পাতিকাক

পাখি প্রজাতি

পাতিকাক (Corvus splendens) (ইংরেজি: House Crow), পাতিকাগ বা পাতিকাউয়া কর্ভিডি (Corvidae) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত অতি পরিচিত একটি পাখি।[২] পাতিকাক অত্যন্ত অজনপ্রিয় একটি পাখি। মানুষ যেসব জায়গায় প্রথম বসতি স্থাপন করে, যেমন-চরাঞ্চলে, সেসব জায়গায় পাতিকাকও মানুষের সাথে সাথে বসতি করে। এর কারণ এরা সর্বভূক আর যেকোন প্রকারে বাসা বানিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়েই এরা জীবনধারণ করতে পারে। মানুষের সান্নিধ্যে বসবাসকারী যে ক'টি পাখি প্রজাতির বিনাশ হওয়ার সম্ভাবনা কম তার মধ্যে কাক একটি।[২] যে এলাকা যতো বেশি নোংরা, সেই এলাকায় ততো বেশি পাতিকাক। সেকারণে শহরাঞ্চলে পাতিকাক বেশি দেখা যায়।

পাতিকাক
Corvus splendens
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: পক্ষী
বর্গ: Passeriformes
পরিবার: Corvidae
গণ: Corvus
প্রজাতি: C. splendens
দ্বিপদী নাম
Corvus splendens
Vieillot, 1817

বিস্তৃতি সম্পাদনা

বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, হংকং, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, কাতার পাতিকাকের প্রধান আবাসস্থল। এছাড়া বার্বাডোস, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, মিশর, জিব্রাল্টার, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইসরাইল, জর্ডান, কেনিয়া, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, নেদারল্যান্ডস, ওমান, সিশেলেস, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, তাঞ্জানিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়েমেনযুক্তরাষ্ট্রে পাতিকাক অবমুক্ত করা হয়েছে।[১] মাঝে মাঝে কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, জাপান, স্পেনযুক্তরাজ্যেও এদের দেখা যায়, এরা সম্ভবত পার্শ্ববর্তী কোন দেশ থেকে চলে আসে। চিলিতে পাতিকাক দেখা গেছে, তবে এদের উৎস সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।[১] অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজের মাধ্যমে পাতিকাক পৌঁছেছিল ও বংশবিস্তার করেছিল, কিন্তু সেখানে এদের প্রায় নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।[৩]

নামকরণ সম্পাদনা

পাতিকাকের দ্বিপদ নাম Corvus splendens, নামকরণ করা হয় ১৮১৭ সালে। এ পর্যন্ত পাতিকাকের চারটি উপপ্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে।[৪][৫] এরা হচ্ছে-

  1. C. s. splendens : ভারতীয় উপদ্বীপ, বাংলাদেশ, নেপালভুটান এদের প্রধান আবাসস্থল।
  2. C. s. zugmayeri : দেহের হালকা অংশগুলো খুব বেশি হালকা, অনেকসময় প্রায় সাদা বলে মনে হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ইরান থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-মধ্য ভারত এদের প্রধান আবাসস্থল।
  3. C. s. insolens : প্রায় C. s. splendens এর মতোই, তবে কালো অংশগুলোর প্রান্তগুলো ক্রমে হালকা হয়ে গিয়েছে। চীনের দক্ষিণাঞ্চল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয় উপদ্বীপের উত্তরাংশ ও ভারতের পশ্চিমাংশ এদের প্রধান আবাসস্থল।
  4. C. s. protegatus : প্রায় C. s. insolens এর মত, তবে দেহের হালকা অংশগুলো বেশি গাঢ়। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত, শ্রীলঙ্কামালদ্বীপ এদের প্রধান আবাসস্থল।
 
উড়ন্ত পাতিকাক

বিবরণ সম্পাদনা

পাতিকাকের মাথার পেছন থেকে গলা ও বুক এবং পেটের সামনের দিকটা ধূসর বা ফ্যাকাসে ধূসর; বাকি সারা দেহ, ঠোঁট, চোখ এবং পা কালো। মাথার তালু, কপাল ও গলার নিচের দিকটাও কালো।[২] ঠোঁট দাঁড়কাকের মত, তবে একটু কম বাঁকা। ঠোঁটে গোঁফ দেখা যায়।[৬] দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৪৪ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ডানার দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৭.৫ সেন্টিমিটার।[৪] ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম।[৭]

স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

শহর ও ছোট জনপদে পাতিকাক বেশি দেখা যায়, গ্রামে কম দেখা যায়। বনে জঙ্গলে একদমই থাকে না, তবে অনেকসময় রাত কাটায়। এরা জীবনধারণের জন্য পুরোপুরি মানুষের উপর নির্ভরশীল।[৬]

 
গোসলের পরে একজোড়া পাতিকাক

পাতিকাকের গোসল করার প্রবণতা প্রবল। জমাট বাঁধা পানিতে বা পানির ধারায় একাকী বা দলবদ্ধভাবে পানি ছিটিয়ে গোসল করে। কখনও কখনও বৃষ্টির সময় কাকেরা জুবুথুবু হয়ে এক জায়গায় বসে বৃষ্টিতে ভেজে। কাকেদের বৃষ্টিভেজা অবয়বের ধারণা থেকেই কাকভেজা বাগধারাটির উৎপত্তি।

পাতিকাকের ডাক কর্কশ কা-কা-কা। বিপদের আশঙ্কা দেখলে এরা একসাথে দলবদ্ধ হয়ে সতর্ক-সূচক কা কা ডাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গলা কর্কশ হলেও কাক আসলে গায়ক পাখি, কিন্তু কোকিল গায়ক পাখি নয়। এর কারণ হচ্ছে কাকের গলায় স্বরথলি বা ভয়েস বক্স (Voice box) আছে, কিন্তু কোকিলের নেই[৬]

 
পাতিকাকের সমাবেশ, কলকাতা, ভারত

শহর অঞ্চলে পাতিকাকেরা ভরদুপুরে বা অপরান্হে সমাবেশ করে। তখন এরা একসাথে ডাকে ও উড়ে বেড়ায়।

প্রায়ই বৈদ্যুতিক তারে বেঁধে পাতিকাক মারা যায়। রাণীক্ষেত, Escherichia coli ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে, কলেরা, বটুলিজম ও বসন্তে আক্রান্ত হয়ে কিছু কাক মারা যায়। পাতিকাক এসব রোগ ছড়াতেও ভূমিকা রাখে। বার্ড ফ্লু রোগের প্রকোপ বেড়ে গেলে জালালি কবুতরের সাথে সাথে পাতিকাকের দিকেও নজর রাখতে হয়।[২] মানুষের নিউক্যাসল রোগ ছড়াতেও পাতিকাক ভূমিকা রাখে।

খাদ্যাভ্যাস সম্পাদনা

পাতিকাক সর্বভূক, অর্থাৎ সব খায়। এদের খাদ্যতালিকা বেশ বড়। প্রাণীর মল থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, হাঁসমুরগীর ছানা, পোকামাকড়, ফলমূল, বড় বড় ফুলের মধু, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, ছোট সরীসৃপ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়।[২][৬] ছোট বাচ্চাদের হাত থেকে খাবার ছিনিয়ে নিতে এরা পটু। পাতিকাক শিকারী পাখির উচ্ছিষ্ট খাবার জন্য ওঁত পেতে থাকে। অনেকসময় শিকারী পাখিকে কায়দামত পেলে দলবদ্ধভাবে ধাওয়া করে তার শিকার ছিনিয়ে নেয়। বেল পাকলে কাকের কী? বলে প্রবাদ থাকলেও কাক বেলও খায়। বেল পেকে পড়ে ফেটে গেলে কাক তা মজা করে খায়।[৬]

প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি সম্পাদনা

পাতিকাকের প্রজনন ঋতু মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত, তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর বিভিন্নতা দেখা যায়।[৪] পাতিকাক কোকিল, চোখগেলো, পাপিয়াসহ অন্যান্য বাসা পরজীবী পাখির পোষকের ভূমিকা পালন করে। এসব পাখি পাতিকাকের বাসায় ডিম পেড়ে যায়, পাতিকাক সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায় আর লালনপালন করে।

বাসা সম্পাদনা

 
ডিমসহ পাতিকাকের বাসা

প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাটা টিনের টুকরো, কাপড়ের টুকরো, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন, কাঠিকুঠি, সাইকেল ও রিকশার স্পোক, সিগারেটের প্যাকেট, ফেলে দেয়া কাগজ অর্থাৎ একটি জনপদের পরিত্যাক্ত প্রায় সবকিছু দিয়েই পাতিকাক আগোছালো বাসা করে। ঘরের ছোটখাটো জিনিস চুরি করেও এরা বাসা বানায় বা সাজায়। কাকের বাসার অগোছালো ধর্মের জন্য একটা বাগধারারই উদ্ভব হয়েছে- কাকের বাসা। অসম্ভব জায়গায় বাসা করার প্রবল প্রবণতা রয়েছে কাকের। যেখানে বাসা করা সম্ভব নয় এমন জায়গায় খড়কুটো এনে জড়ো করে। খড়কুটো পড়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলেও বারবার সেখানেই খড়কুটো নিয়ে আসে। বাসা বানাবার অদম্য চেষ্টা চলতেই থাকে।[৬] তবে সাধারণত লোকালয়ে গাছের ডালে, বৈদ্যুতিক খুঁটি, জানালার আলিশায় বা বসতবাড়ির কোণায় এরা বাসা করে। কলোনি করে বাসা করে না, তবে যেসব অঞ্চলে পাতিকাকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি, সেসব অঞ্চলে এক জায়গায় অনেকগুলো বাসা দেখা যায়। মূলত স্ত্রী কাকই বাসা করে, পুরুষ কাক একটু সহযোগিতা করে মাত্র।[৬] বাসায় ডিম থাকলে পাতিকাকের আচরণ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এসময় বাসার আশেপাশে মানুষ, কুকুর, বিড়াল বা অন্য প্রাণী বা পাখি এলে এরা ডাইভ দিয়ে পড়ে ঠোকর দেয় বা তাড়া করে।

 
একজোড়া পাতিকাক, কলকাতা, ভারত
 
Eudynamys scolopaceus + Corvus splendens

ডিম সম্পাদনা

পাতিকাক একবারে ৩-৬ টি ডিম দেয়। ডিমের রঙ সবজে-আকাশী, তার উপর কালচে-বাদামী ফোঁটা। ডিমের মোটা অংশে বাদামী ফোঁটার ঘনত্ব বেশি। স্ত্রী কাকই মূলত ডিমে তা দেয়। পুরুষ কাকও দেয়, তবে খুব কম সময়ের জন্য। তবে বৃষ্টি নামলে. শিলাবৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড রোদ পড়লে পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সাথে ডিম আগলে রাখে।[৪][৬] ১৬ থেকে ১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।[৪][৭]

পাতিকাকের ছানা সম্পাদনা

সদ্যোজাত ছানার গায়ে পালক থাকে না, চোখ বন্ধ থাকে। দেহের বর্ণ আর ঠোঁট গোলাপী থাকে। ৭-১০ দিন বয়েসী ছানার শরীর কালচে হয়, ঠোঁট কালচে-ধূসর। চোখ কালো। ২১ থেকে ২৮ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে।[৬][৭]

সংস্কৃতি, সাহিত্য ও উপকথায় পাতিকাক সম্পাদনা

বাংলা সাহিত্যে অন্য কোন পাখির পদচারণা কাকের মত এত ব্যাপক নয়। কাকভোর, কাকচক্ষু, কাকতালীয়, কাক ভুষুণ্ডি, তীর্থের কাক, কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং ইত্যাদি বাগধারা ও উপমা বাংলা সাহিত্যে প্রচুর ব্যবহৃত হয়। কাকের মত ধূর্ত বা কাক কাকের মাংস খায় না এসব প্রবাদও ব্যবহৃত হয়েছে প্রচুর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুড়ো আংলা উপন্যাসে পাতিকাক একটা বড় ভূমিকা পালন করে। সুকুমার রায়ের শিশুসাহিত্যের অন্যতম চরিত্র শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। ঈশপের তৃষ্ণার্ত কাকের উপকথাটি পাতিকাক বিষয়ক আরেকটি জনপ্রিয় সাহিত্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত দুর্ভিক্ষের চিত্রমালাতে বার বার এসেছে পাতিকাক। রফিকুন নবীর জনপ্রিয় কার্টুন টোকাইয়ে পাতিকাক একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।

কাকের ডাক অমঙ্গলের প্রতীক- এটা কুসংস্কারইউরোপউত্তর আমেরিকার কয়েকটি দেশে কাককে অভিশাপের চিহ্ন বলে ধরা হয়। সেখানে কাক অন্ধকার আর অশুভের প্রতীক। ফসলে পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাঠে কাকতাড়ুয়া দাঁড়া করানো থাকে। অনেকক্ষেত্রে কাকেদের ভয় দেখানোর জন্য একটা কাক মেরে উঁচু জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা হয়।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Corvus splendens[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], The IUCN Red List of Threatened Species, পাতিকাক বিষয়ক পাতা।
  2. বাংলাদেশের পাখি, রেজা খান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা (২০০৮), পৃ. ২১৭।
  3. National animal pest alert
  4. The Fauna of British India including Ceylon and Burma, Birds Vol. 1, E. C. Stuart Baker, London: Taylor and Francis (1922), p. 32.
  5. Bird Forum, পাতিকাক বিষয়ক পাতা।
  6. বাংলাদেশের পাখি, শরীফ খান, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা (২০০৮), পৃ. ৩১৪।
  7. birding.in, পাতিকাক বিষয়ক পাতা।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা