দেবকোট

পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নস্থল

দেবকোট (অপর নাম কোটিবর্ষ, দেবীকোট বা দেওকোট) ছিল বাংলার এক প্রাচীন শহর এবং কোটিবর্ষ বিষয়ের (আঞ্চলিক বিভাগ) প্রশাসনিক কেন্দ্র। কোটিবর্ষ বিষয় ছিল পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির একটি অংশ; চন্দ্র, বর্মন ও সেনযুগে এই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়[১] কোটিবর্ষের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বায়ুপুরাণ (২৩।২০৯) ও বৃহৎ সংহিতা-এ (১১।২)। অভিধানকার হেমচন্দ্র (অভিধানচিন্তামণি ৪।৯৭৭) ও পুরুষোত্তম (ত্রিকাণ্ডশেষ) এই শহরটিকে নানা নামে অভিহিত করেছেন – উমাবন (উষাবন?) বাণপুর ও শোণিতপুর। সন্ধ্যাকর নন্দী তার রামচরিতে এই শহরের মন্দির ও হ্রদগুলির বর্ণনা দিয়েছেন।[২] অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর শহরের বাণগড় গ্রামে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। কোনো কোনো মতে, দেবকোট ছিল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত।[৩] এখানে একটি বৌদ্ধ মঠও ছিল।[৪]

১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলায় প্রথম যে আফগান রাজ্যটি স্থাপন করেন, সেটি লক্ষ্মণাবতী বা লখনৌতি নামে পরিচিত ছিল। এই রাজ্যের রাজধানী কখনও ছিল লখনৌতিতে, কখনও ছিল দেবকোটে। ১২০৫-০৬ নাগাদ বখতিয়ার খিলজি দেবকোটে মারা যান। সম্ভবত তিনি নারানকোহের শাসনকর্তা আলি মর্দানের হাতে নিহত হয়েছিলেন।[৫]

বাণগড়ে খননকার্য সম্পাদনা

১৯৩৮-৩৯ সাল নাগাদ কে জি গোস্বামীর নেতৃত্বে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল প্রথম বাণগড়ে খননকার্য চালিয়েছিলেন। পুনর্ভবা নদীর পাড়ে অবস্থিত এই খননস্থলটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে এটিকে শহরাঞ্চল বলেই মনে করা হয়। খননস্থলের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি ছিল একটি সিটাডেল বা দুর্গশহরের অনুরূপ। আত্মরক্ষার জন্য তাকে ঘিরে প্রায় ২৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছিল মাটির ঢিবি। এটিই শহরের প্রাচীনতম অংশ, তবে এর সময়কালটি সঠিক জানা যায়নি।[১] দুর্গশহর এলাকাটিতে পাঁচটি আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক স্তর দেখা যায়। প্রথম স্তরটি মৌর্য যুগের সমসাময়িক। এই সময় শহরটি ছিল খুব সাদামাটা একটি বসতি অঞ্চল। আশেপাশের কাদার ঢিপিজাতীয় প্রাচীরগুলি সম্ভবত এই সময়েই গড়ে ওঠে। পরবর্তী স্তরটি কুষাণ যুগের (২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দ)। এই সময় শহরকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ইঁটের ঢিপিজাতীয় প্রাচীর। এই স্তরে শহরে নিকাশি নালা, ঢাকা নর্দমা ও পোড়া ইঁটের বড় বড় বসতবাড়িও গড়ে ওঠে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এই সময়েই দেবকোটের নগরসভ্যতা পূর্ণবিকাশ লাভ করেছিল। গুপ্ত যুগে অবশ্য কুষাণপর্বের আভিজাত্য কিছুই টেঁকেনি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষভাগ থেকে এই শহরের অবক্ষয় শুরু হয়। বিশেষ করে, নতুন নির্মাণের সংখ্যা কমে আসে। তবে পাল যুগে (৮ম-১২শ শতাব্দী) আবার শহরের পুরনো আভিজাত্য ফিরে আসে। এই সময় গড়ে ওঠা ঢিপিজাতীয় প্রাচীর, ক্ষেত্রপ্রাচীর, বসতবাড়ি, পার্শ্বপথ ও প্রাচীরসহ মন্দির, স্যাঁতস্যাঁতে-ভাব প্রতিরোধক শস্যাগার, স্নানাগার, নালা ও গোলাকার কুয়ো দেখে মনে হয়, এই যুগে শহরটি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছিল।[৬]

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Chakrabarti, Dilip K. (2006, reprint 2007). Relating History to the Land in Patrick Oleville (ed.) Between the Empires: Society in India 300 BCE to 400 CE, New York: Oxford University Press, আইএসবিএন ০-১৯-৫৬৮৯৩৫-৬, p.9
  2. Roy, Niharranjan (1993). Bangalir Itihas: Adiparba (in Bengali), Calcutta: Dey's Publishing, আইএসবিএন ৮১-৭০৭৯-২৭০-৩, p.301
  3. Majumdar, Dr. R.C., History of Ancient Bengal, First published 1971, Reprint 2005, p. 10, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৮৯১১৮-০১-৩.
  4. Majumdar, Dr. R.C., p. 457
  5. Majumdar, Dr. R.C., History of Mediaeval Bengal, First published 1973, Reprint 2006, pp. 3, 67, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন ৮১-৮৯১১৮-০৬-৪.
  6. "Eight eras of Indian history unearthed in Bangarh off"। The Telegraph। ১৪ মে ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৯-২৩ 

টেমপ্লেট:Dakshin Dinajpur topics