প্রয়াস ও প্রমাদ

শিখন বা সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি যাতে বারংবার বহুবিধ বিফল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরে শেষ পর্য

প্রয়াস ও প্রমাদ (ইংরেজি Trial and error) বলতে সমস্যা সমাধানের একটি মৌলিক পদ্ধতিকে বোঝায়[১] যেখানে পদ্ধতিটির প্রয়োগকারী সমস্যা সমাধানে সফলতা লাভের আগ পর্যন্ত কিংবা নিজ থেকে থামার আগ পর্যন্ত বারংবার বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।[২] একে প্রচেষ্টা ও ত্রুটি সংশোধন নামেও ডাকা হতে পারে। এই পরিভাষাটি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত হয়।

একজন রেডিও এর মাধ্যমে কিছু শুনছেন

প্রকৌশলবিদ্যায় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রয়াস ও প্রমাদ হল এক ধরনের সমস্যা সমাধান কৌশল বা পদ্ধতি যেখানে যুক্তিপাত ব্যবহার করে কোনও সমস্যার সমাধান বের করা হয়। যখন কোনও প্রদত্ত সমস্যাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাধান করার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্ঞান বা তথ্যের অভাব থাকে, তখন এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে সমস্যাটির একটি সমাধান কল্পনা করে সেটিকে পরীক্ষা করে দেখা হয় (প্রয়াস)। সমাধানটি ব্যর্থ হলে উদ্ভূত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক সমাধানটিতে পরিবর্তন সাধন করে (প্রমাদ সংশোধন) আবারও সংশোধিত সমাধানটি প্রয়োগ করা হয়। এভাবে সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বারংবার প্রয়াস ও প্রমাদ সংশোধন করা হতে থাকে।[৩]

প্রাণী আচরণবিদ্যায় প্রয়াস ও প্রমাদ বলতে প্রাণীদের মধ্যে দৃষ্ট খুবই সাধারণ একটি শিখন কৌশল বা পদ্ধতিকে বোঝায়, যাতে প্রাণীরা কোনও সর্বোচ্চ সন্তুষ্টিবিধায়ক বা কাম্য ফলাফল অর্জনের জন্য বারংবার আপাতদৃষ্টিতে দৈব এলোমেলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সিদ্ধান্তগুলির পরিণামের ভিত্তিতে প্রাণীটি তার যেসব আচরণ ফলপ্রসূ, তৃপ্তিকর ও আরামদায়ক হয়, সেগুলিকে গ্রহণ করে।[৪]

মানুষের শিখন প্রক্রিয়ার মনোবৈজ্ঞানিক আলোচনাতে প্রয়াস ও প্রমাদ হল শিখনের একটি সংযোগবাদী মতবাদ। মার্কিন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড লি থর্নডাইক এই তত্ত্বের জনক। থর্নডাইকের মতে শিখন হল সমস্যা ও সমাধানের মধ্যে ত্রুটিহীন সংযোগ স্থাপন। এক্ষেত্রে সমস্যাটি হল এক ধরনের উদ্দীপক এবং এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যে মানুষ এলোমেলোভাবে বা যাদৃচ্ছিকভাবে একের পর এক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে ও প্রচেষ্টা-পরবর্তী ফলাফলের উপর ভিত্তি করে প্রমাদ বা ত্রুটি সংশোধন করতে থাকে এবং এভাবে হঠাৎ সৌভাগ্যবশত সমস্যাটির একটি সমাধান খুঁজে বের করে ও লক্ষ্যে পৌঁছায়। এভাবে সমস্যা (উদ্দীপক) ও সঠিক সমাধানের (প্রতিক্রিয়া) মধ্যে ত্রুটিহীন সংযোগ স্থাপিত হয়। সঠিক সমাধানটি বের করে মানুষ তৃপ্তিলাভ করে ও পরবর্তীকালে ঐ সমস্যাটি উদ্ভূত হলে আবারও সেই ত্রুটিহীন সমাধানটি প্রয়োগ করে আবার তৃপ্তিলাভ করে, ফলে মানুষের শিখন দৃঢ়ীভূত বা বলবর্ধিত (reinforced) হয়। এর বিপরীতে মনের ভেতরে ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ প্রতিক্রিয়া বা সমাধানগুলির অবস্থান দুর্বল হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। থর্নডাইকের মতে মানুষের দৈহিক ও মানসিক প্রস্তুতি, সমস্যা ও সমাধান বারংবার অনুশীলন ও সমাধান করে তৃপ্তিলাভ - এই তিনটি সূত্র মানুষের শিখনকে দৃঢ়ীভূত ও দীর্ঘস্থায়ী করে।[৫]

কম্পিউটার বিজ্ঞানে এই পদ্ধতিটি উৎপাদন ও পরীক্ষা (Generate and test, অন্য ভাষায় পাশবিক বলপ্রয়োগ তথা ব্রুট ফোর্স Brute force) হিসেবে পরিচিত। মৌলিক বীজগণিতে সমীকরণ সমাধানের ক্ষেত্রে এটি অনুমান ও যাচাই (গেস অ্যান্ড চেক guess and check) নামে পরিচিত।

প্রয়াস ও প্রমাদকে সমস্যা সমাধানের দুইটি মৌলিক পন্থা একটি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এর বিপরীত পন্থাটি হল অন্তর্দৃষ্টিতত্ত্ব ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান। তবে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী পন্থাও আছে; যেমন চালিত অভিজ্ঞতাবাদ (guided empiricism) নামক পন্থায় পদ্ধতিকে চালিত করা জন্য তত্ত্ব ব্যবহার করা হয়।

এই ধরনের চিন্তা দার্শনিক কার্ল পপারের সমালোচনামূলক যুক্তিবাদের একটি প্রধান অবলম্বনে পরিণত হয়েছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Campbell, Donald T. (নভেম্বর ১৯৬০)। "Blind variation and selective retention in creative thoughts as in other knowledge processes"Psychological Review67 (6): 380–400। ডিওআই:10.1037/h0040373পিএমআইডি 13690223 
  2. Concise Oxford Dictionary p1489
  3. Carl Schaschke (২০১৪), A Dictionary of Chemical Engineering, Oxford University Press 
  4. David McFarland (২০১৪), A Dictionary of Animal Behaviour (২য় সংস্করণ), Oxford University Press 
  5. Kundu C L; D N Tutoo (১৯৮৮), Educational Psychology, Sterling Publishers, পৃষ্ঠা 214