স্যার রজার পেনরোজ (জন্ম ৮ই আগস্ট, ১৯৩১), ওএম, এফআরএস একজন ইংরেজ গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ইমেরিটাস রাউজ বল অধ্যাপক। তিনি গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে, বিশেষত সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং মহাবিশ্ব-সৃষ্টি তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে বিখ্যাত। তিনি ২০২০ সালে কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে তার যুগান্তরকারী আবিষ্কারের জন্য রাইনহার্ড গেনৎসেলআন্ড্রেয়া গেজ-এর সাথে যৌথভাবে পদার্থে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।[৩] নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী বলিষ্ঠকরণে কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কারের জন্য রজার পেনরোজকে নোবেল প্রাইজের অর্ধেক মূল্য দেওয়া হবে। অন্যদিকে, বিশাল মহাকাশে ছায়াপথের কেন্দ্রে সুপারম্যাসিভ কমপ্যাক্ট অবজেক্টের আবিষ্কারের জন্য অপর দুই বিজ্ঞানীকে যৌথভাবে পুরস্কারের অর্ধেক দেওয়া হবে। এছাড়াও তিনি একজন শখের গণিতবিদ এবং বিতর্কিত দার্শনিকও বটে। রজার পেনরোজের বাবা লিওনেল এস পেনরোজ ছিলেন একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। তার এক ভাই অলিভার পেনরোজ গণিতবিদ এবং আরেক ভাই জনাথন পেনরোজ দাবার একজন গ্রান্ডমাস্টার।

স্যার রজার পেনরোজ
রজার পেনরোজ, ২০১১ সালে
জন্মআগস্ট ৮, ১৯৩১
নাগরিকত্বইংরেজ
মাতৃশিক্ষায়তনইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন
সেন্ট জনস কলেজ, কেমব্রিজ
পরিচিতির কারণপেনরোজ টাইলিং, চক্র কোয়ান্টায়িত মহারর্ষ, স্থান-কাল এর জ্যামিতি
পুরস্কার
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রগাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী
প্রতিষ্ঠানসমূহ
ডক্টরাল উপদেষ্টাজন এ টড
ডক্টরেট শিক্ষার্থীজর্জ বার্নেট-স্টুয়ার্ট, ম্যাথ্যু গিন্সবার্গ, অ্যাডাম হেলফার, অ্যান্ড্রু হজেস, লেইন হিউস্টন, পিটার ল্য, ক্লড লিব্রুন, রস মুর, ট্রিস্টান নিঢ্যাম, টিম পোস্টন, জর্জ স্পার্টলিং, কে টড, রিচার্ড ওয়ার্ড
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেন

কর্মজীবন সম্পাদনা

১৯৬৫ সালে ছাত্রাবস্থাতেই পেনরোজ সাধারণীকৃত বিপরীত (generalized inverse) পুনরাবিষ্কার করেন (এটা মুর-পেনরোজ বিপরীত হিসাবেও পরিচিত। দেখুন: Penrose, R. "A Generalized Inverse for Matrices." Proc. Cambridge Phil. Soc. 51, 406-413, 1955)।

পেনরোজ ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথিতযশা বীজগণিতজ্ঞ ও জ্যামিতিবিদ জন এ. টডের তত্ত্বাবধানে বীজগণিতীয় জ্যামিতিতে টেনসর পদ্ধতির ব্যবহার নামের একটি গবেষণাপত্র লেখার জন্য পিএইচ. ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। কেমব্রিজে থাকাকালীন সময় ১৯৬৫ সালে তিনি প্রমাণ করেন যে মৃত্যুমুখে পতিত বৃহদাকার নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় ভাঙনের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী-বিন্দু (যেমন- কৃষ্ণবিবর) সৃষ্টি হতে পারে (ফার্গুসন, ১৯৯১: ৬৬)।

১৯৬৭ সালে পেনরোজ টুইস্টর তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যা মিনকভ্‌স্কির অবস্থান-কাঠামোতে (space) অবস্থিত কোন জ্যামিতিক বস্তুকে মেট্রিক স্বাক্ষর (২,২) সহকারে চতুর্মাত্রিক জটিল অবস্থান-কাঠামোতে (complex space) ম্যাপ করে। ১৯৬৯ সালে তিনি মহাজাগতিক সেন্সরশিপ অনুকল্প প্রস্তাব করেন যেখানে বলা হয় যে মহাবিশ্ব ব্যতিক্রমী-বিন্দসমূহের সহজাত অননুমানযোগ্যতা থেকে আমাদের রক্ষা করার প্রয়াসে এদেরকে (ব্যতিক্রমী-বিন্দসমূহকে) আমাদের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখে। এই ধরনের বিবৃতিটি এখন অবশ্য দুর্বল সেন্সরশীপ অনুকল্প হিসাবে পরিচিত; ১৯৭৯ সালে পেনরোজ দৃঢ় সেন্সরশীপ অনুকল্প নামে পরিচিত আরেকটি দৃঢ়তর বিবৃতি প্রদান করেছেন। বিকেএল তত্ত্ব এবং অরৈখিক স্থিতাবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সেন্সরশীপ অনুমানকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারটি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের এই সময়কার সবচেয়ে বহুলালোচিত সমস্যাগুলির একটি।

 
উর্‌স শ্মিডের আঁকা একটি পেনরোজ টাইলিং এর তৈলচিত্র (১৯৯৫); এটা আঁকতে মোটা ও চিকন রম্বস ব্যবহৃত হয়েছে

পেনরোজ ১৯৮৪ সালে করা তার আবিষ্কার পেনরোজ টালিকরণ(Penrose tiling) এর জন্য সুবিখ্যাত। এই তত্ত্বে দুইটি টালি দিয়ে সংশ্লিষ্ট সমতলকে টালি-দিয়ে-ছেয়ে-ফেলা আরম্ভ করা হয়; শর্ত কেবল এটাই যে - টালিকরণ অপর্যায়ক্রমিক হতে হবে। ১৯৮৪ সালে প্রায়-কেলাস পদার্থের (quasi crystals) পারমাণবিক বিন্যাসে এই একই ধরনের ছাঁচ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্ভবত ১৯৭১ সালে করা স্পিন-নেটওয়ার্কের আবিষ্কার। এই স্পিন-নেটওয়ার্ক পরবর্তীতে চক্র কোয়ান্টাম মহাকর্ষের স্থান-কালিক জ্যামিতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বহুল পরিচিত পেনরোজ চিত্র (এক ধরনের কারণ- প্রদর্শী চিত্র)-এর জনপ্রিয়করণে তিনি প্রভাবশালী ভূমিকা রাখেন।

২০০৪ সালে পেনরোজ The Road to Reality: A Complete Guide to the Laws of the Universe নামক ৩৪টি অধ্যায় সংবলিত ১,০৯৯-পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের অদ্যাবধি আবিষ্কৃত সব নীতির বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে।

Discover ম্যগাজিন পত্রিকার ২০০৫ সালের জুন সংস্করণে পেনরোজ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সম্পর্কে তার যাবতীয় ব্যাখ্যা সংক্ষেপে তুলে ধরেন।

পদার্থবিজ্ঞান এবং চেতনা সম্পাদনা

পেনরোজ তার যেসব গ্রন্থে মনুষ্য-চেতনা এবং মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে যোগসূত্র থাকার কথা বর্ণনা করেছেন তাদের প্রতিটিই ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। The Emperor's New Mind (১৯৮৯) বইটিতে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, পদার্থবিজ্ঞানের জানা নীতিগুলি মনুষ্য-চেতনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। পেনরোজ এই ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে কী কী নতুন সংযোজন প্রয়োজন হতে পারে সে ব্যাপারে ধারণা দিয়ে বলেছেন যে, এ কাজের জন্য প্রথাগত এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যে যোগসূত্র (যাকে তিনি নাম দিয়েছেন শুদ্ধ কোয়ান্টায়িত মহাকর্ষ (শুকোম)) স্থাপন করতে হতে পারে। মানুষের মনে যেসব যুক্তিকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় সেগুলি সম্পূর্ণভাবে অ্যালগোরিদম নির্ভর এবং এইসব প্রক্রিয়া যথেষ্ট পরিমাণে জটিল ও শক্তিশালী একটি কম্পিউটার নিখুঁতভাবে অনুকরণ করতে পারবে - এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেন তিনি। এই মতবাদটি অবশ্য জৈবনিক প্রকৃতিবাদের মত মতবাদের বিরোধী অর্থাৎ পেনরোজ যেন এই বিষয়টিতে জৈবনিক প্রকৃতিবাদকেই সমর্থন করছেন, যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে, মনুষ্য-আচরণকে যন্ত্রের সাহায্যে নকল করা সম্ভবপর হলেও মনুষ্য-চেতনাকে এভাবে অনুকরণ করা সম্ভব হবে না। এই বিশ্বাসের ভিত্তি হিসাবে যে যুক্তি দেখানো হয় তা হলো, মনুষ্য-চেতনা যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক যুক্তি-ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত, কাজেই যতি-সমস্যার (Halting problem) অসমাধানযোগ্যতা এবং গ্যডেলের অসম্পূর্ণতা তত্ত্ব এটাই নির্দেশ করে যে, শুধু গাণিতিক ধারণাকে ভিত্তি করে কোন অ্যালগোরিদমকেন্দ্রিক পূর্ণাঙ্গ যুক্তি-ব্যবস্থা পাওয়া সম্ভব না। অবশ্য পেনরোজ এই মতবাদটির জনক নন; এর প্রকৃত জনক হলেন অক্সফোর্ডের মার্টন কলেজের দার্শনিক জন লুকাস

১৯৯৪ এবং ১৯৯৮ সালে পেনরোজ যথাক্রমে Shadows of the Mind এবং The Large, the Small and Human Mind নামক গ্রন্থদ্বয়ে পূর্বে প্রকাশিত The Emperor's New Mind গ্রন্থে উল্লেখিত তার তত্ত্বগুলো পরিমার্জন করেন এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞানীমহলে অবশ্য মনুষ্য চিন্তা-প্রক্রিয়া সংক্রান্ত পেনরোজের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি। মারভিন মিন্‌স্কির মতে, মানুষ যেহেতু ভ্রান্ত ধারনাকে সত্য বলে মনে করতে পারে, সুতরাং চিন্তার প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র নিয়মতান্ত্রিক যুক্তি-ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। শুধু তাই না, এআই প্রোগ্রামগুলিও যেহেতু মিথ্যা বিবৃতিকে সত্য মনে করতে পারে, তাই কেবল মানুষই ভুল করছে, মানবীয় সীমাবদ্ধতা নাই এমন একটি ব্যবস্থা হলে ভুল করতো না এমন ধারণাও আর ধোপে টেকে না। আরেকজন ভিন্নমত পোষণকারী হলেন চার্লস সেইফে। তিনি চিরায়ত ইংরেজ ভদ্রতাকে বাঁচিয়ে বলেছেন, "মনুষ্য-চেতনার নিয়ত-পরিবর্তনশীলতা যে এর কোয়ান্টায়িত প্রকৃতিরই বহিঃপ্রকাশ এমন ধারণা পোষণকারী হাতে-গোনা জনাকয়েক বিজ্ঞানীর মধ্যে একটি সমতলকে নানা আকৃতির টাইল দিয়ে ছেয়ে ফেলা সংক্রান্ত কাজের জন্য বিখ্যাত অক্সফোর্ডের গণিতবিদ পেনরোজ একজন"।

পেনরোজ এবং স্টুয়ার্ট হ্যামারহফ মনুষ্য-চেতনার একটা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, মাইক্রো-নালিকাসমূহের মধ্যে কোয়ান্টায়িত মহাকর্ষের ক্রিয়াশীলতার দরুন মনুষ্য-চেতনার উদ্ভব ঘটে। কিন্তু ম্যাক্স টেগমার্ক Physical Review পত্রিকায় প্রকাশিত তার একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, নিউরনের সক্রিয়ন ও উদ্দীপনের(firing and excitation) জন্য প্রয়োজনীয় সময় বিষমভাবাপন্নতার(decoherence) জন্য প্রয়োজনীয় সময় থেকে কমপক্ষে ১০,০০০,০০০,০০০ গুণ বেশি। টেগমার্কের গবেষণাপত্রটি অনুমোদন করার পিছনে যুক্তি হিসাবে তাকে সমর্থন করে বলা হয়েছে যে, বিবাদ-নিরপেক্ষ পদার্থবিদগণ, যেমন: আই. বি. এম. -এর জন স্মোলিন, এর মতে টেগমার্কের হিসাবটি আসলে আগাগোড়া তারা যেটা সন্দেহ করে আসছিলেন তাকেই নিশ্চিত করেছে। স্মোলিন বলেন, "আমাদের মস্তিষ্কের আবাস তো আর পরমশূন্যের কাছাকাছি কোথাও নয়, এজন্য বিবর্তনের ফলশ্রুতিতে মস্তিষ্কের আচরণ কোয়ান্টায়িত হয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা খুব একটা যৌক্তিক হতে পারে না।" পেনরোজ-হ্যামারহফ প্রস্তাবনার সমালোচকগণ টেগমার্কের গবেষণাপত্রটি ব্যাপকভাবে উল্লেখ করেছেন। হ্যামারহফ দাবী করেছেন যে, টেগমার্কের হিসাব বেশ কয়েকটি ভ্রান্ত অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়েছে(নিচে সংযুক্ত হ্যামারহফ, হ্যাগান ও তুসজিনস্কির গবেষণাপত্রটি দেখুন)। কিন্তু টেগমার্কও যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন যে, সমালোচনাটির কোন ভিত্তি নেই।(নিচের প্রত্যুত্তরমূলক গবেষণাপত্রটি দেখুন)

পুরস্কার সম্পাদনা

বিজ্ঞান বিষয়ে অবদান রাখার জন্য পেনরোজ এ যাবত অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন:

রজার পেনরোজকে লন্ডন ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটি এভাবে সম্মান দেখিয়েছে:

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে তাঁর নিগূঢ় গবেষণাকর্ম কৃষ্ণবিবরের প্রকৃতি বোঝার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর উদ্ভাবিত টুইস্টর তত্ত্বের সাহায্য গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত সমীকরণগুলিকে আরও সুন্দর ও ফলপ্রসুভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত প্রায়-কেলাস পদার্থের ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে তাঁর সমতলের টাইলিং সংক্রান্ত কাজের মধ্যে।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলি সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

উৎসপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা