ভৈরব (সংস্কৃত: भैरव, অর্থ: "ভয়ানক" বা "ভীষণ"[১]) হিন্দু দেবতা শিবের হিংস্র প্রকাশ বা অবতার, যা মৃত্যু ও বিনাশের সাথে সম্পর্কিত।[২] তিনি কাল ভৈরব নামেও পরিচিত। রাজস্থান, তামিলনাড়ু এবং নেপালে হিন্দু পুরাণের দেবতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হিসেবে বিবেচিত। হিন্দু ও জৈন ধর্মে সমানভাবেই তাকে সম্মান করা হয়।

ভৈরব
ধ্বংস (প্রহরী দেবতা)
কাঠমান্ডুর দরবার চত্বরে ভৈরবের মূর্তি।
দেবনাগরীभैरव ( ভারত )
নেপালী ভাষাभैराद्य:
অন্তর্ভুক্তিশিবের একটি অবতার
অস্ত্রত্রিশুল
বাহনকুকুর
সঙ্গীভৈরবী

‘ভৈরব’ সংস্কৃত শব্দ, এর অর্থ ‘ভয়ঙ্কর’, ‘ভয়াবহ’। শিবের একটি বিশেষ রূপকে ‘ভৈরব’ হিসেবে বর্ণনা করে থাকে ‘শিব পুরাণ’ বা ওই জাতীয় শাস্ত্র।

ভৈরব রূপের কাহিনি সম্পাদনা

শিবের ভৈরব রূপের কাহিনিটি এ রকম: সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আদিতে পঞ্চমুখ ছিলেন। শিবও পঞ্চানন। ব্রহ্মা শিবের থেকে অধিক গুরুত্ব দাবি করেন এবং অসম্ভব অহঙ্কার প্রকাশ করতে থাকেন। ক্রুদ্ধ শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তকটি কর্তন করেন। এতে শিবের উপরে ব্রহ্মহত্যার পাপ অর্পণ হয়। ব্রহ্মা-কপাল হাতে নিয়ে শিবকে একটি দীর্ঘ সময় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় কাটাতে হয়। এই ভ্রাম্যমাণ শিবরূপই ‘ভৈরব’।

কালভৈরব সম্পাদনা

হিন্দু পুরাণ, বজ্রযানী বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি জানায়, মহাজগতের বিশেষ স্থানগুলি ভৈরব রক্ষা করেন। ভৈরবের মোট সংখ্য ৬৪। তাদের ৮টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি শ্রেণির আবার একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। প্রধান ৮ ভৈরবকে ‘অষ্ট ভৈরব’ বলা হয়। এই আটজন মহাবিশ্বের আটটি দিকের অধিপতি। এই আট জন আবার নিয়ন্ত্রিত হন মহা স্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। তিনি সাধারণভাবে কালভৈরব নামেই পরিচিত।

কালভৈরব স্বয়ং বরাহরূপী ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে তন্ত্রে বিশ্বাস করা হয়।

ভৈরব ও তার রূপ সম্পাদনা

হিন্দু পুরাণ মতে, কালভৈরব কাল বা সময়ের শাসক। প্রতিটি হিন্দু মন্দিরে কালভৈরবের মূর্তি রয়েছে। তিনি সেই মন্দিরের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত হন। শিব মন্দিরে কালভৈরব এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ওই মন্দিরের চাবির রক্ষক বলে গণ্য হন। প্রত্যেক ভৈরবের একজন করে ভৈরবী থাকেন। অষ্ট ভৈরবের নামগুলি এই প্রকার- অসিতাঙ্গ ভৈরব, রুরু ভৈরব, চণ্ড ভৈরব, ক্রোধ ভৈরব, উন্মত্ত ভৈরব, কপালি ভৈরব, ভীষণ ভৈরব ও সংহার ভৈরব। এ ছাড়াও বহু প্রকারের ভৈরব তন্ত্রে মন্ত্রে বা যন্ত্রে অথবা পুরাণে বর্ণনা করা আছে । বহু মহাবিদ্যাদেরও ভৈরব বর্ণিত; যেমন :- মহাকাল ভৈরব, সদ্যজাত ভৈরব, কামেশ্বর ভৈরব, ত্রম্বক ভৈরব, দক্ষিণামূর্তি ভৈরব, কালরুদ্র ভৈরব, একবক্র ভৈরব, মাতঙ্গ ভৈরব, সদাশিব ভৈরব, দশবক্র ভৈরব ও নীলকণ্ঠ ভৈরব । এ ছাড়াও বটুক ভৈরব, অঘোর ভৈরব ও পঞ্চানন ভৈরব ও বেশ সুপরিচিত ।

জনশ্রুতি আছে প্রতিটি সতীপীঠের রক্ষাকর্তা হিসেবে ভৈরব বিরাজমান যেমন :- নকুলেশ্বর ভৈরব, উমানন্দ, ভীরুকনাথ , ত্রিসন্ধ্যেশ্বর , কাপালি প্রভৃতি । পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে জগন্নাথ দেবকেই ভৈরব বলা হয় ।


ভূতডামর তন্ত্র সম্পাদনা

বজ্রযানী তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে বিপুল পরিমাণে ভৈরব-স্তুতি করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘ডামর’ শাখার তন্ত্রের প্রায় পুরোটাই ভৈরব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ‘ভূতডামর তন্ত্র’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, বৈদিক দেব-দেবীদের প্রভাব কলিযুগে অস্তমিত হবে। প্রধান দেবতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন ভৈরবরা। এ থেকে বোঝা যায়, ১১ শতক নাগাদ বজ্রযান ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে উত্থিত হয়েছিল।

এই সময় থেকেই তারা, ভদ্রকালী, রুদ্রগণেশ প্রভৃতি বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী হিন্দু দেবলোকে প্রবেশ করতে শুরু করেন। এ সময় থেকেই হিন্দু তন্ত্রে জটিলতা বাড়তে থাকে। ছায়াচ্ছন্ন ডামর শাখায় আগ্রহ তুঙ্গে ওঠে।

জৈন ধর্মে সম্পাদনা

জৈন ধর্মেও ভৈরবের অস্তিত্ব একই গুরুত্বের সঙ্গে স্থিত। ভৈরবদের মহিমা অনেকটাই গুপ্ত। সাধারণভাবে জমসমক্ষে পুরাণ-কাহিনি আওড়ানো হয়ে থাকলেও ৬৪ ভৈরব ও তাদের সঙ্গিনী ৬৪ যোগিনী তন্ত্রমতে বিবিধ শক্তির আধার। ভৈরবরা সুপ্ত এবং দূরবর্তী। ভৈরবীরা সক্রিয়। তাই তারা বিভিন্ন পূজা, উপচার ইত্যাদির মাধ্যমে ভৈরবীশক্তিকে তুষ্ট করে ভৈরবের প্রসাদ লাভ করতে চান। এই সাধনধারা দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসছে। নেপালে হিন্দু ও বৌদ্ধ তন্ত্রের এক অনবদ্য মিশেল ঘটেছে দীর্ঘকাল ধরে। এখানকার ভৈরব মূর্তিগুলিতে সেই মিশেলের ছাপ স্পষ্ট।

কাশীর কালভৈরব মন্দিরে বা উজ্জয়িনীর বিবিধ ভৈরব মন্দিরে জমা হয়ে রয়েছে অসংখ্য রহস্যময় আচার ও প্রথা। আজ সেসবের মানে খুঁজতে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু, এক সময় এসব আচারই যে তন্ত্রের বেশ ছায়াময় দিকের সঙ্গে জড়িত ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. For भैरव as one of the eight forms of Shiva, and translation of the adjectival form as "terrible" or "frightful" see: Apte, p. 727, left column.
  2. For Bhairava form as associated with terror see: Kramrisch, p. 471.
  3. http://www.natunsomoy.com/হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] সম্প্রদায়ের হাজার বছরের রহস্য-ধর্ম!