বাউহাউস (জার্মান: [ˈʃtaːtlɪçəs ˈbaʊˌhaʊs] (শুনুন)) ছিল জার্মানির একটি বহুমাত্রিক শিল্প বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত বাউহাউস কার্যকর ছিল। এই প্রতিষ্ঠানটি চারুকলা, কারুকলা, স্থাপত্য, শিল্প-নকশা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করতো। শিল্প ও নকশা বিষয়ক শিক্ষা প্রদানে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যময় ধারার কারণে বাউহাউস বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করে।

ডেসাউতে অবস্থিত বাউহাউস
ভাল্টার গ্রোপিয়াসের এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার ভাস্কর্য
বাউহাউস-এর প্রথম পরিচালক ভাল্টার গ্রোপিয়াস

ইতিহাস সম্পাদনা

জার্মানির ভাইমারে ভাল্টার গ্রোপিয়াস বাউহাউস প্রতিষ্ঠা করেন। জার্মান ভাষায় বাউহাউস অর্থ "বাড়ি নির্মাণ"। তবে বাউহাউস দ্বারা বুঝাতো "ইমারত নির্মাণবিষয়ক বিদ্যালয়"। তবে স্থাপত্য সম্পর্কিত নাম এবং প্রতিষ্ঠাতা একজন স্থপতি হওয়া সত্বেও প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এতে কোন স্থাপত্য বিভাগ ছিল না। প্রতিষ্ঠানটি শুরুর সময়ে লক্ষ্য ছিল এতে শিল্প বিষয়ের সব শাখায় শিক্ষা প্রদান করা হবে, যার মধ্যে স্থাপত্যও পরে অন্তর্ভুক্ত হবে। পরবর্তিতে বাউহাউসের শিল্প বিষয়ক শিক্ষার ধারা ও শৈল্পিকতা বিশ্বের আধুনিক নকশা ও স্থাপত্য, শিল্প ও শিল্প-শিক্ষায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।[১] সেই প্রজন্মের শিল্প, স্থাপত্য, লেখনী, মুদ্রণসহ ইত্যাদি ক্ষেত্র বাউহাউস ধারার সবিশেষ প্রভাব ধারণ করে।[২]


পরিচালনা ও বিস্তৃতি সম্পাদনা

জার্মানির তিনটি শহরে বাউহাউস ছিল: ভাইমারে ১৯১৯ থেকে ১৯২৫, ডেসাউ-এ ১৯২৫ থেকে ১৯৩২ এবং বার্লিনে ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩। তিনজন ভিন্ন ধারার স্থপতি-পরিচালকের অধীনে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়। ১৯১৯ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত ভাল্টার গ্রোপিয়াস, ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত হান্স মায়ার এবং ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত লুডভিগ মিজ ফন ডিয়া রুহা বাউহাউসের পরিচালক ছিলেন। নাৎসি জার্মানির চাপের কারণে ১৯৩৩ সালের শেষাংশে বাউহাউস বন্ধ হয়ে যায়। নাৎসি জার্মানি ধারণা করেছিল যে বাউহাউসে কমিউনিজম বিষয়ক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হয়। বাউহাউস বন্ধ হলেও এর শিক্ষকরা বাউহাউসের বৈশিষ্ট্যময় ধারা বিভিন্নভাবে প্রচার ও প্রসার করতে থাকেন। তারা জার্মানি ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেসব স্থানে বাউহাউস ধারা প্রসারিত করেন।[৩]

তবে বাউহাউসের শিক্ষাপ্রদানের স্থান এবং শিক্ষা প্রদানকারী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পরিবর্তন বাউহাউস-ধারার আঙ্গিক, কৌশল ও ধারণায় ক্রমাগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। যেমন ভাইমার থেকে ডেসাউতে স্থানান্তরের ফলে মৃন্ময়শিল্পের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এটি বাউহাউসের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল। ১৯৩০ সালে মিস ভন ডিয়া রুহা পরিচালক হলে তিনি একে সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন এবং হান্স মায়ারের সমর্থকদের বাউহাউসে যোগদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

প্রভাব সম্পাদনা

বাউহাউস প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলেও এর স্বতন্ত্র শিল্পধারা পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশগুলোর শিল্প ও স্থাপত্য ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এর অন্যতম কারণ ছিল বাউহাউসের শিক্ষকগণ জার্মানি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে সেসব স্থানে বাউহাউস ধারাস প্রচার ও প্রসার ঘটান।। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভে বাউহাউস ধারার প্রচুর স্থাপত্যকর্ম থাকায় ২০০৪ সালে ইউনেস্কো শহরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৩৩ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তি কয়েক বছর ধরে তেল আভিভে প্রায় ৪,০০০ বাউহাউস ধারার ভবন নির্মিত হয়।

১৯২৮ সালে হাঙ্গেরীয় শিল্পী আলেক্সান্ডার বোর্টনিক বুদাপেস্টে একটি শিল্প-শিক্ষার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠানটির শিল্প-ধারা বাউহাউসের হাঙ্গেরীয় সমতুল্য ছিল। পরবর্তিতে এই প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকে বুদাপেস্ট বাউহাউস নামে পরিচিত করে তোলে। বোর্টনিক ব্যক্তিগতভাবে ১৯২৩ থেকে ১৯২৫ এর মাঝামাঝি সময়ে ভাল্টার গ্রোপিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বাউহাউসের শিক্ষক ভাল্টার গ্রোপিয়াস, মার্সেল ব্রয়ার এবং মোহলি-ন্যাগি ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝিতে ব্রিটেনে একত্রিত হন এবং আইসোকন নামের একটি স্থাপত্য-নকশা প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। কিছুকালের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গ্রোপিয়াস হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনে শিক্ষকতা শুরু করেন। তারা তিনজন একত্রে স্থাপত্য চর্চা শুরু করেন এবং বেশ কিছু কাজ করেন। নিউ কেনসিংটন, পেন্সিলভানিয়া এবং পিটসবার্গে তাদের কয়েকটি প্রকল্প নির্মিত হয়। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে হার্ভার্ড স্কুল বিশেষ প্রভাবশালী ছিল। এই স্কুলের ছাত্র ফিলিপ জনসন, আই এম পাই, লরেন্স হালপ্রিন এবং পল রুডলফ বিশ্বের খ্যাতিমান স্থপতি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

১৯৩০ এর শেষাংশে মিস ফন ডিয়া রুহা শিকাগোতে স্থানান্তরিত হন। তিনি শিকাগোর খ্যাতিমান স্থপতি ফিলিপ জনসনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। পরবর্তিতে মিস ফন ডিয়া রুহা স্থপতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। মোহলি-ন্যাগি শিকাগোতে স্থানান্তরিত হন এবং নিউ বাউহাউস প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তিতে ইলিনয় ইন্সটিটিউট অব ডিজাইন-এ পরিণত হয়।

কলকাতায় বাউহাউস চিত্রপ্রদর্শনী সম্পাদনা

 
বাউহাউস চিত্রকরদের অন্যতম ছিলেন পল ক্লি যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অংকণরীতির আশ্চর্য সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর থেকে কলকাতায় জার্মানীর বাউহাউস দলের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর উদ্যোগ ছিল: তিনি সে বছরই জামার্ণীর ভাইমার ভ্রমণ করেছিলেন এবং তখন বাউহস স্কুলের চিত্রীদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যার মধ্যে ছিলেন ভাল্টার গ্রোপিয়াস এবং পল ক্লী।[৪] কলকাতায় অনুষ্ঠিত চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজক ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব অরিয়েন্টাল আর্ট। এ প্রদর্শনীতে যাদের চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল তারা হলেন লিওনেল ফেইনিয়ার (৩৫ টি শিল্পকর্ম), জোহানেস ইটেন (২৩টি শিল্পকর্ম), ওয়াসিলি কান্ডেনিস্কি (৪টি শিল্পকর্ম), পল ক্লী (৯ টি শিল্পকর্ম), জেরহার্ড মাকৃস (২০টি শিল্পকর্ম), গর্গ মুশে (৭টি শিল্পকর্ম), লথার শ্রেইরার (৭টি শিল্পকর্ম), সেটি কর্ণার (২টি শিল্পকর্ম) প্রমুখ। এই সব ছবি কখনই ফেরত দেয়া হয়নি।[৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Pevsner, Nikolaus, সম্পাদক (১৯৯৯)। A Dictionary of Architecture and Landscape Architecture (Paperback)। Fleming, John; Honour, Hugh (5th সংস্করণ)। London: Penguin Books। পৃষ্ঠা 880আইএসবিএন 0-14-051323-X 
  2. "Bauhaus Movemen"Rethinking the world Art and Technology – A new Unity 
  3. ...], [contributors Rachel Barnes (২০০১)। The 20th-Century art book. (Reprinted. সংস্করণ)। London: Phaidon Press। আইএসবিএন 0714835420 
  4. পল ক্লী’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অংকণরীতির আশ্চর্য সাযুজ্য পরিলক্ষিত হয়।
  5. ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, “ছবির জগতে রবীন্দ্রনাথ : একটি কালপঞ্জী নির্মাণের প্রয়াস”, সমকাল ঈদ সংখ্যা, ২০১৬, ঢাকা।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা