ফেরদৌসী রহমান

বাংলাদেশী সংগীতশিল্পী

ফেরদৌসী রহমান (জন্ম ২৮ জুন ১৯৪১) একজন বাংলাদেশী কণ্ঠশিল্পী। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তার সঙ্গীত জগতে পদচারণা চলছে। পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিকসহ সব ধরনের গানই তিনি করেছেন। ১৯৯৫ সালে সঙ্গীতে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'স্বাধীনতা পদক', ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক এবং ২০১৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করা হয়।[১]

ফেরদৌসী রহমান
জন্ম
ফেরদৌসী রহমান

(1941-06-28) ২৮ জুন ১৯৪১ (বয়স ৮২)
কুচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ববাংলাদেশ
মাতৃশিক্ষায়তনট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
পেশানজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য
পরিচিতির কারণগায়িকা, গবেষক, সঙ্গীত পরিচালক
পিতা-মাতা
আত্মীয়মুস্তাফা জামান আব্বাসী (ভাই)
মোস্তফা কামাল (বিচারপতি) (ভাই)
ওয়েবসাইটferdausi.com

প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা

ফেরদৌসী রহমান ১৯৪১ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের কোচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন পল্লীগীতি গায়ক আব্বাস উদ্দিন। ছোটবেলায় গানে হাতে খড়ি হয় তার পিতার কাছে। পরবর্তীতে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খান প্রমূখ সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছেন।[২] খুব অল্প বয়স থেকে তিনি মঞ্চে পারফরম্যান্স শুরু করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে রেডিওতে খেলাঘর নামের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ফেরদৌসী রহমানের বড় ভাই (সাবেক প্রধান বিচারপতি) মোস্তফা কামাল। ১৯৫৬ সালে ২৬ জুন ফেরদৌসী রহমান মেট্রিকে স্ট্যান্ড করেন। [৩]

১৯৬০ সালে ‘আসিয়া’ নামের চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম নেপথ্য কণ্ঠদান করেন। ৬০ ও ৭০-এর দশকের বহু চলচ্চিত্রে তিনি নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তার প্লে ব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম রেডিওতে গান করেন। তখন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম বড়দের অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করেন। ২৭ ডিসেম্বর ‘এসো গান শিখি’ গানের অনুষ্ঠান শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে।[৪]

চলচ্চিত্র সম্পাদনা

১৯৬০ সালে ফেরদৌসী রহমান ইউনেস্কো ফেলোশীপ পেয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ৬ মাসের সঙ্গীতের ওপর স্টাফ নোটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ৩টি লং প্লেসহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তার। তার মাত্র ১টি সিডি বের হয়েছে ‘এসো আমার দরদী’। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তার। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা সংগীত পরিচালক। ১৯৬০ সালে রবীন ঘোষের সাথে ‘রাজধানীর বুকে’ নামক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে এসো গান শিখি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।[৪]

ব্যক্তিগত জীবন সম্পাদনা

 
শাহবাগ হোটেলে তার বিয়ের অনুষ্ঠানে স্বামীর সাথে ফেরদৌসী রহমান (১৯৬৬)

১৯৬৬ সালের ২৬শে অক্টোবর হোটেল শাহবাগে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে) তিনি বিয়ে করেন রেজাউর রহমানকে, যিনি একজন যন্ত্র প্রকৌশলী। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। ফেরদৌসী রহমানের দুই ছেলে। একজন রুবাইয়াত রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে থাকেন, ফেসবুকে চাকরি করেন। রুবাইয়াতের তিন ছেলেমেয়ে। আর ছোট ছেলে রাজিন রহমান, লন্ডনে থাকেন তিনিও ওখানকার একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। রাজিনের দুই মেয়ে। আর ফেরদৌসী রহমানের স্বামী রেজাউর রহমান এখন অবসরজীবন যাপন করছেন। তিনি ছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর একটা ইন্ডাস্ট্রি ছিল, ফিল্টার তৈরির। দেশের একমাত্র ফিল্টার তৈরির প্রতিষ্ঠান। ছেলেরা বাইরে চলে যাওয়ার পর ফ্যাক্টরিও বিক্রি করে দেওয়া হয়। তিনি ১৯৬৩ সাল ও ১৯৬৬ সালে রাশিয়া এবং চীনে বেড়াতে যান এবং গান করেন।[৪]

সম্মাননা সম্পাদনা

ফেরদৌসী রহমান নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আমাদের সঙ্গীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। তার অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭)। এছাড়াও তিনি নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার লাভ করেন।[৪] ২০১৩ সালে তিনি আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস আয়োজন হতে পরম্পরা পরিবার পদক লাভ করেন।[৫]

টিপ-হয়রানিতে স্মৃতিচারণ সম্পাদনা

টিপ পরা নিয়ে ২০২২ সালে ঢাকার রাস্তায় পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেক কর্তৃক হয়রানির শিকার হন তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার।[৬] সে প্রসঙ্গে অনেক বিশিষ্টজন টিপ পরার পক্ষে বিবৃতি দেন। তাঁদের একজন হিসেবে ফেরদৌসী রহমান বলেন[৭]:

টিপ আমরা বাংলার মেয়েরা, বাংলাদেশি মেয়েরা জন্ম থেকেই পরে আসছি। এটার মধ্যে রিলিজিয়াস কোনো ইমপ্লিকেশনস নাই।

... টিপের ব্যাপারে আমার চাইতে বেশি সোচ্চার আর কেউ হবে না। পাকিস্তানি আমলে টেলিভিশনে একবার আমাকে বলেছিল, টিপ দেওয়া যাবে না। তখন আমি বলেছিলাম টিপ যদি না দেওয়া যায়, তাহলে আমরা গানও গাইব না। তখন অন্য মেয়েরাও আমার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল।

... পিটিভির রজতয়ন্তীতে আমি পাকিস্তানে গান গাইতে গেলাম। আমি তো টিপ পরে গাইব। তখন দেখলাম প্রোডিউসাররা এটা নিয়ে ফিসফাস করছে। কেউ একজন আমাকে এটা নিয়ে প্রশ্নও করে বসলো। তখন আমি বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। টিপ তো আমি পরবোই।

... একটা সময় যখন আমরা পাকিস্তানে যেতাম, তখন সেখানকার মেয়েরা পাগলের মতো আমাদের কাছে দৌড়ে আসত টিপ দেখার জন্য। আমাদের কাছে টিপ চাইত। আমি যতবার পাকিস্তানে গেছি, সেখানকার পরিচিত মেয়েদের জন্য আমি বাংলাদেশ থেকে টিপ নিয়ে গিয়েছি উপহার হিসেবে।

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. প্রতিবেদক, গ্লিটজ। "বহু পুরস্কার পেয়েছি, কিন্তু এটার অনুভূতি অন্যরকম: ফেরদৌসী রহমান"bdnews24। ২০২৩-০৩-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-১৫ 
  2. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৩ আগস্ট ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ 
  3. প্রতিবেদক, বিনোদন (২০২২-০৬-২৮)। "জন্মদিনে জানা–অজানা ফেরদৌসী রহমান"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১২-২৬ 
  4. রহমান, মোমিন; হোসেন, নবীন (১৯৯৯)। "গানের পাখি: ফেরদৌসী রহমান"। অন্যদিন, ঈদ সংখ্যা। মাজহারুল ইসলাম। (১): ৩৫২। 
  5. শাওন, রাশেদ (২৭ জানুয়ারি ২০১৩)। "আরটিভির সেরা সজল ও মৌসুমী"বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ১৫ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০২০ 
  6. "লতা সমাদ্দারকে হেনস্তার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি"আরটিভি নিউজ। 8 april 2022। সংগ্রহের তারিখ 13 April 2024  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  7. "টিপ নিয়ে হয়রানি 'সংকীর্ণতা ও পশ্চাৎপদতার' ফল"The Daily Star বাংলা। ৪ এপ্রিল ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০২৪ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা