নরকাসুর

প্রদত্ত পুরুষ নাম

ভাগবত পুরাণে উল্লেখ থাকা মতে, নরকাসুর বা নরক ভূমি (ভূদেবী) এবং বরাহর (বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার) অসুর পুত্র। বিদেহের (উত্তর বিহার) রাজা জনক তাকে বড়ো করেন। পরে বাণাসুরের প্রভাবে তিনি অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন।[১] তিনি শেষ দানব রাজা ঘটকাসুরকে সিংহাসনচ্যুত করে প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য স্থাপন করেন। পশ্চিমে করতোয়া থেকে পূর্বে দিক পর্যন্ত তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল।[২] নরক বিদর্ভের রাজকুমারী মায়াকে বিয়ে করেছিলেন। পরে শ্রীকৃষ্ণের হাতে তার মৃত্যু হয়।

নরকাসুর
নরকাসুর
নরকাসুরের সৈন্যের সঙ্গে কৃষ্ণ এবং সত্যভামার যুদ্ধ - মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট এর চিত্র
তথ্য
লিঙ্গপুরুষ
দাম্পত্য সঙ্গীমায়া (বিদর্ভের রাজকুমারী)
সন্তানভগদত্ত (পুত্র)
আত্মীয়
রাজবংশভৌম রাজবংশ

নরকাসুরের কিংবদন্তি অসমের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ; কারণ কামরূপ শাসন করা কয়েকটি রাজবংশ নরকাসুরের থেকেই হয়েছে বলে মানা হয়। গুয়াহাটীর দক্ষিণে তার নামে একটি পাহাড় আছে। শক্তি দেবী এবং উপাসনার স্থান কামাখ্যার সাথেও তার নাম যুক্ত করা হয়।

ইতিহাস সম্পাদনা

রামায়ণ এবং মহাভারতের প্রথম শতকের পর লেখা অংশগুলিতে নরকাসুর এবং তার প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের উল্লেখ আছে। তার পুত্র ভগদত্ত‌ মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে মানা হয়। বরাহ প্রজাপতির কথা শতপথ ব্রাহ্মণে আছে যদিও আনুমানিক পঞ্চম শতকে রচিত "হরিবংশ"-এ ভূদেবীর বরাহ অবতারের সংস্পর্শে পুত্র উৎপন্ন হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। বিষ্ণু পুরাণে নরকের এই কাহিনী বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। পরে রচিত ভাগবত পুরাণে এই কাহিনী পুনরায় বর্ণিত হয়েছে।

১০ শতকে রচিত উপপুরাণ কালিকা পুরাণ এ নরকাসুরের কিংবদন্তি অনেক বেশি বর্ণিত হয়েছে। এতে সীতার পিতা বিদেহের রাজা জনকের কাহিনীও নরকাসুরের কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

কিংবদন্তি সম্পাদনা

 
সুদর্শন চক্র দ্বারা কৃষ্ণের নরকাসুরকে বধ করার দৃশ্য

নরকের মাতা ভূমি দেবী বিষ্ণুর কাছে বর চেয়েছিলেন যেন তার পুত্র দীর্ঘ জীবন লাভ করে এবং সে শক্তিশালী হয়। বিষ্ণু এই বর পূরণ করেন। বিষ্ণু নরককে কামাখ্যা দেবীর পূজা করতে শেখান। প্রথম অবস্থায় ভাল শাসক ও ধার্মিক নরক শোণিতপুরের বাণাসুরের প্রভাবে পরে অত্যাচারী হয়ে ওঠে। এরফলে তার নামের শেষে অসুর যুক্ত হয়।

নরকাসুর কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। দেবীকে একথা বলাতে দেবী শর্ত রাখেন যে, মোরগ বা কুক্কুট রাত পেরোনোর জানান দেওয়ার আগে যদি নরক নীলাচল পাহাড়ের তলা থেকে মন্দির পর্যন্ত এক রাতের মধ্যে সিঁড়ি নির্মাণ করতে পারেন তবে তিনি বিয়ে করতে রাজী হবেন। নরকাসুর সেইমত সিড়ি নির্মাণ করে রাত পেরোনোর আগে শেষ করার উপক্রম করলেন। কামাখ্যা দেবী তখন ভয় পেয়ে একটি মোরগকে চেপে ধরাতে সে ডাক দেয়। নরকও রাত পেরোলো বলে ভেবে কাজ অর্ধেক রাখলেন। পরে আসল কথা জানতে পেরে নরক কুক্কুটটিকে ক্রোধবশত ধাওয়া করে হত্যা করেন। এজন্য দরং জেলায় "কুকুরাকটা" নামে একটি স্থান আছে। অন্যদিকে, অসমাপ্ত সিঁড়িটিকে "মেখেলা-উজোয়া পথ" বলে অভিহিত করা হয়। এরপর বশিষ্ঠ মুনিকে কামাখ্যা মন্দিরে উপাসনা করতে অনুমতি না দেওয়ায় মুনি নরক এবং দেবীকে অভিশাপ দেন যে এই মন্দিরে পূজা করা কারো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে না। শিবের হস্তক্ষেপে এই অভিশাপ সেই বছর পর্যন্ত সীমিত হয়। এতে নরকাসুর বিষ্ণু এবং কামাখ্যার অপ্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন।[২]

পৃথিবীর সকল রাজ্য জয় করার পর নরকাসুর স্বর্গ আক্রমণ করেন এবং ইন্দ্র পালাতে বাধ্য হন। এরপর নরক অদিতি দেবীর কুণ্ডলজোড়া চুরি করেন এবং ১৬০০০ নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যান।[৩] ইন্দ্রসহ সকল দেবতা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে নরকাসুরের বিনাশের জন্য কাকুতি-মিনতি করে। বিষ্ণু কৃষ্ণ অবতারে সেই কাজ সমাপন করবেন বলে কথা দেন। বিষ্ণুর ভূদেবীকে দেয়া বর অনুসারে নরক দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণের ভার্যা সত্যভামাকে (নরকাসুরের মা ভূদেবীর অবতার) অদিতি নরকাসুরের কুকীর্তি বলে। সত্যভামা কৃষ্ণকে নরকাসুরের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য রাজি করান। কৃষ্ণ এবং সত্যভামা গরুড়ে উঠে নরকাসুরের রাজ্য আক্রমণ করেন। কৃষ্ণ‌ নরকাসুরের সেনাপতি "মুরাসুর"কে বধ করেন ও "মুরারী" বলে পরিচিত হন। অবশেষে সুদর্শন চক্র দ্বারা কৃষ্ণ‌ নরকাসুরকে বধ করেন এবং অদিতির সোনার কুণ্ডলের সঙ্গে ১৬০০০ জন স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের সিংহাসনে নরকাসুরের পুত্র ভগদত্তকে অভিষিক্ত করা হয়। অপহৃত সেই ১৬০০০ জন নারীকে কৃষ্ণ তার অসুরপত্নী রূপে গ্রহণ করেন।

উত্তর গুয়াহাটীতে "অশ্বক্রান্ত" (অর্থ - অশ্বের আরোহণ) নামে একটি মন্দির আছে। বিশ্বাস করা হয় যে, প্রাগজ্যোতিষপুর আক্রমণ করার পূর্বে কৃষ্ণ এই স্থানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং তার ঘোড়াগুলি এখানে জল খেয়েছিল।

নরকাসুরের মৃত্যুর পূর্বে তিনি মাতা সত্যভামাকে অনুরোধ করেন যে, সকলে যেন তার মৃত্যু রঙিন আলোকোজ্জ্বলভাবে উদ্‌যাপন করে। সেইজন্য এই দিনটি 'নরক চতুর্দশী' হিসেবে (দীপান্বিতার আগের দিনটি) পালন করা হয়।[৪] দক্ষিণ ভারতে এই প্রথা জনপ্রিয়।[৫]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Srimad Bhagavatam। The Bhaktivedanta Book Trust International, Inc.। পৃষ্ঠা 3.3.6। ৩ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ এপ্রিল ২০১৮ 
  2. Edited by Suresh Kant Sharma, Usha Sharma (২০০৫)। "Discovery of North-East India"। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 147। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৭ 
  3. Swami, Parmeshwaranand (২০০১)। Encyclopaedic Dictionary of the Puranas। New Delhi: Sarup and Sons। পৃষ্ঠা 941। আইএসবিএন 8176252263 
  4. Ray, Dipti (২০০৭)। Prataparudradeva, the Last Great Suryavamsi King of Orissa (A.D. 1497 to A.D. 1540)। Northern Book Centre। পৃষ্ঠা 89। আইএসবিএন 8172111959। সংগ্রহের তারিখ ২২ অক্টোবর ২০১৪ 
  5. Maithily Jagannathan। "South Indian Hindu Festivals and Traditions"2005। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 120। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৭ 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • Epico-Puranic and Allied Legends, D. C. Sircar, in The Comprehensive History of Assam, Vol 1, ed H. K. Barpujari 1990.
  • Vettam Mani, Puranic Encyclopaedia.