মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও সাংবাদিক।[১] তিনি কবি ও লেখক হিসাবেও পরিচিত। তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি ও উর্দুতে লেখালেখি করেন। মুসলিম যুগের চট্টগ্রামের সরকারি নাম ইসলামাবাদের নামানুসারেই তিনি নিজের নাম ইসলামাবাদী রাখেন।[২]

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
জন্ম
মনিরুজ্জামান

২২শে আগস্ট ১৮৭৫
মৃত্যু২৪শে অক্টোবর ১৯৫০
কদম মোবারক, চট্টগ্রাম
জাতীয়তাভারতীয় বাঙালী
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৮৭৫-১৯৪৭)
 পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৫০)
পেশাকবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ
রাজনৈতিক দলভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস,

কৃষক প্রজা পার্টি,

জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ

জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

ইসলামাবাদী ২২শে আগস্ট ১৮৭৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার) বরমা-আড়ালিয়া (চড়) গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।[৩]

তিনি কলকাতার হুগলী সিনিয়র মাদরাসায় ছয় বছর অধ্যয়ন করে সেখান থেকে ১৮৯৫ সালে এফএম ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে রেভিনিউ আইন অধ্যয়ন এবং মোক্তারি পরীক্ষা পাসের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল।[৪]

কর্মজীবন সম্পাদনা

শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি রংপুর শহরের মুনশীপাড়া জুনিয়র মাদরাসায় হেড মৌলভী পদে যোগ দিয়ে ১৮৯৬-১৮৯৭ সালে পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এরপর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার কুমেদপুর হারাগাছি সিনিয়র মাদরাসায় হেড মৌলভী পদে ১৮৯৮-১৯০০ সাল পর্যন্ত শিকতা করেন। মাদরাসাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি চট্টগ্রাম ফিরে এসে সেখানে মৌলভী আবদুল আজিজ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বোর্ডিংয়ে সুপারিন্টেনডেন্ট পদে ১৯০০ সালে. ৬ মাস কাজ করেন। এরপর সীতাকুণ্ড সিনিয়র মাদরাসার প্রধান শিক্ষক পদে শিক্ষকতা করেন।

তিনি সোলতান (পত্রিকা) (১৯০১), হাবলুল মতিন (১৯১২), মোহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনুর (১৯১১), বাসনা (১৯০৪) এবং আল এছলাম পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।[৫]

পরবর্তী জীবন এবং মৃত্যু সম্পাদনা

১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রামের কদমমোবারক মুসলিম এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সময়ে তিনি কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা হারান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সমর্থন দিয়ে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করা। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করেন। নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে ‘দিল্লি চলো’ শ্লোগান তুলে এগিয়ে চলছিলেন ভারতের দিকে ঐ সময় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাথে পরিচয় ঘটে বেংগল ভলান্টিয়ার্স এর সুবোধ চক্রবর্তীর। সুবোধের সাথে আলাপ করে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এত বেশি মুগ্ধ হন যে শেষ বয়সে একটা ঝুঁকি নেবার জন্য রাজি হয়ে পড়েছিলেন। সুবোধকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড়ে। চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে আরাকানের পথ ধরে আবারও নেতাজীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে যখন পথ চলছিলেন তখন সীমান্ত এলাকায় ছিল সতর্ক পাহারা। আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলে থাকার কারণে সতর্কতা যেন সীমাহীন হয়ে পড়েছিল।

মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বীরকণ্ঠে তার সহচরকে বলছিলেন, আমার জীবনের মাত্র কয়েকদিন বাকি, এই চরম ঝুঁকি নিতে আমার অসুবিধেও নেই। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিলেন, শ্যালক মোর্শেদকে নিয়ে একেবারে ফকির সেজে নেতাজীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মওলানার সমস্ত বিপ্লবী কার্য টের পায়। সে কারণে তার শহরস্থ বাড়ি, তৎকালীন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ) বাড়ি, সীতাকুন্ডের বাড়ি, কলকাতার বাসভবনে ইংরেজ সার্জেন্টের নেতৃত্বে বিপুল সৈন্যের মাধ্যমে তল্লাশি চালানো হয়। ঐ সময় মওলানাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রভৃতি নেতার সাথে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকেও দিল্লির লালকিল্লায় বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাকে সেখান থেকে পাঞ্জাবের ময়াওয়ালী জেলে স্থানান্তর করেন। সেখানকার জেলের ছাদের বিমের সঙ্গে রজ্জু দিয়ে ৬৫ বছর বয়স্ক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর দু’পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে তার উপর অশেষ নির্যাতন চালানো হয়েছিল গোপন তথ্য জানার জন্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পুরো জীবনের তিন ভাগের দুই ভাগ কেটেছেন অন্ধকার জেলে। ব্রিটিশদের নির্যাতন এর মধ্যদিয়ে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বন্দী ছিলেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, "বৃদ্ধ বয়সে আমার উপর যেভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন ব্রিটিশ সরকার করেছেন, পৃথিবীর কোন সভ্য জাতির ইতিহাসে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে না, কিন্তু তারা আমার দেশকে লুটে খাওয়ার জন্য আমাদের দেশে মানুষের উপর নির্মম অত্যাচার করে চলেছেন, এই অত্যাচারের একদিন শেষ হবে, আমরা স্বাধীন হব! এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই স্বাধীনতা ভোগ করবে এটি আমার বিশ্বাস।"

আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ইসলামাবাদী সম্পাদনা

চট্টগ্রামের দক্ষিণ মহকুমার কর্ণফুলীর তীরবর্তী দেয়াং পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তার আজীবন। ১৯১৫ সালে তিনি সেই লক্ষ্যে সরকার থেকে ৬০০ বিঘা জমি ও ওই এলাকার জমিদার আলী খান থেকে ৫০০ কানি ভূমি রেজিস্ট্রিমূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গ্রহণ করেছিলেন। বিখ্যাত নেতা ও শিক্ষাবিদ শেরেহিন্দ মাওলানা শওকত আলী ১৯৩৫ সালে এ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। জঙ্গে জিহাদ, শাহ বদিউল আলম, শাহ জুলফিকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবল সমর্থক হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে ঐ সময় চট্টগ্রামে থাকতে রাজি হন। দেয়াং পাহাড়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ স্থান পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হন ভারতীয় সেরা রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরম খাঁ, মুন্সী রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী। তিনি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।[৩] কিন্তু তবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার হাজারো আলেমের মনের ঐকান্তিক ইচ্ছার ফল স্বরূপ ‘ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাদ্বারা হয়তো আলেম সমাজের মনের বাসনা পূরণ লাভ করেছে।[৬] মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর শিক্ষক। তিনি কদম মোবারক মুসলিম এতিম খানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পটিয়ার দেয়াঙ পহাড়ে তিনি ইসলামী আরবী বিশ্ব বিদ্যালয়ের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে তিনি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদের কবরস্থানে শায়িত আছেন।

সাহিত্য কর্ম সম্পাদনা

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সফললভাবে সাহিত্য চর্চা ও রচনা করেছেন। তার সাহিত্য রচনায় সাহসিকতা চর্চা প্রাধান্য পেয়েছিলো। তিনি একাধিক ভাষায় ইসলামি সভ্যতা ও গণমানুষের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। তিনি দেশীয় ও বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়েও লেখালিখি করেছেন। তিনি ৪২ টির মতো গ্রন্থ রচনা করেন। অন্যতম গ্রন্থগুলো হলো:

  • ভারতে মুসলিম সভ্যতা
  • সমাজ সংস্কার
  • ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান
  • ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান
  • ভারতে ইসলাম প্রচার
  • সুদ সমস্যা
  • ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান (৩ খণ্ড)
  • ইসলামী শিক্ষা
  • কোরআন ও বিজ্ঞান
  • আত্মজীবনী প্রভৃতি

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

উদ্ধৃতি সম্পাদনা

  1. "মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও তাঁর অবদান"দৈনিক আজাদী। ২০১৯-০৯-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  2. পরিষদ, সম্পাদনা (জুন ১৯৮২)। সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ ২য় খণ্ড। শেরেবাংলা নগর, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ২৮৭। আইএসবিএন 954-06-022-7 
  3. "মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রহ.)-এর জীবনালেখ্য"banglanews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  4. (ছৈয়দ মোস্তফা জামাল সম্পাদিত, মাওলানা ইসলামাদী; ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য।) 
  5. "ইসলামাবাদী, মওলানা মনিরুজ্জামান - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৭ 
  6. http://www.dainikpurbokone.net/index.php/-lfontglfont-colorq5a5757qg-lfontg/2013-08-21-19-07-00/45812-2014-10-10-18-06-53[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহি:সংযোগ সম্পাদনা

.