বঙ্গীয় শিল্পকলা, যাকে সাধারণত বঙ্গীয় শিল্পরীতি বলে উল্লেখ করা হয়,[১] একটি শিল্প আন্দোলন ও একটি ভারতীয় চিত্রকলা পদ্ধতি যেটি ব্রিটিশ শাসনকালে বিংশ শতাব্দির প্রথমার্দ্ধে বাংলায় বিকশিত হয়েছে, প্রাথমিকভাবে কলকাতা এবং শান্তিনিকেতনে, এবং পল্লবিত হয় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে। প্রথমদিকে এটি "ভারতীয় ঘরানার চিত্রকলা" হিসেবেও পরিচিতি পায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১)নেতৃত্বে এই চিত্রকলাশৈলী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও (স্বদেশী আন্দোলনের) সঙ্গে সংযুক্ত হয় কিন্তু তা সাহায্য ও প্রসার পায় ই.বি.হ্যাভেলের মতো ব্রিটিশ শিল্প পরিচালকের। যিনি ১৮৯৬ সাল থেকে গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট, কলকাতা অধ্যক্ষ ছিলেন; যা পরবর্তীকালে আধুনিক ভারতীয় চিত্রশৈলীতে উন্নীত হয়। [১][২][৩]

ভারত মাতা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৭১-১৯৫১) কৃত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র, এবং ভারতীয় শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ

বঙ্গীয় শিল্পরীতি অনেকটা আভঁ-গার্দ বা পথিকৃৎ স্বরূপ। সেই সময় রাজা রবি বর্মার মতো কিছু ভারতীয় শিল্পী ও ব্রিটিশ শিল্পধারা দ্বারা উৎসাহিত শিক্ষায়তনিক শিল্পকর্ম এর বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। পাশ্চাত্যে ভারতীয় অধ্যাত্মিক প্রভাব অনুভব করে, ব্রিটিশ শিল্পকলা শিক্ষক আর্নেস্ট বিনফিল্ড হ্যাভেল, কলকাতা আর্ট স্কুলের ছাত্রদের মুঘল মিনিয়েচার অঙ্কন শিল্পকে অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করেন।[৪][৫] বিষয়টি তখন বিতর্কের সৃষ্টি করে। ছাত্ররা হরতাল শুরু করে, আঞ্চলিক সংবাদপত্র ও জাতীয়তাবাদীরা, যাঁরা মনে করেছিলেন এটি একটি পশ্চাতগত পদক্ষেপ, তারা অভিযোগ করতে শুরু করলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র, হ্যাভেলকে সমর্থন করলেন। অবনীন্দ্রনাথ মুঘল চিত্ররীতিকে অনুসরণ করে অনেকগুলি চিত্র আঁকলেন। তিনি এবং হ্যাভেল মনে করতেন, এই চিত্ররীতিতে ভারতীয় অধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট যা পাশ্চাত্যের "বস্তুবাদ"এর বিপরীত, তা ধরা পড়ে। অবনীন্দ্রনাথের সর্বাধিক পরিচিত চিত্র "ভারত মাতা", যাতে চারটি হস্ত বিশিষ্ট হিন্দু দেবীর ন্যায় তরুণী মূর্তি অঙ্কিত হয়েছে, যিনি তার চারটি হাতে ভারতের জাতীয় কাঙ্ক্ষিত বস্তুগুলি ধারণ করে আছেন। এই চিত্রের নাম প্রথমে ‘বঙ্গমাতা’ ছিল যার নাম পরিবর্তিত হয়ে ১৯০৫ সালে ‘ভারতমাতা’ হয়।[৬] পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ জাপানের শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগে একটি প্যান-এশীয় শিল্পধারা গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন। "ভারত মাতা" চিত্রটি আঁকার মাধ্যমে অবনীন্দ্রনাথ, একটি জাতীয়তাবাদী ধারার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বঙ্গীয় শিল্পপ্রীতি শিল্পী ও চিত্রশিল্পীরা হলেন নন্দলাল বসু,এম.এ.আর.চুঘতাই, সুনয়নী দেবী (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভগ্নী), মনীষী দে, মুকুল দে, কালিপদ ঘোষাল, অসিত কুমার হালদার, সুধীর খাস্তগীর,ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার, সুঘ্রা রবাবি[১]

১৯২০ সালে আধুনিকতার প্রসারের সঙ্গে বঙ্গীয় শিল্পরীতির প্রভাব কমতে থাকে। ২০১২ সাল-এর হিসাব অনুযায়ী, বঙ্গীয় শিল্পরীতির প্রতি বিদ্বান ও গুণগ্রাহীদের মধ্যে আগ্রহের উচ্ছ্বাস দেখা যায়। [৭].

বিমল শীল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি জলরঙে এঁকেছেন। তার আঁকাগুলি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সংরক্ষণেই পাওয়া যায়।

উত্তরাধিকার সম্পাদনা

আধুনিক ভারতে, বাংলা ক্রমাগত শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের উপহার দিয়ে চলেছে। সরকারী শিল্প ও কারুশিল্প কলেজের একটি বিভাগ প্রায় শতাব্দী ধরে ছত্রছাত্রীদের প্রথাগত টেম্পেরা ও তুলিতে আঁকা কালো বা হলকা রঙের ছবি আঁকা পদ্ধতি শিখিয়ে চলেছে। এইসব ছাত্রছাত্রীরা বঙ্গীয় শিল্পরীতির শিল্পীদের উত্তরাধিকার বহন করছেন, যাঁরা গোড়ায় অবনীন্দ্রনাথের ঘরাকে অনুসরণ করেছেন ও তার নান্দনিক দৃষ্টিকে ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম হলেন বঙ্গীয় শিল্পকলার প্রবাদ প্রতিম শিল্পী। তিনি হস্তলিপি শিল্পতে বিশারদ এবং তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী যারা বঙ্গীয় চিত্রশিল্প ধারাকে বহন করছেন। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা হলেন, অমিত সরকার, অজয় ঘোষ, শংকরলাল আইচ,অমল চাকলাদার, নরেন্দ্রনাথ দে সরকার, সুক্তিশুভ্র প্রধান, রতন আচার্য। সাম্প্রতিক বাংলায় সর্বাধিক পরিচিত শিল্পীরা হলেন যোগেন চৌধুরী, মৃণাল কান্তি দাস, গোপাল সান্যাল, গণেশ পাইন, মনীষী দে, শানু লাহিড়ী, গণেশ হালুই [৮] জহর দাশগুপ্ত, সমীর আইচ, বিকাশ ভট্টাচার্য,সুদীপ রায়, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দেবজ্যোতি রায়। বঙ্গীয় শিল্পরীতির শেষ জীবিত পথ প্রদর্শক হলেন সনৎ চ্যাটার্জী। তিনি অসিত কুমার হালদারের কাছে প্রায় পনের বছর শিক্ষা লাভ করেছেন।

আর. শিব কুমারের মতপার্থক্য সম্পাদনা

আর.শিব কুমার, '৮০র দশকের প্রথমদিকে শান্তিনিকেতনের শিল্পীশ্রেষ্ঠদের কাজ ও কর্মপ্রণালী নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তিনি নন্দলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেইজ এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীদের বঙ্গীয় শিল্পরীতির অন্তর্ভুক্তির যুক্তি সহকারে বিরোধিতা করেছেন। শিব কুমারের মতে, 'আগের লেখকরা, এই শিল্পীদের অঙ্কনশৈলী, বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, শিল্পচর্চার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনার থেকে শিক্ষানবিশী অনুসারে কুলজিনামা তৈরী করার প্রতি মনোযোগী ছিলেন।" [৯]

তার এই বিষয়ের প্রতি যে ধারণা, তা সূত্রাকারে প্রদর্শনীর বিবরণীতে তালিকাভুক্ত করেছেন। শান্তিনিকেতন: দ্য মেকিং অফ কন্টেক্সচুয়াল মর্ডানিসম

আরও দেখুন সম্পাদনা

অতিরিক্ত পাঠ্য সম্পাদনা

তথ্যাদি সম্পাদনা

  1. "Showcase - Bengal School"National Gallery of Modern Art 
  2. Mitter (১৯৯৪)। "How the past was salvaged by Swadeshi artists"। Art and nationalism in colonial India, 1850-1922: occidental orientations। Cambridge, UK: Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 267–306। আইএসবিএন 978-0-521-44354-8। সংগ্রহের তারিখ ৮ মার্চ ২০১২  অজানা প্যারামিটার |firstodern Indian painting= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  3. Onians, John (২০০৪)। Atlas of world art। London: Laurence King Publishing। পৃষ্ঠা 304। আইএসবিএন 978-1-85669-377-6। সংগ্রহের তারিখ ৮ মার্চ ২০১২ 
  4. Mitter, Partha (২০০১)। Indian art । Oxford University Press। পৃষ্ঠা 177আইএসবিএন 0-19-284221-8Ernest Binfield Havell education. 
  5. Cotter, Holland (আগস্ট ১৯, ২০০৮)। "Art Review: Indian Modernism via an Eclectic and Elusive Artist"New York Times 
  6. "স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারতমাতা"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-৩০ 
  7. Ghose, Archana Khare (১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। "For many art lovers, it's back to the old school"Times of India। New Delhi। ৮ মে ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ মার্চ ২০১২ 
  8. "Shanu Lahiri dead"The Telegraph (Calcutta)। ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ১৫, ২০১৩ 
  9. http://humanitiesunderground.org/all-the-shared-experiences-of-the-lived-world-ii/

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা