প্রচার মাধ্যম বিদ্যা

জ্ঞানের শাখা যেখানে যোগাযোগ মাধ্যমগুলির প্রকৃতি ও প্রভাব নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়

প্রচার মাধ্যম বিদ্যা (ইংরেজি: Media studies) একটি উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্যবিষয়, জ্ঞানের শাখা ও গবেষণার ক্ষেত্র যেখানে প্রচার মাধ্যমের বিভিন্ন দিক অধ্যয়ন করা হয়।

দৈনন্দিন জীবনে যেসব প্রণালীর মাধ্যমে তথ্য জ্ঞাপন বা প্রচার করা হয়, সেগুলিকে প্রচার মাধ্যম বলে। সংবাদপত্র, সাময়িকী, টেলিভিশন, বেতার, জনপ্রিয় সংগীত, আন্তর্জাল (ইন্টারনেট), চলচ্চিত্র, চলমান চিত্র (অ্যানিমেশন), ভিডিও গেম, বিজ্ঞাপন, বিপণন, ইত্যাদি হল কিছু প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যম। নির্দিষ্ট মাধ্যম-সংক্রান্ত বিদ্যা যেমন টেলিভিশন বিদ্যা, বেতার বিদ্যা, আন্তর্জাল বিদ্যা, ইত্যাদি প্রচার মাধ্যম বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।

প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় একজন স্রষ্টা (ব্যক্তি, শিল্প প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন) বাস্তব বিশ্বের (কিংবা কাল্পনিক কোনও বিশ্বের) কোনও কিছু সংক্রান্ত তথ্যের একটি অর্থবহ রূপ (ব্যক্ত্যর্থ ও জাত্যর্থ) কোনও পাঠক-দর্শক-শ্রোতার কাছে উপস্থাপন করেন। যে অর্থবহ বস্তুটি উৎপাদন করা হয়, তাকে প্রচার মাধ্যম উৎপাদ (Media text) বলে। প্রচার মাধ্যম বিদ্যায় এই উৎপাদ কে সৃষ্টি করে, কী প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোন্‌ প্রক্রিয়ায় এগুলি সৃষ্টি করা হয়, কী ধরনের ভাষা বা সাংকেতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে এগুলির মাধ্যমে বাস্তবতা উপস্থাপন করা হয় ও অর্থ জ্ঞাপন করা হয়, কোন্‌ উদ্দেশ্যে ও কোন্‌ আদর্শবাদ বা মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে এগুলিকে সৃষ্টি করা হয়, কাকে উদ্দেশ্য করে এগুলি সৃষ্টি করা হয়, উদ্দীষ্ট পাঠক-দর্শক-শ্রোতা কীভাবে নিজস্ব পরিচয়, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই উৎপাদগুলির সাথে আন্তঃক্রিয়া ও আপোসরফা করে অর্থ অনুধাবন করে, এই সবকিছুই প্রচার মাধ্যম বিদ্যাতে আলোচনা করা হয়।

প্রচার মাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের শাখা। আধুনিক বিশ্বে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সর্বত্র সর্বক্ষণ প্রচার মাধ্যম বিদ্যমান। মানুষ এখন আর প্রচার মাধ্যমগুলির বাইরে অবস্থান করে না, বরং এগুলির ভিতরে সর্বত্র সর্বক্ষণ অচেতনভাবে নিমজ্জিত থাকে। কোনও মানুষ নিজের ও বিশ্ব সম্পর্কে কী প্রত্যক্ষণ বা উপলব্ধি করবে, এগুলি থেকে কীভাবে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করবে, প্রচার মাধ্যমগুলি এই ব্যাপারগুলির উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। প্রচার মাধ্যমগুলিতে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব বিশ্বকে প্রচলিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খাইয়ে উপস্থাপন করা হয়। এজন্য সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রচার মাধ্যম কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে সচেতনতা বা সাক্ষরতা থাকা জরুরি। প্রচার মাধ্যম সংক্রান্ত সাক্ষরতা পাঁচটি মূল ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত, প্রচার মাধ্যমের সমস্ত বার্তা কৃত্রিমভাবে নির্মিত, সুতরাং বার্তাটি কে কী উদ্দেশ্যে কোন্‌ উপাদান ব্যবহার করে নির্মাণ করেছে, সে ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রচার মাধ্যমের বার্তাগুলি ঐ মাধ্যমের সৃষ্টিশীল ভাষা, শৈলী, সংকেতপদ্ধতি ব্যবহার করে নিজস্ব রীতিনীতি, নিয়মকানুন ও নন্দনতত্ত্ব (সৌন্দর্যবোধ) মেনে তৈরি করা হয়, তাই যোগাযোগা মাধ্যমের ভাষার ব্যাকরণ ও রূপকগুলি সম্পর্কে জানলে দর্শক-শ্রোতা-পাঠক কৌশলে ভুলপথে পরিচালিত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে পারবেন। তৃতীয়ত, প্রতিটি ব্যক্তি প্রচার মাধ্যমে উপস্থিত একই বার্তাকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে, কারণ প্রত্যেকেই তার বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে বার্তার নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করে। চতুর্থত, প্রচার মাধ্যমের বার্তাগুলি নির্মিত বলে এগুলিতে স্রষ্টার মতাদর্শ, মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রথিত থাকে, অর্থাৎ কোন্‌ পরিস্থিতি, কোন্‌ চরিত্র ও তাদের কোন্‌ কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ বা পছন্দনীয়, তা যোগাযোগ বার্তার মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে। পঞ্চমত, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উপস্থাপিত সিংহভাগ বার্তাই অর্থ মুনাফা বা ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়, যেখানে পাঠক-শ্রোতা-দর্শককে কোনও পণ্য কিনতে বা ক্ষমতার বলয়ে আনতে প্ররোচিত করা হয়, তাই প্রচার মাধ্যমের বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিণাম আছে।[১][২]

প্রচার মাধ্যম বিদ্যাতে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, সংকেতবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক বিদ্যা, অলংকারশাস্ত্র, দর্শন, সাহিত্য তত্ত্ব, শিল্পের ইতিহাস, চলচ্চিত্র তত্ত্ব, তথ্য তত্ত্ব, ইত্যাদি বিভিন্ন জ্ঞানের শাখাতে ব্যবহৃত মূলনীতি ও পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করা হয়।

যুক্তরাজ্যে ১৯৭০-এর দশকে সাংস্কৃতিক বিদ্যার পাশাপাশি একটি ক্ষেত্র হিসেবে উচ্চশিক্ষায়তনিক পাঠ্য বিষয় হিসেবে যোগাযোগ বিদ্যার উত্থান ঘটে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটিকে মূলত যোগাযোগ বিদ্যা ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া সাংবাদিকতা বিদ্যার সাথেও এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "The key concepts"। MedienABC। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০২১ 
  2. "Media Literacy: Five Core Concepts"। Young African Leaders Initiative। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০২১ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা