। আইএসবিএন 81-7612-766-3 
  4. "মাগুড়া জেলার পর্যটন অঞ্চল/দর্শনীয় স্থান সমূহ - Golden Bangladesh"www.goldenbangladesh.com। ২০১৯-০৩-০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৪ 
  5. Karim, MR; Parvin, MS; Hossain, MZ; Islam, MT; Hussan, MT (২০১৪-০৯-১৬)। "A Report on Clinical Prevalence of Diseases and Disorders in Cattle and Goats at The Upazilla Veterinary Hospital, Mohammadpur, Magura"Bangladesh Journal of Veterinary Medicine12 (1): 47–53। আইএসএসএন 2308-0922ডিওআই:10.3329/bjvm.v12i1.20463 
  6. "মণিরামপুর উপজেলা"manirampur.jessore.gov.bd (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৭-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১১ 
  7. "স্মরণীয় যাঁরা সীতারাম রায় উমা ভট্টাচার্য শরৎ ২০১৬"জয়ঢাক- বাংলায় প্রথম ছোটোদের ওয়েবজিন। ২০০৭ থেকে ছোটদের সঙ্গে (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৬-০৮-২৫। ২০২০-১২-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৩-০৪