নূর হুসাইন কাসেমী

বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত

নূর হুসাইন কাসেমী (১০ জানুয়ারি ১৯৪৫ — ১৩ ডিসেম্বর ২০২০) ছিলেন একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় বক্তা। তিনি একাধারে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশজমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, আল হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকাজামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগরের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। হেফাজত আন্দোলন, খতমে নবুয়ত আন্দোলনসহ প্রভৃতি আন্দোলনে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ইসলামি নেতা হিসেবে মুসলিম জনসাধারণের মাঝে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন।

শায়খুল হাদিস, আল্লামা

নূর হুসাইন কাসেমী
২০২০ সালে কাসেমী
মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
অফিসে
১৫ নভেম্বর ২০২০ – ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
পূর্বসূরীজুনায়েদ বাবুনগরী
উত্তরসূরীনুরুল ইসলাম জিহাদী
সহ সভাপতি, আল হাইআতুল উলয়া
অফিসে
৩ অক্টোবর ২০২০ – ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
পূর্বসূরীআব্দুল কুদ্দুস
উত্তরসূরীমুহাম্মদ ওয়াক্কাস
মহাসচিব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ
অফিসে
৭ নভেম্বর ২০১৫ – ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
পূর্বসূরীমুহাম্মদ ওয়াক্কাস
উত্তরসূরীমঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী
মহাপরিচালক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা
অফিসে
১৯৮৮ – ১৩ ডিসেম্বর ২০২০
উত্তরসূরীমুনির হোসাইন কাসেমী
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১০ জানুয়ারি ১৯৪৫
মৃত্যু১৩ ডিসেম্বর ২০২০(৭৫)
ধর্মইসলাম
জাতীয়তাবাংলাদেশি
সন্তান
  • যুবায়ের হুসাইন
  • জাবের কাসেমী
পিতামাতা
  • আব্দুল ওয়াদুদ (পিতা)
জাতিসত্তাবাঙালি
যুগআধুনিক
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
আন্দোলনদেওবন্দি
প্রধান আগ্রহহাদিস, ফিকহ, তাসাউফ, রাজনীতি, শিক্ষা সংস্কার, ইসলামের ইতিহাস
উল্লেখযোগ্য কাজ
যেখানের শিক্ষার্থী
মুসলিম নেতা

জন্ম ও বংশ সম্পাদনা

কাসেমী ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা নামক গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল ওয়াদুদ। [১]

শিক্ষাজীবন সম্পাদনা

বাড়ির পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। এখানে চতুর্থ শ্রেনী শেষ করে চড্ডার কাশিপুর কাশেমুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন বরুডার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসায়। এখানে হেদায়া জামাত (স্নাতক ২য় বর্ষ) পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। [২]

এরপর তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার উদ্দেশ্যে ভারতে গমন করেন। নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পেরে ভর্তি হন ভারতের সাহারানপুর জেলার বেড়ীতাজপুর মাদ্রাসায়। এখানে জামাতে জালালাইন (স্নাতক) সমাপ্তির পর দারুল উলুম দেওবন্দে চলে যান। দেওবন্দ মাদ্রাসায় তার অধ্যয়নকাল মোট ৩ বছর। এখানে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপ্তির পর আরবি সাহিত্য ও দর্শনে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন। [২]

তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে: মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী, আনজার শাহ কাশ্মীরি, ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী, মুহাম্মদ সালেম কাসেমি, তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী সহ প্রমুখ খ্যাতিমান ব্যক্তি। [২]

কর্মজীবন সম্পাদনা

ভারতের মজঃফরনগর জেলায় অবস্থিত মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুরাদিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। এখানে ১ বছর শিক্ষকতার পর ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার নন্দনসার মুহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস ও মুহতামিম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে তিনি ৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন এবং ছাত্রাবাস পরিচালক ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি কাজী মুতাসিম বিল্লাহ প্রতিষ্ঠিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে চলে আসেন। এখানে তার অধ্যাপনাকাল মোট ৬ বছর। [২]

এরপর ১৯৮৮ সালে তিনি জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা এবং ১৯৯৮ সালে জামিয়া সোবহানিয়া মাহমুদ নগর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের শায়খুল হাদিস ও মহাপরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি প্রায় ৪৫টি মাদ্রাসা পরিচালনার কাজে যুক্ত ছিলেন। [২]

২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। [৩] আইন অনুসারে একই সাথে তিনি আল হাইআতুল উলয়ার কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। [৪]

২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি হেফাজতের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি ছিলেন। [৫][৬]

১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি খতমে নবুয়ত আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। [২]

রাজনীতি সম্পাদনা

১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন এবং ৭ নভেম্বর ২০১৫ সালে তিনি এর মহাসচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তিনি মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর দেশব্যাপী সংগঠন বিস্তৃত লাভ করে। [২][৭]

তাসাউফ সম্পাদনা

ভারতের মুরাদিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনাকালে তিনি মুহাম্মদ জাকারিয়া কান্ধলভির কাছে বাইআত গ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর পর তিনি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহীর নিকট বায়’আত হন এবং খেলাফত [ক] লাভ করেন। কাসেমীর খলিফা [খ] মোট ৭ জন। ১.মাওলানা ইছহাক, মানিকনগর ২. মাওলানা বশির আহমদ, সৈয়দপুর ৩. মাওলানা মাসউদুল করীম, দারুল উলূম টঙ্গী ৪. মাওলানা নোমান, হেমায়েতপুর ৫. মাওলানা আবুল খায়ের, জামিয়া সুবহানিয়া ৬. মাওলানা আবু হানীফা নোমান,মোমেনশাহী ৭. মাওলানা জালালুদ্দিন হক্কানী, সিলেটর)। [২]

পরিবার সম্পাদনা

পারিবারিক জীবনে তিনি ২ ছেলে যুবায়ের হুসাইন ও জাবের কাসেমী এবং দুই মেয়ের জনক। তার ছোট ছেলে জাবের কাসেমী একজন ইসলামি পণ্ডিত ও জামিয়া মাহমুদিয়া ইসহাকিয়া মাদ্রাসা, মানিকনগরের অধ্যাপক।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

দৃষ্টিভঙ্গি সম্পাদনা

ভারতের হিন্দুত্ববাদের সমালোচনা

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় অভিযুক্ত সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেয় ভারতের বিশেষ আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাসেমী বলেন, ‘ভারতীয় আদালত উগ্র হিন্দুত্ববাদের পক্ষ নিয়ে সত্য, ন্যায়-ইনসাফ ও বাস্তবতার সঙ্গে শুধু তামাশাই করেনি, বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনকে বৈধতা দিতে শুরু করেছে। এই রায়ে ভারতের বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়াই কেবল প্রমাণ করে না; বরং দেশটির বিচার বিভাগের ওপরও যে হিন্দুত্ববাদিরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে সেটাও স্পষ্ট হয়েছে।’ [৮]

মৃত্যু সম্পাদনা

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ছোট ছেলে জাবের কাসেমীর ইমামতিতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তার জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তারই প্রতিষ্ঠিত সোবহানিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাযার নামাজ জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সরকারি অনুমতি দেওয়া হয় নি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। [৯][১০]

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা সম্পাদনা

  1. উত্তরসূরি মনোনীত করা
  2. মনোনীত উত্তরসূরি

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "হেফাজত মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী আর নেই"নয়া দিগন্ত। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৪ 
  2. আলম, সাইদুল (৫ অক্টোবর ২০১৯)। "মাওলানা নুর হোসাইন কাসেমীর বর্ণাঢ্য জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ"কওমিপিডিয়া 
  3. প্রতিবেদক, নিজস্ব (৩ অক্টোবর ২০২০)। "কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সভাপতি মাহমুদুল হাসান, মহাসচিব মাহফুজুল হক"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৬ 
  4. ডেস্ক, যুগান্তর (৩ অক্টোবর ২০২০)। "কারা আসছেন বেফাকের নেতৃত্বে?"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৬ 
  5. প্রতিনিধি, হাটহাজারী (১৬ নভেম্বর ২০২০)। "নতুন আমির বাবুনগরী, মহাসচিব কাসেমী | কালের কণ্ঠ"কালের কন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৬ 
  6. ডেস্ক, ওয়েব (১৫ নভেম্বর ২০২০)। "হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ"সময় টিভি। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৬ 
  7. রিপোর্ট, ট্রিবিউন (৭ নভেম্বর ২০১৫)। "জমিয়তের নির্বাহী সভাপতি ওয়াক্কাছ, মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী"বাংলা ট্রিবিউন। ২০২০-০৮-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১১-১৬ 
  8. রিপোর্ট, যুগান্তর (১ অক্টোবর ২০২০)। "বিচারের নামে তামাশা করেছে ভারতের আদালত: আল্লামা কাসেমী"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-০১ 
  9. "হেফাজত মহাসচিব কাসেমী আর নেই"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৩ 
  10. "লাখো মানুষের ঢল, জানাজা সম্পন্ন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর"নয়া দিগন্ত। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৪ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা