দ্বিতীয় জয়বর্মণ

কম্বোডিয়ার নবম শতাব্দীর রাজা

দ্বিতীয় জয়বর্মণ (খ্‌মের: ជ័យវរ្ម័នទី២) (সি. 770-835):৫৯[২] ছিলেন নবম শতকের একজন কম্বোডিয়ার হিন্দু রাজা, যাঁকে খেমার সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারূপে, ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। খেমার সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখন্ডের মাঝামাঝি পর্যন্ত অত্যন্ত প্রভাবশালী এক সাম্রাজ্য যা প্রায় পঞ্চদশ শতক অবধি টিকে ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে তার রাজত্বের সময়কাল ছিল ৮০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।:xiii,৫৯[৩] ।অনুমান করা হয়, দ্বিতীয় জয়বর্মণের আগে পর্যন্ত, কম্বোডিয়ার এই অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট সামন্তপ্রভুরা রাজত্ব করতেন, যারা প্রায়ই নিজেদের মধ্য যুদ্ধ বিবাদে লিপ্ত হতেন। দেশটি একজন শাসকের অধীনে যুক্তরাজ্য রূপে ছিল না। 

দ্বিতীয় জয়বর্মণ
'খমের সাম্রাজ্যের চক্রবর্তী সম্রাট'
রাজত্ব৮০২ – ৮৩৫[১]:xiii,৫৯
উত্তরসূরিতৃতীয় জয়বর্মণ
জন্মca. 770
মৃত্যু৮৩৫ (বয়স ৬৪–৬৫)
আঙ্কোর, খেমার সাম্রাজ্য
রাজবংশখমের সাম্রাজ্য
ধর্মহিন্দু

চক্রবর্তী সম্রাট সম্পাদনা

দ্বিতীয় জয়বর্মণকে কম্বোডিয়ার ইতিহাসে আংকর যুগের ভিত্তি স্থাপনকারী সম্রাট রূপে বিবেচনা করা হয়। জাভানিজ রাজত্ব থেকে সম্ভবত কাম্বুজা স্বাধীনতা (সম্ভবতঃ "প্রতিবেশী চেমস" বা চিবদের থেকে) উদ্‌যাপন করতে ৮০২ খ্রিষ্টাব্দে মহেন্দ্রপর্বতে(বর্তমানে ফঁম কুলেন) এক পূজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।[৪] সেই অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় জয়বর্মণকে সর্বজনীন চক্রবর্তী সম্রাট (কম্বোডিয়া ভাষায় 'কামরাত্রে জগদ তাহ রাজা') বা দেবরাজা (সংস্কৃত ভাষায় দেব রাজা) ঘোষণা করা হয়। কিছু সূত্র অনুসারে, দ্বিতীয় জয়বর্মণ শৈলেন্দ্রদের (পর্বতের অধিপতি) রাজত্বকালে কিছু সময় জাভাতে বসবাস করেছিলেন এবং তাই দেবরাজ বা ঈশ্বর রাজা ধারণাটি জাভা থেকে দৃশ্যত আনয়ন করা হয়েছিল বলেই ধারণা করা যায়। সে সময়, শৈলেন্দ্ররা জাভা, সুমাত্রা, মালয় উপদ্বীপ ও কম্বোডিয়ায় কিছু অংশে রাজত্ব করতেন। সাদক কাক থম মন্দিরের একটি শিলালিপি উল্লেখ করে যে মহেন্দ্রপর্বতে, দ্বিতীয় জয়বর্মণ ব্রাহ্মণ হিরণ্যদাম এবং তার প্রধান পুরোহিত ঠাকুর শিবকৈবল্যের পৌরোহিত্যে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন,(খেমার: ទេ វ ৃতht) যা তাকে মহাবিশ্বে চক্রবর্তী রাজা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। :৯৯–১০১ বর্তমানকালের রাউলুসের নিকটবর্তী হরিহরালয়ে জয়বর্মণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভিত্তিটি পরবর্তীতে আংকোর সাম্রাজ্যর কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল।:৯৮ খমের ইতিহাস, এই মূল ভূমিকা সত্ত্বেও, জয়বর্মণ সম্বন্ধে খুব কম নিশ্চিত উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। তার দ্বারা রচনা করা হয়েছে এমন কোন শিলালিপি পাওয়া যায় নি; যদিও তার নাম উল্লেখ করা হযেছে, এরকম অনেক শিলালিপি পাওয়া যায় অন্য সম্রাটদের রাজত্বকাল,যাঁর বেশিরভাগই লেখা তার মৃত্যুর পর। মনে করা হয় অভিজাত বংশে জন্ম হয় তার, এবং বর্তমান কম্বোডিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বিজয়লাভের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি সেই সময় জয়বর্মণ ইবিস নামে পরিচিত ছিলেন। একটি শিলালিপি তাকে বর্ণনা করে এই বলে যে "এই পুরোপুরি খাঁটি রাজকীয় জাতির মানুষের সমৃদ্ধির জন্য,এক মহান কমল যার একটিও কাঁটা নেই, তিনি এক নবীন পদ্মফুল হিসেবে আবির্ভূত হলেন" .[৫] বিভিন্ন অন্যান্য বিবরণে দেখা যায়, তিনি হ্যাং অমৃতা-র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ;[৬] এবং তিনি দক্ষিণ-পূর্ব লোবোক স্রোতে একটি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন:৫৪–৫৬

সদোক কাক থম সম্পাদনা

দ্বিতীয় জয়বর্মণের বিষোয়ে সবচেয়ে মূল্যবান শিলালিপি হল বর্তমান থাইল্যান্ডে সদোক কাক থম মন্দিরে প্রাপ্ত, ১০৫২ খ্রিষ্টাব্দের শিলালিপি, যা কিনা তার মৃত্যুর দুইশত বছর বাদে প্রোথিত।.[৭]:৯৭[৮]:৩৫৩–৩৫৪ "যখন মহামান্য পরমেশ্বর জাভা থেকে আসেন, রাজকীয় শহর ইন্দ্রপুরা শাসন করতে, ঠাকুর শিবকৈবল্যে তাঁর পারিবারিক প্রধান পুরোহিত এবং তাঁর গুরু হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তিনিঈ রাজগুরুর পদ অলংকৃত করেন," সম্রাটের মরণোত্তর নাম উল্লেখ করে এই শিলালিপিতে উল্লেখ পাওয়া যায়।.[৯] পরবর্তী একটি পরিচ্ছদে,শিলালিপিতে বলা হয় যে, "যাদু শক্তির প্রবক্তা" হিরণ্যদাম নামক ব্রাহ্মণকে একটি মহিমান্বিত অনুষ্ঠান করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সম্রাট, যা কাম্বোজ [রাজ্য] কে জাভা শাসনের দাসত্বনিগড় থেকে মুক্তি দেবে। পাঠ্যটি দেবরাজা ঘোষণার পালনীয় ক্রিয়াকর্ম সম্বন্ধেও উল্লেখ করে, যা ছিল জয়বর্মণের রাজসভার প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং পরবর্তীকালে খেমার জনগণের দ্বারা পালনীয় এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। 

"জাভা" শব্দের ব্যাখ্যা সম্পাদনা

শিলালিপিতে যে "জাভা" শব্দটি প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছে তা অবিরাম বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। জর্জ কোয়েডস এবং লরেন্স পালমার ব্রিগসের মতো কিছু প্রাথমিক পণ্ডিতগণ এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করেছেন যে বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপটিকে বোঝায়। খেমার ও জাভানিদের মধ্যে যুদ্ধের পৌরাণিক কাহিনীগুলি শৈলেন্দ্রদের কাছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যাঁরা জাভা এবং সুমাত্রান শ্রীভিজয়- উভয়এর শাসনকর্তা ছিলেন।

চার্লস হাইম ইত্যাদি পরবর্তী পণ্ডিতরা সন্দেহ করেন যে এই শব্দটি মোটেও দ্বীপটিকে বোঝায় না। মাইকেল উইক্যারি এই শব্দটিকে আবার "চ্যামস" বলে বুঝিয়েছেন,যা দ্বারা খেমারের পূর্বের দিকে প্রতিবেশীদের , 'শিবা'কে বর্ণনা করেছেন.[১]:৫৬

অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে যেমন তাকাশি সুজুকি সুপারিশ করেন যে জাভা হল মালয়েশিয়ার উপদ্বীপ,[১০] বা বিশেষভাবে কেদেহ, যা শৈলেন্দ্রদের শাসনাধীন শ্রীবিজয়ের কেন্দ্রস্থল ছিল। 

ঐতিহাসিক মূল্যায়ন সম্পাদনা

বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে,সত্যিই দ্বিতীয় জয়বর্মণের শাসনটি খেমার ইতিহাসে একটি মৌলিক পরিবর্তনশীল বিন্দুকে প্রতিনিধিত্ব করে কিনা অর্থাত ছোট সামন্তবাদী রাষ্ট্রগুলির থেকে একটি স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের কৃতিত্ব তারই কিনা, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অবশ্যই শিলালিপিগুলি ইঙ্গিত করে যে পরবর্তীকালে খেমের রাজারা তাকেই তাদের প্রথম যোগ্য পূর্বসূরী বলে বিবেচনা করতেন। কিন্তু হিন্দু সভ্যতা ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে শতাব্দী ধরে বিদ্যমান ছিল; তাই একথা বলাই যায় যে জয়বর্মণ ছাড়াও আরো অনেক উল্লেখযোগ্য সম্রাট ছিলেন এই অঞ্চলে।[১১]

মরণোত্তর নাম সম্পাদনা

দ্বিতীয় জয়বর্মণ ৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন:৫৯ এবং তার মরণোত্তর নাম হয় পরমেশ্বর,:১০৩ "শিবের মহাপ্রভু"। তার পরে তৃতীয় জয়বর্মণ সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তারপরে তার বৈবাহিক পরিবারের আরো দুজন উত্তরাধিকারী সিংহাসনে আরোহণ করেন। পরবর্তীকালে সম্রাট প্রথম ইন্দ্রবর্মণ কর্তৃক ৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে রৌলসের মন্দিরগাত্রে প্রোথিত প্রেহ কো-তে দ্বিতীয় জয়বর্মণ এবং তার বৈবাহিক বংশের আরো দুই জন সম্রাটকে মরণোত্তর শ্রদ্ধা প্রদান করা হয়।

নোট সম্পাদনা

  1. Higham, C., 2001, The Civilization of Angkor, London: Weidenfeld & Nicolson,
  2. "birth and death dates, Britannica.com, Retrieved 11-23-2010"। Britannica.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৩-১৭ 
  3. Mabbett & Chandler, The Khmers p. 261
  4. Albanese, Marilia (২০০৬)। The Treasures of Angkor। White Star। পৃষ্ঠা 24আইএসবিএন 88-544-0117-X 
  5. Briggs, The Ancient Khmer Empire p. 83.
  6. DiBiasio, Jame (২০১৩)। "Chapter 1: King of the Gods"। The Story of Angkor। Silkworm Books। আইএসবিএন 978-1-6310-2259-3। সংগ্রহের তারিখ ২ ডিসেম্বর ২০১৪ 
  7. Coedès, George (১৯৬৮)। The Indianized States of Southeast Asia। trans.Susan Brown Cowing। University of Hawaii Press। আইএসবিএন 978-0-8248-0368-1 
  8. Higham, C., 2014, Early Mainland Southeast Asia, Bangkok: River Books Co., Ltd.,
  9. Sak-Humphry, “The Sdak Kok Thom Inscription,” p. 46.
  10. Takashi Suzuki (25 December 2012). "Śrīvijaya―towards ChaiyaーThe History of Srivijaya". http://www7.plala.or.jp/seareview/newpage6Sri2011Chaiya.html
  11. Mabbett and Chandler, The Khmers’’ pp. 87-89.

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Sak-Humphry, Chhany. The Sdok Kak Thom Inscription. The Edition of the Buddhist Institute 2005.
  • Higham, Charles. The Civilization of Angkor. University of California Press 2001.
  • Briggs, Lawrence Palmer. The Ancient Khmer Empire. Transactions of the American Philosophical Society 1951.
  • Mabbett, Ian and Chandler, David. The Khmers. Blackwell Publishers Ltd. 1996.
  • Coedès, Georges. Les capitales de Jayavarman II.. Bulletin de l'EFEO (Paris), 28 (1928).
  • Wolters, O. W. (১৯৭৩)। "Jayavarman II's Military Power: The Territorial Foundation of the Angkor Empire"। Cambridge University Press: 21–30। জেস্টোর 25203407 
  • Jacques, Claude and Lafond, Philippe. The Khmer Empire: Cities and Sanctuaries from 5th to 13th Century. River Books [2007].
  • Jacques, Claude. La carrière de Jayavarman II., Bulletin de l'EFEO (Paris), 59 (1972): 205-220.
  • Jacques, Claude. On Jayavarman II., the Founder of the Khmer Empire. Southeast Asian Archaeology 3 (1992): 1-5.
  • Jackson, Rees and Dau Du Gau "The Khmer Empire: Jayavarman the II/History" (2001) (New-Zealand)

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

দ্বিতীয় জয়বর্মণ
খেমার রাজবংশের
জন্ম: 770? মারা যান: 835
পূর্বসূরী

সম্রাট, অ্যাংকর

৭৭০-৮৩৫
উত্তরাধিকারী

তৃতীয় জয়বর্মণ