ভগিনী ক্রিস্টিন

স্বামী বিবেকানন্দের বিদ্যালয়ের শিক্ষক, এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিষ্য

ভগিনী ক্রিস্টিন অথবা ক্রিস্টিনা গ্রীন্সটাইডেল[১] (১৭ অগাস্ট ১৮৬৬— ২৭ মার্চ ১৯৩০) একজন শিক্ষিকা, সমাজসেবী এবং স্বামী বিবেকানন্দের অন্যতমা শিষ্যা ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ সালে ক্রিস্টিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা প্রথম শোনেন যা তাকে সবিশেষ রূপে প্রভাবিত করে। ১৮৯৫ সালে বিবেকানন্দ তাকে ব্রহ্মচর্য-এ দীক্ষা প্রদাণ করেন।

ভগিনী ক্রিস্টিন

১৯০২ সালে স্বামী বিবেকনন্দের মৃত্যুর আব্যহতি পূর্বে তিনি ভারতবর্ষে আগমন করেন। ১৯১১ সালে ভগিনী নিবেদিতার মৃত্যুর পর তিনি তার নারী শিক্ষা বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। [২] ১৯১৪ সাল অবধি ভারতে বসবাস করার পর তিনি ১৯১৪ সালে আমেরিকা ফিরে যান।[৩] কিছু বিশেষজ্ঞ যেমন ভগিনী গার্গী , পরিব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা মনে করেন,স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী ক্রিস্টিনকে নিজের মেয়ে মনে করতেন।[৪][৫]

বাল্যকাল ও কর্মজীবন সম্পাদনা

ভগিনী ক্রিস্টিন এর আসল নাম ছিল ক্রিস্টিনা গ্রিনস্টাইডেল। তিনি ১৮৬৬ সালে ১৭ আগস্ট জার্মানির নুরেমবার্গে জন্ম গ্রহণ করেন। [১] তার আরও পাঁচ জন ছোট বোন ছিল। তিন বছর বয়সে তার পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে। [১][৪] তারা মিশিগানের ডেট্রয়েট এ বসবাস শুরু করেন। তার বাবা ছিলেন একজন জার্মান বিদ্বান ব্যক্তি। ক্রিস্টিনের বয়স যখন ১৭ তখন তার বাবা মারা যান। পুরো পরিবারের দায়িত্ব ক্রিস্টিনকে নিতে হয়। ক্রিস্টিন ১৮৮৩ সালে ডেট্রয়েট পাবলিক স্কুল সিস্টেমে শিক্ষকতা শুরু করেন।

স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাৎ সম্পাদনা

১৮৯৪ সালে ক্রিস্টিন ও তার বন্ধু ম্যারি ফাঙ্কের ডেট্রয়েট এ স্বামী বিবেকানন্দের বেশ কিছু লেকচার শোনার সৌভাগ্য হয়।[৪] ২৪ ফেব্রুয়ারি তারা স্বামীজীর লেকচারে উপস্থিত ছিলেন। ক্রিস্টিন স্বামীজীর লেকচারে এমনই মোহিত হয়ে যান যে পরপর বেশ কিছু লেকচারে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং স্বামীজির শিষ্যা হয়ে যান।তিনি পরবর্তীতে স্বামীজীর লেকাঁচারে প্রথমবারের মত উপস্থিত হবার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন—[৪][৬]

Never have I heard such a voice, so flexible, so sonorous. It was the voice of God to me! That range of emotion, that silvery music—I have never heard in any other. It was sheer music...
It was the mind that made the first great appeal, that amazing mind! What can one say that will give even a faint idea of its majesty, its splendour? It was a mind so far transcending other minds, even of those who rank as geniuses... Its ideas were so clear, so powerful, so transcendental that it seemed incredible that they could have emanated from the intellect of a limited human being.

ক্রিস্টিন আরও লিখেছিলেন,স্বামীজীর কথা শুনে আমি ভারতকেও ভালবাসতে শুরু করলাম। [৭][৮]

ক্রিস্টিন এ সম্পর্কে বলেন, Our love for India came to birth, I think, when we first heard [Swami Vivekananda] say the word, "India", in that marvellous voice of his. It seems incredible that so much could have been put into one small word of five letters. There was love, passion, pride, longing, adoration, tragedy, chivalry, heimweh,[৯] and again love. Whole volumes could not have produced such a feeling in others. It had the magic power of creating love in those who heard it. Ever after, India became the land of heart's desire.

স্বামীজী ডেট্রয়েট থেকে থাউজ্যাণ্ড আইল্যান্ড পার্কে চলে আসলে ক্রিস্টিন ও ফাঙ্কও সেখানে আসেন। সেখানে তারা প্রায় ১৮ টি লেকচার শোনেন। [১০]

 
স্বামী বিবেকানন্দ (নিউইয়র্ক,১৮৯৫) থাউজ্যাণ্ড আইল্যান্ড পার্কে এই বছরে স্বামীজী ক্রিস্টিনকে ব্রহ্মচর্য দীক্ষা দেন

দীক্ষা ও ব্রহ্মচর্য গ্রহণ সম্পাদনা

থাউজ্যাণ্ড আইল্যান্ড পার্কে থাকার সময়ই ক্রিস্টিন কে বিবেকানন্দ দীক্ষা দান করেন। এ সময় ক্রিস্টিন বিবেকানন্দের প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন। সেখানে স্বামীজী যে পাঁচজনকে ব্রহ্মচর্য দীক্ষা দেন তাদের মধ্যে ক্রিস্টিন একজন। [১০][১১]

ভারত আগমন সম্পাদনা

১৯০২ সালের ৭ এপ্রিলে ক্রিস্টিন কলকাতায় পৌঁছান। পরেরদিন সকাল বেলায় তিনি বেলুড়মঠে আসেন এবং বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেদিন পুরো দিন তিনি বেলুড় মঠে ছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দের নোটবুক থেকে জানা যায়,ক্রিস্টিন মাঝে মাঝেই বেলুড় মঠে আসতেন এবং ১৮,২৩,২৫,২৬ এপ্রিল এবং ১ ও ৪ মে বেলুড় মঠ এসেছিলেন এবং পুরো দিন সেখানে ব্যয় করেছিলেন। [১২]

গ্রীষ্মে কলকাতায় তীব্র ঊষ্ণ আবহাওয়ার কারণে স্বামীজী তার পাশ্চাত্যের শিষ্যদের মায়াবতী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। স্বামীজী নিজেও তাদের সাথে হিমালয়ে যেতে চেয়েছিলেন তবে পড়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন- যা ভগিনী নিবেদিতার জোসেফিন ম্যাকলিওডের নিকট ১৯ এপ্রিলে পাঠানো পত্র থেকে জানা যায়। [১৩]

১৯০২ সালে ৫ মে ক্রিস্টিন এবং নিবেদিতা মায়াবতীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। স্বামীজী তাদের যাত্রা পথে খরচের জন্য ১৫০ টাকা বরাদ্দ করেন। [১৩] তারা ১০ মে তারিখে মায়াবতী পৌঁছান।সেখানে মিসেস সেভিয়ার তাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেন। মায়াবতীতে তারা অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সাথে ছিলেন। [১৪]

বিবেকানন্দের মৃত্যু ও কলকাতা প্রত্যাগমন সম্পাদনা

নিবেদিতা জুনের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় ফিরে এসে তার বিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন যেটি ইতিমধ্যে চালু হয়ে গিয়েছিল। [১৫] স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ৪ জুলাই মৃত্যু বরন করেন।স্বামীজী ক্রিস্টিনকে সর্বশেষ পত্র লেখেন ২১ জুন(১৯০২) । জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্রিস্টিন নিবেদিতার পত্র হাতে পান। পত্রে নিবেদিতা লিখেছিলেন[১৫]

Tomorrow you will receive this news that will desolate your life. I can only tell Dear, that if my presence could keep you there, you were never absent from his side on Saturday ... Death came to him so beautifully on Friday night! A half hour's sleep after meditation, and he was gone!

 
ভগিনী ক্রিস্টিন (বায়ে) ও ভগিনী নিবেদিতা (ডানে)

বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর ক্রিস্টিন কলকাতায় ফিরে আসেন। তিনি বোসপাড়া লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন এবং নিবেদিতার বিদ্যালয়ে যুক্ত হন। এছাড়া তিনি বৃদ্ধ মহিলাদের সাহায্য শুরু করেন। তিনি ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিলেন এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। ১৯২৪ সালে ক্রিস্টিন পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসেন। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার পরিচিত বোসপাড়া লেন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। এক দশক আগে তিনি যে বাড়িতে ছিলেন সে বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তিনি পুনরায় বিদ্যালয়ে যুক্ত হতে চাইলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ক্রিস্টিন ৮, বোসপাড়া লেনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদ বশীশ্বর সেনের বাড়িতে ওঠেন। বশীশ্বর সেন বা বশী সেন ক্রিস্টিন কে ‘মা’ ডাকতেন আর ক্রিস্টিন তাকে তার ‘মানস পুত্র’ আখা দেন। ক্রিস্টিনকে জোসেফিন ম্যাকলিওড বাৎসরিক ৫০০ ডলার পাঠাতেন। ক্রিস্টিন তার জীবনের একমাত্র সঞ্চিত সম্পদ জপমালা এবং স্বামীজীর লেখা চিঠি গুলো বশীকে দিয়ে যান।এরপর তিনি আলমোড়াতে চলে যান। সেখানে তিনি গভীর ভাবে ‘রাজযোগ’ অবলম্বন করতেন যা স্বামীজী তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। [১৬]

পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র যাত্রা ও মৃত্যু সম্পাদনা

১৯২৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ক্রিস্টিন ভারতে ছিলেন।এরপর তিনি ক্রমাগত স্বাস্থ্যহানীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে মনঃস্থির করেন।[২] তিনি ডেট্রয়েটে ফিরে আসেন। সেখান থেকে নিউ ইয়র্কে যান। নিউ ইয়র্কে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নার্সিং হোমে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালের ২৭ মার্চ তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। [২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Vrajaprana 1996, p. 3
  2. Vrajaprana 1996, pp. 100–106
  3. Vrajaprana 1996, পৃ. 4
  4. Shack 2012, p. 2
  5. Vrajaprana 1996, pp. 44–47
  6. Vrajaprana 1996, p. 5
  7. RKMIC & 1995, p. 409
  8. Vivekananda 1996, p. backcover
  9. "Heimweh" is a German word roughly equivalent to "homesickness". See Heimweh for details.
  10. Vrajaprana 1996, pp. 8–9
  11. Vrajaprana 1996, p. 7
  12. Vrajaprana & 1996 77.
  13. Vrajaprana & 1996 77
  14. Vrajaprana & 1996 78.
  15. Vrajaprana & 1996 79
  16. Boshi Sen - Scientist and Karmayogi, by Hironmoy Mukherjee, Bulletin of Ramakrishna Mission Institute of Culture, 2009

পাদটীকা সম্পাদনা