বৃহদ্ধর্ম পুরাণ (সংস্কৃত: वृहद्धर्म पुराण) হল একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থএবং পুরাণ। এই পুরাণেই (পূর্বখণ্ড, শ্লোক ২৫-২৬) এটিকে ১৮টি উপপুরাণের একটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ গ্রন্থের যে সংস্করণটি বর্তমানে প্রচলিত আছে, সেটি তিনটি ‘খণ্ড’ বা ভাগে বিভক্ত। এগুলি হল: ‘পূর্বখণ্ড’, ‘মধ্যখণ্ড’ ও ‘উত্তরখণ্ড’। এই পুরাণে সংস্কৃত শব্দগুলির অদ্ভুত অর্থ করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয় সংস্কৃত বাগধারাগুলিও এই পুরাণে সন্নিবেশিত হয়েছে। এই জন্য আধুনিক গবেষকদের মধ্যে অনেকে মনে করেন যে, এটি বাংলা অঞ্চলে লিখিত একটি পুরাণ। আধুনিক গবেষক আর. সি. হাজরার মতে, এই পুরাণটি খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধপ রচিত হয়।[১] তিনি এই পুরাণটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক উপপুরাণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।[২]

সংস্করণ ও অনুবাদ সম্পাদনা

বৃহদ্ধর্ম পুরাণ গ্রন্থের প্রথম মুদ্রিত সংস্করণটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বিবলিওথিকা ইন্ডিকা গ্রন্থমালার (১৮৮৮-৯৭) অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এটি সম্পাদনা করেছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ১৮৯৪ সালে কলকাতার বঙ্গবাসী প্রেস থেকে এই পুরাণের আরেকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণটি সম্পাদনা করেন পঞ্চানন তর্কালঙ্কার। এই সংস্করণে তিনি পুরাণটির একটি বঙ্গানুবাদও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৯১৫ সালে শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই পুরাণের একটি সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ লখনউয়ের ইন্ডিয়ান কমার্সিয়াল প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদটি ছিল উক্ত প্রকাশনা সংস্থার রাম্বেলস ইন স্ক্রিপচার ল্যান্ড গ্রন্থমালার অংশ।[১]

বিষয়বস্তু সম্পাদনা

এশিয়াটিক সোসাইটি ও বঙ্গবাসী সংস্করণের পূর্বখণ্ড ও মধ্যখণ্ডের প্রতিটিতে রয়েছে ৩০টি অধ্যায়। এশিয়াটিক সোসাইটি সংস্করণের উত্তরখণ্ডে রয়েছে ১৪টি অধ্যায়। অন্যদিকে বঙ্গবাসী সংস্করণের উত্তরখণ্ডে রয়েছে ২১টি অধ্যায়। আর. সি. হাজরা মনে করেন এই অতিরিক্ত সাতটি অধ্যায় (১৫শ-২১শ অধ্যায়) গ্রন্থটির একটি অপরিহার্য অংশ।[১]

পূর্বখণ্ড সম্পাদনা

পূর্বখণ্ডের পটভূমি পৌরাণিক বন নৈমিষারণ্য। সেখানে সূত সমবেত ঋষিগণের কাছে ধর্ম প্রসঙ্গে জাবালির প্রতি ব্যাসের উপদেশগুলি বর্ণনা করছেন। সূত বললেন, ঋষি ব্যাস ধর্ম বলতে বুঝিয়েছেন সত্য, দয়া, শান্তি ও অহিংসা। জাবালির পরের প্রশ্নের উত্তরে ব্যাস তাকে গুরু সম্পর্কে সাধারণ উপদেশ দেন এবং পিতামাতাকে সর্বোচ্চ গুরু বলে উল্লেখ করেন। পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ব্যাধ তুলাধর ও ব্রাহ্মণ কৃতবোধের প্রতি তার উপদেশের উপাখ্যানটি বর্ণনা করেন। ৫ম থেকে ৩০শ অধ্যায়ে রয়েছে, জাবালির আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে ব্যাস দেবী রুদ্রাণীর দুই সখী জয়া ও বিজয়ার কথোপকথনের আকারে তীর্থস্থানগুলির বর্ণনা দেন। এই বর্ণনাটির শুরুতে দেবী গঙ্গার একটি স্তবগান রয়েছে। এতে তুলসী ও বিল্ববৃক্ষের উৎপত্তি ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া এই অংশে বর্ণিত হয়েছে ‘কালতীর্থে’র (শুভ সময়) কথা। কালতীর্থের বর্ণনার মধ্যে দেবী উপাসনা ও ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের প্রশস্ত সময়ের বর্ণনা রয়েছে।[১]

মধ্যখণ্ড সম্পাদনা

মধ্যখণ্ডের শুরুতে দেখা যায়, জাবালি গঙ্গা সম্পর্কে আরও জানতে চাইছেন। ব্যাস ঋষি শুক ও তার শিষ্য জৈমিনির কথোপকথনের আকারে তার প্রশ্নের উত্তর দেন। ১ম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে ব্রহ্মার সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণুশিবের প্রকৃতির তিন গুণের যোগের ফলে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনা। ২য় অধ্যায়ে দক্ষ ও তার কন্যা সতীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। ৩য় অধ্যায় থেকে দক্ষ, শিব ও সতীর উপাখ্যানটির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই বর্ণনার শেষ হয়েছে বিষ্ণু কর্তৃক সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার পর সতীর যোনী কামরূপে পড়ার উপাখ্যানে এসে। ১১শ অধ্যায়ে রয়েছে শিবের কাছে সতীর আগমনের উপাখ্যান। এই অধ্যায়ে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু শিবের কাছে এসে জানাচ্ছেন, সতীর গঙ্গা ও উমার রূপে অবতার গ্রহণ করবেন। ১২শ থেকে ২৮শ অধ্যায়ে রয়েছে হিমালয় ও মেনার কন্যার রূপে গঙ্গার জন্মগ্রহণ করার উপাখ্যান। ১৪শ অধ্যায়ে রয়েছে দেবর্ষি নারদের প্রতি নারায়ণের সংগীত-সংক্রান্ত উপদেশ। এটি পূর্বোক্ত উপাখ্যানের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি উপাখ্যানের আকারে বর্ণিত হয়েছে। ২৩শ অধ্যায়ে এসে গঙ্গার উপাখ্যান সাময়িক স্থগিত হয়েছে। এই অধ্যায়ে হিমালয় ও মেনার কন্যা রূপে উমার জন্মের কথা বর্ণিত হয়েছে। ২৯শ অধ্যায়ে মনু, মন্বন্তরসমূহ এবং সূর্য ও চন্দ্রবংশীয় রাজাদের কথা বর্ণিত হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে (৩০শ অধ্যায়) রয়েছে গণেশের জন্ম ও তার হস্তীমুণ্ড প্রাপ্তির উপাখ্যান।[১]

উত্তরখণ্ড সম্পাদনা

উত্তরখণ্ড শুরু হয়েছে ধর্ম-সংক্রান্ত আলোচনা দিয়ে। ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ আলোচনার পর চার বর্ণ ও চার আশ্রমের আচরণীয় ধর্মের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই অংশে সতীদাহ প্রথার সমর্থন পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে, স্বামীর মৃত্যুর পর তার অনুগমন স্ত্রীর কর্তব্য (৮ম অধ্যায়, শ্লোক ৮-১০)। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে একাধিক ব্রত, নবগ্রহের স্তব, চার যুগের ও রাজা বেণের উপাখ্যান রয়েছে। এই উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে বেণ ৩৬টি মিশ্র জাতি সৃষ্টি করেন এবং বেণের পুত্র পৃথুর রাজত্বকালে কীভাবে ব্রাহ্মণরা সেই ৩৬টি জাতিকে নির্দিষ্ট বাণিজ্যে নিযুক্ত করেন, তার বিবরণ।[১]

বঙ্গবাসী সংস্করণে প্রাপ্ত ১৫শ থেকে ২১শ অধ্যায়ে রয়েছে কৃষ্ণের জন্ম এবং সেই জন্মের ক্ষেত্রে দেবীর ভূমিকার কথা। এই অংশে কলিযুগের বর্ণনাও রয়েছে। পুরাণটি শেষ হয়েছে এই পুরাণের একটি মাহাত্ম্য বর্ণনার মাধ্যমে এই মাহাত্ম্য এই পুরাণকে একটি বৈষ্ণব, শৈবশাক্ত পুরাণ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে (অধ্যায় ২১, শ্লোক ৫)।[১]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Rocher, Ludo (১৯৮৬)। "The Purāṇas"। Jan Gonda (ed.)। A History of Indian Literature (ইংরেজি ভাষায়)। Vol.II, Epics and Sanskrit religious literature, Fasc.3। Wiesbaden: Otto Harrassowitz Verlag। পৃষ্ঠা 164–6। আইএসবিএন 3-447-02522-0 
  2. Hazra, R. C. (1962, reprint 2003). The Upapuranas in S. Radhakrishnan (ed.) The Cultural Heritage of India, Vol.II, Kolkata:The Ramakrishna Mission Institute of Culture, আইএসবিএন ৮১-৮৫৮৪৩-০৩-১, p.285