মধ্যযুগীয় সাহিত্য

মধ্যযুগের সাহিত্যকর্ম

মধ্যযুগীয় সাহিত্য একটি বিস্তৃত বিষয়বস্তু। মধ্যযুগে (আনু. খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে পশ্চিম রোমান সামাজ্যের পতনের ১০০০ বছর থেকে ১৫শ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্লোরেন্তিন রেনেসাঁ শুরুর সময় পর্যন্ত) লিখিত সকল কাজ এই বিষয়ের আওতাধীন। এই সময়ের সাহিত্যে মূলত ধর্মীয় লেখা ও ধর্ম বহির্ভূত কাজসমূহ লিপিবদ্ধ হয়। এছাড়া এই সময়ের সাহিত্যকে উৎস, ভাষা ও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।[১]

ভাষা সম্পাদনা

রোমান ক্যাথলিক চার্চের ভাষা লাতিন হওয়ায় পশ্চিমমধ্য ইউরোপে এই ভাষার প্রভাব দেখা যায়। কারণ গির্জাসমূহে শিক্ষার প্রধান ভাষা ছিল লাতিন। ফলে মধ্যযুগীয় লেখায় লাতিন ছিল একটি প্রধান ভাষা, যদিও ইউরোপের কিছু স্থানে কখনোই রোমান ভাষা গ্রহণ করে নি। পূর্ব ইউরোপে, যেখানে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যপূর্ব গোঁড়াবাদী চার্চের প্রভাব ছিল, সেখানে লেখার ক্ষেত্রে গ্রিকপ্রাচীন চার্চ স্লাভনিক ভাষার প্রভাব ছিল।[২]

সাধারণ মানুষজন তাদের নিজেদের প্রচলিত ভাষা ব্যবহার করত। কয়েকটি উদাহরণ হল, প্রাচীন ইংরেজি বেউলফ, মধ্য উচ্চ জার্মান নিবেলুনজেনলিড, মধ্যযুগীয় গ্রিক ডিগেনিস আক্রিতাস, প্রাচীন পূর্ব স্লাভিক দ্য টেল অব আইগর্‌স ক্যাম্পেইন, এবং প্রাচীন ফরাসি চানসন দে রোল্যান্ড। এইসব মহাকাব্যসমূহ অজ্ঞাত কোন একজন কবির লেখা হলেও এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে মহাকাব্যসমূহ তাদের পূর্বপুরুষদের মৌখিক বর্ণনা থেকে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেল্টিক ধারা মারি দে ফ্রান্সের ব্রেন্টন লাই, মাবিনজিয়ন, ও আর্থারিয়ান সাইকেল-এ মধ্যে বেঁচে আছে।[১]

অজ্ঞাত সম্পাদনা

মধ্যযুগীয় অনেক সাহিত্যই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। তা শুধুমাত্র সেই সময়ের দলিলপত্র না পাওয়ার কারণেই নয় বরং তা লেখকদের ব্যাখ্যার ধরনের কারণে, যা রোমান্টিক যুগে ও বর্তমান যুগে বিষয়বস্তুসমূহের ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। মধ্যযুগীয় লেখকগণ ধ্রুপদী লেখক ও গির্জার পাদ্রীদের সম্মান করতেন এবং তাদের মধ্যে নতুন গল্প না লিখে পূর্বের লেখক বা পাদ্রীদের কাছ থেকে শুনা বা পাঠ করা গল্প পুনরায় বলা ও এই গল্পসমূহ বিস্তৃত করার প্রবণতা ছিল। কিংবা তারা কখনো নতুন গল্প লিখলেও তারা তা নিজের বলে দাবী করতে কুণ্ঠিত হতেন। এর ফলে অনেক লেখকদের নাম তেমন গুরুত্ব বহন করে নি এবং এইসব গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহ কোন নির্দিষ্ট নামে লিপিবদ্ধ হয় নি।[১]

লেখার ধরন সম্পাদনা

জীবনী সম্পাদনা

জীবনী বিষয়ক সাহিত্য লেখা শুরু হয় ৫ম শতাব্দীতে, অর্থাৎ মধ্যযুগে জীবনী লেখার উদ্ভব হয়।[৩] সেসময়ের কিছু জীবনী গ্রন্থ হল প্লুতার্ক রচিত প্যারালাল লাইভস এবং সুয়েতনিয়াস রচিত দ্য টোয়েলভ সিজারস্‌

ধর্মীয় সম্পাদনা

ধরমতত্ত্ব বিষয়ক কাজই মধ্যযুগের সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে এবং গ্রন্থাগারে স্থান দখল করে। ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রীগণ মধ্যযুগের সমাজের বিদ্বানদের কেন্দ্রবিন্দু এবং তাদের রচিত সাহিত্যই বেশি পাওয়া গেছে। প্রার্থনার নিয়মাবলী সংবলিত অগণিত স্তোত্র এখনো রয়ে গেছে। প্রার্থনার নিয়মাবলী নির্দিষ্ট ছিল না। ফলে সাধারণ ধারণা থেকেও কিছু নিয়মাবলী লেখা হয়েছিল। ধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত, যেমন - ক্যান্টারবেরির আনসেম, টমাস আকুইনাস, ও পিঁয়ের আবেলার্দ দীর্ঘ ধর্মতত্ত্বদর্শন বিষয়ক লেখা লিখেন। এছাড়া মার্টিন লুথার গির্জার পাপকে প্রশ্রয় দেয়ার চর্চার বিরুদ্ধে দ্য নাইটি-ফাইভ থিসিস রচনা করেন।[১]

জ্যাকবাস দে ভরাজিন রচিত গোল্ডেন লিজেন্ড সে সময়ে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বলা হয়ে থাকে তা বাইবেল থেকেও বেশি পাঠ করা হত। আসিসির ফ্রান্সিস একজন বাগ্মি কবি ছিলেন এবং তার ফ্রান্সিস্কান অনুসারীরাও তার কাব্য লিখতেন। দায়েজ ইরেস্তাবাত মেতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ লাতিন ভাষার ধর্ম বিষয়ক কবিতা। ভিন্নমত পোষণের ক্ষেত্রে গোলিয়ার্ডিক কাব্য (চার স্তবকের ব্যঙ্গকাব্য) ব্যবহার করতেন।[৪] পাদ্রী ব্যতীত লিখিত একমাত্র বহুল পঠিত ধর্মীয় রচনা ছিল মিস্ট্রি প্লে - বাইবেলের একটি দৃশ্যের সরণি-বিন্যাস। প্রত্যেকটি মিস্ট্রি প্লে বাইবেলের একেকটি ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই নাটকের লেখাগুলো স্থানীয় সমিতি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত এবং নাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ হত।[৫]

মধ্যযুগে ইউরোপে ইহুদি সম্প্রদায়েরও কিছু নামকরা লেখক জন্মগ্রহণ করেন। কর্দবা, স্পেন জন্ম নেওয়া মাইমোনিদেস এবং ফ্রান্সের ট্রয়েজে জন্ম নেওয়া রাশি দুইজন প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী ইহুদী লেখক।

ধর্মনিরপেক্ষ সম্পাদনা

 
বিওউল্‌ফ-এর প্রথম পৃষ্ঠা

এই সময়ে ধর্মীয় সাহিত্যের মত ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য এত পরিমাণ লেখা হয় নি, তবুও কিছু বই এখনো পাওয়া যায়। ১১শ শতাব্দী শিষ্ট প্রেম ধারণা প্রসার লাভ করে, বিশেষ করে লাতিন ভাষায়। এছাড়া এই ধারার সাহিত্য রচনায় ফরাসি, স্প্যানিশ, গালিসিয়ান-পর্তুগীজ, কাতালান, প্রভেঙ্কা ভাষা উল্লেখযোগ্য ছিল এবং গ্রিক ভাষার কিছু ভ্রমণপ্রিয় গায়ক তাদের জীবনধারণের জন্য গান গাইতেন। জার্মানিতে মিনিসেঙ্গাররা এই ধারা চলমান রাখে।[৬]

প্রাচীন ইংরেজি ধারার মহাকাব্য বেউলফ; জার্মান ধারার মহাকাব্য নিবেলুনজেনলিড; চানসন দে গেস্তে ধারার মহাকাব্য, যেমন - ম্যাটার অব ফ্রান্স সম্পর্কিত দ্য সং অব রোল্যান্ডআক্রিটিক গান সম্পর্কিত ডিজেনিস আক্রিটাস; শিষ্ট প্রেম ধারার ম্যাটার অব ব্রিটেনম্যাটার অব রোম সম্পর্কিত রোমান কার্তুজ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। রোমান কার্তুজ শুধু বিষয়বস্তুই নয় বরং প্রেম ও বীরত্ব বিষয়ে জোর দেওয়ার কারণে চানসন দে গেস্তে থেকে অনেকটাই ভিন্ন।[৬]

মধ্যযুগে রাজনৈতিক কাব্যও লেখা হয়, বিশেষ করে এই যুগের শেষের দিকে। এই সময়ে ভ্রমণ সাহিত্য খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং বেশিরভাগই ছিল কাল্পনিক স্থান নিয়ে রচিত। মূলত সাহিত্যগুলো একটি নির্দিষ্ট ছোট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, যে অঞ্চলের জনগণ কখনো সেই অঞ্চলের বাইরে যায় নি। ফলে তার অন্য কোন স্থানের বর্ণনায় বিনোদন লাভ করত। তবে এক্ষেত্রে তীর্থযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে সান্তিয়াগো দে কম্পস্তেলায় যাত্রা। এছাড়া মধ্যযুগের এই তীর্থযাত্রা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল জিওফ্রে চসার রচিত দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস[৭]

মধ্যযুগের ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি লেখকদের মধ্যে অন্যতম হলেন সলোমন ইবন গাবিরলইয়েহুদা হালেভি, তারা দুজনেই ধর্মীয় কবির হিসেবেও পরিচিত।[৮]

নারীদের সাহিত্য সম্পাদনা

মধ্যযুগে নারীরা পুরুষের সমতুল্য না হলেও কয়েকজন নারী তাদের প্রসিদ্ধির জন্য তাদের লেখার দক্ষতা দেখিয়েছেন। নারীরা মূলত ধর্মীয় রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ তা ছিল সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। তাদের লেখাসমূহ পাদ্রীগণ প্রতিবেদন, ও প্রার্থনা হিসেবে প্রকাশ করতেন। মধ্যযুগের নারী লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আসিসির ক্লেয়ার, সুইডেনের ব্রিজেত, ও সিয়েনার ক্যাথরিন[৯]

নারীদের ধর্মীয় চিন্তাধারা প্রচলিত রীতি বহির্ভুত ছিল এবং নরউইচের জুলিয়ান, মেগডেবাগের মেচথিল্ড, ও বিঞ্জেনের হিল্ডেজার্ড রচিত রহস্যঘন দৃশ্যকল্পসমূহ মধ্যযুগীয় সমাজকে চিত্রিত করে যা তৎকালীন ইউরোপের শাসকরা সহজে মেনে নিতে পারেন নি। নারীরাও ধর্মনিরপেক্ষ কিছু প্রভাববিস্তারকারী রচনা লিখেছেন, যেমন মারি দে ফ্রান্সক্রিশ্চিন দে পিজান রচিত শিষ্ট প্রেম ও সমাজ সম্পর্কিত রচনা, যা মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে।

ডি এইচ গ্রিনের ২০০৭ সালে রচিত ওম্যান রিডারস্‌ অফ দ্য মিডল এজেস এক্সপ্লোরস্‌ লিটারেসি অ্যান্ড লিটারেচার ইন টার্মস অব ওম্যান ইন মেডিয়েভাল সোসাইটি কাজে তিনি নারীদের সাহিত্য ইতিহাসের প্রতিফলন দেখিয়েছেন। বইটির পর্যালোচনা করে অ্যা র‍্যাডিকেল রিঅ্যাসেসমেন্ট অব ওম্যান্‌স কন্ট্রিবিউশন টু মেডিয়েভাল লিটারেরি কালচার নামে একটি বই রচিত হয়েছে।[১০]

রূপক সম্পাদনা

মধ্যযুগীয় সাহিত্যে কিছু ধরনের মধ্যে রূপক একটি অন্যতম ধরন ছিল। এসময়ে লেখকগণ কোন অবাস্তব বিষয়, ঘটনা ও প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গ বুঝাতে সাহিত্যে রুপকের ব্যবহার করেছেন। প্রথম সার্থক রূপক হিসেবে অউরেলিয়াস ক্লেমেনস্‌ প্রুডেন্তিয়াস রচিত সাইকোমাচিয়া (আত্মার যুদ্ধ) কে ধরা হয়।[১১] এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রূপকসমূহ হল রোমান্স অব দ্য রোজ, এভরিম্যান, পিঁয়ের্স প্লাউম্যান, রোমান দে ফাউভেল, ও ডিভাইন কমেডি[১২]

উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সম্পাদনা

নির্দিষ্ট নিবন্ধ সম্পাদনা

অঞ্চল ও ভাষা অনুযায়ী সম্পাদনা

ধরন অনুযায়ী সম্পাদনা

সময়কাল অনুযায়ী সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Medieval Literature"Medieval Life and Times। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  2. Rothwell, William (১৯৭৩)। Studies in Medieval Literature and Languages: In Memory of Frederick Whitehead। Manchester University Press। পৃষ্ঠা 403। আইএসবিএন 9780719005503 
  3. Kendall, Paul Murray। "biography - Historical development"। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা 
  4. "Medieval Literature"Essential Humanities। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  5. Evans, Simon (১৯৮৬)। Medieval Religious Literature। University of Wales Press। পৃষ্ঠা 93আইএসবিএন 9780708309384 
  6. Matthews, William (১৯৬৫)। Medieval Secular Literature: Four Essays। University of California Press। পৃষ্ঠা 89 
  7. Thomas Tyrwhitt, সম্পাদক (১৮২২)। "Introductory Discourse to the Canterbury Tales"। The Canterbury Tales of Chaucer। W. Pickering and R. and S. Prowett। পৃষ্ঠা 126 note 15। আইএসবিএন 978-0-8482-2624-4 
  8. Sirat, Colette (১৯৮৫)। A History of Jewish Philosophy in the Middle Ages। Cambridge University Press। 
  9. Green, D.H. "Women Readers of the Middle Ages". Cambridge University Press, England. আইএসবিএন ৯৭৮-০-৫২১৮৭-৯৪২২
  10. McDonald, Nicola. " Women Readers in the Middle Ages (review)"
  11. J. Stephen Russell, ed., Allegoresis: The Craft of Allegory in Medieval Literature (New York: Garland, 1988)
  12. "Medieval Medieval Allegory and Philosophical Texts"Encyclopedia.com। সংগ্রহের তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা