বিদারমায়ার

ইউরোপীয় শিল্পকলার আন্দোলন বিশেষ

মধ্য ইউরোপে যখন মধ্যবিত্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং শিল্পকলা জনসাধারণ্যের সংবেদনশীলতাকে আহ্বান করছিল, সেই সময়ে ইউরোপীয় শিল্পকলার ইতিহাসের ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যবর্তী এই কয়েকটি দশক বিদারমায়ার যুগ নামে পরিচিত। ইউরোপে ১৮১৫ সালে নেপলিয়নের যুদ্ধগুলোর অবসান ঘটার পর ঐতিহাসিক যে ভিয়েনা সম্মেলন চলে তখন থেকেই এই যুগের শুরু হয়, আর এর সমাপ্তি ঘটে ১৯৪৮ সালের বিপ্লবের সূত্রপাতের সাথে সাথে। এই সময়েরই কোনো এক সাহিত্যিক উৎস বা ভাণ্ডার থেকে বিদারমায়ার শব্দটি স্বতঃউদ্ভূত হয়েছে। তাসত্ত্বেও, এই শব্দটি মূলত এমনই এক শৈল্পিক-শৈলীকে বোঝাতে প্রয়োগ করা হয়, যে শৈল্পিক-শৈলীটি সাহিত্য, সঙ্গীত, দৃশ্যকলা ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জগতে জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছিল অথবা এসব উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই যুগটি তার পরবর্তী শৈল্পিক-শৈলীসমূহের ওপর, বিশেষতঃ ভিয়েনায় উৎপত্তি লাভ করেছে যে শৈল্পিক-শৈলীসমূহ, তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে।[১]

কার্ল স্পিটজওয়েগের আঁকা Der Sonntagsspaziergang (রবিবারের পদব্রজে ভ্রমণ, ১৮৪১) তৈলচিত্রটি বিদারমায়ার যুগের একটি টিপিকাল নমুনা।
কানাডার মন্ট্রিল মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টসের কোনো এক প্রদর্শনীতে আনুমানিক ১৮১৫–২৫ সালের অস্ট্রীয় বিদারমায়ার সোফা। মেহগনি কাঠ নির্মিত গদিতে যে কভারের আবরণ দেওয়া হয়েছে তা আসল নয়।

পটভূমি সম্পাদনা

 
ভিয়েনার হফবার্গ প্রাসাদে গভীর পড়াশোনায় নিমগ্ন অস্ট্রীয় সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস। প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ নকশা বিদারমায়ার ধাঁচের। ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয় শক্তিসমূহের মধ্যে যে সমঝোতা হচ্ছিল তার প্রতি অস্ট্রীয় চ্যান্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখের নিশ্চয়তা প্রদানের ফলে ইউরোপে একটি শান্তিময় যুগ ও পরিবেশ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এমন এক পরিস্থিতিতেই বিদারমায়ার-সংবেদনশীলতার বিকাশ ঘটে।

বিদারমায়ার যুগ বলতে কোনো যুগকে সামগ্রিকভাবে বোঝায় না, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট মেজাজ ও একগুচ্ছ চলকে (trend) বোঝায়, যেগুলোর উত্থান ঘটেছে মধ্য ইউরোপের সেই সময়ের অনন্য (unique) ভিত্তিসমূহ থেকে। এই যুগের বিকাশে দুটি চালিকাশক্তি কাজ করেছিল। নতুন এক শহুরে-মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবে নেতৃত্ব দানকারী "ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন" ছিল এই চালিকাশক্তিগুলোর একটি, যা (অর্থাৎ, এই ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন) শিল্পকলার জন্য নতুন এক শ্রেণির দর্শক তৈরি করেছিল। অপর চালিকাশক্তিটি ছিল নেপলিয়নের যুদ্ধ[২] এবং ভিয়েনা-সম্মেলন শেষে ক্লেমেন্স ভন মেটরনিখের অধীনে বিরাজমান বা বলবৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। শিল্পী ও সমাজের জন্যে স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবেশটি বা আবহটি ছিল গার্হস্থ্যের প্রতি ও (অন্ততপক্ষে জনসমক্ষে) অরাজনৈতিক বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশের। লেখক, চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীতকরগণ এসময় নিরাপদ পরিবেশ পেতে শুরু করেছিলেন, যার ফলে এবং গৃহজীবনের ওপর বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্তশ্রেণির জোর দেওয়ার ফলে আসবাবপত্রের নকশায় ও অভ্যন্তর-সাজসজ্জায় একটি প্রস্ফুটন ঘটেছিল।[৩]

সাহিত্যে বিদারমায়ার সম্পাদনা

বিদারমায়ার শব্দটি সর্বপ্রথম সাহিত্য জগতে একটি ছদ্মনাম হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। ১৮৫০ সালে গ্রামাঞ্চলীয় চিকিৎসক অ্যাডলফ কুসমাউল এবং আইনজীবী লুডভিগ আইখরোড মিউনিখের ব্যাঙ্গাত্মক সাপ্তাহিক ফ্লিগ্রেন্ডে ব্ল্যাট্টারে প্রকাশিত কিছু কবিতায় গোটলিব বিদারমায়ার শব্দজোড়টি একটি ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।[৪]

স্যামুয়েল ফ্রেডরিখ সাউটার ছিলেন জার্মানির একজন প্রাথমিক শিক্ষক ও এক প্রকার অপেশাদার কবি, উপরন্তু তিনি ছিলেন লুডভিগ আইখরোডের একজন বন্ধু। তিনি অরাজনৈতিক ও পেটি বুর্জোয়া পরিচয়ে উইল্যান্ড গোটলিব বিদারমায়ার ছদ্মনামে তার কবিতাগুলোতে সেই যুগের মানুষকে প্যারোডি করেছিলেন।[৫] এই ছদ্মনামটি এসেছে "Biedermanns Abendgemütlichkeit" (বিদারম্যানের সন্ধ্যাকালীন স্বাচ্ছন্দ্য) এবং "Bummelmaiers Klage" (বুমেলমায়ারের ফরিয়াদ) কবিতা দুটির শিরোনাম থেকে; জোসেফ ভিক্টর ভন শেফেল ১৮৪৮ সালে একই ম্যাগাজিনে কবিতা দুটি প্রকাশ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] যুগের ছাপচিহ্নরূপে এই শব্দটি প্রায় ১৯০০ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রকাশনার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে এবং সরকারি সেন্সরশিপের কারণে বিদারমায়ার লেখকরা প্রথমদিকে তাদের কার্যক্রমকে মূলত ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য ও গ্রামীণ জীবনের মতো অরাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পৃক্ত করে রেখেছিলেন। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সাধারণত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উপস্থিতিতে ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

অ্যান্নেটে ভন ড্রস্টে-হুল্সহফ, ফ্রিডরিখ হাম, অ্যাডেলবার্ট ফন শামিসো, এডওয়ার্ড মরিকাউইলহেম মুলার হলেন কয়েকজন টিপিক্যাল বিদারমায়ার কবি। বিদারমায়ার কবিদের মধ্যে রবার্ট শুমান, হুগো ওল্ফফ্রাঞ্জ শুবার্ট সংগীতীয় সাহিত্য কর্মের জন্য সুপরিচিত। অ্যাডালবার্ট স্টিফটার ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক। তার কাজের মধ্যে, বিশেষকরে তার ডার নাখসমার উপন্যাসটিতে, বিদারমায়ার আন্দোলনের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা প্রতিফলিত হয়েছিল। ইতিহাসবিদ হিসেবে কার্ল এমিল শোর্স্কে লিখেছেন, "বেনিডিক্টীয় বিশ্ব ধর্মতত্ত্ব, জার্মান মানবতাবাদ এবং বিদারমায়ার কনভেনশনালিটির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিল্ডাংয়ের ওপর স্টিফটারের যে ধারণা, সেটার চিত্রায়নে এবং একে ছড়িয়ে দিতে তিনি বিশ্বকে তার ডার নাখসমার উপন্যাসটি উপহার দিয়েছেন।[৬]

জেরেমিয়াস গঠেল্ফ ১৮৪২ সালে দ্য ব্ল্যাক স্পাইডার উপন্যাসিকাটি লেখেন, যা লেখকের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে চিহ্নিত করা হয়। রূপকাশ্রয়ী এ সাহিত্যকর্মে (allegorical) গথিক আবহের প্রয়োগ ঘটেছে। এই উপন্যাসিকাটি বিদারমায়ার যুগের ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মগুলোর একটি হবে বলে প্রথমবার অগভীর দর্শনে বর্তমানের অনেক সমালোচকই বিবেচনা করেন। থমাস ম্যান তার দ্য জেনেসিস অব ডক্টর ফস্টাসে লিখেছেন যে, গঠেল্ফ "প্রায়ই হোমারীয়তাকে স্পর্শ করেছেন" এবং মোহিত করেছেন দ্য ব্ল্যাক স্পাইডারকে, যা "বিশ্বসাহিত্যের আর কোথাও করা হয়নি"।[৭]

আসবাবপত্রাদির নকশায় এবং অভ্যন্তর সাজ-সজ্জায় বিদারমায়ার সম্পাদনা

 
পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ক্রুশসনুভের জাদুঘরে একটি বিদারমায়ার কক্ষ।
 
লিওপোল্ড সিয়েকার আঁকা জিমারবিড (আনু: ১৮২৫)। চিত্রটি তৎকালীন বার্লিনের বিদারমায়ার আভ্যন্তর নকশার একটি উদাহরণ।

আসবাবপত্রাদির নকশায় বিদারমায়ার ছিল একটি প্রভাবশালী জার্মান শৈলী, যার বিকাশ ঘটেছে ১৮১৫ থেকে ১৮৪৫ সালে। যেসব রাষ্ট্র মিলিত হয়ে জার্মান জাতি গঠন করেছিল, ১৮৭১-এর পূর্বে বার্লিনের শাসনের মাধ্যমে সেগুলোর একীভূত না হওয়া পর্যন্ত এই রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার ফলে এই বিদারমায়ার যুগটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সময় পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়েছিল।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] ঐতিহাসিকতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত বিদারমায়ারোত্তর এই সংগ্রামগুলো তাদের নিজস্ব শৈলীসমূহকে গঠন করেছে। পুরো সময়কাল জুড়ে উপযোগিতাবাদী নীতির আলোকে বিদারমায়ার-এর ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিচ্ছন্ন দিকরেখা ও ন্যূনতম অলঙ্করণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, এই যুগটির প্রবাহমানতার সাথে সাথে, এই শৈলীটি রোমান্টিক যুগের অস্থিরতা বিরোধী প্রারম্ভিক বিদ্রোহ থেকে সরে গিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছিল একটি উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী কর্তৃক সৃষ্ট ক্রমবর্ধিষ্ণু অলঙ্কৃত কাম্য-করণীয়তার (তথা কমিশনের) দিকে, যে শ্রেণিটি আবার তাদের সদ্যপ্রাপ্ত সম্পদ প্রদশর্নের প্রতি ছিল অত্যাগ্রহী। পরিচ্ছন্ন দিকরেখা ও উপযোগিতাময় ভঙ্গিমাগুলোর ধারণা আজকের মতো সময়েও ক্রমপ্রবাহমানতার মাধ্যমে একবিংশ শতকে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। মধ্যকালীন বিদারমায়ার থেকে পরবর্তী-বিদারমায়ার আসবাবপত্রাদির নকশা ঐতিহাসিকতাবাদের প্রতি এবং পুনরুজ্জীবন যুগের প্রতি দীর্ঘকালীন প্রত্যাশার এক আগমণবার্তা ঘোষককে উপস্থাপন করেছিল।

স্থাপত্যে বিদারমায়ার সম্পাদনা

দৃশ্যকলায় বিদারমায়ার সম্পাদনা

সঙ্গীতে বিদারমায়ার সম্পাদনা

চেজ ভূমিতে বিদারমায়ার সম্পাদনা

বর্তমান প্রয়োগ সম্পাদনা

ঐতিহাসিক বিদারমায়ার এবং বর্তমান জার্মানের মধ্যকার সাদৃশ্য ও তুলনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিয়োনাডে-বিদারমায়ার[৮] কিংবা জেনারেশন বিদারমায়ার-এর মত শব্দগুলোর উদ্ভব ঘটেছে। এই অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটি এর সাথে সম্পর্কযুক্ত "ভাব-প্রকাশক শব্দাবলী" কিংবা "ভাব-প্রকাশক রীতি"র ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন এটা ব্যবহার করা হচ্ছে বিয়োনাডে-বুর্জোয়ার (Bionade-Bourgeoisie) মতো শব্দে। বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি রয়্যাল ডাচ শেল তরুণ জার্মানদের মনোভাব, মূল্যবোধ, অভ্যাস ও সামাজিক আচরণের ওপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। ২০১০ সালে মূলধারার তরুণ প্রজন্মের জন্য তারা (Shell Jugendstudie) জেনারেশন বিদারমায়ার শব্দটি ব্যবহার করেছিল। সে সময় রাজনৈতিক প্রসঙ্গের চেয়ে নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত সুখ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল।[৯]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Smith, Roberta (ডিসেম্বর ২০০৬)। "Crisp, Clean and Modern, Before Its Time"The New York Times 
  2. Christopher John Murray, Encyclopedia of the Romantic Era, 1760–1850, Volume 1 p. 89, Taylor & Francis, 2004.
  3. "Biedermeier – Elegant, Simple Interior Design"। Biedermeier.us। ২০১৩-০৭-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৬-২৭ 
  4. Barea, Ilsa (১৯৯২)। "III Biedermeier, pp 111-188"। Vienna: legend and reality। London: Pimlico। পৃষ্ঠা 112আইএসবিএন 0-7126-5579-4 
  5. Ludwig Eichrodt 1827–1892 Renate Begemann Verlag der Badischen Landesbibliothek, 1992, p.115
  6. Schorske, Carl E. (১৯৮১)। Fin-De-Siecle Vienna: Politics and Culture। Cambridge: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 283। আইএসবিএন 0-521-28516-X 
  7. "The Black Spider"। One World Classics। নভেম্বর ২, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১১ 
  8. Henning Sußebach (২০০৭-১১-০৭)। "Bionade-Biedermeier"Zeit Online। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৯-২৬ 
  9. Von Thomas Fischermann (২০১২-০৮-৩১)। "Gibt es einen German Dream?"Zeit Online। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৯-২৭ 

আরও পড়ুন সম্পাদনা

  • Ilsa Barea (1966, republished 1992), Vienna: legend and reality, London: Pimlico. Chapter 111, Biedermeier, pp. 111–188.
  • Jane K. Brown, in The Cambridge Companion to the Lied, James Parsons (ed.), 2004, Cambridge.
  • Martin Swales & Erika Swales, Adalbert Stifter: A Critical Study, Cambridge: Cambridge University Press, 1984.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা