ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো

ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো (তিব্বতি: བསྟན་སྐྱོང་དབང་པོওয়াইলি: bstan skyong dbang po) (১৬০৬-১৬৪২) তিব্বতের গ্ত্সাং-পা রাজবংশের ষষ্ঠ তথা অন্তিম রাজা ছিলেন। তার আমলে দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায় ও পঞ্চম দলাই লামার সঙ্গে গ্ত্সাং-পা রাজবংশের বিরোধ চরমে ওঠে যার ফলশ্রুতিতে রাজবংশের পতনের মাধ্যমে তিব্বতে দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি স্থাপিত হয় যা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

সিংহাসনলাভ ও যুদ্ধ সম্পাদনা

ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো গ্ত্সাং-পা রাজবংশের পঞ্চম রাজা ফুন-ত্শোগ্স-র্নাম-র্গ্যালের পুত্র ছিলেন এবং ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে পিতার মৃত্যু হলে তিনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন।[১]:৯৯-১০২[২]:২৮৪ তার কম বয়সের কারণে রাজ্যের দুই মন্ত্রী দ্রোন্যের বোঙ্গোং এবং গাংজুকপা রাজ্যভার হাতে নেন। কিংহাই মঙ্গোলদের সঙ্গে দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হওয়ার কারণে এই দুই মন্ত্রী সদ্য চিহ্নিত পঞ্চম দলাই লামার নিকট প্রতিনিধিদল পাঠাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। ১৬২১ খ্রিষ্টাব্দে ল্হাত্সুন এবং হুংতাইজির নেতৃত্বে মঙ্গোলরা দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের সমর্থনে দ্বুস অঞ্চল আক্রমণ করলে ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো গ্যাথাংগাং নামক স্থানে তাদের সম্মুখীন হন কিন্তু তিনি ও তার সৈন্যদল মুঙ্গোলদের কাছে পরাজিত ও বন্দী হন।[৩]:৬৯৭ এই সময় চতুর্থ পাঞ্চেন লামা ব্লো-ব্জাং-ছোস-ক্যি-র্গ্যাল-ম্ত্শান সহ দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রধান লামারা তাদের মুক্তির জন্য মঙ্গোলদের অনুরোধ করলে তারা মুক্তি পান। কিন্তু এর পরিবর্তে দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায় তাদের পূর্বেকার সমস্ত বৌদ্ধবিহার পুনরায় অধিকার করে এবং দ্বুস অঞ্চলে গ্ত্সাং-পা রাজবংশের সমস্ত সামরিক ছাউনিগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

চোগথু মঙ্গোলদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পাদনা

১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়কে পিছু হঠিয়ে দিতে সক্ষম হন, যার ফলশ্রুতিতে পঞ্চম দলাই লামা শক্তিহীন ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজবংশের অধীনস্থ নেদং অঞ্চলে আশ্রয় নিত বাধ্য হন।[৩]:৫৯ এই সময় ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো লিগদান খান নামক এক বরিষ্ঠ মঙ্গোল নেতার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে লিগদান খান কোকোনর এলাকা নিজের অধিকারে নিয়ে আসে কিন্তু পরের বছর গুটিবসন্ত রোগে তার মৃত্যু হলে তার রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে।[৪] ১৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে চোগথু মোঙ্গোলদের নেতা আর্সলান তিব্বত আক্রমণ করলে ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো তার সঙ্গেও সন্ধি স্থাপন করেন। এই জোট তৈরী হওয়ার পর আর্সলান দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের বৌদ্ধবিহার ধ্বংসের উদ্দেশ্যে লাসার দিকে যাত্রা করেন, কিন্তু অকস্মাৎ তিনি দলাই লামার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোর বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং গ্যাংত্সে ও রাজধানী শিগাত্সে অধিকার করে নেন। ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো এরপর আর্সলানের পিতার নিকট দূত পাঠিয়ে আর্সলানের বিশ্বাসঘাতকতার খবর পাঠালে তার পিতার দূত আর্সলান ও তার সমর্থকদের হত্যা করেন।[১]:১০৩,১০৪[৩]:৬০,৬১

গুশ্রী খান এবং পরাজয় সম্পাদনা

আর্সলানের মৃত্যুর পর ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দলাই লামাপন্থী খোসুত মঙ্গোল নেতা গুশ্রী খান দ্জুঙ্গার নেতা এর্দেনি বাতুরের সঙ্গে কোকোনর অঞ্চলে চোগথু মোঙ্গোলদের পরাজিত করেন। এই সমুয় ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো খাম্স অঞ্চলের বোন ধর্মাবলম্বী ও দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায় বিরোধী রাজা দোন-য়োদ-র্দো-র্জের সাথে সন্ধি স্থাপন করলে ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে গুশ্রী খান আমদো অঞ্চলের পারিক জনজাতির সাথে মিলিতভাবে খাম্স অঞ্চল আক্রমণ করে দোন-য়োদ-র্দো-র্জেকে হত্যা করেন। এরফলে খাম্স অঞ্চল দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।[১]:১০৪-১০৭[৩]:৬১-৬৩ এরপর গুশ্রী খান ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। পঞ্চম দলাই লামা ঙ্গাগ-দ্বাং-ব্লো-ব্জাং-র্গ্যা-ম্ত্শো এই ব্যাপারে কোন ধরনের রক্তপাতের পক্ষপাতী না হলেও তার অন্যতম প্রধান সহায়ক ব্সোদ-নাম্স-ছোস-'ফেল এই যুদ্ধের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। গুশ্রী খান ও তার সেনাবাহিনী খুব সহজে গ্ত্সাং-পা রাজ্যের তেরোটি জেলা অধিকার করে নেন এবং রাজধানী শিগাত্সে অবরোধ করেন কিন্তু ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোর তীরন্দাজেরা তাদের মাসের পর মাস ঠেকিয়ে রাখেন। এই সময় ব্সোদ-নাম্স-ছোস-'ফেল দ্বুস অঞ্চলে গ্ত্সাং-পা রাজবংশের প্রভাধীন এলাকাগুলিকে বলপূর্বক নিজের অধিকারে আনেন। এরপর তিনি গুশ্রী খানের সমর্থনে বহু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শিগাত্সে অবরোধে সামিল হন।[১]:১১০ ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে শিগাত্সের পতন হয় এবং ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো তার পরিবারসহ লাসা শহরের নিকট নেউ দুর্গে বন্দী হন। কয়েকদিন পরে গুশ্রী খান ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো এবং তার দুই মন্ত্রী দ্রোন্যের বোঙ্গোং ঙ্গো গাংজুকপাকে কো-থুমগ্যাব-পা পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোকে একটি বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে নেউ দুর্গের নিকটস্থ নদী ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। এরফলে সমগ্র মধ্য তিব্বত অঞ্চল দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।[১]:১১১,১১২[৫]

বিদেশীদের চোখে সম্পাদনা

ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোর আমলে একাধিক পর্তুগীজ খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারক তিব্বত যাত্রা করেন। ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে এস্তেভাও সাসেল্লা এবং জোয়াও সাব্রাল গ্ত্সাং-পা রাজবংশের রাজধানী শিগাত্সে যাত্রা করেন এবং ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা রাজাকে বুদ্ধিমান, সুন্দর এচং গরীব দরদী যুবক বলে বর্ণনা করেন। তাদের বর্ণনানুযায়ী রাজপ্রাসাদ পাহাড়ের শীর্ষে স্থাপিত ছিল, রাজসভা ছিল আড়ম্বরপূর্ণ, চিত্রায়িৎ, কারুকার্যময়ত,ও চীনা দামাস্ক দিয়ে তৈরী পর্দায় সজ্জিত।[৩]:৬৩ পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারকেরা তাকে সমগ্র মধ্য তিব্বতের অধিপতি বলে বর্ণনা করেন।[n ১]

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. It was not more than 60 years ago that Thibet, that is variously called Toubet, Thibet and Tangout, was governed by a king native to that land, called Tsanpa han [Tsangpa Khan], whom the Chinese call Tsan pou in their histories. This prince was once very powerful […]; although the grand lama who is called Dalai Lama stayed in Poutala, that our travellers called variously Botala, Lassa and Barantola, he was still not the temporal sovereign of the land; it was Tsan pa who then ruled, and who lost the crown in the way that I will recount.[৩]:৬৪

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Tsepon W.D. Shakabpa, Tibet. A Political History, Yale 1967
  2. Tsepon W.D. Shakabpa, One Hundred Thousand Moons, Leiden 2010
  3. Giuseppe Tucci, Tibetan Painted Scrolls, Rome 1949
  4. Ya Hanzhang, Biographies of the Tibetan Spiritual Leaders Panchen Erdenis, Beijing 1994, p. 34.
  5. Sarat Chandra Das, 'Tibet, a Dependency of Mongolia', Journal of the Asiatic Society of Bengal I:5 1905, p. 153-54.

আরো পড়ুন সম্পাদনা

  • Dung-dkar blo-bzang 'phrim-las, The Merging of Religious and Secular Rule in Tibet. Beijing 1991.
  • David Snellgrove & Hugh Richardson, A Cultural History of Tibet. Boston & London 1986.
পূর্বসূরী
ফুন-ত্শোগ্স-র্নাম-র্গ্যাল
ব্স্তান-স্ক্যোং-দ্বাং-পো
ষষ্ঠ গ্ত্সাং-পা শাসক
উত্তরসূরী