পাণ্ডুয়া, মালদহ জেলা

মালদহ জেলার একটি বসতি
(পাণ্ডুয়া, মালদা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

পাণ্ডুয়া (অন্যান্য নাম আদিনা হযরত পাণ্ডুয়াফিরুজাবাদ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ জেলায় একটি শহরের ধ্বংসাবশেষ। এটি প্রায় এক শতাব্দী ধরে বাংলা সালতানাতের রাজধানী ছিল। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে (৮৫৭ বঙ্গাব্দে) এর রাজধানী লখনৌতি হয়েছিল।[১]

পাণ্ডুয়া
আদিনা মসজিদের মেহরাব, তোরণ ও স্তম্ভ
পাণ্ডুয়া, মালদহ জেলা পশ্চিমবঙ্গ-এ অবস্থিত
পাণ্ডুয়া, মালদহ জেলা
পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান
বিকল্প নামহযরত পাণ্ডুয়া, ফিরুজাবাদ
অবস্থানপশ্চিমবঙ্গ, ভারত
স্থানাঙ্ক২৫°০৮′২৪″ উত্তর ৮৮°০৯′১১″ পূর্ব / ২৫.১৪০° উত্তর ৮৮.১৫৩° পূর্ব / 25.140; 88.153
ধরনবসতি
ইতিহাস
প্রতিষ্ঠিতচতুর্দশ শতক
পরিত্যক্তষোড়শ শতক
স্থান নোটসমূহ
খননের তারিখউনিশ শতক

নামকরণ সম্পাদনা

গৌড়ের মতো প্রাচীন আর প্রসিদ্ধ না হলেও পাণ্ডু নগরীতে প্রচুর হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এছাড়াও এখানে বহু প্রাচীন স্থাপনারও অস্তিত্ব আছে। ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে (৭৬০ বঙ্গাব্দে) সুলতান ইলিয়াস শাহ এর নামকরণ করেন ফিরুজাবাদ। এই নামকরণ সম্ভবত বাংলার আর এক স্বাধীন সুলতান ফিরুজ শাহ (১৩১১–১৩২২ খ্রিস্টাব্দ) এর নাম অনুসারে করা হয়েছিল। পাণ্ডুয়া নগরীর আদূরে জালাল উদ্দিন তবরীজিনূর কুতুব আলম নামে দুইজন দরবেশের খানকাহ আছে। যার কারণে এলাকাটি হযরত পাণ্ডুয়া নামেও প্রসিদ্ধ। বলা হয় যে পাণ্ডুয়ার নাম করান হয় পাণ্ডুইয়া>পাণ্ডুভিয়া থেকে। যদিও কানিংহামের মতে পাণ্ডুবিস নামক জলজ পাখির নাম হতেই পাণ্ডুয়ার নামকরণ হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ইতিহাস সম্পাদনা

দিল্লী সালতানাতের বলবন বংশের মুদ্রায় পাণ্ডুয়াকে ফিরোজাবাদ বলে অভিহিত করা হয়েছিল, যা শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনকে চিহ্নিত করছে। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে (৭৫৯ বঙ্গাব্দে) শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার তিন মুসলিম রাজ্যকে একত্রিত করে ইলিয়াস শাহী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিল্লী সালতানাত তখন উত্তর-পশ্চিম ভারতে মোঙ্গল আক্রমণের দিকে ব্যস্ত ছিল। বাংলার মুসলিম শাসকেরা সুযোগ বুঝে স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেহেতু বাংলা ও দিল্লির দূরত্ব অনেক বেশি। বাংলার ইতিহাসে সালতানাতটির প্রতিষ্ঠা অনেক গুরুত্ব পেয়েছে, কারণ এর ফলে দিল্লি থেকে স্বতন্ত্র শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বাংলার সমস্ত বিভাগ একত্রিত হয়ে একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। পাণ্ডুয়া প্রথম একশ বছর ধরে বাংলা সালতানাতের রাজধানী ছিল।[২]

১১৪ বছর ধরে পাণ্ডুয়া থেকে ৯ জন শাসক বাংলায় শাসন করেছিলেন। একমাত্র রাজা গণেশ, তাঁর পুত্র জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ এবং পৌত্র শামসউদ্দিন আহমাদ শাহ বাদ দিয়ে সমস্ত শাসকেরা ইলিয়াস শাহী রাজবংশের। তাঁরা বিভিন্ন প্রাসাদ, দুর্গ, সেতু, মসজিদ ও সমাধিসৌধ তৈরি করেছিলেন, বর্তমানে যার বেশিরভাগই হয় ভগ্নদশায় না হয় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত। সুলতান সিকান্দার শাহ বাংলা সালতানাত–দিল্লি সালতানাত যুদ্ধে বাংলার জয়ের পর আদিনা মসজিদ তৈরি করেছিলেন। আদিনা মসজিদ দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের আদলে তৈরি এবং এটি ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ ছিল। সুলতান জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে একলাখী সমাধিসৌধে সমাধি দেওয়া হয়েছিল, যা বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যকলার এক পরিচয়। রাজপ্রাসাদের উঁচু সিঁড়ি, ৯টি দেওয়াল, তিনটি দরজা এবং একটি দরবার কক্ষ। তখনকার এক সূত্রের বিবরণ অনুযায়ী ঐ দরবার কক্ষের স্তম্ভগুলি পিতলনির্মিত, খোদাই করা, পালিশ করা এবং ফুল ও প্রাণীর চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল; দামি পাথর দিয়ে অলঙ্কৃত উঁচু সিংহাসনে শাসক পায়ে পা দিয়ে বসতেন এবং দুদিকে ধার করা এক তলোয়ার তাঁর কোলে থাকত। বাংলার সুলতানগণ ফার্সি‌ দরবারের আচার-আচরণকে অনুসরণ করতেন।[৩] মিং দূত মা হুয়ানের মতে, পাণ্ডুয়া এক ছোট অজগ্রাম থেকে এক কসমোপলিটান রাজধানী ও বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এছাড়াও এতই একটি সেনা ছাউনি ছিল। জনসংখ্যার মধ্যে রাজপরিবার, অভিজাত, সেনা, সাধারণ মানুষ এবং ইউরেশীয় ভ্রমণকারী ও বণিক ছিল যারা হয় ওখানে বসতি স্থাপন করেছিল বা বাণিজ্য পথ বরাবর এক ভাসমান জনসংখ্যা ছিল। মা হুয়ান লিখেছেন যে "শহরের দেওয়ালগুলি চিত্তাকর্ষক, বাজারগুলি সুগঠিত, দুপাশে দোকান, স্তম্ভগুলি নিয়মিত সারি বরাবর এবং তারা বিভিন্নরকমের মালে পরিপূর্ণ।" পাণ্ডুয়া প্রস্তুতি ও বাজারির কেন্দ্র ছিল। পাণ্ডুয়ার বাজারে কমপক্ষে ৬ রকমের মসলিনরেশমজাত দ্রব্য পাওয়া যেত। সেখানে চার রকমের মদ ছিল। তুঁত গাছ থেকে উচ্চমানের কাগজ তৈরি হত। তখন কাগজ এক হাল্কা সাদা কাপড়ের মতো ছিল।[৪]

পাণ্ডুয়াতে জ্ঞাত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পাওয়া যেত। শহরটি কাপড় ও মদের প্রচুর রফতানি করত। বণিকেরা জাহাজ তৈরি করতেন, বিদেশে গিয়ে বাণিজ্য করতেন এবং সেখানে শাসকের দূতের মতো কাজ করতেন। ধনীরা পাণ্ডুয়াতে বিলাসভাবে কাটাতেন। তাঁরা সেহনাই গায়কদের সুরে সকালে জেগে যেতেন, যাদের টাকা ও মদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হত। মেয়েদের নাচ দেখে অভিজাতরা মনরঞ্জিত হতেন। অতিথিদের পানসহ গোমাংসের কাবাব, মটন, গোলাপজল ও বিভিন্ন ধরনের শরবত দেওয়া হত।[৪] শহরের পুরুষেরা সুতির পোশাক, পাগড়ি, ধুতি, চামড়ার জুতো ও কোমরে বেল্ট পরতেন। মহিলারা সুতির শাড়ি পরতেন। উচ্চশ্রেণির মহিলারা সোনার গয়না পরতেন। মনোরঞ্জকেরা এক চেন দেওয়া বাঘকে নিয়ে মনোরঞ্জন করতেন। হিন্দুরা গোমাংস খেত না। বাংলা ভাষা এর প্রধান ভাষা ছিল, যদিও দরবারের সভ্য ও বণিকেরা ফার্সি ভাষায় কথা বলতেন।[৪]

১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে (৮৫৭ বঙ্গাব্দে) বাংলার রাজধানী পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে স্থানান্তরিত হয়েছিল। স্থানান্তরের কারণ এখনও পরিষ্কার নয়, তবে নদীর গতিপথের পরিবর্তন এর কারণ হিসেবে মনে করা হয়েছে।[২] তবে এর পরেও পাণ্ডুয়াতে বিভিন্ন টাঁকশাল ছিল যেখান থেকে রুপোর টাকা প্রস্তুত হত। সেই টাঁকশালগুলি শহর-ই-নও ও মুজাফফরাবাদ নামে পরিচিত।[৫] শের শাহ সুরির কয়ের পর থেকে পাণ্ডুয়ার পতন শুরু হয়েছিল। পাণ্ডুয়া ক্রমশ এক জনমানবহীন স্থানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শতকের ভূমিকম্পে এর বিভিন্ন ভবনের ক্ষতি হয়েছিল। বাংলার উচ্চ আর্দ্রতা ও মৌসুমির প্রভাবে এর স্থাপত্যের বেশিরভাগই ভেঙে পরেছিল। উঁচু ঢিপিতে অবশেষ ছাড়া পাণ্ডুয়ার রাজপ্রাসাদের কিছুই অবশিষ্ট নেই।

পুরা নিদর্শন সম্পাদনা

অতীতের সাক্ষ্য বুকে নিয়ে আদিনা মসজিদ, একলাখী সমাধিসৌধ, পীর-দরবেশদের সমাধীসৌধ, দনুজ দীঘি এবং সতাশগড় দিঘি প্রভৃতি পুরা নিদর্শন আজ অবধি বিদ্যমান আছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

সাহিত্যে প্রভাব সম্পাদনা

কোনো অতি সাধারণ ব্যক্তি অতি সাধারণ ও প্রত্যন্ত স্থানে থাকাকালীন কোনো বিশেষ বা গুরুত্বপূর্ণ বা অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে, কটাক্ষ করে বলা হতো, "পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর"। এই "পেঁড়ো"-ই হলো পাণ্ডুয়ার বিকৃত রূপ। অর্থাৎ, একজন ব্যাক্তি পিঁড়িতে বসে পাণ্ডুয়ার খবর নিচ্ছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Aniruddha Ray (13 September 2016). Towns and Cities of Medieval India: A Brief Survey. Taylor & Francis. p. 165. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৩৫১-৯৯৭৩১-৭.
  2. Aniruddha Ray (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। Towns and Cities of Medieval India: A Brief Survey। Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 165। আইএসবিএন 978-1-351-99731-7 
  3. Foundation, Encyclopaedia Iranica। "Welcome to Encyclopaedia Iranica"iranicaonline.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৭ 
  4. María Dolores Elizalde; Wang Jianlang (6 November 2017). China's Development from a Global Perspective. Cambridge Scholars Publishing. pp. 57–70. আইএসবিএন ৯৭৮-১-৫২৭৫-০৪১৭-২.
  5. "টাকশাল, মধ্যযুগীয় - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৭ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা