মৌরিতানিয়ার ইতিহাস

ইতিহাসের বিভিন্ন দিক

মৌরিতানিয়া উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ।

আলমোরাভিদ সাম্রাজ্য, ১১শ শতক
২০শ শতকের প্রথমার্ধে মৌরিতানিয়া ফরাসি পশ্চিম আফ্রিকার অংশ ছিল।

উত্তর মৌরিতানিয়ায় প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্বর নামের যাযাবর এক জাতির লোকেরা খ্রিস্টের জন্মের ১ হাজার বছর আগে অঞ্চলটিতে প্রবেশ করে এবং সেখানকার স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ জনগণকে পদানত করে। এই নবাগত বর্বররা ছিল সানহাজা গোত্রভুক্ত। মৌরিতানিয়া দখল করার পর এরা বহুদিন ধরে উত্তর আফ্রিকা ও প্রাচীন ঘানা রাজ্যের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। প্রাচীন ঘানা রাজ্যের রাজধানী কুম্বি সালেহ বর্তমান মৌরিতানিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত ছিল।

১০৭৬ সালে মৌরিতানিয়ার সানজাহা বর্বররা আলমোরাভিদ নামক এক শাসকের নেতৃত্বে কুম্বি সালেহ শহরটিকে ধ্বংস করে। তবে ঘানা রাজ্যটি এরপরেও ১৩শ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৬শ শতকে এসে আরবেরা মৌরিতানিয়ার বার্বারদের পরাজিত করে। আরবদের বংশধরেরা দেশটির সমাজব্যবস্থার উচ্চস্তর গঠন করে। ধীরে ধীরে দেশটির জনগণ বিভিন্ন বার্বার উপভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। ১৯শ শতকের শেষ দিকে ফরাসিরা উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকাতে ঔপনিবেশিক অভিযান চালানো শুরু করে। তারা সেনেগাল নদী ধরে মোরিতানিয়াতে প্রবেশ করে এবং ১৯২০ সালের মধ্যে মোরিতানিয়া ফ্রান্সের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৪৬ সালে মোরিতানিয়াকে ফ্রান্সের একটি বহিঃস্থ প্রশাসনিক অঞ্চল বানানো হয়। ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে মোরিতানিয়াতে দাসপ্রথা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।

১৯৫৮ সালের ২৮শে নভেম্বর মৌরিতানিয়া নিজেকে ফরাসি ৫ম প্রজাতন্ত্রের অধীনস্থ একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। ঠিক দুই বছর পরে ১৯৬০ সালের ২৮শে নভেম্বর এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬১ সালে দেশটি জাতিসংঘে যোগদান করে। ঐ একই বছরে মোক্তার উলদ দাদ্দাহ দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৬, ১৯৭১ ও ১৯৭৬ সালে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে ও ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে মোরিতানিয়াতে ভয়াবহ খরা হয়। তা সত্ত্বেও লোহা ও তামার খনি আবিষ্কৃত হওয়ায় মোরিতানিয়ার অর্থনীতি ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন স্পেনীয় সাহারার দক্ষিণ তৃতীয়াংশ স্পেন মোরিতানিয়াকে দিয়ে দেয়। বাকী দুই-তৃতীয়াংশ দেওয়া হয় মরক্কোকে। কিন্তু পশ্চিম সাহারার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন, পোলিসারিও ফ্রন্ট, পশ্চিম সাহারেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এই যুদ্ধের কারণে মোরিতানিয়ার অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালে একটি সামরিক কু-তে রাষ্ট্রপতি দাদ্দা ক্ষমতাচ্যুত হন। তাকে প্রতিস্থাপনকারী সামরিক শাসক মোহামেদ উলদ লুলিও পরে কু-র মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে মোরিতানিয়া পশ্চিম সাহারা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯৮০ সালে মোরিতানিয়াতে আরেকবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ উলদ হাইদাল্লা রাষ্ট্রপতি হন। তিনি দেশে কঠোর ইসলামী আইনের প্রবর্তন করেন। ১৯৮১ সালে হাইদাল্লা একটি কু প্রতিহত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে সেনাপ্রধান কর্নেল মাউইয়া উলদ সিদি আহমেদ তায়া তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৮৯ সালে মোরিতানিয়া ও সেনেগালের সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেয়। সেনেগাল থেকে ১ লক্ষ লোক মোরিতানিয়াতে চলে আসে এবং মোরিতানিয়া থেকে ১ লক্ষ ২৫ হাজার সেনেগালিকে বিতাড়িত করা হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি তায়া ১৯৯১ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন যাতে বিরোধী দলসমূহের রাজনীতির সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে তায়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, কিন্তু বিরোধী দলগুলি কারচুপির অভিযোগ করে। ১৯৯৭ সালে তায়া পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং পুনরায় তার বিরুদ্ধে ভোটচুরির অভিযোগ করা হয়।

১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে তায়া মোরিতানিয়াতে ইসলামী চরমপন্থী দলগুলির প্রভাব খর্ব করার প্রয়াস নেন এবং ইসরায়েল ও পশ্চিমা শক্তিগুলির সাথে মোরিতানিয়ার সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন। ১৯৯৯ সালে মোরিতানিয়া ইসরায়েলের সাথে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা ছিল আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরল একটি ঘটনা।

২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বে পরিচালিত ইরাক আক্রমণ মোরিতানিয়াতে ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। সরকার ইরাকপন্থী ও ইসলামী দলগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। ঐ বছর রাষ্ট্রপতি তায়া আরেকটি কু-এর হাত থেকে রক্ষা পান এবং ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে একটি বিতর্কিত নির্বচনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

২০০৫ সালের আগস্ট মাসে তায়া সরকার উৎখাত হয়। “ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের জন্য সামরিক কাউন্সিল” নামের একটি কাউন্সিল দেশের ক্ষমতাভার গ্রহণ করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে দুই বছর অন্তর্বর্তীকালীন শাসন শেষে দেশে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেওয়া হবে। এই সামরিক কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন জাতীয় পুলিশ প্রধান কর্নেল এলি উলদ মোহামেদ ভাল। যখন এই সামরিক কু-টি ঘটে, তখন তায়া দেশের বাইরে সৌদি আরবের বাদশা ফাহদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং ইসলামীপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণের কারণে তায়া এসময় কিছু অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, এবং এগুলিকে তার বিরুদ্ধে কু-এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে দেখানো হয়। [১]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকান ইউনিয়ন তায়াকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার জন্য মোরিতানিয়ার নতুন শাসকদের চাপ দেয়। ২০০৬ সালের জুন মাসে মোরিতানিয়াতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় এবং ২০০৭ সালের মার্চ মাসে নতুন নির্বাচন হয়। এই নির্বাচলে সিদি উলদ শেখ আবদাল্লাহি নির্বাচিত হন এবং ভাল ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি তায়া এখনও দেশের বাইরে নির্বাসনে আছেন।

২০০৮ সালে মোরিতানিয়াতে আবার একটি রক্তপাতহীন কু ঘটে এবং মোরিতানিয়ার সেনাবাহিনীর কিছু সিনিয়র আফিসার নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আবদাল্লাহিকে গৃহবন্দী করে। [২][৩][৪]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. (BBC)
  2. "afp.google.com, Coup in Mauritania as president, PM arrested"। ৯ আগস্ট ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ 
  3. news.bbc.co.uk, Troops stage 'coup' in Mauritania
  4. "ap.google.com, Coup under way in Mauritania: president's office"। ১২ আগস্ট ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১০