পরিবহন প্রকৌশল বলতে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে বিদ্যমাণ ব্যবস্থা পদ্ধতিকে নিরাপদ, সাশ্রয়ী, দ্রুত, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ, সহজ, সুষ্ঠু, ও পরিবেশগতভাবে সামঞ্জস্য করে তুলবার প্রয়াসে গৃহীত পরিকল্পনা, নির্বাহী নকশা ও ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্তসমূহের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক নীতি ও আধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে গড়ে ওঠা শাস্ত্রকে বোঝায়। পরিবহন প্রকৌশল পুরকৌশলের একটি উপবিভাগ। পুরকৌশল পেশার ক্ষেত্রে পরিবহন প্রকৌশলের গুরুত্ব সম্পর্কে আন্দাজ করা যেতে পারে ASCE (মার্কিন পুরকৌশলী সমিতি) নামক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত পরিবহন সংক্রান্ত অধিদপ্তরগুলোর সংখ্যা দেখে। ASCE সংস্থাটির ১৮টি দপ্তরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দপ্তর তথা ছয়টি দপ্তর কেবল পরিবহন সংক্রান্ত। এগুলো হচ্ছেঃ উড়োপথ, আকাশপথ পরিবহন, মহাসড়ক, পাইপ-লাইন, জলপথ, বন্দর, উপকূল ও সমুদ্রপথ; এবং নগরকেন্দ্রিক পরিবহন।

ব্রিস্টল, ইংল্যান্ডের এই ঘূর্ণিরাহাটির ক্ষেত্রে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তা শকট প্রবাহটিকে নির্বিঘ্নে পথ চলায় সাহয্য করছে।

বাংলাদেশ সড়ক ও পরিবহন সংস্থা (BRTC) পরিবহন ব্যবস্থাগুলো তদারক করে। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশ সরকারের 'সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়' 'রেল মন্ত্রণালয়', 'বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়' নামে তিনটি মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।

পরিবহন প্রকৌশলের পরিকল্পনার দর্শনগুলো সাধারণত নগর পরিকল্পনার উপাদানের সাথে সম্পর্কিত; এবং এ পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- কারিগরি পূর্বাভাস বিবেচনায় নিয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রণয়ন যা রাজনৈতিক নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হয়। যাত্রীদের ভ্রমণ বিষয়ে যে কারিগরি পূর্বাভাস দেওয়া হয় সেখানে মূলত একটি নগর পরিবহন পরিকল্পনা মডেল উপস্থাপন করা হয়। এ মডেলে থাকে ভ্রমণ উৎপত্তি (কতটি ভ্রমণ, কী উদ্দেশ্যে), ভ্রমণ বণ্টন (গন্তব্য স্থল—কোথায় সফরকারী যাচ্ছেন), পছন্দসই মাধ্যম (কোন ধরনের যান-বাহন যাত্রী বাছাই করেছেন) এবং গমনপথ নিয়োজন (কোন রাস্তা ব্যবহার করা হচ্ছে) এ চারটি বিষয়। যাত্রীদের ভ্রমণগুলোই পরিবহন প্রকৌশলের মূল কেন্দ্রবিন্দু কারণ যেকোন পরিবহন ব্যবস্থায় যানবাহনের চাহিদার শীর্ষমান এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণগুলোর কারণেই হয়ে থাকে।

পুরকৌশলীদের দ্বারা চর্চিত পরিবহন প্রকৌশল প্রাথমিকভাবে গুরুত্বারোপ করে যে সব বিষয়ের উপর সে্গুলো হচ্ছে- পরিকল্পনা, নকশা, নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, এবং পরিবহন সুবিধাগুলো ঠিক মতো কাজ করছে কি না তা তদারকি করা। নকশাকরণ বলতে বোঝানো হয়- পরিবহন সুবিধাগুলোর মাত্রা ঠিক করা (যেমনঃ কয়টি লেন, অথবা কী পরিমাণ ক্ষমতা আছে), সড়ক নির্মাণে মাল-মশলাগুলোর উপাদান বাছাই করা এবং সড়কের পুরুত্ব কী হবে তা হিসেব করা, সড়কপথের অনুভূমিক ও উলম্ব দিকের জ্যামিতিক গঠন কাঠামো নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

যে কোন পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে একজন প্রকৌশলী অবশ্যই প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সংগ্রহ করবেন। এই সব তথ্যকণিকার মধ্যে আছে- (১) জনসংখ্যা (২) ভূমি ব্যবহার (৩) অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (৪) পরিবহন সুবিধাদি ও সেবাসমূহ (৫) সফর সজ্জা ও সফরের পরিমাণ (৬) প্রচলিত আইন ও অধ্যাদেশমালা (৭) সংশ্লিষ্ট এলাকার অর্থায়নের উৎস (৮) এলাকার মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষা

কার্যনির্বাহকরণ ও ব্যবস্থাপনার সময় নজর রাখতে হবে যে, যান-বাহনগুলো নির্বিঘ্নে ও স্বচ্ছন্দ্যে পথ চলতে পারছে কী না। এটি নিশ্চিত করবার জন্য প্রচলিত সনাতন পদ্ধতিগুলো হচ্ছে যথাযথ চিহ্ন, সংকেত, নির্দেশাংক ও টোল-ব্যবস্থা। তুলনামূলক অধুনা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে আছে- ITS বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা, ভ্রমণকারীর তথ্যভিত্তিক আধুনিক পদ্ধতি (যেমনঃ পরিবর্তনশীল বার্তা নিশানা); আধুনিক যান-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাদি (যেমনঃ র্যাম্প মিটার) ইত্যাদি।

জনপথ ও মহাসড়ক প্রকৌশল সম্পাদনা

এ বিশেষায়িত ক্ষেত্রটিতে প্রকৌশলীগণঃ-

  • সড়ক ও জনপথের পরিকল্পনা, নকশা, নির্মাণ, ও নির্বাহের বিষয়গুলো তদারকি করেন। পাশাপাশি, তারা বিভিন্ন যানবাহনের সুবিধাদি তদারক করেন, এসব যানবাহনের মধ্যে মোটর চালিত যান যেমন আছে তেমন বাইসাইকেলও আছে; এমন কি পথচারীদের পায়ে হাটার জন্য সুগম্য রাস্তার বিষয়টিও আছে।
  • পরিবহন খাতে জনগণের কী পরিমাণ চাহিদা আছে তা নিরূপণ করেন করেন এবং প্রকল্পে কী পরিমাণ তহবিল দরকার পড়বে তা প্রাক্কলন করেন।
  • সড়কের ধারণক্ষমতা বজায় রাখার জন্য কোন কোন জায়গায় অনেক যান-সমাগম হয়, তা বিশ্লেষণ করেন। এছাড়া, যাত্রীদের ভ্রমণকে নিরাপদ করতে সংঘর্ষের স্থানগুলিও চিহ্নিত করেন।
  • পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে পুরকৌশলের জ্ঞান প্রয়োগ করেন।
  • ত্রি নকশা নিয়ন্ত্রক তথা- চালক, যানবাহন, ও সড়কপথ এই তিনটি নিয়ামকের সদ্ব্যবহার করেন।

রেলপথ প্রকৌশল সম্পাদনা

রেলপথ প্রকৌশলীরা রেলপথের নকশা, নির্মাণ ও নির্বাহের কাজগুলো দেখাশোনা করেন। তারা গণপরিবহন ব্যবস্থার উপযোগিতা বিচার করে দেখেন যে, তা প্রযোজ্য হবে কি না। MRT বা ভর পারাপার ব্যবস্থা মূলত বিশেষ ধরনের রেলপথ ব্যবস্থা যেখানে একটি স্থায়ী স্বাবলম্বন ব্যবহার করা হয় (যেমনঃ হালকা রেল অথবা এমনকি একক রেল)।

বন্দর ও পোতাশ্রয় প্রকৌশল সম্পাদনা

বন্দর-পোতাশ্রয় প্রকৌশলীরা বন্দর, পোতাশ্রয়, খাল এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পরিবহন সুবিধাদির নকশা প্রণয়ন, নির্মাণ ও নির্বাহ করে থাকেন। তবে, নৌ-প্রকৌশলের সাথে এর তফাৎ রয়েছে।

বিমানবন্দর প্রকৌশল সম্পাদনা

বিমানবন্দর প্রকৌশলীরা বিমানবন্দরের নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ করে থাকেন। উড়োযানের ঘাতবল এবং উড়োযানের বাৎসরিক চাহিদার পরিমাণ মাথায় রেখে বছরে কয়টি উড়োযান নির্মিতব্য বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন ও অবতরণ করবে- এ সব হিসাব মাথায় রেখে নকশা প্রণয়ন করেন। বিমানবন্দরের রানওয়ের অভিমুখ নির্বাচনের জন্য বিমানবন্দর প্রকৌশলীকে বায়ুপ্রবাহের অভিমুখ বিশ্লেষণ করতে হয়। পাশাপাশি রানওয়ের চওড়া, নিারাপত্তা এলাকা, উড়োজাহাজের এক পাখনার প্রান্ত থেকে অপর পাখনার প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব ইত্যাদি হিসেব রাখতে হয়।

আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান সংস্থা, বাংলাদেশ (ICAB) বাংলাদেশে বিমান বন্দর সংকান্ত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।

অনুশীলন ও প্রকৌশল ডিগ্রি সম্পাদনা

পরিবহন প্রকৌশলী হতে হলে চার বছর মেয়াদী পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করতে হবে। সমাপনী বর্ষে পুরকৌশলের এই পরিবহন প্রকৌশল বিভাগে বিশেষায়িত অধ্যয়ন করতে হবে এবং গবেষণামূলক অভিসন্দর্ভপত্র প্রকাশ করতে হবে। পরবর্তীতে, স্নাতকোত্তরও করা যায় এ বিভাগে। বিশ্বের প্রায় সব প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশে বুয়েট সহ রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, আই.ইউ.টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি জায়গায় এ বিষয়ে পাঠদান করা হয়।

পাঠ্যসূচী সম্পাদনা

পরিবহন প্রকৌশলে সাধারণ পুর-প্রকৌশলের অন্যান্য শাস্ত্রের পাশাপাশি নিম্নলিখিত শাস্ত্রগুলোর উপর পাঠদান করা হয়ঃ

১। সড়ক পরিবহন

ক) সড়কের উপাদান

খ) সুপার এলিভেশন

গ) রাস্তার ব্যাংকিং

ঘ) বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা

ঙ) যান বাহনের চাহিদা

চ) রাস্তার ধারণ ক্ষমতা

ছ) পার্কিং এর নকশা

জ) জ্যামিতিক নকশায়ন

২। বিমান পরিবহন

৩। রেলপথ পরিবহন

৪। জলপথ পরিবহন

৫। জরিপ (সার্ভে)

৬। ব্যবহারিক জরিপ

বিমান বন্দর

তথ্যসূত্রসমূহ সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা