নিউট্রোফিল এক প্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সাড়া প্রদানকারীদের ভেতরে এরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চার ধরনের শ্বেত রক্তকণিকার মধ্যে নিউট্রোফিল সর্বাধিক। শ্বেত রক্তকণিকার ৫৫ থেকে ৭০ ভাগই নিউট্রোফিল। নিউট্রোফিল কোনো নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে কাজ করে না। বরং সমগ্র দেহে (যেমনঃ শিরা, টিস্যু ইত্যাদি) টহল দেয় ও ক্ষতিকর জীবাণু বা অ্যান্টিজেন নাশ করে।

নিউট্রোফিল

মানবদেহ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন শ্বেত রক্তকণিকা সন্দেহজনক ও বহির্ভূত কণিকাকে টার্গেট করে। এগুলো যদি দেহের জন্য ক্ষতিকর হয় তবে এন্টিজেন হিসেবে চিহ্নিত করে৷ নিউট্রোফিলের প্যাটার্ন রিকগনিশন রিসেপ্টর (PRR) এর মাধ্যমে প্যাথোজেনের PAMP (Pathogen Associated Molecular Patterns) শনাক্ত করে এন্টিজেন বা প্যাথোজেনকে চিহ্নিত করে। এরপরে প্রতিরক্ষা সৈন্য হিসেবে ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিলকে আক্রান্ত স্থানে প্রেরণ করে৷ এই এন্টিজেনগুলোর ভেতরে রয়েছে ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফানজাই, বিষ, ক্যান্সার কোষ ইত্যাদি। নিউট্রোফিল ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় অণুজীব ও প্যাথোজেনকে সরাসরি ভক্ষণ করে। [১]

দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

নিউট্রোফিল আকারে ৯ থেকে ১০ মাইক্রোমিটারের সমান। (ব্যাস)(১ মাইক্রোমিটার = ১০⁻৬ মিটার)। এরা চুলের ন্যায় সরু ফিলামেন্ট দিয়ে নির্মিত। এদের চলন এমিবয়েড প্রকৃতির। দ্রুত চলনের জন্য এরা সিউডোপোডিয়াম প্রসারিত করে। সাইটোপ্লাজমের ফিলামেন্টগুলোর সংকোচন দ্বারা এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়। দৈনিক ১০০ মিলিয়ন নিউট্রোফিল একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে জন্ম নেয়। বোন ম্যারো হতে জন্মানো এসব নিউট্রোফিলের পরিপক্কতা পেতে সাধারণত এক সপ্তাহ সময় লাগে। তবে নিউট্রোফিলসমূহ শীঘ্রই মারা যায়। (টিস্যুতে স্থানান্তর হলে কয় ঘণ্টা বেশি বেঁচে থাকে)। এজন্য বোন ম্যারো কিছু সংখ্যক নিউট্রোফিল আগে থেকেই বাঁচিয়ে রাখে। ফলস্বরূপ, দেহে কোনো এন্টিজেন প্রবেশ করলে বোন ম্যারো সংরক্ষিত নিউট্রোফিলগুলো প্রেরণ করে। [২]

জীবাণু ভক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পাদনা

নিউট্রোফিল একটি ফ্যাগোসাইটিক শ্বেত রক্তকণিকা এবং ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু ভক্ষণ করে। তারা ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব সরাসরি গিলে ফেলে হজম করে ফেলে।

মানবদেহে বহিরাগত কোনো কণা দ্বারা শরীরের কোনো টিস্যু আক্রান্ত হলে সেই কোষের রাসায়নিক পদার্থ (যেমনঃ কাইনিন, হিস্টামিন, প্রোস্টোগ্ল্যান্ডিস ইত্যাদি) এর দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে নিউট্রোফিল আক্রান্ত স্থানে গমন করে। একে কেমোট্যাক্সিস বলা হয়। বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জার নিউট্রোফিলসমূহ ভাগ হয়ে অর্ধেক নিউট্রোফিল টিস্যুতে অবস্থান করে ও অন্য ভাগ নিউট্রোফিল রক্তকণিকায় অবস্থান নেয়। আবার এই নিউট্রোফিলগুলোর অর্ধেক রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় ও অন্য ভাগ রক্তবাহিকার অন্তঃপ্রাচীর ঘেঁষে গমন করে। এভাবে এরা আক্রান্ত টিস্যুর কেমোট্যাটিক সিগন্যাল এর জন্য তৈরি হয়।

নিউট্রোফিলের ফ্যাগোসাইটের লাইসোজোম থেকে এনজাইম নিঃসৃত হয় যা অনেক ধরনের কোষীয় পদার্থ ভক্ষণ করতে সক্ষম। কোনো নিউট্রোফিল যখন ব্যাকটেরিয়াকে ভক্ষণ করে, তখন সেই ব্যাক্টেরিয়া ক্ষণপদের মাঝে সৃষ্ট গহ্বরে আবদ্ধ হয়। এরপর বিপাকীয় প্রক্রিয়ার ফলে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও সুপার অক্সাইড তৈরি হয়। যার ক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা যায়। [৩]

নিউট্রফিলদের গুরুত্ব সম্পাদনা

নিউট্রোফিল বহিরাগত ক্ষতিকারক কণাগুলোকে নাশ করার দ্বারা শরীরে কোনোরূপ ক্ষতি হতে দেয় না। এর পাশাপাশি নিউট্রোফিলসমূহ অন্যান্য কোষের সাথে যোগাযোগ করে সেই কোষগুলোর ক্ষয়পূরণে সহায়তা করে ইমিউন সাড়া বৃদ্ধি করে। ফলে শরীর সহজে কোনো জীবাণু কর্তৃক আক্রান্ত হয় না৷ সহজাত প্রতিরক্ষার (মানবদেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তৃতীয় স্তরের একটি উপস্তর) ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অপরিসীম। [৪]

রোগ সম্পাদনা

নিউট্রোপেনিয়া

শরীরে নিউট্রোফিলের পরিমাণ কম বেশি হওয়ার কারনে রোগ দেখা দিতে পারে। শরীরে যদি নিউট্রোফিলের পরিমাণ কম থাকে তাহলে সে অবস্থাকে নিউট্রোপেনিয়া বলা হয়। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে ১৫০০ টি নিউট্রোফিল থাকা আবশ্যক। এর কম হয়ে গেলে নিউট্রোপেনিয়া রোগ দেখা দেয়।

এ রোগের কারনগুলোর ভেতরে মূল হলো অস্থিমজ্জায় পর্যাপ্ত পরিমাণে নিউট্রোফিল তৈরি না হওয়া। অথবা যে পরিমাণে নিউট্রোফিল তৈরি হয় তার থেকে বেশি ধ্বংস হয়। এছাড়াও হেপাটাইটেসিস, যক্ষ্মা, ঘা, লাইম রোগ (Borrelia burgdorferi ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ) ও কেমোথেরাপির মতো তেজস্ক্রিয় চিকিৎসার কারনে শরীরে নিউট্রোফিলের পরিমান কমে যেতে পারে।

এ রোগের লক্ষণগুলো হলো শরীর ফুলে যাওয়া, শরীরে ক্রমাগত ক্ষত তৈরি হওয়া ও জ্বর। [৫]

নিউট্রোফিলিয়া

শরীরে নিউট্রোফিলের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াকে নিউট্রোফিলিয়া বলে। সাধারণত ব্যাক্টেরিয়াজনিত ঘা এর ফলে নিউট্রোফিলিয়া রোগ দেখা দেয়। এ রোগের লক্ষণগুলো হলো চোখে ঝাপসা দেখা, কানে কম শোনা, কন্ঠ জড়তা, প্রলাপ বকা ও মাথা ঘুরানো। এসবের পাশাপাশি রোগী সায়ানোসিস, রেটিনাল ভেইল ডিস্টেনশন, রেটিনাল হিমোরেজসহ অন্যান্য রোগে ভোগে। [৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Neutrophils healthline.com হতে সংগৃহীত
  2. Neutrophil britannica.com হতে সংগৃহীত
  3. Neutrophil britannica.com হতে সংগৃহীত]
  4. What are Neutrophils and what do they do medicalnewstoday.com হতে সংগৃহীত
  5. Neutropenia clevelandclinic.com হতে সংগৃহীত
  6. Causes of Neutrophilia & treatment gponline.com হতে সংগৃহীত