ভ্যালেরি টেইলর

স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি

ভ্যালেরি অ্যান টেইলর, ওবিই (ইংরেজি: Valerie Taylor; জন্ম: ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪) বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিআরপি (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড)-এর পরিকল্পক ও প্রতিষ্ঠাতা। একজন নারী হিসেবে তিনি মূলত ইংল্যান্ডের নাগরিক। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন।সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী তাকে সম্মান পূর্বক এই নাগরিকত্ব প্রদান করেন। স্বেচ্ছাসেবা এবং সম্পূর্ণ আপন প্রচেষ্টায় একটি পূর্ণাঙ্গ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তিনি বিশ্বে এক বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। চিকিৎসা ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।[১]

ভ্যালেরি টেইলর
জন্ম৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪
জাতীয়তাবাংলাদেশী
ইংরেজ
পেশাফিজিওথেরাপিস্ট
পরিচিতির কারণস্বেচ্ছাসেবী
পিতা-মাতাউইলিয়াম টেইলর
মেরি টেইলর
পুরস্কারস্বাধীনতা পদক, অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার, আর্থার আয়ার স্বর্ণপদক, শেলটেক পদক, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট পুরস্কার

কর্মজীবন সম্পাদনা

ভ্যালেরি টেইলরের জন্ম, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে যুক্তরাজ্যের কেন্ট শহরে। ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪ সালে উইলিয়াম টেইলর এবং মেরি টেইলর দম্পত্তির সংসারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তরুণ বয়সে ১৯৬৯ সালে ভলান্ট্যারি সার্ভিস ওভারসীজ (ভিএসও) নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান: বাংলাদেশ) আসেন। উদ্দেশ্য ছিল ফিজিওথেরাপি প্রদান। তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের নিকটে অবস্থিত চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতালে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পুনরায় বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তখনও যুদ্ধ শেষ হতে দুই মাস বাকি ছিল। এ সময় তার কাজ আরও বেড়ে গিয়েছিল। কারণ যুদ্ধের কারণে পঙ্গুত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। তিনি সফলভাবেই একাজ করতে সমর্থ হন। নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর তিনি আরও ২ বছর এদেশে থেকে তার কাজ চালিয়ে যান। ১৯৭৩ সালে আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান। উদ্দেশ্য ছিল মানবসেবার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশে একটি স্বার্থক ফিজিওথেরাপি সংগঠন তৈরির জন্য উপযুক্ত অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। ১৯৭৫ সালে তিনি আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

সিআরপি সম্পাদনা

এবার বাংলাদেশে ফেরার পর আরও প্রায় ৪ বছর স্বাভাবিকভাবে কেটে যায়। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে অনেক কষ্ট এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই হাসপাতালের দুইটি পরিত্যক্ত গুদাম ঘর পান। এখানেই প্রথম একেবারে ছোট আকারে প্রতিষ্ঠা করেন ফিজিওথেরাপির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সিআরপি এবং রোগী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রতিষ্ঠার পর অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন এর উন্নতির জন্য। সাইকেলে চেপে বিভিন্নজনের ঘরে ঘরে যেতেন সাহায্যের জন্য। এজন্য তাকে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছিল। এভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে সমর্থ হয়। পরিণত হয় ৪০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি দাতব্য ক্লিনিকে। এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে তাকে নেতৃস্থানীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে এটি দাতব্য থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বর্তমানে অবশ্য তার পদ তিনি ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু এর উদারনৈতিক স্বেচ্ছাসেবার অভিযান অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে।

১৯৯০ সালের পূর্ব পর্যন্ত তিনবার তার চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থান পরিবর্তিত হয়। পরে ঢাকা মহানগরীর অদূরে সাভারে একটি স্থায়ী পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।[২] বর্তমানে ভেলরির এই কেন্দ্রটি সিআরপি নামে সমধিক পরিচিত।

একাজেই তার জীবনের অধিকাংশ সময় পার হয়ে যায় যদিও তখনও কোন বিয়ে করেননি। এসময় দুটি পঙ্গু ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত মেয়েকে দত্তক নেন। তাদের নাম জয়তিপপি। তাদেরকে নিজে কাজ শেখান। এদের মধ্যে একজনকে সিআরপি-তে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। অন্যজনের অবস্থা খুব খারাপ থাকায় চাকরি করতে পারেনি। সেই মেয়েটি এখনও টেইলরের বাসায় থাকে।

সম্মাননা সম্পাদনা

দুঃস্থ, দুর্গত মানুষের সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ সালে তিনি আর্থার আয়ার স্বর্ণপদক লাভ করেন। স্বাস্থ্যসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন।[৩] ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়।[২] এছাড়াও, বেসরকারী হাউজিং প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রাঃ) লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৯৯৮ সাল থেকে প্রবর্তিত শেলটেক পদক, ২০১১-এর জন্য মনোনীত হয়েছেন।[৪] মানবসেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় সিআরপি'র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে এ পদক প্রদান করা হয়।[২] একই কারণে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্টের দি ওয়ান প্রজেক্ট কর্তৃক তাকে এক লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়।[৫]

এছাড়া, ৬৮ বছরের কর্মজীবনে ভ্যালেরি লাভ করেছেন অনেক স্বীকৃতিসহ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "মতিয়া চৌধুরীসহ বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ পেলেন সাত ব্যক্তিত্ব"দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২১ জানুয়ারি ২০২২ 
  2. দৈনিক যুগান্তর, ১০ মার্চ, ২০১২ইং, মুদ্রিত সংস্করণ, খবর, পৃষ্ঠা-৩
  3. www.crp-bangladesh.org- এই ওয়েবসাইটের ইতিহাস অংশে প্রাপ্ত টেইলরের জীবনী
  4. দৈনিক প্রথম আলো, ৪ জানুয়ারী, ২০১২ইং, মুদ্রিত সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১৮
  5. "লাখ ডলার পুরস্কার পেলেন ভেলেরি, সমকাল, সংগ্রহ: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ইং"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা