মিলিন্দপঞ্‌হ (পালি: মিলিন্দের প্রশ্ন) হল একটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ। এটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০ অব্দ নাগাদ রচিত হয়। থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের তিপিটকের ব্রহ্মদেশীয় সংস্করণে এটিকে খুদ্দক নিকায় বলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও উক্ত গ্রন্থের থাই বা শ্রীলঙ্কার সংস্করণে এটি পাওয়া যায় না। অবশ্য এর একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রকায় পাঠ চীনা মহাযান অনুবাদগুলির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

রাজা মিলিন্দ (মেনান্দ্রোস) প্রশ্ন করছেন।

মিলিন্দপঞ্‌হ গ্রন্থে ভারত-গ্রিক রাজ্য ব্যাক্ট্রিয়ার রাজা প্রথম মেনান্দ্রোস (পালি: মিলিন্দ) ও বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের কথোপকথন লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রথম মেনান্দ্রোস খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

ইতিহাস সম্পাদনা

এই গ্রন্থের প্রাচীনতম অংশটি সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১০০ থেকে ২০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত।[১] সম্ভবত বইটি প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল।[২] তবে শ্রীলঙ্কার পালি সংস্করণ এবং সেটির টীকা, অনুবাদ ইত্যাদি ভিন্ন বইটির অন্য কোনো কপি পাওয়া যায় না।

গবেষকেরা সাধারণত এই বিষয়ে একমত যে,[৩] এই গ্রন্থটি বেশ জটিল। পরবর্তীকালে কিছু অংশ এতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। এই বক্তব্যের সমর্থনে দেখানো হয় যে, এই গ্রন্থের চীনা সংস্করণগুলি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রকায়।[৪]

পালি ধর্মগ্রন্থটির প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিটির প্রতিলিপি গৃহীত হয়েছিল ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। এই গ্রন্থে প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা যায়, এই গ্রন্থের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারিয়ে গিয়েছে। ফলে এই গ্রন্থটিই একমাত্র পালি ধর্মগ্রন্থে পরিণত হয়েছে, যেটি অসম্পূর্ণ।[৫]

ব্রহ্মদেশীয় পঞ্চম সঙ্গীতিষষ্ঠ সঙ্গীতির ধর্মগ্রন্থগুলির মুদ্রিত সংস্করণ অনুসারে এই ধর্মগ্রন্থ তিপিটকের অন্তর্ভুক্ত।

রাইস ডেভিস বলেছেন যে, এই গ্রন্থটি ধ্রুপদি ভারতীয় গদ্যসাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।[৬] যদিও মর্টিজ উইনটের্নিটিজ বলেছেন, কেবলমাত্র এই গ্রন্থের প্রথম অংশগুলির ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য।[৭]

বিষয়বস্তু সম্পাদনা

মিলিন্দপঞ্‌হ গ্রন্থের বিষয়বস্তু হল:

  1. পূর্বজন্ম কথা
  2. বৈশিষ্ট্যগুলির পার্থক্যকরণ-সংক্রান্ত প্রশ্নাবলি : (মনোযোগ ও প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য, প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য, যোগাযোগের বৈশিষ্ট্য, অনুভূতির বৈশিষ্ট্য, ধারণার বৈশিষ্ট্য, কামনার বৈশিষ্ট্য, চেতনার বৈশিষ্ট্য, প্রযুক্ত চিন্তার বৈশিষ্ট্য, নিরবচ্ছিন্ন চিন্তার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি)
  3. জটিলতা ছেদকরণ-সংক্রান্ত প্রশ্নাবলি : (রূপান্তর ও পুনর্জন্ম, আত্মা, দুষ্কর্মের বন্ধন, বিভিন্ন স্থানে যুগপৎ উত্থান, জ্ঞানত ও অজ্ঞানত কৃত দুষ্কর্ম ইত্যাদি)
  4. সমস্যা-সংক্রান্ত প্রশ্নাবলি : বিভিন্ন ধাঁধা ও ৮২টি সমস্যায় সেই ধাঁধাগুলিকে বিন্যাস
  5. সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাধান-কৃত একটি প্রশ্ন
  6. কৃচ্ছ্রসাধনের বিশেষ গুণাবলির আলোচনা
  7. উপমার কথা-সংক্রান্ত প্রশ্নাবলি

হিনুবারের (২০০০) মতে, রাজা মেনান্দ্রোস যে ঐতিহাসিক চরিত্র সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ভিক্ষু নাগসেন অজ্ঞাত চরিত্র। বইটিতে কালনির্দেশে কিছু ভুল আছে। কথোপকথনের মধ্যে গ্রিক প্রভাব কম। অথচ উপনিষদের প্রভাব এসে স্পষ্ট।[৮]

গ্রন্থে নাগসেনের পিতা সোঙুত্তর, গুরু রোহন, বত্তনিয়ার অস্‌সগুত্ত এবং পাটলীপুত্রের নিকটবর্তী অশোক আরামের ধম্মরক্‌খিতের কথা পাওয়া যায়। এছাড়া সাগলের নিকট সনখেয়ার আয়ুপাল নামে আরেক গুরুর নামও পাওয়া যায়।

রাজা মিলিন্দ সম্পাদনা

মিলিন্দপঞ্‌হ-র মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে মিলিন্দ, যিনি কিনা প্রথম মেনান্দ্রোস নামে পরিচিত, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বলা আছে যে তাঁর নিরাপত্তার্থে সবসময়ে পঞ্চশত গ্রিক (যবন) সেনারা মোতায়েন করা থাকত।

মিলিন্দ প্রশ্নে, রাজা মিলিন্দের বর্ণনা:

উভয়ের মধ্যে শ্রামণের জম্বুদ্বীপে সাগল নগরে মিলিন্দ নামে রাজা হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন। তিনি পণ্ডিত, পারদর্শী, মেধাবী ও সুদক্ষ নরপতি ছিলেন। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমস্ত যোগ বিধান ক্রিয়াদিতে সুবিবেচনার সহিত ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান করিতেন। বহু শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। শ্রুতি, সম্মতি, সংখ্যা, যোগ, নীতি, বৈশেষিক, গণিত, গন্ধর্ব চিকিৎসা, চতুর্বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, জ্যোতিষ, ইন্দ্রজাল, হেতু, মন্ত্রণা, যুদ্ধ, ছন্দ, সামুদ্রিক এই ঊনবিংশতি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি তর্ক-শাস্ত্রে এমন বাগ্মী ছিলেন যে, তাঁহার বাগ্মিতায় কেহ ঠাঁই দিতে পারিত না। বহু তীর্থকরের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন। সমস্ত জম্বুদ্বীপে মিলিন্দ রাজের সমান কেহই ছিল না। যেমন জ্ঞানে, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে, তেমন শারীরিক বল, শৌর্য, বীর্য, সাহসেও তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। ধন বৈভবে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিল না। অসংখ্য সৈন্য সামন্ত তাঁহার বিদ্যমান ছিল।


— মিলিন্দ প্রশ্ন - শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (অনুবাদক), বনভন্তে প্রকাশনী, ১৯৩১

বৌদ্ধ পরম্পরায় জানানো হয় যে ভিক্ষু নাগসেনের সঙ্গে তাঁর ধর্মালোচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মিলিন্দ বৌদ্ধধর্ম আমৃত্যু গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যের ভার নিজের ছেলের হাতে সঁপে দিয়ে জাগতিক সংসার থেকে অবসর নেন। ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে পরে তিনি সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্হৎ হন।

বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা

  1. মিলিন্দ প্রশ্ন - শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (অনুবাদক), বনভন্তে প্রকাশনী, ১৯৩১
  2. মিলিন্দপঞ্হ, অনুবাদক: সাধনকমল চৌধুরী, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০১।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Hinuber (2000), pp. 85-6, para. 179.
  2. Hinüber (2000), p. 83, para. 173, suggests, based on an extant Chinese translation of Mil as well as some unique conceptulizations within the text, the text's original language might have been Gandhari.
  3. Hinüber (2000), pp. 83-86, para. 173-179.
  4. According to Hinüber (2000), p. 83, para. 173, the first Chinese translation is believed to date from the 3rd century and is currently lost; a second Chinese translation, known as "Nagasena-bhiksu-sutra," (那先比丘經 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৮ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে) dates from the 4th century. The extant second translation is "much shorter" than that of the current Pali-language Mil.
  5. Hinuber (2000), p. 85, para. 178.
  6. Rhys Davids (1890, 1894), p. xlviii, writes: "[T]he 'Questions of Milinda' is undoubtedly the masterpiece of Indian prose, and indeed is the best book of its class, from a literary point of view, that had then been produced in any country."
  7. History of Indian Literature
  8. von Hinuber (2000), p. 83, para. 172.

সূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা